নবম ও দশম শ্রেণির একটি পাঠ্যবইয়ে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এনসিটিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া ওই বইয়ের অনলাইন ভার্সন বা পিডিএফে আগের সেই গ্রাফিতি বাদ দিয়ে এরই মধ্যে নতুন একটি গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছে। যেভাবে বা যে প্রক্রিয়ায় ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতিটি বাদ দেওয়া হলো, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও আলোচনা–সমালোচনা তৈরি হয়েছে।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ‘শিক্ষার্থীদের একটি অংশের’ দাবির মুখে গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনসিটিবি। শিক্ষার্থীদের সেই একটি অংশ হলো ‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি’ নামে একটি সংগঠন। ‘আদিবাসী’ শব্দটি বাতিলসহ কয়েকটি দাবিতে এই সংগঠনের ব্যানারে গত রোববার মতিঝিলে এনসিটিবি ঘেরাও করে বিক্ষোভ করা হয়।

শিক্ষার্থী বা যেকোনো শ্রেণি–পেশার মানুষ বা সংগঠন তাদের নীতি–আদর্শ–চিন্তা–চাহিদা অনুযায়ী সরকারি কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কাছে যেকোনো দাবি জানাতেই পারে। বিভিন্ন পক্ষ বা অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সেই দাবি কতটা যৌক্তিক, সেটা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দেওয়ার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের। দাবিদাওয়ার ক্ষেত্রে এভাবেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু বিক্ষোভের নামে জোরজবরদস্তি কিংবা মবের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে সেই দাবি আদায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ রকম কিছু ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

এ ক্ষেত্রে এনসিটিবিরও দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ, কোনো একটি পক্ষ বা গোষ্ঠী কিছু একটা দাবি করলেই বিচার–বিবেচনা ছাড়াই সেটা মেনে নেওয়া কোনো ভালো দৃষ্টান্ত নয়। এর আগে একই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ রকমটা চলতে থাকলে যে কেউ যেকোনো দাবি নিয়ে হাজির হতে পারে এবং সেটা মেনে নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারে। এই প্রবণতাকে অনেকেই ‘মবের মুল্লুকের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন।

স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টির ভাষ্য, সংবিধান অনুযায়ী ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহারের সুযোগ নেই। সংবিধানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠীর কথা বলা হয়েছে। সংগঠনটির একজন নেতা জানান, তাঁদের বিক্ষোভ চলাকালে এনসিটিবির চেয়ারম্যানের প্রতিনিধিরা তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে তাঁরা জানিয়েছেন ভুল থেকে এটি হয়েছিল। (প্রথম আলো, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫)।

লক্ষণীয় হলো, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা দীর্ঘদিন ধরে ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছেন। রাষ্ট্র এখনো সেই দাবি পূরণ না করলেও তারা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ভবিষ্যতে তাঁরা আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন কি না, সেটা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিষয়।

আমাদের স্মরণে থাকা উচিত, ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতিটি আঁকা হয়েছিল জুলাই–আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের সময়। এই গ্রাফিতির স্পিরিট বা চেতনা হলো ধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রীতি এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য। জুলাই–আগস্টে আন্দোলনমুখর দিনগুলোতে এই গ্রাফিতি নিয়ে কেউ কোনো আপত্তি জানায়নি। তাহলে এখন কেন এই আপত্তি?

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর দেশে মেজরটিরিয়ান বা সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী কর্মকাণ্ড অনেক বেশি দৃশ্যমান হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার অজুহাতে তারা ভিন্ন ধর্ম বা জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভূমিকাকে স্বীকার করতে চাচ্ছে না। তাদের এই কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ছিল গণতন্ত্র, বাক্‌স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ইত্যাদি বিষয়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখন অনেকের প্রধান প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘মবোক্রেসি’ বা ‘মবের মুল্লুক’ অর্থাৎ ‘জোর যার মুল্লুক তার’। এই ‘মবোক্রেসি’ ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্রের জন্য একটি বড় বাধা।

২০২৪–এর ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান আমাদের নিশ্চিতভাবেই আশাবাদী করেছে। এ রকম একটি ঐতিহাসিক ঘটনার পর ‘মবের মুল্লুক’ চলতে থাকলে তা গণ–অভ্যুত্থানের স্পিরিট বা চেতনাকে দিন দিন দুর্বল করবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি এবং গণ–অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিকে তাই অতি দ্রুত ‘মবের মুল্লুক’ থামাতে হবে।

মনজুরুল ইসলাম  প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রুটে দুই ট্রেনের সময় বদলে যাচ্ছে

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে চলা সৈকত এক্সপ্রেস ও প্রবাল এক্সপ্রেস ট্রেনের সময়সূচি পরীক্ষামূলকভাবে নতুন করে নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। নতুন সময়সূচি আগামী ১০ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে।

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারগামী সৈকত এক্সপ্রেস (৮২১ নম্বর ট্রেন) ট্রেনটি এখন সকাল সোয়া ৬টায় চট্টগ্রাম স্টেশন ছেড়ে যায়। নতুন সূচি অনুযায়ী, পরীক্ষামূলকভাবে এ ট্রেন চলাচল করবে ভোর ৫টা ৫০ মিনিটে।

আর কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামগামী প্রবাল এক্সপ্রেস (৮২২ নম্বর ট্রেন) ট্রেনটি কক্সবাজার স্টেশন ছাড়বে সকাল ১০টায়। এখন এ ট্রেন ছাড়ে ১০টা ২০ মিনিটে। গত মঙ্গলবার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে চলাচলরত সৈকত এক্সপ্রেস ও প্রবাল এক্সপ্রেসের সময়সূচি পরীক্ষামূলকভাবে পরিবর্তনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের উপপ্রধান পরিচালন কর্মকর্তা তারেক মুহাম্মদ ইমরান।

রেলওয়ের সহকারী প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু বক্কর সিদ্দিকীকের সই করা এক চিঠিতে বলা হয়েছে, যাত্রীদের চাহিদা ও সময়ানুবর্তিতা রক্ষায় সুষ্ঠুভাবে ট্রেন পরিচালনার জন্য কক্সবাজারগামী সৈকত এক্সপ্রেস এবং চট্টগ্রামমুখী প্রবাল এক্সপ্রেস ট্রেনের সময়সূচি পরিবর্তন করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রুটে এখন দুই জোড়া আন্তনগর ট্রেন চলাচল করে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত চলাচল করে আরও দুই জোড়া আন্তনগর ট্রেন।

কক্সবাজার রেললাইনে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর। প্রথমে ঢাকা থেকে কক্সবাজার এক্সপ্রেস নামে আন্তনগর বিরতিহীন ট্রেন দেওয়া হয়। এরপর গত বছরের জানুয়ারিতে চলাচল শুরু করে পর্যটক এক্সপ্রেস। এটাও দেওয়া হয় ঢাকা থেকে। চট্টগ্রাম থেকে ট্রেন না দেওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়।

গত বছরের ৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এক জোড়া বিশেষ ট্রেন চালু করা হয়। দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই ট্রেন। এরপর ইঞ্জিন ও কোচের সংকটের কথা বলে গত বছরের ৩০ মে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের চাপে সেই অবস্থান থেকে সরে আসে রেলওয়ে। গত বছরের ১২ জুন থেকে আবার চালু হয় ট্রেন। আর নিয়মিত ট্রেন চলাচল শুরু হয় চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে।

সৈকত এক্সপ্রেস ট্রেনটি যাত্রী ওঠানামার জন্য ষোলশহর, জানালী হাট, পটিয়া, দোহাজারী, সাতকানিয়া, চকরিয়া, ডুলাহাজরা ও রামু স্টেশনে থামবে।

আর প্রবাল এক্সপ্রেস যাত্রাপথে থামবে ষোলশহর, গোমদণ্ডী, পটিয়া, দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ডুলহাজারা, ইসলামাবাদ ও রামু স্টেশনে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ