ভূমিহীন কৃষকদের জন্য স্বপ্নধরার অভিনব উদ্যোগ ‘প্লট ফার্মিং’
Published: 14th, January 2025 GMT
বাংলাদেশি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি স্বপ্নধরার উদ্যোগে শুরু হয়েছে প্লট ফার্মিং। এই অভিনব উদ্যোগের ফলে ভূমিহীন কৃষক পাবে চাষ করার জমি। অন্যদিকে শহরের মানুষ পাবে নিজের জমিতে উৎপাদিত ফসল। স্বপ্নধরার এই উদ্যোগের মাধ্যমে ব্যবহার করা হবে রিয়েল এস্টেট কোম্পানির ফেলে রাখা জমি। সেই সঙ্গে উপকৃত হবে দেশের ভূমিহীন কৃষক।
প্রতি বছরই বাড়ছে বাংলাদেশের জনসংখ্যা। মাথাপিছু জমির পরিমাণ বিশ্বে সর্বনিম্ন মাত্র শূন্য দশমিক ২৫ একর। ছোট্ট এই দেশে বাড়তি মানুষের জন্য তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন বাড়ি। ফলে কমে আসছে আবাদি জমির পরিমাণ। একই কারণে কমে আসছে ফসলের উৎপাদন। আর তাই কৃষকের জীবিকাও আজ হুমকির মুখে। অন্য কাজের খোঁজে কৃষক চলে আসছে শহরে। ফলে আবারও বাড়ছে শহরের জনসংখ্যা। আর তাই অনাবাদী জমির পরিমাণ কমিয়ে আনা এখন সবচেয়ে জরুরি।
এই কাজটাই করার উদ্যোগ নিয়েছে স্বপ্নধরা। তাদের হাউজিং প্রোজেক্টে আছে প্লট হিসেবে বিক্রি হওয়া অব্যবহৃত জমি। স্বপ্নধরার উদ্যোগে এই পড়ে থাকা জমিতেই ভূমিহীন কৃষক চাষ করছে ফসল। প্লটের জমিকেই উৎপাদনশীল কৃষি জমিতে পরিণত করা হয়েছে। এই উদ্যোগের ফলে ভূমিহীন কৃষকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে, বাড়ছে দেশের উৎপাদন। পড়ে থাকা প্লটকে কাজে লাগানোর এই অভিনব উদ্যোগের নামই ‘প্লট ফার্মিং’।
স্বপ্নধরার পক্ষ থেকে ক্রিয়েটিভ এজেন্সি ‘পপ ফাইভ’ ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে প্লট ফার্মিং উদ্যোগটি শুরু করে। এজন্য প্রথমে নিবন্ধিত প্লটের মালিকদের সম্মতি নেয়া হয়। এরপর তাদের সম্মতিক্রমে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ও তত্ত্বাবধানে ভূমিহীন কৃষকরা এখানে চাষাবাদ শুরু করেন। এসময় প্লটগুলোতে শুরু হয় শীতকালীন ফসল উৎপাদন, যা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে।
বাংলাদেশে বহু শতাব্দী ধরে চলে আসা বর্গা চাষ ব্যবস্থা থেকে অনুপ্রাণিত এই প্লট ফার্মিং। প্লটগুলোতে উৎপাদিত ফসল জমির মালিক এবং কৃষকদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হয়। যার মাধ্যমে কৃষক ও প্লট মালিক উভয়ই লাভবান হচ্ছে। প্লট ফার্মিং প্রচলিত বর্গা চাষি প্রথাকে আধুনিকভাবে পুনর্বিবেচনা করে রিয়েল এস্টেট বিনিয়োগ এবং কৃষির মধ্যে একটি মেলবন্ধন তৈরি করেছে।
অব্যবহৃত জমিগুলিকে আবাদি জমিতে রূপান্তরিত করে প্লট ফার্মিং প্রমাণ করছে যে শহরায়ন এবং কৃষি একে অপরের পাশাপাশি এগিয়ে যেতে পারে। এই উদ্যোগটি একদিকে কৃষকদের স্বাবলম্বী করছে, অপরদিকে উদ্ভাবনী চিন্তাধারায় অব্যবহৃত জমিকে করছে একাধিক মানুষের জন্য লাভজনক ও টেকসই আয়ের উৎস।
দেশের রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলা দীর্ঘ দিন ধরে প্লট বানিয়ে বিক্রি করছে। আর সেখানে প্লট কিনে বছরের পর বছর জমি ফেলে রাখছে মানুষ। তাই অন্যরাও যদি এই উদ্যোগে এগিয়ে আসে তাহলে কোনো জমিই আর অনাবাদী থাকবে না, এমনটাই মনে করে স্বপ্নধরা কর্তৃপক্ষ।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ভিসা ও প্রযুক্তি দিয়ে আসিয়ানে সংযোগ বাড়াচ্ছে চীন
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের সদস্যরা এখনও মধ্যম আয়ের ফাঁদে আটকা। এসব দেশে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ কম থাকায় গবেষণা ও উন্নয়নে তেমন অগ্রগতি নেই। প্রযুক্তির সীমিত বিস্তারের কারণে আজও এই অঞ্চলটি পেছনে পড়ে আছে। শিল্প খাতে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও নিম্নমানের শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি মানবসম্পদ উন্নয়নেও অঞ্চলটি পিছিয়ে।
প্রতিরক্ষা খাত দুর্বল হওয়ায় পরিবর্তিত ঝুঁকি ও হুমকির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহস নেই দেশগুলোর। এ কারণে মিয়ানমার সংকটে শক্তিশালী কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না জোটটি। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ বহিরাগত শক্তি এই অঞ্চলে ক্রমশ জেঁকে বসছে। বিশেষ করে চীন বিনিয়োগের পাশাপাশি ভিসা ও প্রযুক্তির ব্যবহার করে আসিয়ানে সংযোগ বাড়াচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমার সংকট নিয়ে আসিয়ান এখনও বিভক্ত। একদিকে চীনের প্রভাব আসিয়ানকে মিয়ানমারে পদক্ষেপ নিতে বাধা দিচ্ছে, অন্যদিকে বহিরাগত শক্তির ওপর নির্ভরতা নিজেদের সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করছে। আঞ্চলিক নেতৃত্ব এবং ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপটে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা না রাখায় মিয়ানমার সংকট গভীর হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এই অঞ্চল ঘিরে চীন প্রতিরক্ষাসহ নানা খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। থেমে নেই যুক্তরাষ্ট্রও। উৎপাদন ও প্রযুক্তি খাতে যথেষ্ট উন্নতি না করতে পারায় দেশগুলো সামনের দিকে অগ্রসর হতে বাধা পাচ্ছে।
শক্তিশালী শাসনব্যবস্থার অভাবে তারা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। এই অবস্থায় এই অঞ্চলে অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
আসিয়ানের সদস্য দেশগুলো হলো- ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম।
১০ দেশের এই জোটটির লক্ষ্য দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। আসিয়ানে গড় মাথাপিছু আয় প্রায় ৫ হাজার ৩০০ ডলার এবং দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার।
আসিয়ান কোন দিকে ঝুঁকছে, যুক্তরাষ্ট্র না চীন- এই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ নিক্কেই এশিয়ায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দেশগুলোর উচিত বেইজিংয়ের প্রবৃদ্ধি থেকে লাভবান হওয়া। তিনি ভারতের সঙ্গেও বাণিজ্য বৃদ্ধির ওপর জোর দেন।
অন্যদিকে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কলিন্স চং ইউ কিট মনে করেন, আত্মরক্ষার নিজস্ব শক্তি ও ক্ষমতা অর্জন না করা পর্যন্ত আসিয়ান দেশগুলোকে মার্কিন নিরাপত্তার ছাতার তলেই থাকতে হবে।
অধ্যাপক কলিন্স ইউরেশিয়া রিভিউকে বলেন, গত কয়েক দশক ধরে আসিয়ান দেশগুলো নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের ওপর নির্ভর করেছে। হঠাৎ করে চীন এই অবস্থানে যেতে পারবে না। আসিয়ান দেশগুলো এটা ভালো করেই জানে। যদিও বেইজিংকে এই অঞ্চলের প্রধান অর্থনৈতিক বিকল্প ও সম্পদের প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে দেখা হয়।
গালফ নিউজের সিনিয়র বিশ্লেষক বলরাম মেনন মনে করেন, অনেক বছর ধরে আসিয়ানসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো বাণিজ্যে স্থিতিশীলতা রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে আসছে। অঞ্চলটিতে যুক্তরাষ্ট্র ভোক্তা বাজার সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। তাছাড়া প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিনিয়োগও বাড়াতে চায় ওয়াশিংটন।
থাইল্যান্ডের মাহিদোল ইউনিভার্সিটি ইন্টারন্যাশনাল কলেজের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক উইলিয়াম জে জোন্স মনে করেন, আসিয়ান রাষ্ট্রগুলোকে বহিরাগত শক্তির কাছে ঐক্যবদ্ধ বিশ্বাসযোগ্যতা প্রদর্শন করতে ইচ্ছুক হতে হবে। ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতির পরিবর্তনের প্রভাব পড়বে পূর্ব এশিয়াও। এজন্য আসিয়ানকে বাস্তবসম্মতভাবে একটি ঐক্যফ্রন্ট উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
আসিয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করছে চীন
ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ও ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে আসিয়ান ও চীনের মধ্যে সহযোগিতার গভীরতা আগের চেয়ে বেড়েছে। চীন দেশগুলোর সঙ্গে সখ্য গড়তে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহারকে গুরুত্ব দিচ্ছে। দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা চীনকে এআই প্রযুক্তি কাজে লাগাতে পরামর্শ দিয়েছেন।
এছাড়া চীন আঞ্চলিক সংযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য চালু করেছে ‘আসিয়ান ভিসা’। আন্তঃসীমান্ত ভ্রমণ এবং আঞ্চলিক একীকরণে এটি চীনের বড় পদক্ষেপ।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান মনে করেন, নতুন ভিসা সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে বিদ্যমান পারস্পরিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করবে।
গত ২৭ মে কুয়ালালামপুরে হয়ে গেল আসিয়ান-চীন-জিসিসি (উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ) শীর্ষ সম্মেলন। তিনটি পক্ষ তাদের নিজ বাজারকে সংযুক্ত করার মাধ্যমে বিশাল অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ উন্মোচন করতে পারে। তিন পক্ষের সম্মিলিত শক্তি বিশ্ব অর্থনৈতিক দৃশ্যপটকে নতুন রূপ দিতে পারে।
ক্ষমতার আধিপত্য বজায় রেখেছে ওয়াশিংটন
অধ্যাপক কলিন্স চং ইউ কিট মনে করেন, আসিয়ানে প্রযুক্তিগত আধিপত্যসহ অর্থনৈতিক ও সামরিক খাতে আগামী ৫০ বছর ওয়াশিংটন প্রধান ভূমিকায় থাকবে। এই সময়ের মধ্যে দেশগুলোতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক বিভাজন ঘটতে পারে। ফলে বিনিয়োগ, প্রযুক্তি এবং নিরাপত্তার জন্য তারা বিদেশি শক্তির ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এসব ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই সুবিধা নেবে যুক্তরাষ্ট্র।
কঠোর নিরপেক্ষতা থাকা সত্ত্বেও আসিয়ান দেশগুলো প্রায় নিশ্চিতভাবেই নতুন সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে বলেও মনে করেন কলিন্স চং। তিনি বলেন, দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ান কেন্ত্রিক এই সংঘাত শুরু হতে পারে। এই সংঘাতে ওয়াশিংটন যুক্ত হয়ে পড়লে দক্ষিণ চীন সাগরে চীন বেকায়দায় পড়বে। ফলে আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যে আরও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা থাকবে।
সূত্র: গালফ নিউজ, ইউরেশিয়া রিভিউ, ইস্ট এশিয়া ফোরাম