যৌক্তিকভাবে হিমাগারের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে, দাবি হিমাগার সমিতির
Published: 8th, February 2025 GMT
দেশের হিমাগারমালিকেরা বলেন, বর্তমানে সারা দেশে ৪০০ হিমাগার আছে। ব্যাংকঋণ ও অন্যান্য পরিচালনা ব্যয় বহন করতে না পেরে এর মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ বা প্রায় ৩০০টি হিমাগার রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু হিমাগার ঋণখেলাপি হয়ে গেছে।
আজ শনিবার রাজধানীর পুরানা পল্টনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানায় বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন বা হিমাগার সমিতি। সংগঠনটির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন হিমাগার সমিতির সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী। এ সময় সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, সহসভাপতি ও পরিচালকেরা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে মোস্তফা আজাদ চৌধুরী জানান, চলতি বছর যৌক্তিকভাবে হিমাগারের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। সব খরচ বিবেচনায় নিয়ে ভাড়া আট টাকা করা হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা কমানোর সুযোগ নেই। তবে সরকার ঋণের সুদহার কমানোসহ কিছু সহায়তা দিলে ভাড়া কমানো সম্ভব বলে জানান তিনি।
সাধারণত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ থেকে হিমাগারে আলু সংরক্ষণ শুরু হয়। এই কার্যক্রম শেষ হয় জুলাই মাসে। এরপর আলু খালাস (খুচরা বাজারে সংরক্ষিত আলু বিক্রি) শুরু হয়, যা চলে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। এরপর বাজারে নতুন আলু আসতে শুরু করে।
সংবাদ সম্মেলনে হিমাগার সমিতির সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, হিমাগারের প্রধান ব্যয়ের খাত হচ্ছে ব্যাংকঋণের কিস্তি ও বিদ্যুৎ বিল। গত এক বছরে সুদহার প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে এবং উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বিদ্যুৎ বিলও। এ ছাড়া হিমাগারে আলু আনা-নেওয়া (লোডিং-আনলোডিং), কর্মীদের বেতন–ভাতাসহ আনুষঙ্গিক সব খরচই বেড়েছে।
মোস্তফা আজাদ বলেন, এসব আবশ্যক ব্যয় বিবেচনায় নিয়ে ২০২৫ সালে হিমাগারে আলু সংরক্ষণে কেজিপ্রতি ভাড়া ৯ টাকা ৬২ পয়সা হওয়ার কথা। তবে আলুচাষি ও আলু সংরক্ষণকারী ব্যবসায়ীদের আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় ভাড়া ৮ টাকা নির্ধারণ করেছে সমিতি। তবে ন্যূনতম এই ভাড়া অনেকে দিতে চাচ্ছেন না।
এদিকে চলতি বছর হিমাগারের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে সম্প্রতি দেশের কয়েকটি স্থানে বিক্ষোভ করেন ক্ষুব্ধ কৃষক ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। যেমন, গত ২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলায় মহাসড়কে আলু ফেলে বিক্ষোভ করেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। তাঁদের দাবি, হিমাগার ভাড়া চার টাকা থেকে বাড়িয়ে আট টাকা করা হয়েছে।
মোস্তফা আজাদ বলেন, ২০২৪ সালে হিমাগার ভাড়া কেজিতে ৭ টাকা করে ছিল। এই সত্য গোপন করে এবং হিমাগার পরিচালনার আবশ্যকীয় ব্যয় বিবেচনায় না নিয়ে কিছু মধ্যস্বত্বভোগী মনগড়া বক্তব্য ও কর্মসূচি দিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা দিয়েছেন মোস্তফা আজাদ। তিনি বলেন, সাধারণত হিমাগারে ৫০ কেজির বস্তায় আলু সংরক্ষণের বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা আছে। তবে দেখা গেছে, অতীতে অনেক ব্যবসায়ী এ নিয়ম না মেনে ৭০ থেকে ৭২ কেজি আলু বস্তায় ভরে হিমাগারে রেখেছেন।
মোস্তফা আজাদ বলেন, গত বছর কেজিপ্রতি আট টাকা করে ৫০ কেজির বস্তার জন্য মোট ৩৫০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। তবে যাঁরা ৭০-৭২ কেজির বস্তা রেখেছিলেন, তাঁরাও ৩৫০ টাকা করে ভাড়া দিয়েছিলেন। সেই হিসাবে তাঁদের কেজিতে পাঁচ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। চলতি বছর এ ধরনের অনিয়ম একেবারে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মূলত এ কারণেই একটি মহল অপপ্রচার ও ভাড়া কমানোর আন্দোলন করছে।
সংবাদ সম্মেলনে হিমাগারমালিকেরা জানান, বস্তায় ১৫-২২ কেজি আলু বেশি রাখায় তাঁরা এত দিন এসবের ভাড়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আবার এ কারণে হিমাগারের আলুর ধারণক্ষমতাও ২০-২৫ শতাংশ কমে যায়। এতে ১০ হাজার টনের একটি হিমাগারে বছরে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়। এসব কারণে দেশের ৪০০ হিমাগারের মধ্যে প্রায় ৩০০ হিমাগারই রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আরও বেশ কিছু হিমাগার ঋণখেলাপি হয়ে গেছে।
হিমাগারমালিকেরা আরও জানান, দেশে আলুর চাহিদা প্রায় ৯০ লাখ টন। এর মধ্যে হিমাগারের ধারণক্ষমতা ৪৫ লাখ টনের মতো। চলতি বছর আলু উৎপাদন হতে পারে ১ কোটি ২০ লাখ টনের মতো। সেই হিসাবে বিপুল পরিমাণ আলু হিমাগারের বাইরে থাকবে এবং পণ্যটির দাম সেভাবে বাড়বে না। এতে কৃষকেরা ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন।
সমিতির সভাপতি মোস্তফা আজাদ বলেন, এমন বাস্তবতায় দেশ থেকে উদ্বৃত্ত আলু রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি হিমাগারের ভাড়া কমানোর জন্যও সরকারি সহায়তা প্রয়োজন। এ ছাড়া হিমাগারের যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে, তা যাচাই করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে।
হিমাগারে আলু সংরক্ষণ ভাড়া কমাতে সরকারের কাছে পাঁচটি দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সেগুলো হচ্ছে—ব্যাংকঋণের সুদহার ১৭ শতাংশ (দণ্ডসুদসহ) থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ করা; বিদ্যুৎ বিলের ইউনিটপ্রতি খরচ কমিয়ে ৫ টাকা করা; হিমগার–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যয়ের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার করা; উৎসে কর (টিডিএস) প্রত্যাহার করা ও ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় ত্রৈমাসিকের পরিবর্তে বার্ষিক করা। হিমাগারমালিকেরা বলেন, আলু সংরক্ষণ ভাড়া কৃষকদের সহনীয় পর্যায়ে আনতে হিমাগারশিল্পকে কৃষিভিত্তিক শিল্প ঘোষণা করে সরকারকে এসব পদক্ষেপ নিতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবস য় ত হয় ছ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।