খাদ্য অধিদপ্তরে চাল, আটা ও ময়দা কলের মালিকদের তালিকাভুক্তি নিয়ে চলছে ব্যাপক অনিয়ম। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা মিলেমিশে গড়ে তুলেছেন ঘুষ বাণিজ্যের সিন্ডিকেট। তাদের ‘খুশি’ করতে না পারলে আবেদন করলেও যোগ্য মিলারদের তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে না। দিনের পর দিন ফেলে রাখা হয় আবেদন। এমন ঘটনাও ঘটেছে, মিলার হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর চাহিদামাফিক ‘খুশি’ না করায় এক মিলারের অনুমোদনপত্র পরদিনই বাতিল করা হয়েছে।

আবার খাদ্য অধিদপ্তরের তালিকাভুক্তির জন্য জেলা খাদ্য কর্মকর্তার মাধ্যমে আবেদনের নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি। অসাধু কর্মকর্তাদের হাত করে সরাসরি খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বা সচিব বরাবর আবেদন করে তালিকাভুক্তির ঘটনাও ঘটেছে। এতে তালিকাভুক্তির বাইরে থেকে যাচ্ছেন অনেক প্রকৃত মিলার। ফলে দেশে খাদ্য মজুতের সঠিক চিত্রও অনেক সময় আড়ালে থেকে যায়। এটি সরকার ও দেশের মানুষেরও ভয়াবহ সংকটে পড়ার ঝুঁকি তৈরি করছে। 

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধান-চাল সংগ্রহ ও দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ধান, চাল, আটা ও পুষ্টি চালের মিল তালিকাভুক্ত করে সরকার। পরে এসব মিলারের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী পুষ্টি চালের প্রয়োজনীয়তার যৌক্তিক কারণ উল্লেখ করে ডিসি ফুড বরাবর আবেদন করেন স্থানীয়রা। ওই কর্মকর্তা যৌক্তিকতা পর্যালোচনা করে আগ্রহী মিলারদের কাছ থেকে আবেদন আহ্বান করেন। তাদের আবেদন যাচাই-বাছাই করে বৈধ ও যোগ্য আবেদনগুলো অনুমোদনের জন্য খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এ নিয়ম অনুপস্থিত।

গত ২৭ অক্টোবর আবেদন ছাড়াই খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের পিএস আরিফুল ইসলাম নিজেই কুষ্টিয়ার কুমারখালীর শিলাইদহের আড়পাড়ায় অবস্থিত মেসার্স নামিরা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেওয়ার জন্য খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন দেন। এ প্রতিষ্ঠানটির মালিক গাজী নাজমুল তারেক। নামিরা এন্টারপ্রাইজকে যোগ্য হিসেবে উল্লেখ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার জন্য মহাপরিচালক আবদুল খালেক তা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেন। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জয়নাল মোল্লা সেটি অনুমোদনের পক্ষে মত দেন। পরে গত ১৭ ডিসেম্বর নামিরা এন্টারপ্রাইজ অনুমোদন পেয়ে যায়। 

অভিযোগ রয়েছে, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে এই অনুমোদন দেওয়ার পেছনে মিলারের কাছ থেকে একটি বড় অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নিয়ে এ কাজ করেছেন পিএস আরিফ। এর সুবিধাভোগী হয়েছেন খাদ্য অধিদপ্তরসহ মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা। 

আবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের মরিয়ম অটো ফ্লাওয়ার মিলের মালিক মজিবুর রহমান নিয়ম মেনে অনুমোদনের জন্য আবেদন করলেও তাঁর আবেদনটি দীর্ঘদিন পড়ে থাকে। পরে তিনি সচিবের সেই পিএসের সঙ্গে দেখা করেন। আরিফ সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা গোলাম রব্বানীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। পরে ওই কর্মকর্তা অনুমোদন বাবদ আট লাখ টাকা খরচ আছে বলে জানান। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে রব্বানীকে পাঁচ লাখ টাকা দেন মজিবুর রহমান। টাকা দেওয়ার পরদিন গত ২৩ ডিসেম্বর মরিয়ম অটো ফ্লাওয়ার মিল অনুমোদন পেয়ে যায়। কিন্তু অনুমোদনের পর বাকি তিন লাখ টাকা দিতে গড়িমসি করেন মিলার। ফলে অনুমোদনের পরদিনই মিলের অনুমোদন বাতিলের আদেশ দেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জয়নাল মোল্লা।
এ ঘটনার পর মজিবুর রহমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের জামায়াতে ইসলামীর সাবেক এমপি লুৎফর রহমানের শরণাপন্ন হন। তিনি সশরীরে খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক আবদুস সালামকে বিস্তারিত জানান। পিএস আরিফ ও পিও রব্বানীকে টাকা দেওয়ার কথাও অবহিত করেন। ওই মুহূর্তে উপসচিব জয়নাল মোল্লাও উপস্থিত ছিলেন। ধরা পড়ে যাওয়ায় পরদিনই রব্বানী মরিয়ম অটো ফ্লাওয়ার মিলের মালিককে তিন লাখ টাকা ফেরত দিয়ে দেন।

অবশ্য এ প্রসঙ্গে গোলাম রব্বানী বলেন, মিলার হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য কারিগরি কমিটির একটি প্রতিবেদন লাগে। কিন্তু তাঁর প্রতিবেদনটি ছিল বেশ আগের। কিন্তু যে কর্মকর্তা এটির মূল্যায়ন করেন, তিনি মতামত দিয়েছিলেন হালনাগাদ প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য। কিন্তু ই-নথি হওয়ার কারণে ভুলে ক্লিক করার ফলে অনুমোদন পেয়ে যায়। পরে ধরা পড়ার পর সেটি বাতিল করা হয়। এর সঙ্গে আর্থিক কোনো সম্পৃক্ততা নেই। পরে প্রতিবেদন দিলে সেটি অনুমোদন পায়।
এ প্রসঙ্গে উপসচিব জয়নাল মোল্লা বলেন, একটি মিল অনুমোদন পেয়েছিল। কেন সেটি বাতিল হলো সে ব্যাপারে সাবেক এমপি লুৎফর রহমান সচিব মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কিন্তু কেন অনুমোদন পেল, আবার কেনই বা বাতিল হলো– সে প্রসঙ্গে তিনি কিছু বলতে চাননি। 

এ প্রসঙ্গে সাবেক এমপি লুৎফর রহমান সমকালকে বলেন, কী আর বলব। যখন আমি গেলাম তখন বলল, কাগজপত্রের ঘাটতি আছে। কিন্তু যদি ঘাটতিই থাকে তাহলে তারা আগে কেন দেখল না? এখানে একটা রহস্য তো আছেই। সেটা আর বলতে চাই না। তবে যে কাগজের কথা বলেছিল, সেটা পূরণ করার পর তারা আবার মিলটিকে তালিকাভুক্ত করেছে।
এদিকে প্যাকেট আটা-ময়দা বিক্রির জন্য আটার মিলগুলোরও বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অনুমোদনের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু খাদ্য অধিদপ্তরের কোনো প্রকার সুপারিশ ছাড়াই বেশ কয়েকটা আটা-ময়দার মিলকে অনুমোদন দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পাবনা সদরের বলরামপুরের মোহাম্মদ আজাদ খানের মালিকানাধীন মেসার্স ইন্ট্রা ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। গত ২৩ ডিসেম্বর এই মিলটি অনুমোদন পায়।

সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানান, খাদ্য অধিদপ্তর ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মিলারদের তালিকাভুক্ত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এসব কারসাজি চলছে। এ ক্ষেত্রে ঘুরেফিরে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের পিএস, খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক আবদুস সালাম, অনুমোদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জয়নাল মোল্লা, সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা গোলাম রব্বানীর নাম ঘুরেফিরে আসছে। নানা ধরনের বদলি বাণিজ্যও এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এর মধ্যে সচিবের পিএস আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ হলো, সরকার থেকে ৩০ লাখ টাকা সুদমুক্ত ঋণ নিয়ে গাড়ি কেনার পরও তিনি খাদ্য অধিদপ্তরের একটি গাড়ি (পাজেরো ঢাকা মেট্রো ১৪১৮৬২) সার্বক্ষণিক পরিবারের কাজে ব্যবহার করেন। ওই গাড়ির চালক দীন ইসলাম খাদ্য অধিদপ্তরেরই কর্মী।

অবশ্য এসব প্রসঙ্গে পিএস আরিফুল ইসলাম বলেন, নিয়ম অনুযায়ী ডিসি ফুডের মাধ্যমেই আগ্রহী মিলারদের আবেদন করতে হয়। অনেকে সরাসরি সচিব বরাবর করে। তবে এখানে তাঁর কিছু করার নেই। খাদ্য অধিদপ্তর থেকেই অনুমোদনের সব প্রক্রিয়া হয়। মন্ত্রণালয় সেটা চূড়ান্ত করে। এ ছাড়া খাদ্য অধিদপ্তরের কোনো গাড়ি ব্যবহার করেন না বলেও দাবি করেন তিনি। 
এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানাতে রাজি হননি মেসার্স নামিরা এন্টারপ্রাইজের মালিক গাজী নাজমুল তারেক ও মরিয়ম অটো ফ্লাওয়ার মিলের মালিক মজিবুর রহমান।
অপর অভিযুক্ত খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক আবদুস সালামও সমকালের কাছে এসব অনিয়মের কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এ বিষয়ে একটি কারিগরি কমিটি আছে। তাদের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে মহাপরিচালক মো.

আবদুল খালেকের মোবাইলে একাধিবার ফোন দিলে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় না দিয়ে কল রিসিভ করে বলেন, ‘স্যার  ব্যস্ত আছেন’।

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এ প রসঙ গ র জন য র পর চ ন র পর ইসল ম বর বর পরদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

জ্বালানি উপদেষ্টার পিএসকে বদলি

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের একান্ত সচিব (পিএস) মুহাম্মদ হাসনাত মোর্শেদ ভূঁইয়াকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদে বদলি করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

৬ এপ্রিল জারি করা প্রজ্ঞাপনে হাসনাত মোর্শেদকে কী কারণে উপদেষ্টার একান্ত সচিবের পদ থেকে সরানো হয়েছে, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

বিসিএস ২৮তম ব্যাচের কর্মকর্তা হাসনাত মোর্শেদ গত বছরের ১৮ আগস্ট ফাওজুল কবির খানের পিএস হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। 

উপদেষ্টাদের পছন্দ অনুযায়ী উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে তাদের একান্ত সচিব নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। 

ওই প্রজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়, উপদেষ্টা যত দিন পদে থাকবেন অথবা পিএস হিসেবে কাউকে রাখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করবেন, তত দিন পর্যন্ত পিএস পদে থাকবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জ্বালানি উপদেষ্টার পিএসকে বদলি