তালেবানের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক কোন পথে?
Published: 24th, February 2025 GMT
২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে সৌদি আরব আফগানিস্তানের কাবুলে তাদের কূটনৈতিক মিশন আবার চালু করার ঘোষণা দেয়। ২০২১ সালে তালেবান আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতা দখলে নেওয়ার পর সৌদি আরব তাদের কাবুল দূতাবাস বন্ধ করে দিয়েছিল। দূতাবাস চালুর ঘোষণা সৌদি আরবের নীতির পরিবর্তন ও আফগান তালেবানের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহকে প্রকাশ করে।
যাহোক, আফগানিস্তান ও সৌদি আরব দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি নির্ভর করবে তালেবান সরকার সৌদি আরবের আধুনিকীকরণ কর্মসূচির সঙ্গে নিজেদের কতটা প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারবে, তার ওপর। বিষয়টি সৌদি আরব–আফগানিস্তান সম্পর্কের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণে মূল ভূমিকা পালন করবে।
ঐতিহাসিকভাবে সৌদি আরব আফগানিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। সোভিয়েত–আফগান যুদ্ধের সময় সৌদি আরব আফগান মুজাহিদিনদের প্রয়োজনীয় সম্পদ ও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছিল।
সোভিয়েতদের সরে যাওয়ার পর আফগানিস্তানে যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, তারই এক পর্যায়ে ১৯৯৬ সালে তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তিনটি দেশ তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে তৃতীয় দেশটি ছিল সৌদি আরব।
যাহোক, সম্পর্কে বড় একটা ধাক্কা লাগে ১৯৯৮ সালে। সৌদি আরব তালেবান সরকারকে আল–কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হস্তান্তর করতে বলেছিল। তালেবান সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বড় ধরনের অবনতি হয়েছিল। সৌদি আরব তালেবান সরকারকে অর্থ সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছিল।
৯/১১ বা যুক্তরাষ্ট্রে আল–কায়েদার হামলার (টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে হামলা) পর সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত তালেবানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। ওই সন্ত্রাসী হামলার দুই সপ্তাহ পর, সৌদি আরব বলেছিল, মৌলবাদীদের আশ্রয় না দেওয়ার ব্যাপারে তারা যে সতর্কবার্তা দিয়েছিল, সেটা আমলে নেয়নি তালেবান। ৯/১১–এর সন্ত্রাসী হামলার কোনো দায় যাতে না আসে, সে কারণে আফগান তালেবান ও ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে দূরত্ব দেখানোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
কাবুলে সৌদি আরবের দূতাবাস আবার চালু করা আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে সৌদি আরবের একটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। কিন্তু সৌদি আরবের যে আধুনিকায়ন কর্মসূচি, তাতে করে আফগানিস্তানে তারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এমবিএসের নেওয়া সংস্কার কর্মসূচিই দুই পক্ষের মধ্যে মতাদর্শগত বিভেদ তৈরি করবে।২০০৮ সালে তালেবান ও আফগান সরকারের সঙ্গে আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছিল সৌদি আরব। আলোচনাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল মক্কা শহরে রমজান মাসে। আয়োজক ছিলেন সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ।
এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি সম্পাদন করা, যার মধ্য দিয়ে অস্ত্র সমর্পণ করে তালেবান আফগান সরকারের মূলধারায় সংযুক্ত হবে। কিন্তু সেই আলোচনা ব্যর্থ হয়। কিন্তু সৌদি আরব সরকার তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে আবার সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার নীতি নিয়েছিল, এ ঘটনাটি তারই প্রতিফলন ছিল।
২০১৭ সালে সৌদি যুবরাজ মোহাম্দ বিন সালমান (এমবিএস) সৌদি আরব সংস্কার কর্মসূচি চালু করেন। এমবিএস সৌদি সমাজে নারীদের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কিছু বাধা সরিয়েছেন, উৎসবের ওপর বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছেন, বিদেশে মসজিদ ও মাদ্রাসায় অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছেন।
এই সংস্কার কর্মসূচির প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো, পশ্চিমাদের কাছে ইসলামের একটি সহনশীল এবং মধ্যপন্থী ভাবমূর্তি উপস্থাপন করে।
আফগানিস্তান নিয়ে সৌদি আরবের যে নীতি, সেটাকে অংশত তালেবানবিরোধী বলা যায়। সৌদি আরব আফগানিস্তানে সহিংসতার ব্যবহার ও চরমপন্থার নিন্দা জানিয়েছে। আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফেরাতে ২০১৮ সালে সৌদি আরব ওআইসির দুই দিনের সম্মেলন আয়োজন করেছিল। সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় পণ্ডিতেরা এসেছিলেন, যাঁরা তালেবানের সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছিলেন। সম্মেলনে আফগানিস্তানের প্রতি সৌদি আরবের নতুন কূটনৈতিক অবস্থানকে তুলে ধরা হয়েছিল।
২০২১ সাল থেকে সৌদি আরব আফগানিস্তানে ন্যূনতম সহায়তা দিয়ে আসছে। শুধু মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগে ত্রাণসহায়তা দিয়েছে সৌদি আরব। ওআইসি ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে এমবিএস তাঁর প্রভাব ব্যবহার করে আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তা ট্রাস্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে এই সহায়তাগুলো দিচ্ছেন।
তিন বছর পর এটা স্পষ্ট যে আফগান তালেবান হলো বাস্তবতা। প্রতিবেশী বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোকে তাদের সঙ্গেই সম্পৃক্ত হতে হবে। সৌদি আরবের ক্ষেত্রে মানবিক সহায়তা এবং ওআইসির কাজের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
যদিও তালেবান নেতৃত্বে পরিচালিত আফগানিস্তান পুরোপুরিভাবে সৌদি আরবের সংস্কারমূলক কর্মসূচি মেনে নেবে না। কিন্তু বাস্তবসম্মত উপায়ে তালেবানের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ খুঁজতে হবে। বিশেষ করে উন্নয়ন ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সেই পথ তৈরি করা দরকার।
কাবুলে সৌদি আরবের দূতাবাস আবার চালু করা আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে সৌদি আরবের একটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। কিন্তু সৌদি আরবের যে আধুনিকায়ন কর্মসূচি, তাতে করে আফগানিস্তানে তারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এমবিএসের নেওয়া সংস্কার কর্মসূচিই দুই পক্ষের মধ্যে মতাদর্শগত বিভেদ তৈরি করবে।
আফগানিস্তানের নীতি ও নৈতিকতা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি বেশ কিছু অতি রক্ষণশীল আইন পাস করেছে। এর মধ্যে পুরুষদের দাড়ি কামানো থেকে বিরত রাখা ও নারীদের শিক্ষা বন্ধের মতো পদক্ষেপ রয়েছে।
একইভাবে ইসলামিক স্টেট অব খেরসন, আল–কায়েদা ও তেহরিক–ই–তালেবান পাকিস্তানের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর উপস্থিতির কারণে আফগানিস্তান এখনো সন্ত্রাসবাদের উর্বর ক্ষেত্র।
সৌদি আরবের সংস্কার কর্মসূচির সঙ্গে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পেতে হলে তালেবানের একটি পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক পটভূমির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। সৌদি আরবের সঙ্গে একটি শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হলে, মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতাগুলো মেনে চলতে হবে।
সোলায়মান মুয়েজ ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক
মিডলইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আফগ ন স ত ন র ত ল ব ন সরক র আরব র স কর ছ ল র একট
এছাড়াও পড়ুন:
‘পরিবারতন্ত্র’ উচ্ছেদের রাজনীতি কতটা বাস্তবসম্মত
আমি যখন অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে গিয়েছিলাম, তখন মেলবোর্ন শহরের বাইরে একটু গ্রামীণ পরিবেশে একটি বাসায় ভাড়া থাকতাম। সেই বাসার মালিক ছিলেন বেশ ধনী একজন লোক; তাঁর সম্ভবত ৮ থেকে ১০টি বাড়ি ছিল। তাঁর একটাই মেয়ে ছিল, যাকে তিনি তখনই তাঁর উত্তরাধিকার হিসেবে একটি বাড়ি দিয়েছিলেন।
একদিন আমি ‘বাঙালি স্বভাব’ অনুযায়ী লোকটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনি কি আপনার সব সম্পত্তি মেয়েকে দিয়ে যাবেন?’ তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘না, সব দেব না। আমাদের দেশে এটা ঠিক নয়। এখানে সন্তানেরা নিজেরাই গড়ে ওঠে। সরকার আর সমাজ তাদের পাশে থাকে। তাই সবকিছু সন্তানের নামে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এরপরও কেউ যদি নিজের সব সম্পদ সন্তানদের দিতে চায়, তখন আমরা তাকে নেতিবাচকভাবে দেখি।’
এমন দৃষ্টিভঙ্গি শুধু অস্ট্রেলিয়ার নয়, আমেরিকা–ইউরোপেও দেখা যায়। বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট, ইলন মাস্কদের মতো ধনী ব্যক্তিরাও ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁদের সম্পদের বড় অংশ ‘জনকল্যাণে’ দান করবেন। কারণ, তাঁদের বিশ্বাস, বেশি সম্পত্তি সন্তানের দায়িত্ববোধ নষ্ট করে দেয়।
এসব দেশ বৃদ্ধদের পেনশন, চিকিৎসা দেয়; বেকারদের ভাতা দেয়। তাই বাবা-মায়েদের সন্তাননির্ভর হয়ে থাকতে হয় না। এই চিন্তাভাবনা এক দিনে আসেনি। সমাজকাঠামো আর রাষ্ট্রের ভূমিকা পাল্টে যাওয়ার মধ্য দিয়েই এসব পরিবর্তন এসেছে।
এ অভিজ্ঞতা আমাকে ভাবতে বাধ্য করল, বাংলাদেশে তো পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। আমাদের সমাজে পরিবার মানে শুধু আত্মীয়তা নয়, এটি জীবনের নিরাপত্তা, আশ্রয় ও শেষ ভরসার জায়গা। বাবা-মায়েরা তাঁদের জমি, টাকাপয়সা, সঞ্চয়—সবকিছু সন্তানের হাতে তুলে দেন। তাঁরা মনে করেন, সন্তানই তাঁদের বার্ধক্যের শেষ ভরসা, চিকিৎসা পাওয়ার নিশ্চয়তা ও সামাজিক মর্যাদার ভিত্তি। ফলে সন্তানদের যাবতীয় দায়িত্ব নেওয়া ও পরবর্তী সময়ে তাদেরই সব সম্পদ দিয়ে দেওয়া আমাদের সমাজে একধরনের ‘নিয়ম’ হয়ে গেছে।
আরও পড়ুনরাজনৈতিক দলগুলোর কোনো অনুশোচনা নেই কেন২১ মার্চ ২০২৫পরিবার, অভ্যাস ও সামাজিক পুঁজিএই পরিবারনির্ভরতা কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নেই, এর একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব আমাদের সমাজকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাসেও পড়েছে। বিষয়টি বুঝতে আমরা ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক পিয়েরে বোর্দিওর দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ‘হেবিটাস’ ও ‘সোশ্যাল ক্যাপিটাল’ প্রসঙ্গিকভাবে ব্যবহার করতে পারি।
হ্যাবিটাস বলতে বোঝায় এমন একধরনের স্বভাব বা মানসিকতা, যা গড়ে ওঠে পরিবার, সমাজ, ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাবে। আমরা কীভাবে চিন্তা করি, স্বপ্ন দেখি বা সিদ্ধান্ত নিই, সবই এ অভ্যাসের অংশ। মাইক্রোফিনান্স অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্ট: উইমেন ডেবট ইন বাংলাদেশ বইয়ে লামিয়া করিম দেখিয়েছেন, কীভাবে গ্রামের নারীরা পরিবার ও সমাজের চাপে এমনভাবে গড়ে ওঠে, যেখানে তারা নিজের কথা বলার সুযোগই পায় না। এ অভ্যাসই তাদের আত্মবিশ্বাস বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে আটকে রাখে।
■ বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ, সেখানে পরিবারই হয়ে ওঠে নিরাপত্তা, উপায় ও স্বীকৃতির প্রধান উৎস। ■ পরিবারতন্ত্র সামাজিক কাঠামোরই একটি বহিঃপ্রকাশ, যেখানে মানুষ পরিবারকে জীবনের ভরসা হিসেবে দেখে এবং সেই ভরসা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। ■ আমাদের সমাজে নেতৃত্ব ও ক্ষমতার ধারণা এমনভাবে গঠিত হয়েছে, যেখানে পরিবার মানেই নেতৃত্বের বৈধতা; রক্তের সম্পর্ক মানেই অধিকার। এসব ধারণা এখনো আমাদের সমাজের প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।অন্যদিকে সোশ্যাল ক্যাপিটাল হলো এমন একধরনের শক্তি, যা আমরা সামাজিক সম্পর্ক, পরিচিতি ও যোগাযোগের মাধ্যমে অর্জন করি। ‘মাইগ্রেশন এজ আ লিভিংহুড স্ট্র্যাটেজি অব দ্য পুওর’ গবেষণায় এ ধারণা ব্যবহার করেছেন অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী। তিনি দেখিয়েছেন, বিদেশে থাকা আত্মীয়ের মাধ্যমে অনেকেই সহজে অভিবাসন করতে পারে, যেটা অন্যদের পক্ষে সম্ভব নয়।
তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে একটি পরিবার অভিবাসনের অভিজ্ঞতা, যোগাযোগ আর মানসিকতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তর করে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, পরিবারে কীভাবে হ্যাবিটাস ও সোশ্যাল ক্যাপিটাল একসঙ্গে কাজ করে।
‘ইয়ুথ, পভার্টি অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট’ গবেষণায় প্রায় একই রকমই ব্যাখ্যা দিয়েছেন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেছেন, অনেক তরুণের চাকরি পাওয়া বা সুযোগ তৈরি হওয়া নির্ভর করে কে তার চাচা বা মামা, অর্থাৎ তার পরিচিতি বা সম্পর্ক কেমন, সে বিষয়ের ওপর। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটাই সোশ্যাল ক্যাপিটালের একটি বাস্তব রূপ।
বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ, সেখানে পরিবারই হয়ে ওঠে নিরাপত্তা, উপায় ও স্বীকৃতির প্রধান উৎস। এই পারিবারিক অভ্যাস ও সম্পর্কের শক্তি যখন রাজনীতির ভেতর ঢুকে পড়ে, তখন সেটাকে অভিহিত করা হয় ‘পরিবারতন্ত্র’ বলে।
রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রকে শুধু কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমস্যা বললে ভুল হবে। এটি আমাদের সামাজিক কাঠামোরই একটি বহিঃপ্রকাশ, যেখানে মানুষ পরিবারকে জীবনের ভরসা হিসেবে দেখে এবং সেই ভরসা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়।
রাজনীতির বাইরেও পরিবারতন্ত্রপারিবারিক প্রভাব বা ‘আধিপত্য’ কেবল রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে সীমাবদ্ধ থাকে না; বাংলাদেশে ব্যবসা, শিক্ষা ও উন্নয়ন খাতেও এর স্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়। অনেক এনজিও (বেসরকারি সংস্থা), এমনকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় পরিবারভিত্তিক বোর্ড দ্বারা, যেখানে সিদ্ধান্ত নেন পরিবারের সদস্যরাই।
এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত দক্ষতার চেয়ে সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর ফলে যোগ্যতা নয়, আত্মীয়তাই হয়ে ওঠে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মূল মাপকাঠি। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও একই প্রবণতা লক্ষণীয়; পারিবারিক মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোয় পেশাদার ব্যবস্থাপনার চেয়ে পরিবারভিত্তিক সিদ্ধান্ত বেশি গুরুত্ব পায়।
বাংলাদেশে পরিবারতন্ত্রের গভীর শিকড় কেবল রাজনীতি বা অর্থনীতিতে নয়, এটি আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চর্চার মধ্যেও গেঁথে আছে। উপমহাদেশের সুলতানি, মোগল বা নবাবি আমলে নেতৃত্ব ছিল সম্পূর্ণরূপে বংশানুক্রমিক ও পরিবারকেন্দ্রিক। সেই আমলে শাসকের সন্তান বা আত্মীয়রাই নেতৃত্বে আসার অধিকার দাবি করতেন।
এ ধরনের শাসনব্যবস্থা আমাদের সমাজে নেতৃত্ব ও ক্ষমতার ধারণাকে এমনভাবে গঠন করেছে, যেখানে পরিবার মানেই নেতৃত্বের বৈধতা; রক্তের সম্পর্ক মানেই অধিকার। এসব ধারণা এখনো আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।
এ মনস্তত্ত্ব ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চর্চার ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের দেশে বহু স্থানে পীর-মাজার সংস্কৃতি প্রচলিত। এসব ক্ষেত্রে একজন পীরের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে বা পরিবারের সদস্যরাই পীরের আসনে বসেন এবং অনুসারীরা তা মেনে নেন।
এগুলো কোনো ধর্মীয় বিধান নয়, বরং একটি সামাজিক রীতি বা সাংস্কৃতিক অনুশীলন যা আমাদের পরিবারকেন্দ্রিক নেতৃত্বের মানসিকতা ও স্বীকৃতির দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে। এমন রীতি বা চর্চা সমাজে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে সেটি সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা অবলম্বন করে। এটি প্রমাণ করে যে আমাদের মানসিক গঠন এমনভাবে তৈরি হয়েছে, যেখানে নেতৃত্ব মানেই পারিবারিক উত্তরাধিকার।
আরও পড়ুনক্ষমতাপ্রত্যাশীরা নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী দেখতে চায় না২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫পরিবারতন্ত্র: একটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতাপরিবারতন্ত্র কেবল দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক সমস্যা নয়; বরং এটি একটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতা, যা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মাত্রায় বিদ্যমান। যদিও এর রূপ, পরিসর ও প্রভাব দেশের সামাজিক কাঠামো, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে, তবু সামগ্রিকভাবে দেখা যায়, রাজনৈতিক পরিবারগুলোর ক্ষমতায় থাকার প্রবণতা অনেক দেশের রাজনৈতিক জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বুশ, কেনেডি ও ক্লিনটন পরিবারের মতো প্রভাবশালী পরিবারগুলো দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির মূল স্রোতে সক্রিয়। এমনকি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছেলে ব্যারন ট্রাম্পকে সম্প্রতি রিপাবলিকান পার্টির জাতীয় সম্মেলনের জন্য প্রতিনিধি হিসেবে বাছাই করা হয়েছিল, যদিও পরে তিনি নিজেই সরে দাঁড়ান। অনেকের মতে, তাঁকে ভবিষ্যতে বড় কোনো রাজনৈতিক দায়িত্বের জন্য তৈরি করা হতে পারে।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তাঁর বাবা পিয়েরে ট্রুডোর রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবে দেশ পরিচালনা করেছেন। ইউরোপের দেশ বেলজিয়ামের রাজনীতিতেও পরিবারতন্ত্রের উপস্থিতি দেখা যায়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সংসদ সদস্যদের প্রায় ১০ শতাংশের বাবা বা মা আগে সংসদ সদস্য ছিলেন। এটা ‘রাজনৈতিক উত্তরাধিকার’ ধারণার প্রমাণ বহন করে। যদিও ইউরোপে এ ধরনের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম, তারপরও এটি একেবারে অনুপস্থিত নয় (দ্য ব্রাসেলস টাইমস, ২০২০)।
জাপানে পরিবারতন্ত্রের একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ রয়েছে। এখানে রাজনৈতিক পরিবারগুলো ‘জিবান’ (স্থানীয় ভিত্তি), ‘কানবান’ (পরিবারের নাম ও খ্যাতি) এবং ‘কাবান’ (অর্থনৈতিক সহায়তা) নামের তিনটি মূলধনের ওপর নির্ভর করে। জাপানের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের প্রায় ৩০ শতাংশ সদস্যই উত্তরাধিকারসূত্রে রাজনীতিতে এসেছেন; আর শাসক দল এলডিপির প্রায় ৪০ শতাংশ সদস্যই কোনো না কোনো রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান (দ্য ডিপ্লোম্যাট, ২০১৭ এবং ইস্ট এশিয়া ফোরাম, ২০২৩)।
লক্ষণীয় হলো, এসব দেশ শক্তিশালী নির্বাচনব্যবস্থা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ এ ধরনের পরিবারতান্ত্রিক প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে; পরিবারতন্ত্র থাকলেও সেটি একচ্ছত্র ক্ষমতায় রূপ নেয় না।
আমার এই লেখার মূল বক্তব্য হচ্ছে, পরিবারতন্ত্র শুধু একটা দলের সমস্যা নয়, এটা আমাদের সমাজের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতার অংশ। প্রয়াত ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন একাধিক টক শো ও পত্রিকায় বলেছিলেন, পারিবারিক রাজনীতি আসলে আমাদের সমাজের রাজনৈতিক দলবদ্ধতার প্রতিচ্ছবি। তাঁর মতে, যদি জনগণ একে মেনে নেয়, তাহলে সেটাও একধরণের গণতন্ত্রের প্রকাশ হতে পারে (চ্যানেল আই টক শো)।
অন্যদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলী রীয়াজ বাংলাদেশ: আ পলিটিক্যাল হিস্ট্রি সিন্স ইনডিপেনডেন্স বইয়ে দেখিয়েছেন, কীভাবে ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি ধীরে ধীরে গণতন্ত্রকে ক্ষয় করে। তিনি এটাও বলেছেন, এ সমস্যা আসলে সমাজ থেকেই আসে; দলীয় আনুগত্য, পৃষ্ঠপোষকতা ও নেতাকে নিয়ে ‘নায়কতান্ত্রিক’ সংস্কৃতিই এর মূল শিকড়।
দ্য পলিটিকস অব দ্য গভর্নড বইয়ে ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক পার্থ চ্যাটার্জি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে জনগণ অনেক সময় নেতাকে পরিবারের একজন বড় মানুষের মতো ভাবেন, যিনি সুরক্ষা দেন, সিদ্ধান্ত নেন এবং যাঁর প্রতি ভক্তি তৈরি হয়। ফলে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যোগ্যতা নয়, সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায় প্রধান মানদণ্ড।
এ রকম বাস্তবতায় ‘রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র নিপাত যাক’ কেবল একটি স্লোগান হয়েই থাকবে, যদি না আমরা বুঝতে পারি এটি একটি গভীর সাংস্কৃতিক ও কাঠামোগত বাস্তবতার প্রতিফলন। তবে এর মানে এই নয় যে কোনো রাজনৈতিক পরিবার থেকে কেউ রাজনীতিতে এলে তাঁকে অগ্রাহ্য করতে হবে।
বরং প্রশ্ন হওয়া উচিত, সেই ব্যক্তি কি যোগ্য? তিনি কি সংগঠক হিসেবে দক্ষ? জনগণ কি তার ওপর আস্থা রাখে? যদি এসব প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক হয়, তবে তাঁকে বাধা না দিয়ে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া উচিত কাঠামোগত পরিবর্তনের দিকে; যেখানে থাকবে জবাবদিহি, অংশগ্রহণ ও কার্যকর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
পরিবারতন্ত্রকে শুধু ক্ষমতাধর পরিবারের সমস্যা হিসেবে না দেখে সমাজকাঠামোর অন্তর্নিহিত রূপ হিসেবে বোঝা জরুরি। কেবল স্লোগান, ক্ষোভ, আবেগ কিংবা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া ব্যবস্থার মাধ্যমে কোনো পরিবর্তন আসবে না। পরিবর্তন আসতে পারে শিক্ষা, বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও নাগরিক সচেতনতার মধ্য দিয়ে; ধাপে ধাপে, ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে এগুলো করতে হবে।
●মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়