গত ৮ ফেব্রুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় হলসহ অন্তত ১৯টি স্থাপনার নতুন নামকরণ করা হয়েছে। এটা করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জগদীশচন্দ্র বসু, কবি জীবনানন্দ দাশ, লালন সাঁই, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, শহীদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, জি সি দেব, ডা.

আলীম চৌধুরীসহ বেশ ক’জন ক্ষণজন্মা মনীষীর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে, যারা এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাঙালি জাতিসত্তার মনন নির্মাণে ভূমিকা রেখেছেন। বিষয়টি নিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হতাশা মিশ্রিত ক্ষোভ  প্রকাশ করেছেন। তারা একে দেখছেন আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার একটি প্রয়াস হিসেবে।

স্বীকার্য, সরকার বদলের সঙ্গে বাংলাদেশে স্থান ও স্থাপনার নামের বদল নতুন নয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে চট্টগ্রামে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানবন্দরের নামকরণ করে এম এ হান্নান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এম এ হান্নান ছিলেন চট্টগ্রামের একজন বিশিষ্ট রাজনীতিক এবং চট্টগ্রামে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির একজন সংগঠক। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে এম এ হান্নানের বদলে বিমনবন্দরটির নাম দেয় হযরত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এ ক্ষেত্রে অষ্টাদশ শতকের একজন ইসলামী ধর্মগুরুর নাম ব্যবহারের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। তাই ২০০৮ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ওই বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের সাহস করেনি; বরং টার্গেট করে দেশের প্রধান বিমানবন্দরকে। ২০১০ সালে তারা জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম বদল করে রাখে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এটি প্রতিপক্ষের কৌশল দিয়েই তাদের ঘায়েল করার চেষ্টা।
বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে স্থান বা স্থাপনার নাম বদল নিছক আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্য কোনো দলীয় বিষয় নয়। যেমন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাম এখনও অনেকে বি.বাড়িয়া লেখেন। আপাতদৃষ্টিতে লেখার সুবিধার্থে মনে হলেও বি.বাড়িয়া লেখার পেছনে একটি সাম্প্রদায়িক চিন্তা ছিল– সেটি না বোঝার কারণ নেই। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাম রাখা হয়েছিল রহমানবাড়িয়া।

স্থানের নামের মুসলমানীকরণ সর্বাধিক হয়েছে এরশাদ আমলে। ওই সময় জয়দেবপুরের নাম বদল করে গাজীপুর এবং বিক্রমপুরের নাম মুন্সীগঞ্জ করা হয়। একই ঘটনা ঘটেছে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির ক্ষেত্রেও। ১৯৮৩ সালে স্বরূপকাঠি থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু ১৯৮৫ সালে হঠাৎ স্বরূপকাঠি উপজেলাকে নেছারাবাদ নামকরণ করা হয়। অনেকেই মনে করেন, শর্ষীনার পীরের উত্তরসূরিদের প্রভাবেই স্বরূপকাঠির নাম পরিবর্তন করে নেছারাবাদ রাখা হয়েছে। যদিও সাধারণ মানুষ এখনও জায়গাটিকে স্বরূপকাঠি বলেই চেনে।
ধারণা করা হয়েছিল, ২০২৪-এর আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ধারা সূচিত হবে। পরস্পরকে দোষারোপ বা ঘায়েল করার রাজনীতি শেষ হবে। কিন্তু কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার শুধু পুরোনো ধারার রাজনীতি উৎসাহিতই করছে না; কোনো কোনো ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের চিহ্ন মোছার নামে বাঙালির ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়ার পথে হাঁটতে শুরু করেছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনা এর মোক্ষম দৃষ্টান্ত।

অস্বীকার করা যাবে না, আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছরের শাসনামলে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই শেখ হাসিনা পরিবারের বা পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেকের নামেই দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপনার নামকরণ করা হয়েছে; রাজধানী ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত উপজেলা পর্যন্ত। বিষয়টি সাধারণ মানুষও ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। এমনকি আওয়ামী ঘরানার অনেকেই এটিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেননি। কিন্তু যেসব মনীষী তাদের কাজের মাধ্যমে যুগে যুগে বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ঋদ্ধ করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন, তাদের নাম বাদ দেওয়া কেন? কোনো স্থাপনার নামকরণ নিছক শেখ হাসিনার আমলে হয়েছিল বলেই তা মুছে ফেলতে হবে– এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না।

বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিকস সারাবিশ্বে আদৃত– কে না জানে! তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান। তিনি এমনই এক মনীষী, যাঁর নাম আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। সারাবিশ্বেই উচ্চতর বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই বোসন কণার সঙ্গে পরিচিত, যা কিনা জগদ্বিখ্যাত এ দুই বিজ্ঞানীর নাম বহন করে চলেছে। এমন মানুষের নামে কোনো প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনা থাকলে তা তো গোটা জাতির জন্যই গৌরবের বিষয়। কিন্তু শেখ হাসিনা মর্যাদা দিয়েছিলেন বলে তাঁকেও সরিয়ে দিতে হবে– এ কেমন কথা!

একই কথা খাটে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় কিংবা জীবনানন্দ দাশের ক্ষেত্রে। তারা তো আমাদের অহংকার। তাদের নাম বাদ দেওয়া হলো কোন যুক্তিতে? আর একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবী জি সি দেব, ডা. আলীম চৌধুরী; তারা? তাহলে কি প্রকারান্তরে একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর তদানীন্তন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এবং তাদের দোসর আলবদর-আলশামসদের অপকর্মের চিহ্ন মুছে দেওয়ার প্রয়াস? 
প্রশ্নগুলো আসছে এই কারণে যে, তাদের কেউ আওয়ামী লীগ সরকারের ‘দোসর’ ছিলেন না; থাকার কোনো অবকাশও নেই। তারা প্রত্যেকেই বাঙালির ইতিহাসের একেকটি গৌরবদীপ্ত স্তম্ভ। তাহলে তাদের নাম মুছে ফেলা হলো কেন? একে সাধারণ কোনো সাম্প্রদায়িক বা রাজনৈতিক অভিলাষের প্রকাশ হিসেবে দেখলে ভুল হবে। অতীতে এমন যেসব পরিবর্তন হয়েছে, সেগুলো ছিল নিছক সাম্প্রদায়িক চেতনাজাত; কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার হাতিয়ার। কিন্তু খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়টির শিকড় আরও অনেক গভীরে প্রোথিত বলেই প্রতীয়মান। এটি আসলে বাঙালি জাতিসত্তার অহংকারের চিহ্ন, সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার অপপ্রয়াস। 

প্রশ্ন হলো, এ ক্ষেত্রে কি আমরা ইউক্রেন মডেলকেই অনুসরণ করতে যাচ্ছি? ইউক্রেনে ২০০৪ সালে ‘কমলা বিপ্লব’-এর পর সরকার দেশটির পুরোনো সব ঐতিহ্যস্মারক মুছে দিয়ে ইতিহাসের নতুন ‘বয়ান’ নির্মাণের পথে হাঁটা শুরু করে। কিন্তু এর ফল যে খুব সুখকর হয়নি, তা তো বর্তমানে দেশটির দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
মহাভারতে খাণ্ডব নামে অরণ্য দগ্ধ করে তার সমুদয় প্রাণ উপহার দেওয়া হয়েছিল অগ্নিকে। পঞ্চপাণ্ডব এটা করেছিলেন অগ্নিকে সন্তুষ্ট করার জন্য। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাও এক প্রকার খাণ্ডবদাহন; বাঙালির ইতিহাসের খাণ্ডবদাহন। সময় থাকতেই বন্ধ করতে হবে ইতিহাসের এই খাণ্ডবদাহন।

মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা ও কলাম লেখক

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত হয় ছ ল র র জন আওয় ম সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

লামিনে ‘মেসি’ ইয়ামাল

১৭ বছর বয়সী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো: ১৯ ম্যাচ, ৫ গোল, ৪ গোলে সহায়তা।

১৭ বছর বয়সী লিওনেল মেসি: ৯ ম্যাচ, ১ গোল, গোলে সহায়তা নেই।

১৭ বছর বয়সী লামিনে ইয়ামাল: ১০০ ম্যাচ, ২২ গোল, ৩৩ গোলে সহায়তা।

মেসি–রোনালদোর সঙ্গে তুলনা নয়, লামিনে ইয়ামালের শুরুটা বোঝাতে এই পরিসংখ্যান হাজির করেছে টিএনটি স্পোর্টস। ধূমকেতুর মতো শুরু হলেও ধূমকেতুর মতোই মিলিয়ে যাওয়ার পাত্র তিনি নন।

বার্সেলোনার এস্তাদি অলিম্পিক লুইস কোম্পানিসে  গত রাতের ম্যাচটি স্মরণ করতে পারেন। ৬ গোলের থ্রিলার, যেখানে বার্সেলোনা–ইন্টার মিলান সেমিফাইনাল প্রথম লেগের ‘ক্লাসিক’ লড়াই ৩–৩ গোলে অমীমাংসীত। দুই দলের হয়েই ‘সুপার হিরো’ ছিলেন বেশ কজন। ইন্টারের যেমন ডেনজেল ডামফ্রিস ও মার্কাস থুরাম, বার্সার তেমনি রাফিনিয়া, ফেরান তোরেসরা। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে ঠিকই রবির কিরণের মতো আলো দিয়েছেন এক কিশোর—লামিনে ইয়ামাল নাসরাউয়ি এবানা। সংক্ষেপে লামিনে ইয়ামাল।

আরও পড়ুন৬ গোলের থ্রিলারে বার্সেলোনা–ইন্টার সেয়ানে সেয়ানে টক্কর৮ ঘণ্টা আগে

২৪ মিনিটে ইয়ামালের করা গোলটির প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। যেভাবে খেলেছেন তাতে গোলটি না করলেও লোকে কাল রাতে তাঁর পারফরম্যান্স মনে রাখতেন। পরিসংখ্যান বলছে ১০২টি টাচ, একটি গোল, ২টি গোল হওয়ার মতো পাস, ৬টি শট (পোস্টে মেরেছেন দুবার) এবং ১০টির মধ্যে ৬টি সফল ড্রিবলিং।

কিন্তু পরিসংখ্যানে এ তথ্য নেই—মাঠে ডান প্রান্তকে ইয়ামাল ফাইনালে ওঠার হাইওয়ে বানিয়ে যতবার কাট–ইন করে ইন্টারের বক্সে ঢুকেছেন, সেটা আসলে ইতালিয়ান ক্লাবটির রক্ষণের জন্য দুঃস্বপ্নের। প্রতিবারই মৌমাছির মতো ছেঁকে ধরা হয়েছে ইয়ামালকে। কিন্তু আটকানো কি সম্ভব হয়েছে? রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওগুলো ভাসছে। সেসব আসলে ইয়ামালের পায়ের কারুকাজে ইন্টারের রক্ষণকে স্রেফ খোলামকুচির মতো উড়িয়ে দেওয়ার ভিডিও।

ইয়ামাল কত ভয়ংকর সেটা এই এক ছবিতেই পরিস্কার। সবাই ছেঁকে ধরেও তাঁকে আটকাতে পারেননি

সম্পর্কিত নিবন্ধ