রাজনৈতিক দলের কোর্টে এখন ‘সংস্কারের বল’
Published: 6th, March 2025 GMT
ছয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে মতামত জানাতে রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রতিটি সুপারিশের বিষয়ে ‘একমত’, ‘আংশিক একমত’ এবং ‘ভিন্নমত’– এই তিনটি প্রশ্ন রয়েছে। সংস্কার বাস্তবায়নে পাঁচ বিকল্প দিয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। বিকল্পগুলো হলো– নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে, নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে, নির্বাচনের সময়ে গণভোটের মাধ্যমে, গণপরিষদের মাধ্যমে এবং নির্বাচনের পর সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে। ঐকমত্য কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সূত্র সমকালকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোকে গত কয়েক দিনে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুদক, জনপ্রশাসন এবং পুলিশ সংস্কারবিষয়ক কমিশনের প্রতিবেদন একীভূত করে দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশে একমত হবে, সেগুলোর ভিত্তিতে হবে জুলাই চার্টার বা সনদ। দলগুলো একমত হলে পুলিশ, দুদক, জনপ্রশাসনসহ যেসব বিষয়ে সাংবিধানিক প্রশ্ন নেই, সেগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংস্কার করবে সরকার। সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থাসহ যেসব বিষয়ে সাংবিধানিক প্রশ্ন রয়েছে, সেগুলো গণভোটের মাধ্যমে সংস্কার করা যায় কিনা, তা জানতে চাওয়া হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। আগামী সংসদ নির্বাচনের সঙ্গেই গণভোট করা যায় কিনা, এ বিকল্পও রাখা হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে। দলগুলো একমত হলে নির্বাচনের পর আগামী সংসদেও সংস্কার হতে পারে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের নেতারা গণভোট ও গণপরিষদের কথা বললেও বিএনপি এর ঘোর বিরোধী। একে নির্বাচন বিলম্বিত করার ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। তারা দ্রুত সংসদ নির্বাচন চায়। তবে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দলের নেতারা তাড়াহুড়া নয়, টেকসই সংস্কারে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার সমকালকে বলেন, বুধবার মতামত চেয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাঁচটি বিকল্প দিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে, কোন প্রক্রিয়ায় সংস্কার চায় তারা। আগামী ১৩ মার্চের মধ্যে মতামত জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
যদিও কয়েকটি দলের অভিযোগ, তারা ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পুরোটা পায়নি। কোনো কোনো দল আংশিক পেয়েছে। একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতা সমকালকে জানিয়েছেন, ২৫৪টি প্রস্তাব রয়েছে প্রতিবেদনগুলোতে। প্রতি প্রস্তাবের সঙ্গে তিনটি করে প্রশ্ন করেছে। একমত এবং আংশিক একমত হলে ‘টিক’ দিতে বলা হয়েছে। ভিন্নমত থাকলে তা বিস্তারিত লিখে সরকারকে জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে গত ১২ ফেব্রুয়ারি ছয় মাসমেয়াদি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ কমিশনের সহসভাপতি। নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুদক, জনপ্রশাসন এবং পুলিশ সংস্কারবিষয়ক কমিশনের প্রধানরা ঐকমত্য কমিশনের সদস্য।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এ কমিশন ২৭টি রাজনৈতিক দল এবং জোটের ১০০ প্রতিনিধির সঙ্গে প্রথম বৈঠক করে।
এতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মতামত চাওয়া হবে। এরপর দলগুলোর সঙ্গে আলাদা বৈঠকে বসবে কমিশন। পরে আবার সব দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে বৈঠক হবে। ১৫ ফেব্রুয়ারির বৈঠকে সরকারপ্রধান বলেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। কোনো দল যদি একটি সংস্কার প্রস্তাবেও একমত না হয়, তাতেও অসুবিধা নেই। কোন দল কতটি প্রস্তাবে একমত হয়েছে, তা জানিয়ে দেওয়া হবে। ভিন্নমত থাকলে তা জানাতে পারবে কমিশনকে। কমিশন তা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশ করবে।
১৫ ফেব্রুয়ারির বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন জাতীয় নাগরিক কমিটি (জানাক) এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। শেখ হাসিনার পতন ঘটানো অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া দুই সংগঠনের নেতারা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে দল গঠন করেছেন গত ২৮ ফেব্রুয়ারি।
এ দলও সংস্কারের সুপারিশমালায় মতামত জানাতে চিঠি পেয়েছে। দলটি সংসদের আগে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তুলেছে। গণপরিষদে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কথা বলছে। এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শামরিন সমকালকে বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের চেতনা বাস্তবায়নে গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধানের প্রস্তাব করা হবে।
কোন দল কী মতামত জানাবে– এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল জানিয়েছে, নির্বাচন ব্যাহত বা বিলম্বিত হতে পারে– এমন সংস্কার প্রস্তাবকে সমর্থন করা হবে না। আগামী ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে হবে। এ সময়ের মধ্যে নির্বাচনের জন্য অত্যাবশকীয় সংস্কারে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। যেসব সুপারিশ নির্বাচনের পরে বাস্তবায়ন সম্ভব, সেগুলো আলাদা করা হবে। রাজনৈতিক নেতারা জানিয়েছেন, সংস্কারের সুপারিশ পর্যালোচনা করে মতামত তৈরি করা হবে। দলীয় নেতার বাইরে বিশেষজ্ঞদেরও পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। বিএনপি নেতারা জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারে ছয় সংস্কার কমিশন গঠনের আদলে দলীয়ভাবে ছয়টি কমিটি গঠন করে। এই কমিটিগুলো অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার পর কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে মতামত তৈরি করা হচ্ছে। বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা প্রস্তাবকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
দলটির নেতারা জানান, বিএনপি আগেই সংস্কার কমিশনগুলোতে দলীয় মতামত এবং প্রস্তাব লিখিত আকারে দিয়েছে। ঐকমত্য সুপারিশমালা যে সংকলন তৈরি করেছে, তা পর্যালোচনা চলছে। সেখানে বিএনপির প্রস্তাব কমিশনগুলো কতটা আমলে নিয়েছে, কোন কোন সুপারিশ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তা জানার চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে যেসব সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য, তা আমলে নেওয়া হচ্ছে বলে তারা জানান।
বিএনপির দলীয় সংস্কার কমিটির এক নেতা সমকালকে জানান, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কার কমিশন একই বিষয়ে আলাদা সুপারিশ করেছে। কমিশনগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে তা হয়েছে। আবার কিছু সুপারিশে অস্পষ্টতা, অসংগতি ও বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন রয়েছে, যা বাস্তবায়নে জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। রাজনৈতিক দল বা শক্তিগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য সৃষ্টিতে বাধার সৃষ্টি পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও প্রশাসন সংস্কার কমিটির প্রধান সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা করা হচ্ছে। খুব বেশি সময় লাগবে না। হয়তো দু-একদিনের মধ্যেই হয়ে যাবে। পরে তা লিখিত আকারে জানানো হবে।
৩১ দফার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি বিএনপির নিজস্ব সংস্কার প্রস্তাব, যা দলীয় প্রতিশ্রুতি। এর সঙ্গে হয়তো সরকারের সংস্কার কমিশনের বেশি মিল থাকতে পারে, আবার বাইরে থেকেও কিছু অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যেসব অমিল থাকবে, তা আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব বলে আশাবাদী সালাহউদ্দিন আহমেদ।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে জানিয়েছেন, তারা কমিশনের সুপারিশ পেয়েছেন। মতামত দিতে কাজ চলছে।
১৩ মার্চের মধ্যে মতামত জানানোর অনুরোধের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এত তাড়াহুড়োর তো প্রয়োজন নেই। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সংস্কারের অভূতপূর্ব সুযোগ এসেছে জাতির সামনে। তা কাজে লাগাতে হবে। সংস্কার হতে হবে টেকসই। আবার অন্ততকাল সময়ও নেওয়া হবে না। যৌক্তিক সময়ের মধ্যে বিচার-বিশ্লেষণ পর্যালোচনা করে মতামত চূড়ান্ত করা উচিত। দেশের জন্য দলীয় স্বার্থে ঊর্ধ্বে উঠে সংস্কারে রাজি হতে হবে।’
চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনূস আহমাদ সমকালকে বলেন, ছয়টি কমিশনের সুপারিশের প্রশ্ন আকারে পেয়েছি। দলীয়ভাবে এগুলো ভাগ করে দেওয়া হয়েছে ছয়টি বিশেষজ্ঞ দলকে।
সংস্কারের সুপারিশমালা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি সমকালকে বলেন, প্রস্তাবগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দল একমত, নাকি আংশিক একমত– তা জানতে চাওয়া হয়েছে। ভিন্নমত থাকলে তা জানাতে বলা হয়েছে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সমকালকে বলেন, সংবিধান সংস্কারের সুপারিশমালার পাঁচ খণ্ডের মাত্র একটি পেয়েছি। প্রতিটি সংস্কারে প্রস্তাব যদি ২৫০ পৃষ্ঠারও হয়, তাহলে পড়তে ও বুঝতেও সময় দিতে হবে। একই অভিযোগ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সহসভাপতি তানিয়া রব বলেন, মাত্র একটি সংস্কারের সুপারিশমালার হার্ডকপি পেয়েছি।
ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল আলম বাবলু বলেন, সব সুপারিশ পেয়েছি। দলীয় নেতা ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে কমিশনকে জানানো হবে।
বাংলাদেশ এলডিপির সভাপতি শাহাদাত হোসেন সেলিম জানান, সব সুপারিশ পেয়েছেন। মতামত জানাতে প্রস্তুতি শুরু করবেন।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব এনপ জ ম য় ত ইসল ম মত মত জ ন ত সব স প র শ মত মত চ ব এনপ র ব কল প গণভ ট সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদ নিয়ে জট খুলুন, সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট কথা বলে দুই দেশের উদ্বেগজনক বাণিজ্য বিরোধের মীমাংসা করতে পারলেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বিজ্ঞ নেতারা দীর্ঘ আলোচনা করে ঠিক করতে পারছেন না কীভাবে নির্বাচন ও সংস্কার কাজটি করা যাবে।
অনেক আলোচনা ও বিতর্কের পর ১৭ অক্টোবর বৃষ্টিস্নাত বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় বেশ ঘটা করে ২৫টি দল জুলাই সনদে সই করেছিল; চারটি বামপন্থী দল রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তন করার প্রতিবাদে সনদে সই দেয়নি, তাতে অবাক হইনি। কিন্তু ছাত্রনেতৃত্ব থেকে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি, যারা জুলাই সনদের দাবিটি প্রথম তুলেছিল, তাদের সই না দেওয়াটা অস্বাভাবিক ঠেকেছে। এটা নিয়ে তারা যে দর–কষাকষি করছে, তার পেছনে কি নীতিগত অবস্থান, না ভোটের হিসাব–নিকাশ মুখ্য ছিল, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেওয়ার লক্ষ্যে যে সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করেছে, তা নিয়ে রাজনীতির মাঠ বেশ গরম। বিএনপিসহ বেশ কিছু দল একে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও তামাশা বলেও অভিহিত করেছে। আবার কেউ কেউ স্বাগতও জানিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, জুলাই সনদ ও আইনি ভিত্তি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত না হতে পারলে নির্বাচন হবে কীভাবে?
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তিনটি বলয় তৈরি হয়েছে। একটি বলয় হলো বিএনপি ও তাদের সমর্থক-অনুসারী দল। আরেকটি হলো জামায়াতে ইসলামী ও এর অনুসারী দল। তৃতীয়টি হলো জাতীয় নাগরিক পার্টি। আবার কোনো কোনো দল দুই নৌকায় পা দিয়ে রেখেছে। যেখানে গিয়ে ভোটের মাঠে সুবিধা করা যাবে, শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে যাবে।
মাঠে সক্রিয় থাকা ৩০টি রাজনৈতিক দলকে নিয়েই সরকার তথা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দীর্ঘ আট মাস ধরে আলোচনা করে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ৪৮টি বিষয় যেহেতু সংবিধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেহেতু এগুলোর আইনি ভিত্তি তৈরির জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে, যা নিয়ে আবার মতভেদ দেখা দিয়েছে। যদিও সনদ তৈরির সময় বলা হয়েছিল, তারা আইনি ভিত্তির সুপারিশ করবে না। কিন্তু অসমাপ্ত সনদ করতে গিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আরও জট পাকিয়ে ফেলেছে।
জুলাই সনদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে আসতে না পারলে নির্বাচনের অনিশ্চয়তা কাটবে না। সরকার বলছে, তারা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজি করাতে না পারলে কীভাবে সেই নির্বাচন হবে? প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন সামনে রেখে বড় আক্রমণের আশঙ্কার কথা বলেছেন। সেই আশঙ্কা মোকাবিলার দায়িত্ব তো সরকারকেই নিতে হবে।যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে মতবিরোধ তীব্র, তার একটি হলো গণভোটের তারিখ। জামায়াতে ইসলামী ও তাদের অনুসারীরা বলছে, নভেম্বরেই গণভোট হতে হবে। অন্যদিকে বিএনপি ও তাদের অনুসারীদের দাবি, সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হতে পারবে না। তাঁরা মনে করেন, আগে গণভোটের দাবি তোলা নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার দুরভিসন্ধি ছাড়া কিছু নয়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অবশ্য দুই বিকল্প প্রস্তাবই সরকারের কাছে পেশ করেছে। সমস্যা হলো যিনি সরকারপ্রধান, তিনি ঐকমত্য কমিশনেরও প্রধান। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে কে কার কাছে প্রস্তাব পেশ করেছেন।
দ্বিতীয়ত, জুলাই সনদে ঐকমত্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের আপত্তিগুলো লিপিবদ্ধ হলেও আইনি ভিত্তির সুপারিশে বাদ দেওয়া হয়েছে। বিএনপি ও তাদের অনুসারীদের প্রধান আপত্তি এখানেই। জুলাই সনদে বলা হয়েছে, যেসব বিষয় রাজনৈতিক দলগুলো আপত্তি জানিয়েছে, নির্বাচনে তারা জনগণের রায় পেলে সেটি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য নয়। কিন্তু আইনি ভিত্তিতে যখন সেটি বাদ দেওয়া হয়েছে এবং সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে সেটি অনুমোদন করে নিলে সংসদের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হবে।
তাদের তৃতীয় আপত্তির জায়গা হলো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আইনি ভিত্তি অনুমোদিত হয়ে যাওয়া। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলেছে, যদি ৯ মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ উল্লিখিত বিষয়ে আইন পাস না করে, তাহলে সেটা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে অনুমোদিত হয়ে যাবে। ঐকমত্য কমিশনের এই আইনি ভিত্তির সঙ্গে ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খান প্রণীত এলএফওর মিল খুঁজেও পেয়েছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র অনৈক্যের কারণে জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে ‘দুরূহ চ্যালেঞ্জ’ দেখছে সরকার। তবে গণভোটসহ সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট করার বিষয়টিও গভীরভাবে চিন্তা করছে বলে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’ (প্রথম আলো, ৩১ অক্টোবর ২০২৫)
সিদ্ধান্তটি কবে হবে, কেমন হবে? যদি একই দিনে দুই ভোট করার পক্ষে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে জামায়াত ও এনসিপি কি মেনে নেবে? আর যদি সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হয়, বিএনপি কি তা গ্রহণ করবে? যদি না করে, কী পরিস্থিতি তৈরি হবে?
রাজনৈতিক দলগুলোকে জুলাই সনদের পক্ষে এনে সরকার যতটুকু বাহবা পেয়েছিল, তার বেশি সমালোচিত হয়েছে আইনি ভিত্তি দিতে গিয়ে। এখানে কোনটি ন্যায্য, কোনটি অন্যায্য; তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে একমতে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যেমন একে অপরকে বিশ্বাস করবে না, তেমনি তাদের বড় অংশ সরকারের প্রতিও আস্থাশীল নয়। নির্বাচনের বিষয়ে শুরু থেকে সরকারের দ্বিধাদ্বন্দ্ব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন সন্দেহ বাড়িয়েছে, তেমনি সরকারের প্রতিও একধরনের অনাস্থা সৃষ্টি করেছে।
সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের যেখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা ছিল, রাজনৈতিক দলের সংস্কার, সেখানেই তারা কম গুরুত্ব দিয়েছে। তারা এই একটি বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিলে রাষ্ট্রীয় ও রাজনীতির সংস্কারকাজ অনেকটা সহজ হতো। এখন রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের চাপে সনদে যতই সই করুক না কেন, কাজ করবে তাদের মতো করে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংবিধানের দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন নিয়ে যতটা ব্যস্ত ছিল, রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণ নিয়ে ততটাই উদাসীন থেকেছে।
জুলাই সনদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে আসতে না পারলে নির্বাচনের অনিশ্চয়তা কাটবে না। সরকার বলছে, তারা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজি করাতে না পারলে কীভাবে সেই নির্বাচন হবে? প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন সামনে রেখে বড় আক্রমণের আশঙ্কার কথা বলেছেন। সেই আশঙ্কা মোকাবিলার দায়িত্ব তো সরকারকেই নিতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন যত বাড়বে, আক্রমণের আশঙ্কারও তত জোরদার হবে। এই সহজ সত্যটি সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন, ততই মঙ্গল। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে চাইলে অবিলম্বে সৃষ্ট জট খোলার ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসুন। সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে।
● সোহরাব হাসান, সাংবাদিক ও কবি
* মতামত লেখকের নিজস্ব