এবার ঈদুল ফিতরে টানা ৯ দিনের লম্বা ছুটি। ঘরমুখী মানুষের যাত্রা স্বস্তির হওয়ার প্রত্যাশা সরকারের। কিন্তু দেশের দুটি মহাসড়কে উন্নয়নকাজ, অব্যবস্থাপনা ভোগান্তির কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। বিশেষ করে ঈদের আগের দুই দিন যানবাহনের চাপ বেড়ে গেলে আর ব্যবস্থাপনা ঠিকঠাক না থাকলে তা যানজটে রূপ নিতে পারে।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। এই সড়কের নারায়ণগঞ্জ থেকে নরসিংদী পর্যন্ত হাটবাজারের কারণে এমনিতেই চাপ থাকে।

কিন্তু চার লেনের কাজ চলমান থাকায় কোথাও কোথাও সড়ক সরু হয়ে পড়েছে। কোথাও আবার খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। আছে ধুলার ওড়াউড়ি। এই পথে ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের ৯টি জেলার মানুষ যাতায়াত করেন।

টাঙ্গাইল-রংপুর পথে চার লেনের কাজ চলছে ছয় বছর ধরে। এখনো কাজ শেষ হয়নি। বিশেষ করে যমুনা সেতুর আগের অংশের কাজ এখনো চলমান। ঈদের শেষ চার দিনে যমুনা সেতু হয়ে প্রতিদিন গড়ে ৫০ হাজারের মতো যানবাহন চলাচল করে। ফলে ভোগান্তির আশঙ্কা এই পথেও আছে। এই পথে ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগের ২১টি জেলার মানুষ যাতায়াত করেন।

এর বাইরে ঢাকা-ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন মহাসড়কের নানা স্থানে দুই পাশেই অবৈধ দখলদারদের কারণে সড়ক সংকুচিত হয়ে গেছে। গাজীপুর অঞ্চলে পোশাক কারখানা ছুটি হলে চাপ পড়ে মহাসড়কে। ফলে ব্যবস্থাপনার ঘাটতি হলে যেকোনো সময় যানজট দেখা দিতে পারে।

এবার ঈদযাত্রায় নতুন শঙ্কা যোগ করেছে মহাসড়কে ডাকাতি। পুলিশের হিসাবে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশে ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে ৭৪টি। আগের মাস জানুয়ারিতে এই সংখ্যা ছিল ৭১। অথচ গত বছরের প্রথম দুই মাসে সারা দেশে ডাকাতির ঘটনা ছিল ৬২টি। সারা দেশে মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় ১ হাজার ৪০০ জনের একটি তালিকা করেছে হাইওয়ে পুলিশ।

এবার সড়ক পরিবহন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নগরের প্রতিটি বাস, রেল ও লঞ্চ টার্মিনালে সিসিটিভি ক্যামেরা বসাচ্ছে। এর মাধ্যমে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পর্যবেক্ষণ করবেন। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে পুলিশের উপস্থিতি বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, তিনিসহ সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঈদযাত্রার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তদারকি ও পরিদর্শন করবেন। যেকোনো অভিযোগ, বিশৃঙ্খলা নজরে এলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঢাকা ছাড়েন ১ কোটি ২০ লাখ

পরিবহন খাতের সূত্রগুলো বলছে, ঈদে ঘরমুখী মানুষের যাত্রায় দুর্ভোগের শুরু হয় একেবারে যাত্রার শুরু থেকেই। প্রথমত, ঈদের শেষ চার দিনে ১ কোটি ২০ লাখের মতো মানুষ ঢাকা ছাড়েন। ট্রেন, বাস ও লঞ্চে এত বিপুলসংখ্যক যাত্রীর যাতায়াতের ব্যবস্থা নেই। ফলে ঈদযাত্রায় কাঙ্ক্ষিত যানের টিকিট পাওয়া এবং যাত্রা শুরু করাটাই প্রথম বিড়ম্বনা। এরপর রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল ও লঞ্চঘাটে ভোগান্তি হয়। আছে বাড়তি ভাড়ার চাপ। গতকাল শনিবার ট্রেনের ঈদযাত্রা শুরু হয়েছে। তবে ঢাকা থেকে আন্তনগর ট্রেনে মাত্র ৩৫ হাজার যাত্রী যাতায়াতের ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে মূল চাপ পড়বে সড়কেই।

২০২২ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো.

হাদীউজ্জামান ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়ে একটি সমীক্ষা করেন। সমীক্ষা অনুযায়ী, ঈদের আগের চার দিনে ঢাকা ছাড়েন ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। সে হিসাবে ঈদের সময় প্রতিদিন গড়ে বাড়ি যান ৩০ লাখ মানুষ। কিন্তু ঢাকাকেন্দ্রিক যে গণপরিবহনব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলো দিয়ে বড়জোর দিনে ২২ লাখ মানুষ পরিবহন সম্ভব।

ঈদের আগের কয়েক দিনে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮ লাখ মানুষ বাস-মিনিবাসে, ১ লাখ ৫ হাজার মানুষ ট্রেনে বসে ও দাঁড়িয়ে এবং সোয়া লাখ মানুষ লঞ্চে যাতায়াত করেন। ব্যক্তিগত গাড়ি ও মাইক্রোবাস ভাড়া করে বাড়ি যান সাড়ে ৭ লাখ মানুষ। মোটরসাইকেলে ঈদযাত্রায় শামিল হন ৪ লাখ মানুষ।

সমীক্ষা বলছে, আরও ৮ লাখ মানুষ ট্রাক, অটোরিকশাসহ নানা অপ্রচলিত বাহনে ভোগান্তি নিয়ে যাতায়াত করেন। এর বাইরে কিছু মানুষ উড়োজাহাজেও যাতায়াত করেন।

অধ্যাপক হাদীউজ্জামান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তিন বছর আগে করা সমীক্ষার পরিবর্তন হয়নি; বরং ঘরমুখী মানুষের সংখ্যা কিছু বাড়তে পারে। যানবাহনের সংখ্যা এবং সড়কের অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি।

ঈদে ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিয়ে হাদীউজ্জামান বলেন, ঈদ সাময়িক সময়ের জন্য মহাসড়কে উন্নয়নকাজ বন্ধ রাখতে হবে। আবার এটাও খেয়াল রাখতে হবে, যাতে ঠিকাদার নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র না রেখে দেন। এমনটা হলে জরিমানা করতে হবে। সরু সড়কে যাতে ওভারটেকিং না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

উত্তরের পথে যত বাধা

উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড়। এই সড়ক দিয়ে উত্তরের ১১৭টি সড়কের কয়েক হাজার যানবাহন চলাচল করে।

চন্দ্রা এলাকার লবিবা পরিবাহনের ব্যবস্থাপক মো. ফয়সাল হোসেন জানান, চন্দ্রা এলাকায় উত্তরবঙ্গের পরিবহনের শতাধিক কাউন্টার রয়েছে। সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠাতে হয়। সড়কে অযথা বিভাজক তৈরি করে সংকুচিত করা হয়েছে। এতে সাধারণ সময়েই যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। ঈদযাত্রা শুরু হলে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

এ মহাসড়কে নিয়মিত চলাচল করা দূরপাল্লার পরিবহনের চালক, যাত্রী ও স্থানীয় লোকজন বলছেন, রাস্তার দুই পাশ দখল করে অবৈধ দোকানপাট, কাঁচাবাজার, অবৈধ পার্কিং ও ইজিবাইকের আধিক্যের কারণে সারা বছর যানজটের ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে। ঈদ এলে ঘরমুখী মানুষের এ ভোগান্তি ব্যাপক আকার ধারণ করে। এবারও সে আশঙ্কাই করছেন তাঁরা।

গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশ সুপার আ ক ম আখতারুজ্জামান বসুনিয়া প্রথম আলোকে বলেন, গাজীপুরসহ আশপাশের কয়েকটি মহাসড়কে এবার ঈদে ৯ শতাধিক পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে। তাঁরা জেলা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবেন।

এদিকে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে যমুনা সেতু পর্যন্ত চার লেনের নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। তবে ইতিমধ্যে দুই লেন সড়কের পাশে ধীরগতির যানবাহন চলাচলের জন্য লেনের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। যানবাহন এই লেন ব্যবহার করতে পারবে এবার ঈদযাত্রায়। ফলে ঢাকা থেকে যমুনা সেতু পর্যন্ত যানবাহন চার লেনের সুবিধা নিয়ে চলাচলের সুযোগ পাবে এবার। তারপরও যমুনা সেতু দুই লেন হওয়ায় এবং মহাসড়কে যানবাহন বিকল হলে যানজটের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

গতকাল সকালে টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার করাতিপাড়া থেকে যমুনা সেতুর পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার রাস্তা সরেজমিনে দেখা যায়, কালিহাতীর এলেঙ্গা পর্যন্ত চার লেনের মহাসড়ক ও দুই লেনের ধীরগতির যানবাহন চলাচলের রাস্তা দিয়ে নির্বিঘ্নে যানবাহন চলাচল করছে।

ভোগাতে পারে ঢাকা-ময়মনসিংহের ৬ স্থান

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাড়িগুলো সাধারণত উত্তরা, গাজীপুর দিয়ে বের হয়। ফলে এই সড়কে বিমানবন্দর বিআরটি করিডর, উত্তরা, আবদুল্লাহপুর, গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকায় গাড়ির জট তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া ভবানীপুর বাজার, হোতাপাড়া, বাঘের বাজার, মাস্টারবাড়ি বাজার, সিডস্টোর বাজার, ভালুকা বাসস্ট্যান্ড—এসব জায়গায় সড়কে বিকেলের পরে বাজার বসার কারণে যানজট হয়। এই মহাসড়কে ছয়টি স্থানে যানজটের আশঙ্কা আছে।

গাজীপুরের পুলিশ সুপার চৌধুরী মো. যাবের সাদেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পবিত্র রমজানের শুরুতেই ঈদের যাত্রার প্রস্তুতি নিয়েছি। এর মধ্যে মহাসড়কের সার্ভিস লেনগুলো দখল হয়ে গিয়েছিল। সেগুলো এরই মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে। সেখানে থাকা বাসস্ট্যান্ডগুলো সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

এদিকে ঈদুল ফিতর সামনে রেখে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক যানজটমুক্ত রাখতে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ডের দুই পাশে শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে উচ্ছেদ অভিযানে নেতৃত্ব দেন দাউদকান্দির সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. রেদওয়ান ইসলাম।

ঢাকা-সিলেট পথের বাধা নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কটি ছয় লেন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ-আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ চলছে। ফলে স্বাভাবিক সময়েই মহাসড়কের প্রায় সব স্থানে দুর্ভোগ হচ্ছে। তবে সবচেয়ে দুর্ভোগপ্রবণ এলাকা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের গাউছিয়া থেকে নরসিংদীর ইটাখোলা পর্যন্ত। বিশেষ করে গাউছিয়া ও বাবুরহাট বাজার এলাকায় সড়কে বেশ খানাখন্দ। ধুলায় আচ্ছন্ন থাকে সব সময়। ইটাখোলা মোড়েও নির্মাণকাজের কারণে সড়ক সরু হয়ে পড়েছে। ভৈরব বাসস্ট্যান্ডে চার রাস্তার মোড়। সেখানে অব্যবস্থাপনা যানজটের কারণ হতে পারে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ থেকে বিশ্বরোড পর্যন্ত অংশে ভারতীয় ঋণে দীর্ঘদিন ধরে চার লেনের নির্মাণকাজ চলছে। কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। কোথাও আবার সড়ক সরু হয়ে পড়েছে। এর বাইরে ধুলার ওড়াউড়ি তো আছেই। বিশ্বরোডের পর যানবাহনের চাপ কিছুটা কমে যায়।

গত শুক্রবার সরেজমিনে দেখা গেছে, আশুগঞ্জ থেকে বিশ্বরোড পর্যন্ত দুই মহাসড়কে ধীরগতিতে চলছে যান। স্বল্প সময়ের জন্য যান চলাচল বন্ধ হলেই সড়কে জটলা লেগে যাচ্ছে। বিশ্বরোড মোড়ে সওজের জায়গা দখল করে অটোরিকশার অবৈধ স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। বিশ্বরোড মোড়ের পূর্ব দিকে সড়কে স্থানীয় প্রভাবশালীদের নির্মাণসামগ্রী পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

ঢাকা-সিলেটগামী বিআরটিসির বাসের চালক শহিদুল ইসলাম বলেন, পুলিশ সড়কে সক্রিয় থাকলে যানজট থাকবে না।

ঢাকা-সিলেট ছয় লেন মহাসড়কের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আমিন এহসান প্রথম আলোকে বলেন, ছয় লেন সড়কের আওতায় সরাইল থেকে হবিগঞ্জের মাধবপুর পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার অংশের যেসব জায়গায় ছোট-বড় খানাখন্দ ছিল, তা সংস্কার করে দেওয়া হয়েছে। ১০-১২টি স্থানে মেরামত করা হয়েছে। আরও সংস্কার করা হবে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন মাসুদ রানা, গাজীপুর; কামনাশীষ শেখর, টাঙ্গাইল; শাহাদৎ হোসেন ও বদর উদ্দিন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া; আবদুর রহমান, দাউদকান্দি, কুমিল্লা]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ত য় ত কর ন প রথম আল ক ঈদয ত র য় র ব যবস থ ক জ চলছ য নজট র পর বহন ব শ বর ব হন র ই সড়ক আশঙ ক গতক ল সড়ক স ঘরম খ

এছাড়াও পড়ুন:

ব্যালটে মামদানি, অদৃশ্য ‘প্রার্থী’ ট্রাম্প

নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচন আগামীকাল মঙ্গলবার। ‘বিশ্বের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত এই শহরে প্রথমবার এমন একজন মেয়র পদে নির্বাচিত হতে পারেন, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির চলতি ধারার একদম বিপরীতমুখী। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর রিপাবলিকান পার্টি এক ‘শ্বেতকায়, খ্রিষ্টান ও রক্ষণশীল’ আমেরিকার কথা বলছেন।

জোহরান মামদানি শ্বেতকায় নন, তিনি বাদামি রঙের দক্ষিণ এশীয়। তিনি খ্রিষ্টান নন, একজন মুসলিম। তিনি অবশ্যই রক্ষণশীল নন, তিনি খোলামেলাভাবে একজন প্রগতিশীল, যিনি নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলতে দ্বিধা করেন না।

‘মামদানি একজন ভয়ানক মানুষ’, সাবধান করে বলেছেন অ্যান্ড্রু কুমো, মঙ্গলবারের নির্বাচনে যিনি মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বী। সারা জীবন ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য থাকলেও বাছাইপর্বে পরাজিত হয়ে তিনি এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন।

ব্যালটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাম না থাকলেও এই নির্বাচনে তিনি একজন অদৃশ্য প্রার্থী। কুমোর পক্ষ নিয়ে তিনিও এই নির্বাচনের একজন অংশগ্রহণকারী। বড় ব্যবধানে মামদানির বিজয় হলে অনেকেই তা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অনাস্থা হিসেবেই দেখবেন।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউইয়র্কের আদি বাসিন্দা। তিনি কোনোভাবেই চান না মামদানি এই শহরের মেয়র নির্বাচিত হোন। তাঁর বিবেচনায় মামদানি শুধু একজন পাক্কা কমিউনিস্টই নন, রীতিমতো উন্মাদ। এমন একজনকে নির্বাচিত করা হলে তিনি নিউইয়র্ক সিটির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল আটকে দেবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, মামদানি একজন অবৈধ অভিবাসী। তা প্রমাণিত হলে তাঁকে বহিষ্কার করা হবে। মেয়র নির্বাচিত হয়ে মামদানি যদি অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের চলতি অভিযানে বাধা দেন, তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে, এমন হুমকিও দিয়েছেন ট্রাম্প।

শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি।

ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়

শুধু নিউইয়র্কে নয়, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আরও অন্তত তিনটি রাজ্যে নির্বাচন হবে আগামীকাল, যার ফলাফল ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের ব্যাপারে একটি রেফারেন্ডাম বা জনরায় হবে ভাবা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে নিউ জার্সি ও ভার্জিনিয়ায় গভর্নর পদে নির্বাচন। এই দুই রাজ্যে প্রতিনিধি পরিষদ ও উচ্চ পরিষদেও ভোট গ্রহণ করা হবে। উভয় রাজ্যই ডেমোক্রেটিক রাজনীতির সমর্থক, বা ‘ব্লু স্টেট’। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই দুই রাজ্যেই ট্রাম্পের হার হয়, কিন্তু ২০১৬ সালের তুলনায় তিনি অনেক ভালো ফল করেন। দেখার বিষয়, দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে এই দুই রাজ্যে ট্রাম্পের জনসমর্থন এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে।

এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ায় গভর্নর গেভিন ন্যুসাম নির্বাচনী ম্যাপ পরিবর্তনের অনুমতি চেয়ে একটি গণভোটের আয়োজন করেছেন। আগামী বছরের নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে রিপাবলিকান পার্টি বড় রকমের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। তা ঠেকাতেই ট্রাম্পের নির্দেশে টেক্সাসের নির্বাচনী ম্যাপ ঢেলে সাজানো হয়েছে, যার ফলে রিপাবলিকান দল কংগ্রেসে আরও পাঁচটি আসন নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হবে ভাবা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ‘ব্লু স্টেট’ ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর ন্যুসামের নির্দেশে নির্বাচনী ম্যাপ বদলানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার ফলে সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য কংগ্রেসে পাঁচটি আসনে বিজয়ের সম্ভাবনা তৈরি হবে।

এই তিনটি নির্বাচনের প্রতিটিতেই ভোটারদের মনে থাকবেন ট্রাম্প, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আইনি বাধা উপেক্ষা করে বিভিন্ন ডেমোক্রেটিক শহরে অবৈধ অভিবাসনবিরোধী অভিযানের নামে সেনাসদস্যদের পাঠাচ্ছেন তিনি। যেসব ডেমোক্রেটিক নেতাকে শত্রু মনে করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছেন। কোনো যুক্তি বা কারণ ছাড়াই ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাঁর পক্ষে ভোট দেয়নি এমন ডেমোক্রেটিক রাজ্যের কেন্দ্রীয় অনুদান বাতিল করছেন। কংগ্রেসের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই একাধিক সরকারি দপ্তর আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা না করে মাদক পাচার বন্ধের নামে ভেনেজুয়েলার সমুদ্রসীমায় সামরিক হামলা চালাচ্ছেন। আমদানি শুল্কের নামে যে বাণিজ্যযুদ্ধ তিনি শুরু করেছেন, তার ফলে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের দাম বাড়া শুরু হয়েছে।

গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।

এসব কার্যকলাপের ফলে সারা দেশে ট্রাম্পের জনসমর্থন কমেছে। অধিকাংশ জনমত জরিপে তাঁর প্রতি সমর্থন ৪২ থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি নয়। সাম্প্রতিক সময়ে মাত্র ১০ মাসের মাথায় অন্য আর কোনো প্রেসিডেন্টের জনসমর্থনে এমন ধস নামেনি।

এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প কোনো রাজ্যেই ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি প্রচারে আসেননি। এমনকি রিপাবলিকান প্রার্থীদের পক্ষে সরব সমর্থনও জানাননি। এর একটা সম্ভাব্য কারণ, জয়ী হবেন এমন প্রার্থীর সমর্থন দিতেই ট্রাম্প ভালোবাসেন। আগামীকালের নির্বাচনে তেমন সম্ভাবনা কম।

এই নির্বাচন যে ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়, তার আরেক প্রমাণ নির্বাচনী প্রচারণায় সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অংশগ্রহণ। ডেমোক্রেটিক পার্টিতে জাতীয় নেতা বলতে তিনিই সবেধন নীলমণি। শনিবার নিউ জার্সির ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী মাইকি শেরিলকে পাশে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। একই দিন ভার্জিনিয়ায় ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী এবিগেইল স্প্যানবার্গারের পক্ষেও প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। উভয় রাজ্যেই ওবামা কঠোর ভাষায় ট্রাম্পের সমালোচনা করে বলেন, ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী নীতির কারণেই আমেরিকা আজ এক দুঃসময়ের মুখোমুখি।

জনমতে এগিয়ে মামদানি

ওবামা মামদানিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দেননি। তবে তিনি যে মামদানির পাশে আছেন, সে কথাও গোপন রাখেননি। মামদানির ক্যাম্পেইন থেকে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি ওবামা নিজেই ফোন করে জানিয়েছেন, তাঁর (মামদানির) বিজয়ের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তিনি বলেছেন, মামদানির নির্বাচনী প্রচার ‘ইম্প্রেসিভ’ বা নজরে পড়ার মতো।

কুমো ক্যাম্প থেকে অহোরাত্রি তাঁকে ‘কমিউনিস্ট’ ও ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ হিসেবে প্রচার সত্ত্বেও মামদানি যেসব জনমত জরিপে এগিয়ে, তার একটি বড় কারণ মাঠপর্যায়ে তাঁর এই ‘ইম্প্রেসিভ’ প্রচারণা। শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি। এতে তিনি ফল পাচ্ছেন, গত দুই সপ্তাহে মামদানির সঙ্গে তাঁর ব্যবধান ১০ শতাংশের মতো কমে এসেছে। নিউইয়র্কের চলতি মেয়র নির্বাচন থেকে এরিক অ্যাডামস সরে দাঁড়ানোয় কুমোর লাভ হয়েছে সন্দেহ নেই, তবে এখনো মামদানির সঙ্গে যে ১৬-১৭ পয়েন্টের ব্যবধান রয়েছে, তা অতিক্রম করা কার্যত অসম্ভব, এই মত অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের।

ভূমিধস পরিবর্তন

একটা বিষয় স্পষ্ট। মেয়র নির্বাচনে মামদানি জয়ী হলে তা মার্কিন রাজনীতিতে প্রজন্মগত ও নীতিগত পরিবর্তনের সূচনা করবে। ভূমিধস পরিবর্তন আসবে ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিতে। মধ্যপন্থী ও ডানঘেঁষা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে এই দল অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কম জনপ্রিয়। এই দলে যাঁরা নেতৃত্বে, তাঁদের অধিকাংশই বয়োবৃদ্ধ, করপোরেট আমেরিকার কাছে এদের হাত-পা বাঁধা। ইসরায়েল প্রশ্নে তাদের সমর্থন এখনো আগের মতো নতজানু।

পিউ রিসার্চের তথ্য অনুসারে, ইসরায়েল প্রশ্নে এখন নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে এমন আমেরিকানের সংখ্যা ৫৩ শতাংশ, যা তিন বছর আগের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। একইভাবে ধনতন্ত্রের প্রতিও আমেরিকানদের সমর্থন নিম্নগামী। গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।

অন্যদিকে ট্রাম্পের নেতৃত্বে রিপাবলিকান পার্টি খোলামেলাভাবে অভিবাসনবিরোধী, দক্ষিণপন্থী, খ্রিষ্টবাদী ও রক্ষণশীল। চলতি সপ্তাহের নতুন উদ্বাস্তু নীতিতে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন শ্বেতকায় ও ইউরোপীয় আশ্রয়প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেবে। এই অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতকায় নাগরিকবৃন্দ, ট্রাম্প প্রশাসনের চোখে যারা সে দেশের সরকারের বৈষম্যের শিকার।

এই প্রতিক্রিয়াশীল রিপাবলিকান পার্টির বিপরীতে একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল ডেমোক্রেটিক আন্দোলন গড়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও কংগ্রেস সদস্য ওকাসিও-কর্তেজ ইতিমধ্যে এই আন্দোলনের প্রধান মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। সবাই মানেন, মামদানির মতো তরুণ ও বুদ্ধিমান নেতৃত্ব এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করবে।

এই সম্ভাবনার কথা খুব স্পষ্ট করে বলেছেন বার্নি স্যান্ডার্স। তাঁর কথায়, এই দেশ করপোরেট আমেরিকার নির্দেশে চলবে, না তার রাজনীতির কেন্দ্রে থাকবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ—এ মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ‘যদি আমরা দ্বিতীয় পথটি বেছে নিতে চাই, করপোরেট আমেরিকার বদলে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিই, তাহলে আমাদের মামদানির পাশে দাঁড়াতে হবে।’

কোন পথ বেছে নেবে নিউইয়র্ক, মঙ্গলবারেই তা নিশ্চিত হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ