দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকায় প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে বোরো ধান উৎপাদিত হলেও উজানের পাহাড়ি ঢল এবং অসময়ের অতিবৃষ্টিতে কৃষক প্রায়ই ফসল হারানোর শঙ্কায় থাকেন। এ সময় সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় হাওরগুলো ১০ থেকে ১৫ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বৃষ্টিপাতের অতিরিক্ত প্রবণতা হাওরের বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলেছে। পরিবর্তিত আবহাওয়ায় কৃষকের ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে গেছে এবং দীর্ঘ সময় পানিতে ডুবে থাকায় পরবর্তী মৌসুমের জন্য জমি প্রস্তুত করাও কঠিন হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ কৃষক ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং খাদ্য সংকটে ভোগেন। এভাবেই হাওরের কৃষিনির্ভর পরিবারগুলো দারিদ্র্যের চক্রে আবদ্ধ থাকে।

হাওর অঞ্চলের কৃষকদের সারাবছরের স্বপ্ন ও জীবিকা বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল। সন্তানের লেখাপড়া ও বিয়ে, স্ত্রীর চিকিৎসা– সবকিছুর ভরসা এই ফসল থেকে পাওয়া আয়। কিন্তু আগাম বন্যায় ফসল তলিয়ে গেলে সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে অনিয়ম
প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হলেও দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে তা কার্যকর হচ্ছে না। বাঁধ নির্মাণে পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) গঠনে কাবিটা নীতিমালা ২০১৭ অনুযায়ী স্বচ্ছতা ও সময়ানুবর্তিতা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা মানা হয় না। পিআইসি গঠনে রাজনৈতিক প্রভাব, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি বাঁধ নির্মাণকে অকার্যকর করে তুলছে। কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী, বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠনে স্থানীয় কৃষকদের সম্পৃক্ত করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয় না। নীতিমালায় ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিটি গঠন করে কাজ শুরু এবং ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সম্পূর্ণ কাজ শেষ করার নির্দেশনা থাকলেও তা যথাযথভাবে মানা হয় না। ফলে তাড়াহুড়ো করে কাজ শেষ করার কারণে বাঁধ দুর্বল থেকে যায়, যা বন্যার ধাক্কায় সহজেই ভেঙে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের কারণে বাঁধ বন্যার চাপ সহ্য করতে পারে না।

হাওর বাঁচাও আন্দোলন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক মিলনের দেওয়া তথ্যমতে, এ বছর সুনামগঞ্জে ১২টি উপজেলার ৫৩টি হাওরে প্রায় ৭০০ প্রকল্পের আওতায় বাঁধের কাজ হচ্ছে। এর জন্য বরাদ্দ হয়েছে ২৫৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১২৪ কোটি টাকা শুধু ডুবন্ত বাঁধ নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শান্তিগঞ্জ উপজেলায় ৬৫টি পিআইসি গঠিত হয়েছে এবং ৪৩ কোটি টাকার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে তদারকি না থাকায় এসব প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। 
সরেজমিন বাঁধ পরিদর্শনে দেখা যায়, পুরোনো ধারায় কাজ চলছে। নতুন মাটি না এনে পুরোনো বাঁধেই এক্সক্যাভেটর মেশিন দিয়ে বাঁধের মাটি এমনভাবে খোঁড়া হয়েছে, দেখলে মনে হবে নতুন বাঁধ তৈরি হয়েছে। কিন্তু স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নতুন করে মাটি আনা হয়নি। 

নদী দখল, ভরাট ও অপরিকল্পিত খনন
হাওরের নদী, বিল ও অন্যান্য জলাভূমিতে উজান থেকে পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে বৃষ্টি হলেই হাওরে পানি প্রবেশ করে এবং দ্রুত জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। যাদুকাটা নদী, ধোপাজান নদী থেকে নির্বিচারে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু ও পাথর উত্তোলনের ফলে প্রতিবছর নদীর পাড় ভেঙে পড়ছে। এতে ফসলি জমি ও বসতভিটা নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
প্রভাবশালীরা প্রশাসনের অনুমতি না নিয়েই কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে। ফলে নদীর বেড়িবাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। বাঁধের গোড়া থেকে বালু ও পাথর উত্তোলনের ফলে বর্ষাকালে বাঁধের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের আতঙ্কের কারণ। 

জলমহাল ইজারা ও মৎস্যজীবীর দুর্দশা
হাওরের ২০ একরের ঊর্ধ্বে জলমহালগুলো মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে ইজারা দেওয়ার কথা থাকলেও প্রভাবশালীরা এসব ভোগদখল করছে। ফলে প্রকৃত মৎস্যজীবীরা অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জলমহাল নীতিমালা ২০০৯-এ জেলের অধিকার সংরক্ষণে সরকার বেশ কিছু ধারা রেখেছে। বাস্তবে এসবের প্রয়োগ হচ্ছে না। কিছু ধারার অস্পষ্টতাও লক্ষণীয়। এ যেন ‘কাজীর গরু’; কেতাবে আছে গোয়ালে নেই। বাস্তবে প্রকৃত মৎস্যজীবী নয়; অমৎস্যজীবীরাই লিজ নিচ্ছে বেশি। ব্যবসায়ী শ্রেণির অ-মৎস্যজীবীরা নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে মা মাছসহ সব পোনা নিধন করছে। বিল শুকিয়ে মাছ ধরার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে মাছের প্রাকৃতিক বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে মাছ ধরার ফলে হাওরের মৎস্য সম্পদ বিশেষত কিছু বিরল প্রজাতির মাছ নিঃশেষ হতে চলেছে। এ ছাড়া বিল পাহারাদাররা দরিদ্র মৎস্যজীবীদের মাছ ধরতে বাধা দিচ্ছে এবং তাদের জাল কেড়ে নিচ্ছে। জলমহাল ইজারা ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে প্রকৃত মৎস্যজীবীর অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন হাওরে ইজারা প্রথা একেবারে বন্ধ করা। ইজারাকৃত জায়গাগুলো মাছের অভয়াশ্রয় ঘোষণা করতে হবে। এতে এসব স্থান দেশের বৃহৎ প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে রক্ষা পাবে।

টেকসই সমাধান
ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও পিআইসি গঠনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। বাঁধ নির্মাণে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার বন্ধ, কঠোর নজরদারি ও তদারকি দরকার। এর প্রতিটি স্তরে প্রকৃত কৃষক ও মৎস্যজীবী প্রতিনিধি নারীসহ অন্তর্ভুক্তি জরুরি এবং প্রকৃত মৎস্যজীবীর অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
হাওর অঞ্চলের টেকসই কৃষি ও জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজন কার্যকর পরিকল্পনা, স্বচ্ছতা ও কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা। যাতে প্রশাসনিক গাফিলতি ও দুর্নীতি দূর করা যায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদে মোকাবিলা করা যায়।

শামসুল হুদা ও সানজিদা খান রিপা: 
যথাক্রমে নির্বাহী পরিচালক ও প্রোগ্রাম 
ম্যানেজার, এএলআরডি

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: হ ওর ন শ চ ত কর প রকল প ব যবস থ জলমহ ল র জন য থ কল ও হ ওর র প আইস ফসল র

এছাড়াও পড়ুন:

৪৬তম বিসিএস পরীক্ষা: পরীক্ষাকেন্দ্রে কতক্ষণ আগে যেতে হবে জানাল পিএসসি

৪৬তম বিসিএসের আবশ্যিক বিষয়ের লিখিত পরীক্ষা ৮ মে থেকে শুরু হবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ কেন্দ্রে একযোগে পরীক্ষা নেওয়া হবে। লিখিত পরীক্ষা শুরু হওয়ার ১৫ মিনিট আগে প্রার্থীকে অবশ্যই পরীক্ষার কক্ষে প্রবেশ করতে হবে।

এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানিয়েছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটের পর কোনো প্রার্থীকে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। বিষয়টি প্রবেশপত্রে এবং পরীক্ষা পরিচালনা–সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনায় উল্লেখ রয়েছে।

আরও পড়ুনইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম মুসলিম দেশ-মঙ্গল শোভাযাত্রা-রেডিও বেগম জেনে নিন বিস্তারিত১৭ এপ্রিল ২০২৫

সুষ্ঠুভাবে বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠান এবং হলের সুশৃঙ্খল পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের পরীক্ষা পরিচালনা–সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা পরীক্ষার্থী এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথাযথভাবে প্রতিপালন করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।

৪৬তম বিসিএসের আবশ্যিক বিষয়ের লিখিত পরীক্ষা চলবে ১৯ মে পর্যন্ত। ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফলাফল গত বছরের ৯ মে প্রকাশিত হয়। এ পরীক্ষায় ১০ হাজার ৬৩৮ প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত করা হয়। এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে নির্বাচিত প্রার্থীদের সঙ্গে আরও সমসংখ্যক প্রার্থী লিখিত পরীক্ষার জন্য যোগ্য বিবেচনা করে পুনরায় ফলাফল ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ফলাফল আবার নতুন করে প্রকাশ করা হয়। এতে মোট উত্তীর্ণ হন ২১ হাজার ৩৯৭ জন। আগের ১০ হাজার ৬৩৮ জন প্রার্থীর সঙ্গে নতুন করে লিখিত পরীক্ষার সুযোগ পান ১০ হাজার ৭৫৯ জন প্রার্থী।

আরও পড়ুন৪৬তম বিসিএসে লিখিত পরীক্ষার শেষ সময়ের প্রস্তুতির জন্য যা যা করণীয়২০ এপ্রিল ২০২৫

এই বিসিএসে ৩ হাজার ১৪০টি পদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নেওয়া হবে স্বাস্থ্য ক্যাডারে। সহকারী সার্জন ১ হাজার ৬৮২ জন ও সহকারী ডেন্টাল সার্জন ১৬ জন নেওয়া হবে। এরপর সবচেয়ে বেশি নেওয়া হবে শিক্ষা ক্যাডারে। বিভিন্ন বিষয়ে এ ক্যাডার থেকে বিসিএস শিক্ষায় ৫২০ জন নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন৪৬তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা, মানতে হবে যে ৪ গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা২ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ