Prothomalo:
2025-09-18@03:07:15 GMT

যদি হতে চান কনটেন্ট ক্রিয়েটর

Published: 6th, April 2025 GMT

‘কনটেন্ট ইজ কিং’—এক নিবন্ধে লিখেছিলেন বিল গেটস। কবে? সেই ১৯৯৬ সালে! আজকের পৃথিবীতে, অর্থাৎ ইন্টারনেটের এই দুনিয়ায় ‘কনটেন্ট’ই যে ‘রাজা’ হয়ে উঠবে, মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা সেটা অনুমান করেছিলেন আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগেই।

কিন্তু কনটেন্ট ক্রিয়েটর, অর্থাৎ কনটেন্টের নির্মাতারা যে এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন, সেটা কি বিল গেটসও ভেবেছিলেন? জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব পর্যায়েই অর্থনীতি থেকে শুরু করে রাজনীতিতে বড় প্রভাব রাখছেন কনটেন্ট ক্রিয়েটররা।

বাংলাদেশেও এখন অনেকে কনটেন্ট তৈরি করছেন, যা আমরা দেখতে পাই ভিডিও, পডকাস্ট, লেখা, ব্লগ, ভ্লগ, নানা আকারে। দেশি কনটেন্ট ক্রিয়েটরের সংখ্যা আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি, বিশেষত কোভিড-পরবর্তী সময়টাতে এই ক্যারিয়ারের উত্থান আমরা দেখেছি। তবে যথাযথ অভিজ্ঞতা ও সঠিক তথ্যের অভাবে অনেকেই এই পথে পা বাড়িয়ে বিপদে পড়ছেন, বিপথে যাচ্ছেন।

বলা যায়, প্রায় পাঁচ বছর শিক্ষামূলক ভিডিও কনটেন্ট বানিয়ে ইউটিউব ও ফেসবুকে দিচ্ছি। আমার এই অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু ব্যাপার তুলে ধরার চেষ্টা করছি, যা হয়তো ভবিষ্যতে যাঁরা কনটেন্ট বানাতে চান, তাঁদের কাজে লাগবে।

পা বাড়ানোর আগে

যাঁরা ফেসবুক বা ইউটিউবের জন্য ভিডিও বানান, আমরা মূলত তাঁদেরই ‘কনটেন্ট ক্রিয়েটর’ ভাবি। তবে শুধু ভিডিও নয়; লেখা, আলোকচিত্র, নকশা, আঁকা, গ্রাফিকস—এসবও কিন্তু কনটেন্টের মধ্যেই পড়ে। তবে আমরা এখানে শুধু ভিডিও কনটেন্ট নিয়েই আলোচনা করব। ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করতে চান, বাংলাদেশে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক। এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয় আপনার মাথায় রাখা উচিত—

১.

আপনি আসলে কেন ভিডিও বানাতে চান? আপনার উদ্দেশ্য কী? আপনি কি শুধু টাকা আয়ের জন্য এই পথে পা বাড়াতে চাচ্ছেন? নাকি সত্যিকার অর্থেই আপনার ভিডিও বানাতে, মানুষকে বিনোদন দিতে, কিছু শেখাতে বা জানাতে ভালো লাগে? এ ব্যাপারে আপনার নিজের ভেতর পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটি ভিডিও দেওয়া কিন্তু সহজ কাজ নয়। নিয়মিত ভিডিও প্রকাশ না করলে অ্যালগরিদম আপনাকে ওপরে ওঠাবে না, যত ভালো ভিডিওই বানান না কেন (তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে)।

২. আপনি নতুন কী দিতে চাচ্ছেন? ‘অমুক তো পুরান ঢাকায় ঐতিহ্যবাহী খাবারের ওপর ভিডিও বানিয়ে অনেক ভিউ পাচ্ছেন, আমিও একই কাজ করলে আমাকেও বুঝি অনেক মানুষ দেখবে।’—এমন ভাবনা থেকে বাংলাদেশে অনেকেই অন্যের দেখাদেখি ভিডিও বানানো শুরু করে দেন। নিজেকেই একটা প্রশ্ন করুন। যে দোকান থেকে খুব ভালো মানের জিনিস আপনি পাচ্ছেন, ওই একই জিনিস কিনতে কি অন্য দোকানে যাবেন? এমন কিছু খুঁজতে হবে, যেটা অন্য কেউ করছে না।

৩. আপনি কি যথেষ্ট পরিশ্রমী? আমার একেকটি ভিডিওর গবেষণার পেছনে ৯-১০ ঘণ্টা সময় দেওয়া লাগে (কিছু ভিডিওর ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি), ভিডিও সম্পাদনা করতে লাগে আরও ৯-১০ ঘণ্টা। থাম্বনেল বানানোর জন্য ১-২ ঘণ্টা। একসময় এই প্রতিটি কাজ আমি নিজে করতাম। জীবনের প্রথম ভিডিওর সম্পাদনা থেকে শুরু করে সব শেষ করতে সময় লেগেছিল প্রায় ১৫ দিন। পরে অবশ্য নিয়মিত কাজ করায় অনেক ভিডিও ৩-৪ দিনেও শেষ করতে পেরেছিলাম। এখন তো আমার একেকটি ভিডিও বানানোর পেছনে পুরোদস্তুর একটা দল কাজ করে। বুঝতেই পারছেন, ভিডিও বানানো চাট্টিখানি কথা নয়।

কনটেন্ট কী ধরনের হতে পারে

বাংলাদেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট নির্মাতা আছেন। তাঁরা একেকজন একেক বিষয়ে পারদর্শী। দেশে যেমন শিক্ষামূলক কনটেন্ট নির্মাতাদের মধ্যে আয়মান সাদিক, মুনজেরিন শহীদ, লাবিদ রাহাত, ইমতিয়াজ অর্ণব (স্টোরিহেড) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁদের কেউ ঘরে বসে কীভাবে ইংরেজি শেখা যায়, সে বিষয়ে ভিডিও বানাচ্ছেন। কেউ দৈনন্দিন জীবনের নানা পরামর্শ সাধারণ মানুষকে দিচ্ছেন। কেউ কেউ আছেন টেক রিভিউয়ার, নানা ধরনের প্রযুক্তি, যেমন মুঠোফোন, ল্যাপটপ থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক সুগন্ধির রিভিউও দেন। এটিসি-অ্যান্ড্রয়েড টো টো কোম্পানি, স্যামজোন, সোহাগ ৩৬০–সহ এমন আরও অনেক চ্যানেল নিশ্চয়ই আপনারা চেনেন। পুরোপুরি বিনোদনমূলক কনটেন্ট তৈরি করেন, এমন অনেক নির্মাতাও আছেন। তাঁদের নাম বলে শেষ করা যাবে না।

বিদেশি কনটেন্ট নির্মাতাদের মধ্যে যেমন আছেন জনি হ্যারিস (যুক্তরাষ্ট্র), ধ্রুব রাঠি (ভারত), মোহক মোঙ্গল (ভারত), জুনায়েদ আকরাম (পাকিস্তান)। তাঁরা মূলত শিক্ষামূলক কনটেন্ট তৈরি করেন। মার্ক রবার কিংবা ডেরেক মুলারের (ভেরিটাসিয়াম) মতো কনটেন্ট নির্মাতারা বিজ্ঞানভিত্তিক বিনোদনমূলক কনটেন্ট বানান। মিস্টার বিস্ট কিংবা পিউডিপাইয়ের মতো যাঁরা আছেন, তাঁরা বিভিন্ন বাস্তব জীবনভিত্তিক গেমিং শো কিংবা অনলাইন গেমিংয়ের মাধ্যমে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছেছেন। আসলে এসব উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, ভিডিওর ধরনের কোনো সীমা নেই।

বেইলি সারিয়ান নামে একজন ইউটিউবার আছেন, যিনি ভিডিওর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাস্তবে ঘটে যাওয়া ক্রাইম ইভেন্ট (রহস্যজনক খুন কিংবা হামলা, যা ট্রু ক্রাইম নামে পরিচিত) বর্ণনা করতে থাকেন আর সেই সঙ্গে নিজের চেহারায় মেকআপ করতে থাকেন। এখন ইউটিউবে তাঁর সাবস্ক্রাইবার ৭৬ দশমিক ৩ লাখের বেশি। ভাবা যায়!

খরচ কি অনেক

কনটেন্ট বানানোর শুরুতে অনেক বেশি টাকা খরচ করার প্রয়োজন নেই। আমি যখন শুরু করি, একদম কম দামি একটি স্মার্টফোনে ভিডিও রেকর্ড হতো। অডিওর জন্য বাসার হেডফোনের মাইক ব্যবহার করতাম, পরে বিভিন্ন ফ্রি মোবাইল অ্যাপে সম্পাদনা করতাম। সবাই যে ভুলটি করেন, ভিডিও বেশি চাকচিক্যময় করতে গিয়ে অডিওর দিকে নজর দেন না। ভিডিওর মান কিছুটা খারাপ থাকলেও অডিও যদি ভালো হয়, মানুষ দেখবে—এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন। অডাসিটি, অ্যাডোবি পডকাস্টের মতো ফ্রি টুল দিয়ে অডিও খুব ভালোভাবে সম্পাদনা করা যায়। ভিডিও সম্পাদনার জন্য সবচেয়ে ভালো ফ্রি সফটওয়্যার হচ্ছে দা ভিঞ্চি রিসলভ। মোবাইলে ক্যাপকাট, ফিলমওরা, কিনেমাস্টারের মতো সফটওয়্যার দিয়েও ভিডিও এডিট করা যায়। থাম্বনেল বানাতে পিকসআর্ট, অ্যাডোবি লাইটরুম, বা অন্যান্য মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন। ইদানীং চ্যাটজিপিটি বা মিডজার্নির মতো এআই নির্ভর প্ল্যাটফর্মও এ ক্ষেত্রে খুব কাজের।

অর্থাৎ কোনো টাকা খরচ না করেও আপনি আপনার কাছে থাকা ডিভাইস ও ফ্রি সফটওয়্যার দিয়ে ভিডিও বানানোর কাজ শুরু করতে পারবেন। আমি আমার জীবনের প্রথম ১৮টি ভিডিওতে নিজের পকেট থেকে এক টাকাও অতিরিক্ত খরচ করিনি। নিজের কাছে যা যা ছিল, তা-ই কাজে লাগিয়েছি। পরে কিছু টাকা জমিয়ে আট হাজার টাকায় একটি কন্ডেন্সার মাইক্রোফোন কিনি, সঙ্গে অন্যান্য কিছু যন্ত্রাংশ। বুঝতেই পারছেন, ভিডিও বানানোর প্রথম খরচটিই করেছি অডিও উন্নয়নের জন্য, কোনো দামি ক্যামেরা প্রথমেই কিনে ফেলিনি।

ভিডিও বানিয়ে কত টাকা আয় করা সম্ভব

ইউটিউবে প্রথম ভিডিও আপলোড দিই ২০২০ সালের ২৭ মে। আর প্রথম আমার কোনো ভিডিও থেকে আয় আসে একই বছরের ২ নভেম্বর। অর্থাৎ প্রায় পাঁচ মাসের বেশি সময় পর। সেদিন আয় হয় মাত্র ২ টাকা ৪১ পয়সা।

তত দিনে প্রায় ২৪টি ভিডিও আপলোড করে ফেলেছি। ভিডিওর গবেষণা আর সম্পাদনার পেছনে ব্যয় করেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময়! টাকার আশায় যদি বসে থাকতাম, তাহলে কখনো হয়তো আর শুরুই করা হতো না। আমার প্রতিটি ভিডিও বানানোর পেছনে এখন প্রায় ১২ হাজার টাকা খরচ হয়। যদি শুরু থেকেই অন্যদের দিয়ে ভিডিওর গবেষণার কাজ ও সম্পাদনা করাতাম, তাহলে এই ২৪টি ভিডিওর পেছনে খরচ হয়ে যেত প্রায় ২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা।

পরে স্পনসরশিপ, মনিটাইজেশন বা পেইড কোলাবোরেশন থেকে আপনি হয়তো অনেক টাকা আয় করতে পারবেন। কিন্তু শুরুটা প্রত্যেক ইউটিউবারের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। টাকার লোভে ভিডিও বানানো শুরু করলে একটা সময় আপনি হতাশ হয়ে পড়তে বাধ্য। ভিডিও বানানোর কাজ উপভোগ করুন, বাকি সব এমনিতেই পেছন পেছন চলে আসবে।

প্রতারণা থেকে বেঁচে চলা

কনটেন্ট বানানো শুরুর পর থেকেই দেশি–বিদেশি অনেক প্রতারক চক্রের কাছ থেকে অনেক টাকার প্রলোভন দেখানো ই–মেইল আসা শুরু করবে। ওরা বলবে ওরা আপনার ভিডিওতে স্পনসর করবে। কিন্তু আদতে প্রতারণা করে আপনার চ্যানেল বা পেজ হ্যাক করাই ওদের মূল ধান্দা। এদের থেকে বাঁচতে নিজের ডিজিটাল লিটারেসি বাড়াতে হবে। কখনো কোনো অপরিচিত বা সন্দেহজনক ওয়েব লিংকে ক্লিক করা যাবে না। কখনো কিছু ডাউনলোড করতে বললে হুট করে ডাউনলোড করে নিজের কম্পিউটারে ইনস্টল করে ফেলবেন না। ই–মেইল এলে ই–মেইল অ্যাড্রেসটি আদতেই কোনো অফিশিয়াল ই–মেইল অ্যাড্রেস কি না, ভালো করে পরীক্ষা করুন। এভাবে সতর্ক থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

সবশেষে বলব সফল কনটেন্ট নির্মাতা হতে পারাটা বেশ পরিশ্রম ও ধৈর্যের কাজ। যথেষ্ট সময়, পরিশ্রম ও আগ্রহ থাকলেই কেবল এখানে নিজের একটি জায়গা বানানো সম্ভব। মন খারাপ? বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে? আজকে ভিডিও দিতে অনেক আলসেমি লাগছে? তা-ও আপনাকে বিছানা থেকে পিঠ উঠিয়ে চেয়ারে বসতে হবে ভিডিওর কাজ করার জন্য। ক্যামেরা বা মাইকের সামনে যত লজ্জাই লাগুক, কথা বলে যেতে হবে। কেউ একজন যথার্থই বলেছেন, একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটরের জন্য দিনের সবচেয়ে কঠিন কাজ ক্যামেরার রেকর্ড বাটনটিতে চাপ দেওয়া।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কনট ন ট ন র ম ত কনট ন ট ত র কনট ন ট ব ন ক কনট ন ট র প রথম ভ ড ওর ক জ কর র জন য আপন র ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

আঠারো শতকের সুফি কবি ও সংগীতজ্ঞ সৈয়দ খাজা মীর দর্দ

আবদালি মারাঠিদের উৎপাত ও অত্যাচারে অন্য কবিরা যখন একে একে দিল্লি ছেড়ে লক্ষ্ণৌ চলে গিয়েছিলেন, তখনো প্রিয় শহর দিল্লি ছাড়েননি সৈয়দ খাজা মীর দর্দ (১৭২০-১৭৮৪ খ্রি.), বরং আমৃত্যু সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। লক্ষ্ণৌয়ে অবস্থানকারী কবিদের কাব্যবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁর কবিতার যে পার্থক্য ছিল, শুধু সে কারণেই তিনি সেই জায়গায় যাননি তা নয়, তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর, কারও তারিফ করে কখনো কসিদা লিখেছেন বলে শোনা যায়নি, সর্বোপরি তাঁর জীবনদর্শনও ছিল সমকালিক অন্য কবিদের থেকে আলাদা। মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন। মির্জা রফী সওদার চেয়েও সাত বছরের অগ্রজ মীর দর্দ এই সবকিছুই নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছেন, পারস্য ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার থেকে অনেক কিছু গ্রহণও করেছেন, তবু আমাদের ধারণা, পারিবারিক বংশধারার প্রভাবেই তাঁর জীবনদর্শন ও কাব্যচিন্তা শুরু থেকেই ভিন্ন ছিল।

মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন।

মাহমুদ আলী খান জামী তাঁর ‘দর্দ কে সো শের’ (প্রকাশকাল: ১৯৫৫ খ্রি., দিল্লি) গ্রন্থে লিখেছেন, খাজা মীর দর্দের দাদা বাদশাহ আলমগীরের শাসনামলে বুখারা থেকে এ দেশে এসেছিলেন, আর বাবা খাজা মাহমুদ নাসির আন্দালিব ছিলেন ‘শায়েরে উর্দু’ এবং ব্যক্তিগত জীবনে একজন সুফি। ভিন্ন মতে, তাঁর বাবার নাম (মাহমুদ নাসির নয়) মুহাম্মদ, আর তিনি উর্দু ভাষার কবি ছিলেন না, ছিলেন ফারসি ভাষার কবি। এঁরা ছিলেন নকশবন্দী ঘরানার পথিকৃৎ খাজা বাহাউদ্দিনের বংশধর ও অনুসারী। সুফি পরম্পরার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই মাত্র বাইশ বছর—ভিন্ন মতে, সাতাশ বছর বয়সে জাগতিক মোহ ত্যাগ করে সুফি শুদ্ধাচারী হয়ে ওঠেন দর্দ এবং সুফি তত্ত্বসংক্রান্ত একাধিক বই লেখেন। ফলে তিনি যখন শের ও গজল লেখেন, তখন সেগুলোতে স্বভাবগত কারণেই সুফি মরমি কবিতার সহজগভীর ভাবের ছায়া পড়েছে। নিচে দর্দ কে সো শের বই থেকে—অন্যত্র গজলরূপে গণ্য এবং গীত—প্রথম ৩টি শের পড়লে এ কথার সত্যতা মিলতে পারে :

তোহমতে চন্দ অপনে জিম্মে ধর চলে
জিস লিয়ে আয়ে থে হম সো কর চলে
জিন্দেগি হ্যয় য়া কোই তোফান হ্যয়
হম তো ইস জিনে কে হাথোঁ মে মর চলে
শমা কে মানিন্দ হম ইস বজম মে
চশম নম আয়ে থে দামন তর চলে

অর্থাৎ :

কত অপবাদ বয়ে নিয়ে আমি চলছি
অথচ যে কারণে এসেছি তা–ই করে গেছি
এ কোনো জীবন, নাকি তুফান
তার হাতেই তো আমি মারা যাব
এই সভার প্রদীপ ছিলাম আমি
এখন আমার চোখের জলে আঁচল ভিজে যায়

[অনুবাদ: লেখক]

অল্প বয়স থেকে যিনি এমন ভাবনায় তাড়িত, তাঁর গজলে এই প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। সুফি কবি ও সাধক হিসেবে স্বীকৃত হলেও গজলকার হিসেবে যেরকম গণ্য হননি খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি, ঠিক একই কারণেই গজলকার হিসেবে কেউ কেউ তাঁর নাম সমকালের মীর তকী মীর ও মির্জা রফী সওদার কাতারে রাখতে কুণ্ঠিত। অবশ্য এ ক্ষেত্রে খোদ মীর তকী মীরের একটি মন্তব্য আছে, যা অনেকেই উদ্ধৃত করেন, তা হলো: তিনি নাকি আড়াইজন কবিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন, যার মধ্যে একজন তিনি নিজে, অন্যজন মির্জা রফী সওদা আর অর্ধজন হলেন খাজা মীর দর্দ।

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

শের ও গজলের ক্ষেত্রে মীর তকি মীর শেষমেশ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন সেই জায়গা থেকে বিচার করে তাঁর এই কথাটিকে সদর্থে ধরে নিলে কবিতায় খাজা মীর দর্দের অবদানকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন না করে উপায় নেই। আসলে পারস্য কবিতার ঐতিহ্য ধারণ করে উর্দু গজলে যখন পরবর্তীকালের জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নারীর সঙ্গে আলাপের আবহ তৈরি হচ্ছে, খাজা দর্দ তখন একই উৎস থেকে গ্রহণ করেছিলেন সুফি ঐতিহ্য। সমালোচকদের মতে, তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান-এ উর্দু’, কিন্তু তাঁর ‘শমা-এ মহফিল’, ‘আহ-এ দর্দ’, ‘দর্দ-এ দিল’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের প্রাঞ্জল ভাষা ও সুফিহৃদয়ের ভাব সেই সময় ও পরবর্তীকালের কবিদেরকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর একটি অনবদ্য শের হলো: ‘তমান্না তেরি হ্যাঁয় অগর হ্যাঁয় তমান্না/ তেরি আরজু হ্যায় অগর আরজু হ্যায়’ অর্থাৎ, আকাঙ্ক্ষা যদি থাকে, তা তোমারই আকাঙ্ক্ষা/ আশা তোমার জন্য, আদৌ আশা বলে যদি কিছু থাকে’। প্রেমের এমন একনিষ্ঠ নিবেদন খাজা দর্দের শেরেই পাওয়া সম্ভব। নিচে পড়ে নিতে পারি তাঁর আরও একটি জনপ্রিয় শের:

হাজারোঁ খওয়াহিশেঁ অ্যায়সি কে হর খওয়াহিশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে ম্যারে আরমান ল্যাকিন পির ভি কম নিকলে

অর্থাৎ :

এমন হাজার বাসনা আমার, যার প্রতিটি বাসনার জন্য প্রাণ ওষ্ঠাগত
কিছু আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো বটে; কিন্তু তা খুবই সামান্য

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

আরও পড়ুনএকাদশ শতকের সুফি কবি হাকিম সানায়ি গজনভি২৮ আগস্ট ২০২৫

মীর দর্দের এমন উচ্চাসনে পৌঁছার অন্য একটি কারণ হলো, তাঁর জন্মের বহু আগে থেকেই গান শোনা ও তার চর্চা বিষয়ে যে তর্ক-বিতর্ক চলে আসছিল, সে বিষয়ে তাঁর সবিস্তার আলোচনা এবং গানবিষয়ক গান লেখার উদাহরণ। আমাদের অজানা নয়, গান বিষয়ে কওয়ালির প্রতিষ্ঠাতা আমির খসরুর একাধিক বাণী আছে, যেমন: ‘গান হলো আত্মার খোরাক’, ‘দরবেশের কাছে গান হলো ঐশ্বরিক জ্যোতির সমতুল’ ইত্যাদি, আর দর্দ লিখেছেন: ‘অগর ঘিনা নফস কো বড়্কায়ে তো হারাম, অগর দিল কো ইলাহ কি তরফ নরম করে তো হালাল’ অর্থাৎ গান যদি মনকে প্রবৃত্তিতাড়িত হতে উসকে দেয় তাহলে হারাম, আর স্রষ্টামুখী করলে হালাল’। এ বিষয়ে দর্দের যে শের রয়েছে, সেটি আরও সুন্দর :

সামা’ আহলে দিল কো হ্যা সোদমন্দ দর্দ
কে ইস সে নরম হোতা হ্যা পাত্থর কা দিল ভি

অর্থাৎ :

হৃদয়বান মানুষের জন্য গান উপকারী, হে দর্দ
কারণ পাথরের মতো হৃদয়ও তাতে গলে যায়।

উল্লেখ্য যে, গান বিষয়ে আলোচনা করবার সময় এ অঞ্চলের গবেষক ও সুফি-বাউল-ফকিরেরা ইমাম গাজ্জালি, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি ও আমির খসরুর বইয়ের তথ্যের উল্লেখ করেন, কিন্তু প্রকাশ ও প্রচারের অভাবে কোথাও সৈয়দ খাজা মীর দর্দের কথা পাওয়া যায় না। জাভেদ হুসেন দর্দের কয়েকটি গজল অনুবাদ করতে গিয়ে তার ভূমিকায় লিখেছেন: ‘দর্দ ছিলেন একজন বড় সংগীতজ্ঞ। সুফি সাধনায় সংগীতের ভূমিকা নিয়ে হুরমতে ঘিনা নামে পুস্তিকা লিখেছেন। উর্দু গজলের গীতিময়তা আজ দেখা যায় তাতে দর্দের ভূমিকা ব্যাপক ও গভীর।’ এই পুস্তিকাটি দুর্লভ, ভবিষ্যতে এটি অনূদিত হলে শায়ের ও গজলকার মীর দর্দের পাশাপাশি সংগীতচিন্তক হিসেবে তাঁর পরিচয়টাও আমরা জানতে পারব।

অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।
ই–মেইল: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ