যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য প্রবেশের ক্ষেত্রে উচ্চ হারে নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর ব্র্যান্ড এবং ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নানান হিসাবনিকাশ করছে। নতুন শুল্ক কে পরিশোধ করবে, তা নিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছে কোনো কোনো ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে রপ্তানি আদেশ স্থগিত করেছে কিছু প্রতিষ্ঠান। তবে এখনও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি, এমন ক্রেতার সংখ্যাই বেশি। সে দেশে সাপ্তাহিক ছুটির পর বাংলাদেশ সময় আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে সব ব্র্যান্ড-ক্রেতার কাছ থেকে স্পষ্ট বার্তা আসতে পারে। 

এদিকে ইতোমধ্যে জাহাজে তোলা হয়েছে এমন পণ্য বন্দর থেকে ঘোষিত হার, না আগের শুল্কহারে পণ্য ছাড় হবে– তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। নতুন শুল্ক ক্রেতা নাকি রপ্তানিকারক পরিশোধ করবেন, তা নিয়ে উদ্বেগ আছে উদ্যোক্তাদের। আবার প্রতিটি পণ্যের গায়ে ‘প্রাইস ট্যাগ’ থাকার আবশ্যকতা রয়েছে। জাহাজে তোলা পণ্যে পুরোনো শুল্ক অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করে ‘প্রাইস ট্যাগ’ লাগানো আছে। এসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরে পৌঁছানোর পর নতুন শুল্কহার কার্যকর হয়ে যাবে। বর্ধিত শুল্ক দিতে হলে ‘প্রাইস ট্যাগ’ পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। এটি কোন প্রক্রিয়ায় হবে, তা নিয়ে রপ্তানিকারক উদ্যোক্তারা উদ্বেগে আছেন। সাধারণত চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছতে গড়ে ৩৫ দিনের মতো সময় লাগে। 

মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে চট্টগ্রামভিত্তিক ওয়েল গ্রুপ। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি এবং ওয়েল গ্রুপের পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম গতকাল সমকালকে বলেন, ‘আমরা আতঙ্কের মধ্যে আছি। হাতে থাকা রপ্তানি আদেশ এবং শিপমেন্ট হওয়া পণ্যে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো চুক্তি অনুযায়ী মূল্যের চেয়ে কম মূল্য, অর্থাৎ ডিসকাউন্ট দাবি করতে পারে। সে রকম হলে বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়ে যাব আমরা।’ সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বেশ কিছু কারখানার মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান পরবর্তী বার্তা না দেওয়া পর্যন্ত ইতোমধ্যে দেওয়া রপ্তানি আদেশের কাজ বন্ধ রাখতে বলেছে। নির্দিষ্ট করে ক্রেতারা কাঁচামাল আমদানি, পণ্য উৎপাদন ও শিপমেন্ট আপাতত স্থগিত রাখতে বলেছেন। 

তৈরি পোশাক খাতের নিট ক্যাটেগরির রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আপাতত বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে বড় ধরনের বিপদেই ফেল দিয়েছে। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রপ্তানি আদেশ স্থগিত এবং ডিসকাউন্টের শিকার হওয়ার শঙ্কা করছেন তারা। বিশেষ করে পুরোনো প্রাইসট্যাগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর পর ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো ওই চালান গ্রহণ করবে কিনা, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে। ক্রেতারা সময়মতো চালান বুঝে না নিলে পোশাকের মূল্য দেশে আসবে না। 

ডিজাইনটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম সমকালকে জানান, তাঁর মার্কিন ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে নিজেই যোগাযোগ করেছেন। ক্রেতারা অফিস খুললে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করবেন বলে তাঁকে জানিয়েছেন। শনি ও রোববার যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি ছুটি। সময়ের ব্যবধানের কারণে বাংলাদেশ সময় আগামীকাল মঙ্গলবার ক্রেতাদের মূল প্রতিক্রিয়া জানা যাবে। 

বিজিএমইএর সাবেক এ সভাপতির মতে, যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ সরকার কোনো কৌশলে মোকাবিলা করবে, সেটিই এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভিয়েতনামের সরকারপ্রধান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ফোন করে তাঁর দেশে মার্কিন পণ্য প্রবেশে শূন্য শুল্ক সুবিধা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন। বাংলাদেশও একই পথে অনুসরণ করতে পারে। যে পণ্যে বাড়তি শুল্ক আছে, সেগুলো কমাতে কোনো অসুবিধা নেই। তুলা আমদানি এখনই কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব। এতে ‘উইন উইন’ ভিত্তিতে দু’দেশের জন্যই শুল্ক সহনীয় হবে। বাণিজ্য আরও বাড়বে। রাইজিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান বাবু সমকালকে জানান, তাঁর গ্রুপের মার্কিন ব্র্যান্ড-ক্রেতারা এখনও কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। হঠাৎ অস্বাভাবিক এ শুল্কহার নিয়ে আসলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারাও ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছেন বলে মনে করেন তিনি। 

যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেন এমন একজন তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তা জানান, তাঁর একটি অর্ডারের পণ্য আগামী ২০ এপ্রিল নাগাদ তৈরি হওয়ার কথা। নতুন শুল্ক আরোপের পর তিনি একটু সময় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কেননা, ক্রেতার সঙ্গে তাঁর ‘নেগোসিয়েশন’ করতে হবে। তাঁর মতে, নতুন পরিস্থিতিতে আমদানিকারক এবং রপ্তানিকারক– দু’পক্ষের জন্য ধাক্কা। কারণ, ক্রেতা যখন অর্ডার দিয়েছিলেন, তখন শুল্ক ছিল ১৫ শতাংশ। ৯ এপ্রিলের পর তাঁকে বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। এর মানে, একটি পণ্যের ক্রয়মূল্য যদি ১০ ডলার হয়, তাহলে ৫২ শতাংশ শুল্ক দিয়ে এর খরচ পড়বে ১৫ ডলার ২০ সেন্ট। নতুন শুল্ক আরোপ না হলে খরচ পড়ত ১১ ডলার ৫০ সেন্ট। তাঁর বাড়তি যে প্রায় ৪ ডলার খরচ হবে, নিয়ম অনুযায়ী তাঁরই বহন করার কথা। কিন্তু অনেকেই তা করবেন না। যারা করবেন না, তারা হয় দামে ডিসকাউন্ট চাইবেন, বাড়তি শুল্ক রপ্তানিকারকের কাছে চাইবেন অথবা ভাগাভাগি করে দিতে চাইবেন। কোন পদ্ধতিতে বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে, তা নির্ভর করবে নেগোসিয়েশনের ওপর। 
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতৃত্বে ছিলেন এমন একজন উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে তিনটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের কথা হয়েছে, যারা বলেছেন, তাদের যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা ক্রয় আদেশ স্থগিত করেছেন। ভবিষ্যৎ ব্যবসার কথা ভেবে তিনি ক্রেতার নাম বলতে চাচ্ছেন না। বিজিএমইএর ওই সাবেক নেতা বলেন, যাদের পণ্য তৈরি হয়ে গেছে, তাদের যে কোনো উপায়ে একটি নিষ্পত্তি করতে হবে। নতুন অর্ডারের ক্ষেত্রে আলাদা হিসাব। 

তৈরি পোশাক বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য। সমজাতীয় পণ্য মিলে মোট রপ্তানি আয়ে এ খাতের হিস্যা ৮৭ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান বাজার। মোট রপ্তানির ২০ থেকে ২২ শতাংশ যায় দেশটিতে। যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। প্রথম এবং দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে চীন এবং ভিয়েতনাম। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৭২০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। অন্যান্য পণ্য মিলে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে মোট রপ্তানি হয় ৮৫০ কোটি ডলারের পণ্য। তৈরি পোশাকের বাইরে উল্লেখযোগ্য অন্য রপ্তানি পণ্যের মধ্য রয়েছে– চামড়াজাত পণ্য, টেক্সটাইল সামগ্রী, ওষুধ, ফার্নিচার, প্লাস্টিক পণ্য, সিরামিক ও বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য। 

 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব জ এমইএর নত ন শ ল ক এমইএর স অন য য় করব ন

এছাড়াও পড়ুন:

শ্রম আইন সংশোধন দ্রুত শেষ করতে বলেছে মার্কিন প্রতিনিধিদল

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে পাল্টা শুল্ক কমাতে হলে বাণিজ্যঘাটতি কমানোর পাশাপাশি শ্রম আইন সংশোধনপ্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করতে বলেছে ঢাকা সফররত মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদল।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতাদের সঙ্গে আজ সোমবার সকালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠক করে এমনটাই বলেছে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদল। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডেন লিঞ্চ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খানের নেতৃত্বে সংগঠনটির সহসভাপতি মো. রেজওয়ান সেলিম, পরিচালক ফয়সাল সামাদ, মোহাম্মদ আবদুস সালাম প্রমুখ মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকে আরও ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন। ব্রেন্ডেন লিঞ্চ দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন বাণিজ্যনীতি বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মার্কিন প্রতিনিধিদল বিজিএমইএর নেতাদের স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিয়েছে যে পাল্টা শুল্ক নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে এখনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি। ফলে পাল্টা শুল্কের হার সেটি আরও কমানোর সুযোগ রয়েছে। তার জন্য বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্যঘাটতি এবং শ্রম আইন সংশোধনপ্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।

জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাণিজ্যঘাটতি কমানোর বিষয়ে আমরা প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছি, ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি শুরু হয়েছে। এ ছাড়া গম, এলএনজিসহ অন্যান্য পণ্য আমদানির প্রক্রিয়াও চলছে। এসব পণ্য আমদানি হলে বাণিজ্যঘাটতি অনেকটাই কমে আসবে। এ ছাড়া শ্রম আইন সংশোধনের ১২৪টির মধ্যে ১২২টির বিষয়ে আমরা ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে একমত হয়েছি। বাকিগুলোর বিষয়েও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানো যাবে। তা ছাড়া আইএলওর কনভেনশন অনুসমর্থন নিয়েও আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’

বিজিএমইএর সভাপতি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা কোনো পণ্য উৎপাদনে ওই পণ্যের মোট মূল্যের কমপক্ষে ২০ শতাংশ যদি দেশটির উপকরণ বা কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়, তাহলে ওই ২০ শতাংশের ওপর পাল্টা শুল্ক প্রযোজ্য না হওয়ার একটি বিষয় আমরা জেনেছি। সেটি পরিষ্কার করার বিষয়ে আমরা মার্কিন প্রতিনিধিদলকে অনুরোধ করেছি। তাঁরা বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন। তাঁরা দ্রুতই জানাবেন।’

পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ২০ শতাংশ হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে বাণিজ্য চুক্তির একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। বাণিজ্য চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত করতে তিন দিনের সফরে ঢাকায় এসেছে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদলটি। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সঙ্গে গতকাল রোববার সচিবালয়ে বৈঠক করে প্রতিনিধিদল। এতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নাজনীন কাউসার চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সফররত মার্কিন দল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সঙ্গেও বৈঠক করবে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শ্রম আইন সংশোধন দ্রুত শেষ করতে বলেছে মার্কিন প্রতিনিধিদল