ইউরোপের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যে আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখা যাচ্ছে, তাতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত এই হুমকির প্রকৃত রূপটি বোঝা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু অর্থনৈতিক মিত্র হিসেবে ধরে রেখে প্রতিযোগিতার যে বর্তমান কৌশল ইউরোপ অনুসরণ করে আসছে, তা থেকেও তাদের সরে আসা উচিত।

সত্যিকারের প্রযুক্তিগত সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্য ইউরোপকে কেবল প্রতিযোগিতা ও নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার সীমিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে অনেক বেশি উচ্চাভিলাষী কৌশলের পথে হাঁটতে হবে।

গত কয়েক বছরে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিসংক্রান্ত আইন পাস করার পর এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন উদ্ভাবন বাড়াতে এবং প্রতিযোগিতা জোরদার করতে চাইছে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট মারিও দ্রাগির ২০২৪ সালের প্রভাবশালী প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইউরোপীয় কমিশন সম্প্রতি প্রকাশ করেছে কম্পিটিটিভনেস কম্পাস। এটি দ্রাগির সুপারিশ বাস্তবায়নের রোডম্যাপ।

প্রতিযোগিতা নিয়ে ইউরোপের বাড়তে থাকা উদ্বেগের মূল কারণ হলো মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্টদের সঙ্গে বাজারে সমানভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারা। দ্রাগির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের উৎপাদনশীলতার পার্থক্য অনেকটাই ইউরোপের প্রযুক্তি খাতের দুর্বলতার কারণে।

ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন এবং প্রযুক্তি কমিশনার হেনা ভিরকুনেনের সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, নীতিনির্ধারকেরা দ্রাগির বার্তাকে গুরুত্বসহকারে নিয়েছেন এবং এখন ইউরোপের প্রযুক্তিনীতির কেন্দ্রে প্রতিযোগিতাকে বসিয়েছেন।

কিন্তু এই একমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনকার প্রযুক্তিগত ও ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে যথেষ্ট নয়, বরং ক্ষতিকরও হতে পারে। প্রতিযোগিতায় মনোযোগ দেওয়া ইউরোপীয় অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর বিগ টেক কোম্পানিগুলোর প্রভাব কমাতে পারে; আবার একইভাবে তাদের আধিপত্য আরও মজবুতও করতে পারে।

ইউরোপীয় নেতারা এখন যে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার দিকে ঝুঁকছেন (দ্রাগির প্রতিবেদনের মাধ্যমে যার গতি আরও বেড়েছে), তা নীতিনির্ধারণকে বড় বড় কোম্পানির লবির কাছে আরও বেশি দুর্বল করে তুলছে এবং এমন কিছু নীতিকে বৈধতা দিতে পারে, যেগুলো ইউরোপীয় মৌলিক মূল্যবোধের সঙ্গে খাপ খায় না।

ফলে ইউরোপীয় কমিশনের এই নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার উদ্যোগ, যেমন প্রস্তাবিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও গোপনীয়তা আইন স্থগিত রাখা, জিডিপিআরসহ প্রযুক্তি আইন সরলীকরণের ঘোষণা—এসব পদক্ষেপ বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকেই বেশি সুবিধা দেবে, নতুন উদ্যোগ বা ছোট ও মাঝারি কোম্পানিগুলোকে নয়। একই সঙ্গে ‘এআই প্রতিযোগিতা’ নিয়ে ইউরোপের তাড়াহুড়া করা এবং সমালোচনাহীন দৃষ্টিভঙ্গি বিগ টেকের এআই প্রযুক্তিতে কর্তৃত্বকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।

এই প্রযুক্তিনির্ভরতা যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও কিছু বড় কোম্পানিকে ইউরোপের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার ওপর অস্বাভাবিক ক্ষমতা দিয়ে দেয়। এই ক্ষমতা ব্যবহার করে ইউরোপীয় প্রযুক্তি খাতের বিকাশে বাধা দেওয়া হতে পারে—উন্নত চিপ সরবরাহ সীমিত করে বা ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের প্রবেশাধিকারকে হালকা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে শর্তযুক্ত করে।

দ্রাগি প্রতিবেদনে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার যে এজেন্ডা তুলে ধরা হয়েছে, তা সিলিকন ভ্যালিতে উষ্ণভাবে গ্রহণ করা হয়েছে—এমনকি ইলন মাস্ক নিজেও এতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তবে কিছু প্রযুক্তি নেতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা শুধু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে ফেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মাস্কের এক্স (আগে যা ছিল টুইটার) ও স্টারলিংক ব্যবহারের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন ও ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর প্রভাব বিস্তার, আর ট্রাম্প প্রশাসনের ইউরোপীয় প্রযুক্তি নীতিমালার ওপর প্রকাশ্য আক্রমণ—এসবই প্রমাণ করে, বিগ টেকের ক্ষমতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা ইউরোপীয় সার্বভৌমত্বের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ প্রেক্ষাপটে ইউরোপের সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো যুক্তরাষ্ট্রের বড় প্রযুক্তি কোম্পানি ও ওয়াশিংটনের তাদের মিত্রদের ক্রমবর্ধমান হুমকি থেকে নাগরিকদের অধিকার, সার্বভৌমত্ব ও মৌলিক মূল্যবোধ রক্ষা করা। ইউরোপ এখন যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র–নিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল অবকাঠামোর ওপর নির্ভরশীল (যেমন সেমিকন্ডাক্টর, ক্লাউড কম্পিউটিং, সাবমেরিন কেব্‌ল ইত্যাদি), তা শুধু ইউরোপের প্রতিযোগিতার ক্ষমতাকেই দুর্বল করে না, বরং স্থানীয় বিকল্পগুলোর পথও রুদ্ধ করে দেয় এবং এই অবকাঠামোর মালিকেরা এটিকে লাভের জন্য ব্যবহার করতে পারে।

আরও ভয়াবহ বিষয় হলো, এই প্রযুক্তিনির্ভরতা যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও কিছু বড় কোম্পানিকে ইউরোপের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার ওপর অস্বাভাবিক ক্ষমতা দিয়ে দেয়। এই ক্ষমতা ব্যবহার করে ইউরোপীয় প্রযুক্তি খাতের বিকাশে বাধা দেওয়া হতে পারে—উন্নত চিপ সরবরাহ সীমিত করে বা ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের প্রবেশাধিকারকে হালকা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে শর্তযুক্ত করে।

আরও পড়ুনট্রাম্পের ‘মাস্তানি’ থামানোর উপায় কী, আনুগত্য না বয়কট?১৩ ঘণ্টা আগে

এ ধরনের চাপ থেকে ইউরোপকে রক্ষা করা হলে তা শেষ পর্যন্ত প্রতিযোগিতাকেই বাড়িয়ে তুলবে। প্রতিযোগিতা আইন এবং ডিজিটাল মার্কেটস অ্যাক্ট কঠোরভাবে প্রয়োগ করা গেলে বিগ টেকের প্রভাব কমবে এবং ইউরোপীয় স্টার্টআপ ও নতুন চ্যালেঞ্জারদের বিকাশের সুযোগ তৈরি হবে। একইভাবে ডিজিটাল সার্ভিসেস অ্যাক্ট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আইন (এআই অ্যাক্ট) বাস্তবায়ন করলে ক্ষতিকর কনটেন্ট ও বিপজ্জনক এআই সিস্টেম থেকে নাগরিকদের রক্ষা করা যাবে এবং ইউরোপ সিলিকন ভ্যালির নজরদারিভিত্তিক ব্যবসায়িক মডেলের একটি প্রকৃত বিকল্প দিতে পারবে।

এ প্রেক্ষাপটে ইউরোপের নিজস্ব বিকল্প ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগ সম্প্রতি গতি পেয়েছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো ‘ইউরোস্ট্যাক’ নামের প্রকল্প, যা ইউরোপের স্বতন্ত্রভাবে কাজ করার সক্ষমতা রক্ষার একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা উচিত। ক্রমাগত অস্থির হয়ে উঠতে থাকা ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সার্বভৌমত্ব মানে শুধু প্রতিযোগিতা নয়—এটা নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও আত্মনির্ভরতার ব্যাপার। তাই ইউরোপীয় নীতিনির্ধারকদের উচিত প্রতিযোগিতার বিষয়টি অন্য—এবং প্রায়ই আরও গুরুত্বপূর্ণ—লক্ষ্যের সঙ্গে তুলনা করে দেখা।

সৌভাগ্যক্রমে ইউরোপকে এমন কঠিন পছন্দ করতে হবে না। প্রযুক্তিগত নির্ভরতা দূর করে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা রক্ষা করে এবং মৌলিক অধিকার বজায় রেখে ইউরোপ সে ধরনের প্রতিযোগিতা গড়ে তুলতে পারে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

মারিয়েত্যে শাখে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইবার পলিসি সেন্টারে আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারণী পরিচালক

ম্যাক্স ফন থুন ওপেন মার্কেটস ইনস্টিটিউটে ইউরোপ ও ট্রান্স–আটলান্টিক অংশীদারত্ব–বিষয়ক পরিচালক।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক ইউর প য় প র ব যবহ র কর ইউর প য় ক ন র ভরত ক ষমত র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

সার্চ দুনিয়ার নতুন দিগন্ত জিইও: দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কী প্

ইন্টারনেট সার্চ দুনিয়ায় চলছে নীরব এক বিপ্লব। তথ্য খোঁজার ধরন বদলে যাচ্ছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত। আগে যেখানে গুগলে উচ্চ র‌্যাংকিং মানেই ছিল সাফল্য, এখন সেই জায়গা নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-নির্ভর সার্চ টুল।

সার্চ জগতের নতুন চ্যালেঞ্জ

চ্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনি, মাইক্রোসফট কপিলট কিংবা পারপ্লেক্সিটি এআই-এগুলো আর শুধু সার্চ ইঞ্জিন নয়, বরং উত্তর তৈরিকারক ইঞ্জিন। ব্যবহারকারী এখন শুধু ‘লিংক’ নয়, বরং সরাসরি উত্তর পেতে চায়। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্যই এসেছে নতুন এক কৌশল- জিইও বা জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন।

জিইও কী?

জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে আপনার ওয়েবসাইট ও কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো হয় যাতে এআই-চালিত সার্চ ইঞ্জিন সহজেই আপনার তথ্য চিনতে, বুঝতে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে সেটি অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।

আগে ব্র্যান্ডগুলোর ফোকাস ছিল গুগলের প্রথম পাতায় জায়গা করে নেওয়া। কিন্তু এখন গুরুত্ব পাচ্ছে- চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-এর উত্তরে আপনার ব্র্যান্ডের নাম আসছে কি না!

এসইও বনাম জিইও: সার্চ দুনিয়ার নতুন যুগের পালাবদল

অনেকেই এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এবং জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এক মনে করেন, কিন্তু এদের মধ্যে মূলত লক্ষ্য ও কৌশল ভিন্ন। এসইও হচ্ছে পুরোনো পদ্ধতি, অন্যদিকে জিইও হচ্ছে নতুন পদ্ধতি।

* মূল লক্ষ্য
এসইও: সার্চ ইঞ্জিনে র‌্যাংক বাড়ানো
জিইও: এআই সার্চের উত্তরে দৃশ্যমান হওয়া

* কাজের ধরন
এসইও: কিওয়ার্ড ও ব্যাকলিংক ভিত্তিক
জিইও: কনটেক্সট, প্রাসঙ্গিকতা ও ব্র্যান্ড অথরিটি নির্ভর

* ফলাফল
এসইও: ক্লিক ও ট্রাফিক বৃদ্ধি
জিইও: ব্র্যান্ড উল্লেখ ও আস্থা বৃদ্ধি

* প্ল্যাটফর্ম
এসইও: গুগল, বিং ইত্যাদি সার্চ ইঞ্জিন
জিইও: চ্যাটজিপিটি, জেমিনি, পারপ্লেক্সিটি, এসজিই ইত্যাদি এআই সার্চ

এসইও এখনও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ভবিষ্যতের সার্চ ইকোসিস্টেমে জিইও সমান অপরিহার্য হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশি ব্যবসার জন্য জিইও-এর গুরুত্ব

বাংলাদেশে ডিজিটাল মার্কেটের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষা, ট্রাভেল, স্বাস্থ্যসেবা, ই-কমার্স, রিয়েল এস্টেট- প্রায় প্রতিটি খাতেই ব্যবসা অনলাইনে আরো দৃশ্যমান হতে চাচ্ছে। কিন্তু বদলেছে মানুষের সার্চ করার ধরন। এখন তারা শুধু গুগলে সার্চ করেই সন্তুষ্ট থাকছে না, তারা এআই-চালিত সার্চ টুলগুলো যেমন চ্যাটজিপিটি, জেমিনি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মাধ্যমে সরাসরি উত্তর খুঁজছে। 

গার্টনারের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ ভলিউম প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যাবে- কারণ ব্যবহারকারীরা দ্রুতই এআই-চালিত সার্চ ও চ্যাটবটের দিকে ঝুঁকছে। (তথ্যসূত্র: Gartner, “Search Engine Volume Will Drop 25% by 2026, Due to AI Chatbots and Other Virtual Agents)

তবে এই পরিবর্তনের প্রভাব ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, কেউ চ্যাটজিপিটি-তে লিখল, ‘ঢাকায় সেরা অ্যাকাউন্টিং ফার্ম কোনটি?’ যদি আপনার কোম্পানির নাম বা কনটেন্ট এআই-এর তৈরি উত্তরে না আসে, তাহলে সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট ও ব্যবসার সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে।

মূলত এখানেই জিইও-এর গুরুত্ব উঠে আসে। জিইও ব্যবহার করে কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো যায় যাতে এআই সার্চ সিস্টেম আপনার ব্র্যান্ডকে সহজেই চিনতে পারে, বুঝতে পারে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে উল্লেখ করে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যবসা যদি এআই-এর দুনিয়ায় দৃশ্যমান থাকতে চায়, জিইও’র সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এখন আর বিকল্প নয়- এটি একান্ত প্রয়োজন।

জিইও’র জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?

জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) কোনো একদিনে শেখার মতো বিষয় না- এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যবসাগুলোকে নিজেদের কনটেন্ট, উপস্থিতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা এআই-বান্ধব করে গড়ে তুলতে হয়। নিচে ধাপে ধাপে দেখা যাক, কীভাবে আপনি জিইও’র পথে প্রস্তুত হতে পারবেন।

১. অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করুন

জিইও’র প্রথম ধাপ হলো আপনার ব্যবসা বা ব্র্যান্ডের বর্তমান অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করা। চ্যাটজিপিটি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মতো এআই-চালিত সার্চ টুলে সার্চ দিন ‘বাংলাদেশে সেরা (আপনার ইন্ডাস্ট্রি)-এর কোম্পানিগুলো কোনগুলো?’

যদি সার্চের উত্তরে আপনার নাম না আসে, বোঝা যাবে যে আপনার এআই-দৃশ্যমানতা এখনও সীমিত। এই ক্ষেত্রে আপনাকে জিইও অনুযায়ী কনটেন্ট ও অনলাইন উপস্থিতি বাড়াতে কাজ শুরু করতে হবে।

২. বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করুন

জেনারেটিভ এআই সার্চ সিস্টেম সেই উৎসকেই অগ্রাধিকার দেয়, যা নির্ভরযোগ্য ও যাচাইযোগ্য। তাই আপনার ওয়েবসাইটে ব্র্যান্ড, টিম, যোগাযোগ ও রিভিউসহ সব তথ্য সম্পূর্ণ ও স্বচ্ছ রাখুন।

গুগল বিজনেস প্রোফাইল নিয়মিত আপডেট করুন-  ঠিকানা, সময়, পোস্ট ও রিভিউসহ।

বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যম ও ব্লগে ব্র্যান্ডের উল্লেখ বাড়ান।

E-E-A-T (Experience, Expertise, Authoritativeness, Trustworthiness) বজায় রাখুন।

এভাবেই এআই ও ব্যবহারকারীর কাছে আপনার ব্র্যান্ড একটি বিশ্বাসযোগ্য সোর্স হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে- যা জিইও সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

৩. কনভারসেশনাল কনটেন্ট লিখুন

এআই সার্চ এখন ব্যবহারকারীর প্রশ্নভিত্তিক অনুসন্ধানকে গুরুত্ব দেয়। তাই আপনার কনটেন্ট তৈরি করুন এমনভাবে যেন এটি প্রাকৃতিক প্রশ্ন ও কথোপকথনের মতো শোনায়। উদাহরণ: ‘Where can I find a trusted IELTS coaching center in Dhaka?’ ‘Where can I apply for a blue-collar job?’ এ ধরনের কনটেন্ট এআই-এর চোখে আরো সহজে বোঝার মতো হয় এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তর হিসেবে উল্লেখযোগ্য।

৪. বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় থাকুন

এআই শুধু ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে না। এটি ফেসবুক, ইউটিউব, লিংকডইন, কোরা এবং অন্যান্য সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম থেকেও তথ্য সংগ্রহ করে। তাই বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আপনার উপস্থিতি নিশ্চিত করা জিইও-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৫. এসইও এবং জিইও একসাথে ব্যবহার করুন

ডিজিটাল দুনিয়ায় এখন শুধু সার্চ র‌্যাংকই যথেষ্ট নয়। এসইও যেমন গুগল সার্চে আপনার কনটেন্টকে শীর্ষে নিয়ে আসে, তেমনি নতুন যুগের জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) আপনার ব্র্যান্ডকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সার্চে আরো দৃশ্যমান করে তোলে।

এসইও মূলত গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে ওয়েবসাইটের অবস্থান উন্নত করে, আর জিইও শেখায়- কীভাবে এআই মডেলগুলো আপনার ব্র্যান্ডকে চিনবে, উল্লেখ করবে এবং বিশ্বাস করবে।

দুটি কৌশল একসাথে প্রয়োগ করলে অনলাইন উপস্থিতি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। একদিকে সার্চে দৃশ্যমানতা বাড়ে, অন্যদিকে এআই-নির্ভর প্ল্যাটফর্মগুলোতেও আপনার ব্র্যান্ডের নাম উঠে আসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

ভবিষ্যতের সার্চ জগতে টিকে থাকতে হলে এখনই সময়- এসইও এবং জিইও-কে একসাথে কাজে লাগানোর।

বাংলাদেশের ব্যবসার জন্য জিইও’র নতুন সম্ভাবনা

জিইও বাংলাদেশের ব্যবসাগুলোর জন্য হতে পারে এক গেম চেঞ্জার। আগে যেখানে অনলাইন দৃশ্যমানতা মানেই ছিল গুগলে র‌্যাংক করা, এখন সেটি ধীরে ধীরে স্থান ছেড়ে দিচ্ছে এআই সার্চ ভিজিবিলিটি–কে।

আজ যদি কোনো ব্যবহারকারী চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-তে জিজ্ঞেস করে- 

‘বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য অনলাইন বই বিক্রির সাইট কোনটা?’

অথবা, ‘ঢাকায় সেরা ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি কারা?’

যদি আপনার ব্র্যান্ডের নাম সেই উত্তরে উঠে আসে, সেটিই হবে প্রকৃত দৃশ্যমানতা- শুধু ক্লিক নয়, বরং আস্থা, প্রভাব ও ব্র্যান্ড অথরিটি–এর প্রতিফলন।

বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন শত শত নতুন অনলাইন ব্যবসা শুরু হচ্ছে- ই–কমার্স, এডুকেশন, হেলথটেক, রিয়েল এস্টেট, ফাইন্যান্স, এমনকি ছোট স্টার্টআপরাও দ্রুত ডিজিটাল হচ্ছে। কিন্তু একইসঙ্গে প্রতিযোগিতাও বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে।

এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে শুধু এসইও নয়, জিইও–কেন্দ্রিক কৌশলও অপরিহার্য।

জিইও’র ভবিষ্যৎ

খুব শিগগিরই এআই সার্চ টেক্সটের বাইরে গিয়ে ভয়েস, ভিডিও ও ইমেজ কনটেন্ট থেকেও উত্তর তৈরি করবে। তখন জিইও কেবল ওয়েবসাইট নয়, বরং ভিডিও, পডকাস্ট, সোশ্যাল প্রোফাইল, নিউজ রিপোর্ট- সবকিছুর মধ্যেই প্রভাব ফেলবে।

তাই এখন থেকেই যারা জিইও-কেন্দ্রিক কৌশল গ্রহণ করবে, ভবিষ্যতের সার্চ রেভোলিউশনে নেতৃত্ব দেবে তারাই।

উপসংহার

জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) শুধু নতুন ট্রেন্ড নয়- এটি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের পরবর্তী অধ্যায়।

এসইও যেমন আপনাকে সার্চ রেজাল্টে নিয়ে যায়, জিইও তেমনি আপনাকে নিয়ে যাবে এআই–এর উত্তরে।

‘ভবিষ্যতের সার্চে র‌্যাংক নয়, ব্র্যান্ডের বিশ্বাসযোগ্যতাই হবে সাফল্যের আসল মাপকাঠি।’

লেখক: হেড অব ওয়েব অ্যানালাইসিস অ্যান্ড এসইও ডিরেক্টর, ইন্টেলেক আইটি এলএলসি (ইউএসএ অ্যান্ড বাংলাদেশ)

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ