ইউরোপের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যে আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখা যাচ্ছে, তাতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত এই হুমকির প্রকৃত রূপটি বোঝা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু অর্থনৈতিক মিত্র হিসেবে ধরে রেখে প্রতিযোগিতার যে বর্তমান কৌশল ইউরোপ অনুসরণ করে আসছে, তা থেকেও তাদের সরে আসা উচিত।

সত্যিকারের প্রযুক্তিগত সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্য ইউরোপকে কেবল প্রতিযোগিতা ও নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার সীমিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে অনেক বেশি উচ্চাভিলাষী কৌশলের পথে হাঁটতে হবে।

গত কয়েক বছরে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিসংক্রান্ত আইন পাস করার পর এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন উদ্ভাবন বাড়াতে এবং প্রতিযোগিতা জোরদার করতে চাইছে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট মারিও দ্রাগির ২০২৪ সালের প্রভাবশালী প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইউরোপীয় কমিশন সম্প্রতি প্রকাশ করেছে কম্পিটিটিভনেস কম্পাস। এটি দ্রাগির সুপারিশ বাস্তবায়নের রোডম্যাপ।

প্রতিযোগিতা নিয়ে ইউরোপের বাড়তে থাকা উদ্বেগের মূল কারণ হলো মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্টদের সঙ্গে বাজারে সমানভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারা। দ্রাগির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের উৎপাদনশীলতার পার্থক্য অনেকটাই ইউরোপের প্রযুক্তি খাতের দুর্বলতার কারণে।

ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন এবং প্রযুক্তি কমিশনার হেনা ভিরকুনেনের সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, নীতিনির্ধারকেরা দ্রাগির বার্তাকে গুরুত্বসহকারে নিয়েছেন এবং এখন ইউরোপের প্রযুক্তিনীতির কেন্দ্রে প্রতিযোগিতাকে বসিয়েছেন।

কিন্তু এই একমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনকার প্রযুক্তিগত ও ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে যথেষ্ট নয়, বরং ক্ষতিকরও হতে পারে। প্রতিযোগিতায় মনোযোগ দেওয়া ইউরোপীয় অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর বিগ টেক কোম্পানিগুলোর প্রভাব কমাতে পারে; আবার একইভাবে তাদের আধিপত্য আরও মজবুতও করতে পারে।

ইউরোপীয় নেতারা এখন যে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার দিকে ঝুঁকছেন (দ্রাগির প্রতিবেদনের মাধ্যমে যার গতি আরও বেড়েছে), তা নীতিনির্ধারণকে বড় বড় কোম্পানির লবির কাছে আরও বেশি দুর্বল করে তুলছে এবং এমন কিছু নীতিকে বৈধতা দিতে পারে, যেগুলো ইউরোপীয় মৌলিক মূল্যবোধের সঙ্গে খাপ খায় না।

ফলে ইউরোপীয় কমিশনের এই নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার উদ্যোগ, যেমন প্রস্তাবিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও গোপনীয়তা আইন স্থগিত রাখা, জিডিপিআরসহ প্রযুক্তি আইন সরলীকরণের ঘোষণা—এসব পদক্ষেপ বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকেই বেশি সুবিধা দেবে, নতুন উদ্যোগ বা ছোট ও মাঝারি কোম্পানিগুলোকে নয়। একই সঙ্গে ‘এআই প্রতিযোগিতা’ নিয়ে ইউরোপের তাড়াহুড়া করা এবং সমালোচনাহীন দৃষ্টিভঙ্গি বিগ টেকের এআই প্রযুক্তিতে কর্তৃত্বকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।

এই প্রযুক্তিনির্ভরতা যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও কিছু বড় কোম্পানিকে ইউরোপের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার ওপর অস্বাভাবিক ক্ষমতা দিয়ে দেয়। এই ক্ষমতা ব্যবহার করে ইউরোপীয় প্রযুক্তি খাতের বিকাশে বাধা দেওয়া হতে পারে—উন্নত চিপ সরবরাহ সীমিত করে বা ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের প্রবেশাধিকারকে হালকা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে শর্তযুক্ত করে।

দ্রাগি প্রতিবেদনে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার যে এজেন্ডা তুলে ধরা হয়েছে, তা সিলিকন ভ্যালিতে উষ্ণভাবে গ্রহণ করা হয়েছে—এমনকি ইলন মাস্ক নিজেও এতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তবে কিছু প্রযুক্তি নেতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা শুধু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে ফেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মাস্কের এক্স (আগে যা ছিল টুইটার) ও স্টারলিংক ব্যবহারের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন ও ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর প্রভাব বিস্তার, আর ট্রাম্প প্রশাসনের ইউরোপীয় প্রযুক্তি নীতিমালার ওপর প্রকাশ্য আক্রমণ—এসবই প্রমাণ করে, বিগ টেকের ক্ষমতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা ইউরোপীয় সার্বভৌমত্বের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ প্রেক্ষাপটে ইউরোপের সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো যুক্তরাষ্ট্রের বড় প্রযুক্তি কোম্পানি ও ওয়াশিংটনের তাদের মিত্রদের ক্রমবর্ধমান হুমকি থেকে নাগরিকদের অধিকার, সার্বভৌমত্ব ও মৌলিক মূল্যবোধ রক্ষা করা। ইউরোপ এখন যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র–নিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল অবকাঠামোর ওপর নির্ভরশীল (যেমন সেমিকন্ডাক্টর, ক্লাউড কম্পিউটিং, সাবমেরিন কেব্‌ল ইত্যাদি), তা শুধু ইউরোপের প্রতিযোগিতার ক্ষমতাকেই দুর্বল করে না, বরং স্থানীয় বিকল্পগুলোর পথও রুদ্ধ করে দেয় এবং এই অবকাঠামোর মালিকেরা এটিকে লাভের জন্য ব্যবহার করতে পারে।

আরও ভয়াবহ বিষয় হলো, এই প্রযুক্তিনির্ভরতা যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও কিছু বড় কোম্পানিকে ইউরোপের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার ওপর অস্বাভাবিক ক্ষমতা দিয়ে দেয়। এই ক্ষমতা ব্যবহার করে ইউরোপীয় প্রযুক্তি খাতের বিকাশে বাধা দেওয়া হতে পারে—উন্নত চিপ সরবরাহ সীমিত করে বা ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের প্রবেশাধিকারকে হালকা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে শর্তযুক্ত করে।

আরও পড়ুনট্রাম্পের ‘মাস্তানি’ থামানোর উপায় কী, আনুগত্য না বয়কট?১৩ ঘণ্টা আগে

এ ধরনের চাপ থেকে ইউরোপকে রক্ষা করা হলে তা শেষ পর্যন্ত প্রতিযোগিতাকেই বাড়িয়ে তুলবে। প্রতিযোগিতা আইন এবং ডিজিটাল মার্কেটস অ্যাক্ট কঠোরভাবে প্রয়োগ করা গেলে বিগ টেকের প্রভাব কমবে এবং ইউরোপীয় স্টার্টআপ ও নতুন চ্যালেঞ্জারদের বিকাশের সুযোগ তৈরি হবে। একইভাবে ডিজিটাল সার্ভিসেস অ্যাক্ট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আইন (এআই অ্যাক্ট) বাস্তবায়ন করলে ক্ষতিকর কনটেন্ট ও বিপজ্জনক এআই সিস্টেম থেকে নাগরিকদের রক্ষা করা যাবে এবং ইউরোপ সিলিকন ভ্যালির নজরদারিভিত্তিক ব্যবসায়িক মডেলের একটি প্রকৃত বিকল্প দিতে পারবে।

এ প্রেক্ষাপটে ইউরোপের নিজস্ব বিকল্প ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগ সম্প্রতি গতি পেয়েছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো ‘ইউরোস্ট্যাক’ নামের প্রকল্প, যা ইউরোপের স্বতন্ত্রভাবে কাজ করার সক্ষমতা রক্ষার একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা উচিত। ক্রমাগত অস্থির হয়ে উঠতে থাকা ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সার্বভৌমত্ব মানে শুধু প্রতিযোগিতা নয়—এটা নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও আত্মনির্ভরতার ব্যাপার। তাই ইউরোপীয় নীতিনির্ধারকদের উচিত প্রতিযোগিতার বিষয়টি অন্য—এবং প্রায়ই আরও গুরুত্বপূর্ণ—লক্ষ্যের সঙ্গে তুলনা করে দেখা।

সৌভাগ্যক্রমে ইউরোপকে এমন কঠিন পছন্দ করতে হবে না। প্রযুক্তিগত নির্ভরতা দূর করে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা রক্ষা করে এবং মৌলিক অধিকার বজায় রেখে ইউরোপ সে ধরনের প্রতিযোগিতা গড়ে তুলতে পারে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

মারিয়েত্যে শাখে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইবার পলিসি সেন্টারে আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারণী পরিচালক

ম্যাক্স ফন থুন ওপেন মার্কেটস ইনস্টিটিউটে ইউরোপ ও ট্রান্স–আটলান্টিক অংশীদারত্ব–বিষয়ক পরিচালক।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক ইউর প য় প র ব যবহ র কর ইউর প য় ক ন র ভরত ক ষমত র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রুটে দুই ট্রেনের সময় বদলে যাচ্ছে

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে চলা সৈকত এক্সপ্রেস ও প্রবাল এক্সপ্রেস ট্রেনের সময়সূচি পরীক্ষামূলকভাবে নতুন করে নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। নতুন সময়সূচি আগামী ১০ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে।

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারগামী সৈকত এক্সপ্রেস (৮২১ নম্বর ট্রেন) ট্রেনটি এখন সকাল সোয়া ৬টায় চট্টগ্রাম স্টেশন ছেড়ে যায়। নতুন সূচি অনুযায়ী, পরীক্ষামূলকভাবে এ ট্রেন চলাচল করবে ভোর ৫টা ৫০ মিনিটে।

আর কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামগামী প্রবাল এক্সপ্রেস (৮২২ নম্বর ট্রেন) ট্রেনটি কক্সবাজার স্টেশন ছাড়বে সকাল ১০টায়। এখন এ ট্রেন ছাড়ে ১০টা ২০ মিনিটে। গত মঙ্গলবার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে চলাচলরত সৈকত এক্সপ্রেস ও প্রবাল এক্সপ্রেসের সময়সূচি পরীক্ষামূলকভাবে পরিবর্তনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের উপপ্রধান পরিচালন কর্মকর্তা তারেক মুহাম্মদ ইমরান।

রেলওয়ের সহকারী প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু বক্কর সিদ্দিকীকের সই করা এক চিঠিতে বলা হয়েছে, যাত্রীদের চাহিদা ও সময়ানুবর্তিতা রক্ষায় সুষ্ঠুভাবে ট্রেন পরিচালনার জন্য কক্সবাজারগামী সৈকত এক্সপ্রেস এবং চট্টগ্রামমুখী প্রবাল এক্সপ্রেস ট্রেনের সময়সূচি পরিবর্তন করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রুটে এখন দুই জোড়া আন্তনগর ট্রেন চলাচল করে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত চলাচল করে আরও দুই জোড়া আন্তনগর ট্রেন।

কক্সবাজার রেললাইনে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর। প্রথমে ঢাকা থেকে কক্সবাজার এক্সপ্রেস নামে আন্তনগর বিরতিহীন ট্রেন দেওয়া হয়। এরপর গত বছরের জানুয়ারিতে চলাচল শুরু করে পর্যটক এক্সপ্রেস। এটাও দেওয়া হয় ঢাকা থেকে। চট্টগ্রাম থেকে ট্রেন না দেওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়।

গত বছরের ৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এক জোড়া বিশেষ ট্রেন চালু করা হয়। দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই ট্রেন। এরপর ইঞ্জিন ও কোচের সংকটের কথা বলে গত বছরের ৩০ মে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের চাপে সেই অবস্থান থেকে সরে আসে রেলওয়ে। গত বছরের ১২ জুন থেকে আবার চালু হয় ট্রেন। আর নিয়মিত ট্রেন চলাচল শুরু হয় চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে।

সৈকত এক্সপ্রেস ট্রেনটি যাত্রী ওঠানামার জন্য ষোলশহর, জানালী হাট, পটিয়া, দোহাজারী, সাতকানিয়া, চকরিয়া, ডুলাহাজরা ও রামু স্টেশনে থামবে।

আর প্রবাল এক্সপ্রেস যাত্রাপথে থামবে ষোলশহর, গোমদণ্ডী, পটিয়া, দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ডুলহাজারা, ইসলামাবাদ ও রামু স্টেশনে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ