ভিআইপি গ্যালারিতে বসে উসখুস করছিলেন তিনি। এমনিতে আগের ম্যাচে আলাভেসের বিপক্ষে লাল কার্ড থাকায় নিষেধাজ্ঞা ছিল। তার ওপর আবার গোড়ালিতে হালকা চোট। সব মিলিয়ে অ্যাথলেটিক বিলবাও ম্যাচের দর্শক ছিলেন এমবাপ্পে, যেখানে শেষ মুহূর্তে গোল করে রিয়ালকে লা লিগার রেসে টিকিয়ে রাখেন ফেদেরিকো ভালবার্দে। 

অতিরিক্ত সময়ে ডান পায়ের দুর্দান্ত ভলিতে বিলবাওয়ের জালে বল পাঠিয়ে দেন উরুগুয়ের এ তারকা। ১-০ গোলের এই জয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে রিয়াল। কেননা এই ম্যাচে হোঁচট খেলেই লা লিগার শিরোপা ধরে রাখার অনেক কঠিন হয়ে যেত তাদের জন্য। 

এই মুহূর্তে পয়েন্ট তালিকায় গায়ে গায়ে দুটি দল। ৩২ ম্যাচে ৭৩ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে বার্সেলোনা, এর ৪ পয়েন্ট পিছিয়ে দ্বিতীয়তে রিয়াল মাদ্রিদ। দুই দলের হাতে রয়েছে ছয়টি করে ম্যাচ। এর মধ্যে আগামী ১১ মে নিজেদের মাঠে রিয়াল মাদ্রিদের মুখোমুখি হবে বার্সেলোনা। মূলত এই এল ক্ল্যাসিকোতে নির্ধারণ হয়ে যাবে লা লিগার শিরোপা যাবে কোন শহরে।

বার্সেলোনার লা লিগা জেতার সহজ সমীকরণ হলো হাতে থাকা সব ম্যাচ জেতা। সেক্ষেত্রে তিনটি বড় প্রতিপক্ষ রয়েছে তাদের সামনে– রিয়াল মাদ্রিদ, ভিয়ারিয়াল ও অ্যাথলেটিক বিলবাও। ছয়টির মধ্যে যদি কোনো একটিতে হার আর একটিতে ড্র করে বার্সা, অন্যদিকে রিয়াল হাতে থাকা সব ম্যাচ জিতে নেয়, তাহলে দুই দলের পয়েন্ট হবে সমান। সেক্ষেত্রে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে গোল ব্যবধানে এগিয়ে থাকার সুবাদে শিরোপা যাবে কাতালানদের ঘরে। 

এই মুহূর্তে বার্সেলোনা ৩২ ম্যাচে গোল করেছে ৮৮টি, হজম করেছে ৩২টি। তাদের গোল ব্যবধান ৫৬। অন্যদিকে রিয়াল মাদ্রিদ সমান ম্যাচে গোল করেছে ৬৫টি, আর হজম করেছে ৩১টি। তাদের গোল ব্যবধান ৩৪। বার্সার সঙ্গে এই গোল গোল খেলায় রিয়াল পিছিয়ে ২২ গোলে। তাই  এমবাপ্পেদের শিরোপা ধরে রাখতে হলে শুধু ছয়টি ম্যাচ জিতলেই হবে না, বার্সাকে অন্তত দুটি ম্যাচ হারতে হবে অথবা এক হারের সঙ্গে দুই ম্যাচে ড্রর প্রার্থনা করতে হবে। হাতে থাকা ছয়টি ম্যাচে দুটি হার এড়াতে পারলেই লা লিগা শিরোপা নিশ্চিত হয়ে যাবে বার্সেলোনার।

এর মধ্যেই অবশ্য ২৭ এপ্রিল এল ক্ল্যাসিকোর পরীক্ষায় বসতে যাচ্ছে দুটি দল। কোপা দেল রের ফাইনালে সেদিন বার্সেলোনা তাদের লা লিগার সর্বোচ্চ গোলস্কোরার (২৫) লেভানডস্কিকে না পেলেও রিয়াল পাচ্ছে তাদের সেরা গোলস্কোরার (২২) এমবাপ্পকে। সেই সঙ্গে ভালবার্দেও আস্থা বাড়িয়ে দিয়েছেন রিয়াল কোচ আনচেলেত্তির। লং রেঞ্জের শট নেওয়ার ব্যাপার রিয়ালের দারুণ এক সম্পদ উরুগুয়ের এ মিডফিল্ডার।

লিগে বেশ কিছু ম্যাচে দূরপাল্লার শটে অসাধারণ গোল করেছেন। ম্যাচ শেষে ভালবার্দের প্রশংসা ছিল আনচেলেত্তির মুখে। সেই সঙ্গে ভিনির একটি গোল বাতিল করা এবং একটি পেনাল্টি না দেওয়ার অভিযোগও ছিল। লিগে হাতে থাকা রিয়ালের ছয়টি ম্যাচের মধ্যে বার্সেলোনারটি বাদ দিলে বাকিগুলো তুলনামূলক সহজ প্রতিপক্ষের বিপক্ষে। গেটাফে, সেল্টাভিগো, মালোর্কা, সেভিয়া আর সোসিয়াদের কেউই তালিকার শীর্ষ পাঁচে নেই।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ক ল য় ন এমব প প গ ল কর

এছাড়াও পড়ুন:

চিনি-লবণের অনুপম পাঠ

চিনি আর লবণ– দুটিই সাদা ও ঝকঝকে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এক হলেও তাদের স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই সরল অথচ গভীর সত্যটি আমাদের চারপাশের সমাজের প্রতিচ্ছবি। আজ যখন মানুষ শুভাকাঙ্ক্ষীর মুখোশ পরে এগিয়ে আসে, আমরা বুঝতে পারি না– কে চিনি, কে লবণ। এই বিভ্রমের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের চিরন্তন দ্বন্দ্ব। তার ফলে সমাজে জন্ম নিচ্ছে ভাঙন, ক্ষয় ও ব্যথার করুণ কাব্য।

শুভাকাঙ্ক্ষী সেজে প্রতারণার ছায়া আজ সমাজের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনও বন্ধুত্বের আবরণে, কখনও আত্মীয়তার মোড়কে, আবার কখনও নির্ভরতার চাদরে ঢাকা পড়ে থাকা বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের বারবার আহত করে। রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাঙ্গন বা পারিবারিক জীবন– বিশ্বাসের অবক্ষয়ের নির্মম চিত্র আজ সর্বত্র বিদ্যমান। সবচেয়ে আপন বলে যার হাত ধরেছি, সেই হাত কখন যে ছুরি হয়ে ফিরে আসে– বলা দুষ্কর।

সম্প্রতি রাজধানীর উপকণ্ঠে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা আমাদের ব্যথিত করেছে। বৃদ্ধ মা তাঁর তিন সন্তানকে অকুণ্ঠ বিশ্বাস করে সব সম্পত্তি লিখে দেন। সন্তানরা কথা দিয়েছিল– শেষ দিন পর্যন্ত মায়ের পাশে থাকবে। কিন্তু দলিলের কালি শুকানোর আগেই মাকে উঠিয়ে দেওয়া হয় বৃদ্ধাশ্রমে। মায়ের চোখের জল তখন ছিল মূল্যহীন; সম্পদের নেশাই ছিল মূল।

অন্যদিকে দীর্ঘদিনের ‘বিশ্বস্ত’ বন্ধু ব্যবসার আড়ালে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে অদৃশ্য হয়েছে রাতের অন্ধকারে। এসব গল্প আজ প্রতিটি নগর-পল্লীর অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্পর্কের পবিত্রতা আজ যেন লোভ ও মুনাফার কাছে নতজানু।

বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা কোনো দাগের মতো নয়, যা সময়ের সঙ্গে মুছে যায়। বরং এটি মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। একজনের আঘাত শুধু তার নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; ছড়িয়ে পড়ে সমাজজুড়ে। গড়ে ওঠে এক অবিশ্বাসের দেয়াল, যেখানে একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। সম্পর্কের উষ্ণতা ক্রমে ঠান্ডা হতে হতে বরফে পরিণত হয়, যা গলাতে লাগে যুগের পর যুগ।

ভোগবাদী সভ্যতা মানুষকে করে তুলেছে আত্মকেন্দ্রিক। মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতার সংকট এবং তাৎক্ষণিক লাভের মোহে সম্পর্কও আজ মুনাফার মাপে মাপা হয়। বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা, প্রেম– সবকিছু যেন পরিণত হয়েছে একেকটি চুক্তিতে। ‘কে কতটা কাজে লাগবে’– এই প্রশ্নই আজ সম্পর্কের মানদণ্ড। তবে সব আলো নিভে যায়নি। অন্ধকার যত গভীর হোক, এক টুকরো মোমবাতি গোটা ঘর আলোকিত করতে পারে। এই সংকটময় সময়ে আমাদের প্রয়োজন আত্মসমালোচনা ও মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ। ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক হতে হবে। কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে, যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবেগের তাড়নায় নয়, বিবেকের আলোয় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। পারিবারিক শিক্ষাকে মজবুত করতে হবে। শিশুর মনে শৈশব থেকেই সততা, বিশ্বস্ততা ও মানবিকতার বীজ বপন করতে হবে। পরিবারই হচ্ছে ব্যক্তিত্ব গঠনের মূল কেন্দ্র। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে সমাজে ন্যায়বোধ প্রতিষ্ঠা পায়। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে নৈতিক চেতনা জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। তবু এই অন্ধকারে কিছু আলোকবর্তিকা রয়েছেন, যারা এখনও বিশ্বাসের মানদণ্ডে অবিচল। যাদের জীবন শুধু নিজের জন্য নয়, অপরের কল্যাণে নিবেদিত। সংকটে পাশে দাঁড়ানো, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বিলানো– এটাই তাদের ধর্ম। এরা প্রমাণ করে– বিশ্বাস এখনও বিলুপ্ত হয়নি পুরোপুরি। শুধু খুঁজে নিতে জানতে হবে।

পরিশেষে, চিনি ও লবণের বাহ্যিক সাদার ভ্রম নয়, আসল স্বাদ বোঝার সক্ষমতা অর্জন করাই আজ সময়ের দাবি। মানুষকে তার কার্যকলাপের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে; বাহ্যিক মোহের ফাঁদে পা না দিয়ে। অন্ধবিশ্বাস নয়– সচেতন, বিবেকবান বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে তুলতে হবে সম্পর্কের ভিত।

মুহাম্মদ ইমাদুল হক প্রিন্স: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ