Samakal:
2025-06-22@05:28:39 GMT

সুন্দরবনে অসুন্দর মাছ শিকার

Published: 5th, May 2025 GMT

সুন্দরবনে অসুন্দর মাছ শিকার

সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বন। ১৯৯৬ সালে সুন্দরবনে তিনটি অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনটি ডলফিন অভয়ারণ্য তৈরি করা হয় ২০১২ সালে। ২০১৪ সালে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডকে মেরিন প্রটেকটেড এরিয়া ঘোষণা করা হয়। ১৯৯২ সালে এটি ৫৬০তম রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে ৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। এই বন বাংলাদেশের মানুষের কাছে মায়ের মতো। কেননা, যখনই জলোচ্ছ্বাস হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় হয়েছে; সুন্দরবন তখনই আমাদের মায়ের মতো বুকে আগলে রেখে রক্ষা করেছে। সিডর, আইলা, রোয়ানু, বুলবুল, ফণী এবং সর্বশেষ আম্পানেও সুন্দরবন আমাদের রক্ষা করেছে। সুন্দরবনের কারণে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের গতি ৭০ কিলোমিটার কমেছে। এটি জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা কমিয়েছে তিন থেকে চার ফুট। অথচ ১৯৬০ সালের পর আমাদের দেশে যত ঘূর্ণিঝড় হয়েছে, তার মধ্যে আম্পান ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ। এত দীর্ঘ হওয়ার পরও সিডর বা আইলার চেয়ে এর ক্ষয়ক্ষতি ছিল অনেক কম। কেননা, সুন্দরবনে এসেই এ ঝড়ের গতি কমতে শুরু করে। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ১৫ থেকে ১৮ ফুট হওয়ার শঙ্কা থাকলেও সুন্দরবনের কারণে এটি কমে ১০ থেকে ১২ ফুট হয়। ২০০৭ সালে সিডর আর ২০০৯ সালে যে আইলার তাণ্ডব দেখা গেছে বাংলাদেশে, তারও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়েছে সুন্দরবন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের গবেষণা প্রতিবেদনমতে, ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় সুন্দরবন ৪৮৫ দশমিক ২৯ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ রক্ষা করেছিল।   

সুন্দরবনের অধিকাংশ এলাকায় জোয়ার-ভাটা হয় বলে এ বনের গাছপালা লবণাক্ততা সহনশীল। এ বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী, গেওয়া, গরান, বাইন, ধুন্দুল, কেওড়া, গোলপাতা। এ ছাড়া রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, বানর এখানকার উল্লেখযোগ্য প্রাণী। সুন্দরবনে ২৮৯ প্রজাতি স্থলজ প্রাণীর বসবাস। এর মধ্যে ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর, মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী আছে। এখানে প্রায় ৫০ প্রজাতির পাখির বাস। এই বনটি উপকূলবর্তী হওয়ায় সমুদ্র দ্বারা প্রভাবিত। সৈকত, মোহনা, জলাভূমি, মাটির প্রকৃতির কারণে এটি স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র গঠন করেছে। 
দিন দিন সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। প্রাণিহত্যা, চোরাচালানের পাশাপাশি বিভিন্ন খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যকে ভয়াবহ হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এক শ্রেণির অসাধু জেলে সুন্দরবনের খালে জোয়ারের আগে চিড়া, ভাত বা অন্য কিছুর সঙ্গে কীটনাশক মিশিয়ে ছিটিয়ে দেয়। এতে অভয়ারণ্যের খালে অল্প সময়েই অনেক মাছ ধরতে পারে। ফসলের পোকা দমনে যেসব কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, তা দিয়েই এসব মাছ ধরা হয়। সাধারণত ডায়মগ্রো, ফাইটার, রিপকর্ড ও ভেসিকল নামে কীটনাশক দিয়ে মাছ ধরা হয়। এসব বিষ প্রয়োগ করা হলে খালের ছোট বড় সব ধরনের মাছ মারা যায়। শুধু মাছ নয়, পোনাও মারা যায়। এসব বিষ মিশ্রিত পানি গভীর সমুদ্রে গিয়ে সেখানকার প্রাণীরও ক্ষতি করে। এই বিষ তাৎক্ষণিক শুধু মাছই মেরে ফেলে না; দীর্ঘদিন খাল বা সমুদ্রে থাকার ফলে জলজ নানা প্রাণীও ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এতে মাছের প্রজনন ক্ষমতাও হ্রাস পায়। মাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ওপর নির্ভরশীল অন্যান্য প্রাণীও খাদ্য সংকটে পড়ে। তা ছাড়া বিষযুক্ত মাছ খেয়ে পাখি ও বড় মাছও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যে সুন্দরবন আমাদের বাঁচায়, তাকে বাঁচাতে আমাদের প্রত্যেকের এগিয়ে আসা উচিত। সুন্দরবনের খালগুলোতে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার যে মাত্রায় বেড়েছে, তাতে সহজেই অনুমেয়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে সুন্দরবন। তাই আসুন সুন্দরবনকে আমরা রক্ষা করি।

ড.

বিভূতিভূষণ মিত্র: শিক্ষক ও গবেষক

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ন দরবন র ঘ র ণ ঝড় আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

বাঘ ও তিমির গল্প

গত ১৮ মে সিঙ্গাপুর যাচ্ছিলাম। ইউসুফ এস আহমেদ লিখিত এবং ইশতিয়াক হাসান অনূদিত উইথ দ্য ওয়াইল্ড অ্যানিমেলস অব বেঙ্গল বইটি অবসরে পড়ার জন্য সঙ্গে নিলাম। ইউসুফ এস আহমেদ একসময় পাকিস্তানের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব ফরেস্ট ছিলেন। ১৯২৬ সালে তিনি বন বিভাগে যোগ দেন এবং ১৯৫৯ সালে অবসরে যান। তাঁর ৩৩ বছরের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ বইটির ৪১ পৃষ্ঠায় লিখিত বক্তব্যটি আমার নজর কাড়ে। ততক্ষণে বিমান সিঙ্গাপুরের মাটি ছুঁয়েছে, যে দেশটি তার শেষ বাঘটি হারিয়েছে ১৯৩০ সালে।

ইউসুফ এস আহমেদ ১৯২৯ সালে সুন্দরবন ডিভিশনের দায়িত্ব পান। বন্য প্রাণীর প্রতি আগ্রহের কারণে শিগগিরই ‘ওয়াইল্ড ম্যান অব ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট’ নামে পরিচিতি পেলেন। তিনি লিখেছেন, ‘ভোলা নদীর ওপারে ধানসাগর গ্রাম সুন্দরবনের এই অংশে পুবের সীমানা হিসেবে কাজ করছে। ১৯২৯/১৯৩০ সালের শীতকাল। বাঘের চামড়া এবং মাথাসহ পুরস্কার দাবি করে একটি চিঠি এল স্থানীয় পুলিশ ক্যাম্প থেকে।’

বাঘটি ধানসাগর গ্রামে ঢুকে পড়লে স্থানীয় শিকারিদের সহায়তায় পুলিশের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইন্সপেক্টরের গুলিতে মারা পড়ে। ধানসাগর শরণখোলা উপজেলার অধীন বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের অন্তর্গত। এটি প্রায় ১০০ বছর আগের ঘটনা।

শত বছর পর ইদানীং বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব একটি পর্যায়ে এসেছে। বাংলাদেশ বন বিভাগের সহযোগিতায় ওয়াইল্ডটিম নামক সংগঠনটি সুন্দরবনের চারপাশে ‘ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম’ গঠন করেছে। সুন্দরবনের প্রায় ৮০ শতাংশ গ্রামে এখন ৩৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক ৪৯টি দলে ভাগ হয়ে প্রায় ১৮ বছর ধরে বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে কাজ করে যাচ্ছেন। কোনো বাঘ গ্রামে ঢুকলেই এই দলের সদস্যরা বন বিভাগের সহযোগিতায় বাঘটিকে বনে ফিরিয়ে দেন। 

দেশের কোথাও বন্য প্রাণী, বিশেষ করে বাঘ মারলে একসময় এলাকায় তিনি ‘হিরো’ হয়ে যেতেন। এটি ছিল সামাজিক স্বীকৃতি। কিন্তু ব্রিটিশরা ভাবলেন, সুন্দরবনের যেসব এলাকা থেকে রাজস্ব বেশি আয় হয়, সেখানকার বনকর্মীদের পুরস্কৃত করলে ওই সব এলাকা বাঘশূন্য করা যাবে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক রঞ্জন চক্রবর্তী লিখেছেন, ১৬ নভেম্বর ১৮৮৩ সালে সরকার ‘ক্যালকাটা গেজেট’–এর মাধ্যমে ঘোষণা করলেন: একটি পূর্ণবয়স্ক বাঘ মারলে ৫০ রুপি এবং বাচ্চা মারলে ১০ রুপি পাওয়া যাবে। অবশ্য চামড়া ও মাথার খুলি জমা দিতে হবে। ১৯০৬ সালে এটি বাড়িয়ে ১০০ রুপি এবং ১৯০৯ সালে ২০০ রুপি করা হলো। ১৮৮১ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত ২ হাজার ৪০০টি প্রাপ্তবয়স্ক বাঘ মারা পড়েছে। যদিও এটি সরকারি হিসাব, বেসরকারি হিসাব কখনো জানা যায়নি। বাংলাদেশে একসময় প্রায় সর্বত্রই বাঘ ছিল, কিন্তু সুন্দরবনই আজ আমাদের ১২৫টি বাঘের শেষ আশ্রয়স্থল।

সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লি কং চিয়ান প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরে প্রদর্শিত তিমির কঙ্কাল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাঘ ও তিমির গল্প