সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বন। ১৯৯৬ সালে সুন্দরবনে তিনটি অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনটি ডলফিন অভয়ারণ্য তৈরি করা হয় ২০১২ সালে। ২০১৪ সালে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডকে মেরিন প্রটেকটেড এরিয়া ঘোষণা করা হয়। ১৯৯২ সালে এটি ৫৬০তম রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে ৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। এই বন বাংলাদেশের মানুষের কাছে মায়ের মতো। কেননা, যখনই জলোচ্ছ্বাস হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় হয়েছে; সুন্দরবন তখনই আমাদের মায়ের মতো বুকে আগলে রেখে রক্ষা করেছে। সিডর, আইলা, রোয়ানু, বুলবুল, ফণী এবং সর্বশেষ আম্পানেও সুন্দরবন আমাদের রক্ষা করেছে। সুন্দরবনের কারণে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের গতি ৭০ কিলোমিটার কমেছে। এটি জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা কমিয়েছে তিন থেকে চার ফুট। অথচ ১৯৬০ সালের পর আমাদের দেশে যত ঘূর্ণিঝড় হয়েছে, তার মধ্যে আম্পান ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ। এত দীর্ঘ হওয়ার পরও সিডর বা আইলার চেয়ে এর ক্ষয়ক্ষতি ছিল অনেক কম। কেননা, সুন্দরবনে এসেই এ ঝড়ের গতি কমতে শুরু করে। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ১৫ থেকে ১৮ ফুট হওয়ার শঙ্কা থাকলেও সুন্দরবনের কারণে এটি কমে ১০ থেকে ১২ ফুট হয়। ২০০৭ সালে সিডর আর ২০০৯ সালে যে আইলার তাণ্ডব দেখা গেছে বাংলাদেশে, তারও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়েছে সুন্দরবন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের গবেষণা প্রতিবেদনমতে, ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় সুন্দরবন ৪৮৫ দশমিক ২৯ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ রক্ষা করেছিল।
সুন্দরবনের অধিকাংশ এলাকায় জোয়ার-ভাটা হয় বলে এ বনের গাছপালা লবণাক্ততা সহনশীল। এ বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী, গেওয়া, গরান, বাইন, ধুন্দুল, কেওড়া, গোলপাতা। এ ছাড়া রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, বানর এখানকার উল্লেখযোগ্য প্রাণী। সুন্দরবনে ২৮৯ প্রজাতি স্থলজ প্রাণীর বসবাস। এর মধ্যে ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর, মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী আছে। এখানে প্রায় ৫০ প্রজাতির পাখির বাস। এই বনটি উপকূলবর্তী হওয়ায় সমুদ্র দ্বারা প্রভাবিত। সৈকত, মোহনা, জলাভূমি, মাটির প্রকৃতির কারণে এটি স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র গঠন করেছে।
দিন দিন সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। প্রাণিহত্যা, চোরাচালানের পাশাপাশি বিভিন্ন খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যকে ভয়াবহ হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এক শ্রেণির অসাধু জেলে সুন্দরবনের খালে জোয়ারের আগে চিড়া, ভাত বা অন্য কিছুর সঙ্গে কীটনাশক মিশিয়ে ছিটিয়ে দেয়। এতে অভয়ারণ্যের খালে অল্প সময়েই অনেক মাছ ধরতে পারে। ফসলের পোকা দমনে যেসব কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, তা দিয়েই এসব মাছ ধরা হয়। সাধারণত ডায়মগ্রো, ফাইটার, রিপকর্ড ও ভেসিকল নামে কীটনাশক দিয়ে মাছ ধরা হয়। এসব বিষ প্রয়োগ করা হলে খালের ছোট বড় সব ধরনের মাছ মারা যায়। শুধু মাছ নয়, পোনাও মারা যায়। এসব বিষ মিশ্রিত পানি গভীর সমুদ্রে গিয়ে সেখানকার প্রাণীরও ক্ষতি করে। এই বিষ তাৎক্ষণিক শুধু মাছই মেরে ফেলে না; দীর্ঘদিন খাল বা সমুদ্রে থাকার ফলে জলজ নানা প্রাণীও ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এতে মাছের প্রজনন ক্ষমতাও হ্রাস পায়। মাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ওপর নির্ভরশীল অন্যান্য প্রাণীও খাদ্য সংকটে পড়ে। তা ছাড়া বিষযুক্ত মাছ খেয়ে পাখি ও বড় মাছও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যে সুন্দরবন আমাদের বাঁচায়, তাকে বাঁচাতে আমাদের প্রত্যেকের এগিয়ে আসা উচিত। সুন্দরবনের খালগুলোতে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার যে মাত্রায় বেড়েছে, তাতে সহজেই অনুমেয়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে সুন্দরবন। তাই আসুন সুন্দরবনকে আমরা রক্ষা করি।
ড.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ন দরবন র ঘ র ণ ঝড় আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
সুন্দরবনের বুকে শেষ হলো রাস উৎসব
খুলনার কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক বিদেশ রঞ্জন মৃধা আজ বৃহস্পতিবার ভোরে ট্রলার থেকে নামলেন কয়রার ঘাটে। তিন দিন পর তিনি ফিরেছেন সুন্দরবনের গভীর দুবলারচরের আলোরকোল থেকে। চোখে–মুখে ক্লান্তি, কিন্তু ভেতরে প্রশান্তি।
বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, ‘গতকাল বুধবার ভোরে বঙ্গোপসাগরের প্রথম জোয়ারে পুণ্যস্নান শেষে আমরা ফিরতি পথ ধরে আজ লোকালয়ে পৌঁছাতে পেরেছি। আমার মা আর দিদি—দুজনেই অসুস্থ। তাঁরাও ছিলেন, খুব ভয়ে ছিলাম।’
৩ নভেম্বর শুরু হওয়া সুন্দরবনের দুবলারচরের আলোরকোলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী তিন দিনের রাস উৎসব শেষ হয় গতকাল ভোরে। পূর্ণিমার জোয়ারের লোনাজলে পুণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে এ উৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটে।
ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী চলে পুণ্যস্নান। আলোরকোলের দুই কিলোমিটারজুড়ে তখন শুধু ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য। হাজারো নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ একসঙ্গে নেমে পড়েন সমুদ্রের জলে। শঙ্খধ্বনি, কীর্তন, ঢাকের বাদ্য আর ধূপের গন্ধে ভরে ওঠে পুরো এলাকা।
কয়রার মহারাজপুর এলাকার পুণ্যার্থী মনোজিত কুমার রায় বলেন, ‘পূর্ণিমার জোয়ারে স্নান করলে পাপমোচন হয়—এ বিশ্বাস নিয়েই গিয়েছিলাম। সৈকতের পাড়ে চোখ বুজে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি।’
বন বিভাগের হিসাবে, এবারের রাস উৎসবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ১৩ হাজার ৫১৯ জন পুণ্যার্থী অংশ নিয়েছেন। পূজা-অর্চনা, ভজন ও লীলাকীর্তন শেষে গতকাল ভোরে তাঁরা সাগরে স্নান করে নিজ নিজ গন্তব্যে রওনা হন। উৎসব চলাকালে বন বিভাগ, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী ও পুলিশের একাধিক দল সার্বক্ষণিক টহলে ছিল। গত মঙ্গলবার সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে সুমন নামের এক পুণ্যার্থী নিখোঁজ হলেও কোস্টগার্ড পরে তাঁকে জীবিত উদ্ধার করে।
রাস উৎসবের ইতিহাস সম্পর্কে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কয়রা উপজেলা সভাপতি অরবিন্দ মণ্ডল বলেন, উনিশ শতকের শুরুর দিকে সাধু হরিভজন প্রথম দুবলারচরের আলোরকোলে রাসপূর্ণিমার পূজা শুরু করেন। তিনি তাঁর ভক্তদের নিয়ে সাগরে পুণ্যস্নান করতেন। পরে ধীরে ধীরে এই আয়োজন লোকসমাগমের মাধ্যমে এক বৃহৎ রাসমেলায় পরিণত হয়। তবে ২০১৭ সাল থেকে বন বিভাগের সিদ্ধান্তে মেলার আয়োজন বন্ধ আছে।
রাস উৎসবের সময় সুন্দরবনে হরিণ শিকার বেড়ে যায়—এ অভিযোগ পুরোনো। তবে এ বছর বন বিভাগ বলছে, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই তারা দমন করতে পেরেছে।
পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘রাস উৎসবের দ্বিতীয় দিন কেওড়াবনে টহলের সময় বনরক্ষীরা প্রায় চার হাজার ফুট লম্বা হরিণ শিকারের ফাঁদ উদ্ধার করেন। এবার উৎসবের সময় ৩২ জন শিকারি আটক হয়েছেন। শিকারের ফাঁদগুলো আগেভাগে না সরাতে পারলে শতাধিক হরিণ মারা যেত।’
দুবলারচরের আলোরকোলে রাস উৎসব উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, শতাব্দীকাল ধরে আলোরকোলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ভারত থেকেও অনেক ভক্ত অংশ নেন। এটি শুধু পূজা নয়, এক আধ্যাত্মিক মিলনমেলা।
সুন্দরবন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, এবারের রাস উৎসব শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। পুণ্যার্থীরা সব নির্দেশনা মেনে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছেন। আগাম প্রস্তুতি ও যৌথ টহলের কারণে অপরাধও অন্য বছরের তুলনায় অনেক কম।