গত ২৮ এপ্রিল তিনজন সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন। সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর কান চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রিত শর্টফিল্ম আলী এর বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা ঘিরে এ ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে অনেকে মতামত তুলে ধরেছেন। মতামতগুলোয় সংবাদমাধ্যমের সেলফ সেন্সরশিপ, সরকার ও সরকার সমর্থক গোষ্ঠীর চাপ, প্রশ্ন করা বা না করা প্রসঙ্গ, প্রশ্নের মান, সাংবাদিকদের পেশাদারত্ব, সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা, স্বাধীন সাংবাদিকতার সংকুচিত পরিবেশ এবং সম্মেলনে উপদেষ্টার ভূমিকা উঠে এসেছে।

বেসরকারি টেলিভিশন নিউজ ২৪ সংবাদ সম্মেলনটি সরাসরি সম্প্রচার করেছিল। সব মিলিয়ে ৩০ মিনিট ২০ সেকেন্ড। এই ভিডিও ও প্রাসঙ্গিক লেখালেখি বিশ্লেষণ করে আলোচনাটি কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।

ক.

শর্টফিল্ম ‘আলী’ প্রশ্নোত্তরে নেই: সংবাদ সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল মূলত কান চলচ্চিত্র উৎসবে শর্টফিল্ম আলী এর আমন্ত্রণ বিষয়ে। শুরুতেই উপদেষ্টা এই শর্টফিল্ম নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরিচয় করিয়ে দেন। মন্ত্রণালয় কীভাবে এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে, তা তুলে ধরেন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিসরে ভালো কাজগুলো তুলে ধরার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেন। সংশ্লিষ্ট সবাইকে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানান। তারপর আলোচনা শুরু হয়।

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, শর্টফিল্ম আলী বিষয়ে প্রেস কনফারেন্সে সেই অর্থে কোনো প্রশ্ন নেই। প্রথমে যে প্রশ্ন গুরুত্বের সঙ্গে আসে, তা হলো বঙ্গবন্ধুর জীবনীভিত্তিক ছবিতে সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টার স্ত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশার অভিনয় প্রসঙ্গে। এরপর আসে পয়লা বৈশাখে চারুকলায় শেখ হাসিনার মোটিফ, রিকনসিলিয়েশন এবং ১ হাজার ৪০০ খুন আদালতের রায় ছাড়া কীভাবে বলা হচ্ছে, সেসব প্রসঙ্গ। প্রশ্নোত্তরের শুরুতেই কান চলচ্চিত্র উৎসবে আলী প্রসঙ্গ হারিয়ে যায়। এই হারিয়ে যাওয়া আরও গভীর হয় যখন তিনজন সাংবাদিক চাকরি হারান। এটাই মূল খবর হয়ে ওঠে।

সাংবাদিকতা বিষয়নির্ভর পেশা। তবে সাংবাদিকেরা কোন বিষয়ে প্রশ্ন করবেন, এটা তাঁদের পছন্দ ও স্বাধীনতার বিষয়। আদর্শগতভাবে চাওয়া হয়, সাংবাদিকেরা মূল বিষয়ে নিবিষ্ট থাকবেন। যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের প্রতিবেদন করবেন। কিন্তু দর্শক-শ্রোতারা দেখেছে, সংবাদ সম্মেলনে উত্তরদাতা খুশি হন—এমন প্রশ্ন করা হয়। প্রায়ই বিষয়ের বাইরে যাওয়া হয়। শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে এ ধরনের অনেক নজির তৈরি হয়েছে।

যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকলে বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন করে উত্তরদাতাকে সহজেই চাপে ফেলা যায়। বিবিসি হার্ডটকের স্টিফেন সকার কিংবা আল-জাজিরার রিজ খানের ‘লিসলিং পোস্ট’ দেখলে সহজেই তা বোঝা যায়। প্রস্তুতি সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার নিতে সাবলীল ও সহজ করে।

খ) সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টার বাচনিক ও অবাচনিক প্রকাশ: সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা প্রশ্নগুলো তাঁর মতো করে সামলেছেন। তিনি বেশ ইংরেজি ব্যবহার করেছেন, যা খুব বেশি প্রয়োজনীয় ছিল বলে মনে হয়নি। অপ্রয়োজনে ইংরেজির প্রয়োগ ঘাবড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত। তিনি পুরোদস্তুর বাংলা দিয়ে বিষয়টি সামাল দিতে পারতেন।

শেখ হাসিনার মোটিফ প্রসঙ্গে ‘সাধারণ মানুষ’ হিসেবে বক্তব্য তুলে ধরেছেন সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পদমর্যাদা ব্যবহার করে ‘সাধারণ মানুষ’ হিসেবে কথা বলার সুযোগ তাঁর নেই। উপদেষ্টা হিসেবেই বক্তব্য দিতে হবে। তাঁর ব্যক্তি ও পেশাগত জীবনের সীমারেখা বিষয়ে উপদেষ্টার বোঝাপড়া যে পরিষ্কার, তা বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে তাঁর স্ত্রীর অভিনয় প্রসঙ্গে স্পষ্ট হয়েছে। তিনি বলেছেন, এই প্রশ্নের উত্তর তিশাই ভালো দিতে পারবেন।

সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা আত্মপক্ষ সমর্থনের কৌশল হিসেবে সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করেছেন; বোঝাতে চেয়েছেন, সাংবাদিকেরা বিষয়টি বোঝেন কি না? সাক্ষাৎকারের সময় কঠিন প্রশ্ন সামলানোর ক্ষেত্রে উত্তরদাতা এমন কৌশলের আশ্রয় নেন। সাংবাদিকতার বয়ানে এগুলো পড়ানো হয়। যেমন তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন, এবারে পয়লা বৈশাখের থিমলাইন কী ছিল? এ বিষয়ে সাংবাদিকদের তিনি কিছুটা নাজেহাল করতে সক্ষম হয়েছেন। এতে সাংবাদিকেরা আরও সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। আরও শক্ত অবস্থানে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। উপদেষ্টা যে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন, তা বোঝা যাচ্ছে বসে কথা বলতে বলতে তিনি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেছেন।

উত্তরদাতা হিসেবে সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টার আরেকটি কৌশল ছিল সাংবাদিকদের উপদেশ দেওয়া—‘ডু ইয়োর ওন রিসার্চ’, ‘কোশ্চেন কিন্তু ইনফর্মড হতে হবে’ ইত্যাদি। উপদেষ্টার এ ধরনের উপদেশের গূঢ় অর্থ হলো আপনাদের জানাশোনার অবস্থা ভালো নয়। আপনারা সাধারণ জ্ঞান নিয়ে চলেন।

কথা সত্য যে সাংবাদিকতায় সাধারণ জ্ঞান থাকতে হয়। কিন্তু পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা বিশেষায়িত জ্ঞাননির্ভর পেশা। সংবাদ সম্মেলনে উত্তরদাতার পরিপ্রেক্ষিত হলো বিষয়ের মধ্যে থাকা এবং সাংবাদিকদের বিষয়ের মধ্যে রাখতে সচেষ্ট হওয়া।

গ) সাংবাদিকদের পরিপ্রেক্ষিত: শর্টফিল্ম আলী বিষয়ে সাংবাদিকদের যে কোনো প্রস্তুতি ছিল না, তা প্রশ্নের ধরন দেখে বোঝা গেছে। উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে লক্ষ করা গেছে একধরনের সংঘবদ্ধতা। আলী এর বাইরে গিয়ে তাঁরা বেশ কিছু প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। সাংবাদিকতার চর্চার দিক থেকে তা অস্বাভাবিক নয়। কারণ, সাংবাদিকেরা চাইবেন এক্সক্লুসিভ করতে, স্কুপ বের করতে। এটা হলো সাংবাদিকদের পরিপ্রেক্ষিত। সাংবাদিকদের গৎবাঁধা প্রশ্নে বেঁধে ফেলা যাবে না। তাহলে তো আর সাংবাদিকতা থাকবে না। এটা হলো সাংবাদিকদের পরিপ্রেক্ষিত।

তবে এই সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের সঙ্গে মন্তব্যের রেশ ছিল। প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে তর্কাতর্কির মনোভঙ্গি লক্ষ করা গেছে। খুব স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর ব্যবহার করেও অনেক জটিল ও গুরুতর প্রশ্ন করা যায়। শেখ হাসিনার উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে সাংবাদিকেরাও উপদেষ্টার ‘ব্যক্তিগত’ মত জানতে চেয়েছেন। এখানে ব্যক্তিগত মত জানার কোনো সুযোগ নেই। এটি ব্যক্তিগত সংবাদ সম্মেলন নয়। সাংবাদিকেরা কোনো ব্যক্তিকে নয়, একটি কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করছেন।

দীপ্ত টিভির সাংবাদিক রহমান মিজান ১ হাজার ৪০০ খুন প্রসঙ্গে যে আদালতের রায়ের কথা বলেছেন, তা খুব ঠুনকো মনে হয়েছে। মানুষ জানে সরকার বা জাতিসংঘের তথ্যে খুনের সংখ্যা এক নয়। কিন্তু একটি খুনও প্রহণযোগ্য নয়। কেবল সংখ্যা দিয়ে খুনের ভয়াবহতা মাপা যায় না। রাজনৈতিক বাস্তবতা সব সময় আদালতের রায় দিয়ে চলে না। জনগণের বিবেচনায় প্রতিদিন অসংখ্য রায় হয়। আদালত বিচার করে আইনকানুনের কাঠামোয় আর জনগণ দেখে তার প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা দিয়ে। সংবাদমাধ্যম এই জনরায় নির্মাণের অংশ।

শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ হুকুমদাতা হিসেবে এসব খুনের সঙ্গে জড়িত, তা জানতে কি আদালতের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? এটি আইনি বিষয়ের চেয়েও কাণ্ডজ্ঞানের বিষয়। জনরায়ের বিষয়। মূলত এই জায়গাটি সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীলতা তৈরি করেছে। এ ধরনের প্রশ্নের ক্ষেত্রে আরও পেশাদারত্ব দরকার ছিল।

ঘ) প্রশ্ন কি করা যাবে না: প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন কাম্য। তাই বলে অপ্রাসঙ্গিক হলেও প্রশ্ন নিরুৎসাহিত করা যাবে না। প্রশ্ন নিরুৎসাহিত করলে সমাজ এগোবে না। সাংবাদিকতা প্রশ্ন ও অনুসন্ধাননির্ভর পেশা। প্রাসঙ্গিক হোক বা অপ্রাসঙ্গিক হোক প্রশ্ন করার কারণে কারও চাকরি চলে যাওয়া প্রহণযোগ্য নয়। এতে সাংবাদিকদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হয়। কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করতে তাঁরা শঙ্কাবোধ করেন।

শেখ হাসিনার পুরো শাসনামলে প্রশ্নহীন সাংবাদিকতার বাড়বাড়ন্ত দেখা গেছে। হোক প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক, অপ্রত্যাশিত, অস্বস্তিদায়ক, তাই বলে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে? সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, সাংবাদিকদের প্রশ্ন করাকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

ঙ) সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা: তিনটি টেলিভিশন চ্যানেল সহজে যা করত পারত, তা-ই করেছে। তিনজন কর্মীর চাকরি খেয়েছে। সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো সব সময় পিঠ বাঁচানোর জন্য তৎপর থাকে। কিন্তু যাঁদের পিঠের চাবুকের দাগে প্রতিষ্ঠানগুলোর সৌধ, তাঁদের সুরক্ষায় নির্বিকার দেখা যাচ্ছে। সাংবাদিকেরা কঠিন অসহায়ত্ব ও অনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছেন। এই তিনটি চাকরিচ্যুতি তাতে নতুন সংযুক্তি। চাকরি খাওয়া হলো চূড়ান্ত পদক্ষেপ। এর আগে অনেকগুলো পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো সেদিকে যায়নি।

সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ ক্রান্তিকালের মধ্যে পড়েছে। কারণ, আওয়াজ আসছে এসব সাংবাদিকের চাকরিচ্যুত না করলে প্রতিষ্ঠানগুলো অভিমুখে লংমার্চ করা হবে। সংবাদমাধ্যম কীভাবে চলবে, তার নিয়ন্ত্রণের ভার অনেকাংশে চলে যাচ্ছে মব বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে। ডেইলি স্টার বা প্রথম আলোর সামনে জিয়াফত বা অবস্থান কর্মসূচি এর বড় উদাহরণ হয়ে আছে। এই তিনটি টেলিভিশন চ্যানেলের হয়তো সেই চাপ নেওয়ার সক্ষমতা ছিল না। এ কারণে তারা নিজের স্বার্থ দেখেছে।

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারা কিছু বলেনি। তথ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দীপ্ত টিভির সংবাদ বন্ধের ব্যাপারে তাদের কোনো নির্দেশনা নেই। কেবল এ বিষয়ে নয়, সার্বিক বিবেচনায় সংবাদমাধ্যমের ওপর নানা দিক থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ বাড়ছে। অনেকে চাকরি হারাচ্ছেন। নানামুখী চাপে কমবেশি প্রতিটি সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে সংবাদ ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। আর তা ঘটেছে মূলত রাজনৈতিক চাপে। শেখ হাসিনার আমলে যে গণমাধ্যমকাঠামো গড়ে উঠেছিল, তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু তা পদ্ধতিগতভাবে সমাধান করতে হবে।

সরকারের অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে, গণমাধ্যমের ওপর কোনো চাপ নেই। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি তা বলছে না। চাপ না থাকলে কি গণমাধ্যম এমনি এমনি ভয় পাচ্ছে, চাকরি খাচ্ছে?

খান মো. রবিউল আলম যোগাযোগ পেশাজীবী ও শিক্ষক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স স ক ত ব ষয়ক উপদ ষ ট র পর প র ক ষ ত উপদ ষ ট র প রস ত ত ব দ কত র প রসঙ গ অবস থ ন দ র পর সরক র ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

রাজনৈতিক দলগুলোকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংস্কারের প্রতি প্রতিশ্রুতি দেখাতে হবে

বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের অবনতির পর্বে, গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। এ জন্য সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারের প্রতি শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিশ্রুতি দেখাতে হবে।

চলতি মাসে বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়া ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক উপকমিটির প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করা হয়েছে।

গতকাল বুধবার ফ্রান্সের স্ত্রাসবুর্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের দপ্তরে প্রতিবেদনটি পেশ করা হয়েছে। প্রতিবেদন উপস্থাপনের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ সফরে আসা প্রতিনিধিদলের প্রধান মুনির সাতোরি।

মুনির সাতোরি বলেন, ‘আমাদের সফরের দুটি উদ্দেশ্য ছিল। একটি হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করা ও গণতান্ত্রিক উত্তরণে মানবাধিকারের গুরুত্ব তুলে ধরা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, প্রায় বিস্মৃত হতে যাওয়া রোহিঙ্গাদের পাশে থাকা। রোহিঙ্গা সংকট যাতে হারিয়ে না যায়, সে জন্য এটি ইইউর রাজনৈতিক এজেন্ডায় আবারও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারকাজ নিয়ে মুনির সাতোরি বলেন, ‘এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে আমরা সহযোগিতার প্রস্তাব করেছি।’

প্রতিনিধিদলের সদস্য ইজাবেল উইসেলার-লিমা বলেন, যখন বিশ্বে নাটকীয়ভাবে গণতন্ত্র অবনতির পথে, তখন বাংলাদেশ পথ পরিবর্তন করে দেখিয়েছে যে গণতন্ত্রের পথে যাওয়া যায়। তারা চেষ্টা করছে গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার। আর এ জন্য সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এটা আশা করা জরুরি যে সামনে নির্বাচন হবে এবং তা প্রতিযোগিতামূলক হবে, যা হওয়া উচিত। অন্তর্বর্তী সরকার এ জন্য চেষ্টা করছে।

রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে ইজাবেল বলেন, ‘কক্সবাজার বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজা সংকটের কারণে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি মানুষ ভুলে যাচ্ছে। এ সংকট আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠেছে। কারণ, মিয়ানমার তাদের দায়িত্ব নিচ্ছে না। আর বাংলাদেশও দরিদ্র দেশ। বাংলাদেশের নিজেরই বিশাল জনসংখ্যা রয়েছে। ফলে রোহিঙ্গাদের জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিয়ে নেওয়া তাদের জন্য সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা সংকটের এখনকার চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাংলাদেশ বর্তমানে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে অবস্থায় রয়েছে।’

প্রতিনিধিদলের আরেক সদস্য আরকাদিউজ মুলারজিক বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিবিরে সবচেয়ে বেশি মানবিক অনুদান আসে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো থেকে, যদিও আগে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা দিত। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রতিশ্রুতি খুবই নগণ্য, এটি আশ্চর্যজনক এবং গ্রহণযোগ্য নয়। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বদলে অনেক দূরে থাকা ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোকে এর দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বড় অংশগ্রহণকারী হওয়া উচিত ছিল। বিষয়টি নিয়ে ভারতের সঙ্গেও কথা বলা উচিত। কারণ, বর্তমানে আমরা ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি নিয়ে দর–কষাকষি করছি।’

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিনিধিদলের সদস্য ক্যাটারিনা ভিয়েরা বলেন, এটি পরিষ্কার যে বাংলাদেশ ইতিহাসে দেশটি বর্তমানে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটি একটি সুযোগ সত্যিকারের অগ্রগতির। শিগগিরই হয়তো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের ভেতরে গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সবাই নির্বাচনটি স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দেখতে চায়। এ বিষয়গুলো শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের থেকে আসেনি, এসেছে নাগরিক সমাজ, ছাত্র ও যুব আন্দোলনের পক্ষ থেকেও, যাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। তারা নিজেদের মধ্যে সংলাপের মধ্যে রয়েছে। যদিও অনুতাপের বিষয় হচ্ছে ধর্মীয়, লিঙ্গ ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু এবং নারীদের এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ নেই। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সমাজ গঠনে এখানে উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে।

আরকাদিউজ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে সংস্কারে উৎসাহ, যারা সংস্কারে কাজ করছেন, তাঁদের প্রতি সংহতি প্রকাশ ও গণতান্ত্রিক কাঠামোয় গঠনমূলক সহযোগিতা করে ইইউ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্ব যখন গণতন্ত্রের উল্টো পথে যাত্রা করছে, তখন বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের আশা করার অবকাশ রয়েছে। গণতন্ত্রের পথে আরও অনেক কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় বাংলাদেশ সামনে দিকে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেবে বলে মনে করি। এটি এখন নির্ভর করছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারের প্রতি শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিশ্রুতি দেখাতে হবে।’

১৬ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার উপকমিটির পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশ সফর করে। এ সময়ে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল, বেসরকারি সংস্থা, নাগরিক সমাজ সংগঠন, শ্রমিক প্রতিনিধি এবং মাঠপর্যায়ে কর্মরত বহুপক্ষীয় সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে।

এ ছাড়া প্রতিনিধিদলটি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরও পরিদর্শন করে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ