মানুষের আত্মহত্যার বহুবিধ কারণ রয়েছে। পুলিশ যেহেতু মানুষ, তাই পুলিশও আত্মহত্যা করতে পারে। এটি যেমন একদিক থেকে স্বাভাবিক, আবার অন্যদিক থেকে কিছুটা অস্বাভাবিক।
কেননা সাধারণ মানুষের থেকে পুলিশের তফাত আছে। পুলিশের প্রশিক্ষণ আছে। একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য যখন আত্মহত্যার মতো পথকে বেছে নেন, তখন এর নেপথ্যের বিষয়গুলোকে আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ কিংবা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে।
৭ মে আমার এক জুনিয়র সহকর্মী পুলিশ কর্মকর্তার মরদেহ তাঁর কার্যালয় থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। যেসব তথ্য ও আলামত পাওয়া গেছে, তাতে এটি প্রায় নিশ্চিত, তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
আরও পড়ুনপুলিশ সংস্কারের সুপারিশ: যা কিছু বাদ পড়ে গেল২২ জানুয়ারি ২০২৫এটি সত্যিই দুঃখজনক, অত্যন্ত বেদনার। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে সুইসাইডাল নোটের বরাতে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে পারিবারিক অশান্তি কিংবা কলহের জেরের বিষয়টি উঠে এসেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা যেটিকে কেবল পারিবারিক কলহ হিসেবে সাধারণীকরণ করে ফেলছি, বিষয়টি কি আসলে ততটুকু, নাকি এর চেয়ে গভীর কিছু?
পুলিশ সদস্যদের আত্মহত্যার ঘটনা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটে চলছে। গত ৯ জানুয়ারি থানা ভবনের একটি কক্ষ থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
এরপর গত ২৩ জানুয়ারি পটুয়াখালী জেলা পুলিশ লাইনসের ব্যারাকে এক নারী পুলিশ সদস্য গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এমন অনেক উদাহরণ আছে।
আরও পড়ুনপুলিশের যে সমস্যাগুলোর কথা কেউ বলে না ০৯ মার্চ ২০২৫আপনি যদি এসব আত্মহত্যার কারণগুলোকে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী পর্যালোচনা করেন, তাতে দেখবেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কারণ হিসেবে বলা হয়েছে মানসিক রোগ, পারিবারিক কলহ, কাজের চাপ, কিছু ক্ষেত্রে প্রেমঘটিত বিষয়।
বিশেষ করে জুনিয়র পুলিশ সদস্যদের আত্মহত্যার অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হলো পারিবারিক বা প্রেমঘটিত বিষয়। এখন প্রশ্ন হলো, এসব কারণের নেপথ্যের ঘটনা কী? কেন এমনটা হচ্ছে?
মাঠপর্যায়ে চাকরির সুবাদে পুলিশের কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যার বিষয় প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে, যেগুলোকে আমরা কখনোই একাডেমিক ডিসকোর্সে বড় আকারে আলোচনা করতে চাই না।
কনস্টেবল ও সাব-ইন্সপেক্টর পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যার ঘটনাগুলোর উল্লেখযোগ্য দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে, পুলিশের চাকরির শর্ত অনুযায়ী তারা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিয়ে করতে পারেন না।
আরও পড়ুনপুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানো বন্ধ হবে কি২৩ জানুয়ারি ২০২৫অর্থাৎ এসব পদে আবেদনের শর্তেই উল্লেখ করা থাকে, অবিবাহিত থাকতে হবে। এ ছাড়া তাঁদের চাকরি স্থায়ী হওয়া পর্যন্ত বিয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, তাঁদের ভালোবাসার মানুষটি হয়তো তাঁকে ওই পর্যন্ত সময় দিতে চাচ্ছেন না কিংবা যেহেতু পুলিশের প্রশিক্ষণের জন্য দূরে থাকতে হয়, তাই লং ডিসটেন্স রিলেশনশিপের কারণে সমস্যা তৈরি হতে থাকে।
তখন ভালোবাসার মানুষের পক্ষ থেকে বিয়ের চাপ আসতে থাকে, অন্যদিকে অস্থায়ী অবস্থায় বিয়ে করলে চাকরি হারানোর ঝুঁকিও থাকে।
যেহেতু সব মানুষের মানসিক সামর্থ্য এক নয়, তাই এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলাতে না পেরে কিংবা ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে আত্মহননের মতো পথকে বেছে নেন।
এখানে মৌলিকভাবে আমাদের এ প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন, নির্দিষ্ট পদের চাকরির ক্ষেত্রে কেন আমাদের অবিবাহিত হওয়ার শর্ত রাখতে হবে? বিয়ে মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়।
আরও পড়ুনপুলিশ কেন স্বাধীন কমিশন চায়১৮ মার্চ ২০২৫এমন শর্ত এখনো আমাদের রাখার প্রয়োজন আছে কি না। এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বা ইম্পেরিয়াল উপযোগিতা আছে কি না, তা আমাদের গভীরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত।
সারা পৃথিবীতেই পুলিশের চাকরি স্ট্রেসফুল। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই চাপ অনেক বেশি। পুলিশ আইনে বলা হয়েছে, পুলিশ সদস্যদের ২৪ ঘণ্টার জন্য কাজে নিয়োজিত থাকতে হয়।
এটি অন্যান্য সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে লেখা থাকলেও পুলিশের মতো খুব কম পেশা আছে, যেখানে আসলে এমন লম্বা সময় ধরে ডিউটি করতে হয়।
লম্বা সময়ের ডিউটির পাশাপাশি আরেকটি বিষয় হলো অনির্দিষ্ট ডিউটি। যেমন খুব কমসংখ্যক পুলিশ সদস্যই জানেন, আগামীকাল তাঁকে কতক্ষণ পর্যন্ত ডিউটি করতে হবে। কোথায় ডিউটি হবে, সেটি জানতে পারলেও কখন ডিউটি শেষ হবে, সেটি অধিকাংশ সময়েই নির্দিষ্ট থাকে না।
আরও পড়ুনপুলিশ সংস্কার কি আদৌ হবে, কতটুকু হবে২৯ মার্চ ২০২৫এ কারণে পুলিশ সদস্যরা চাইলেও তাঁর মতো করে নিজেকে নিয়ে পরিকল্পনা সাজাতে পারেন না। এ কারণে ধীরে ধীরে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সদস্য কিংবা ভালোবাসার মানুষের একধরনের দূরত্ব বাড়তে থাকে।
ফলে তা ক্রমেই পারিবারিক কলহ কিংবা সম্পর্কের অবনতির দিকে ধাবিত করে। আপনি যদি কোনো পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসা করেন, গত এক বছরের কতগুলো পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন, আপনি দেখবেন, খুব ব্যতিক্রম ছাড়া অনেকেরই উত্তর থাকবে, তিনি অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় পাননি কিংবা যেতে পারেননি।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য সরকারি চাকরি কিংবা বেসরকারি পর্যায়ের চাকরিতে যেখানে শুক্র-শনিবার কিংবা অন্যান্য বন্ধের দিনে ছুটি পাওয়া যায়, সেখানে পুলিশ সদস্যদের এসব দিনে যেন আরও বেশি ডিউটি পালন করতে হয়।
এ কারণে অন্যান্য পেশার মানুষেরা যেখানে বছরে কমপক্ষে ১১০ দিন অতিরিক্ত ছুটি পেয়ে থাকেন, সেখানে অধিকাংশ পুলিশ সদস্য তেমন সুযোগ পান না। কেননা ঘটনা ঘটলেই পুলিশকে রেসপন্স করতে হয়।
ঘটনা-দুর্ঘটনা তো আর বন্ধ-খোলার দিন দেখে হয় না। আমি আমার চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এমন বন্ধের দিনগুলোতে যখন পুলিশ সদস্যদের নিয়মিতভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়, তা ব্যাপকভাবে তাঁর ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলে।
এতে ক্রমেই স্ত্রী-সন্তান, পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে। যেহেতু নানা আয়োজনে, পালা-পার্বণে পুলিশ সদস্যকে তাঁর পরিবার বা প্রিয়জন কাছে পায় না, কাজেই তাঁকে ছাড়াই পরিবারকে চলতে হয়। ফলে সময়ের ব্যবধানে পুলিশ সদস্য নিজের অজান্তেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
পুলিশের অভ্যন্তরীণ আরেকটি বড় সমস্যা হলো, কিছু হলেই ট্রান্সফার আর ঠুনকো কারণে শাস্তি প্রদান। আপনি দেখবেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগ ওঠামাত্রই পুলিশ সদস্যকে ট্রান্সফার কিংবা ক্লোজ করে দেওয়া হয়।
এটি তদন্তের নিরপেক্ষতার স্বার্থে করা হলেও তদন্তে যদি ওই পুলিশ সদস্য নিরপরাধ প্রমাণিত হন, তবু তাঁকে আসলে আগের পদে বা স্থানে পদায়ন করা হয় না।
প্রায় ৮৩ শতাংশ পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাতে ঘুমের সমস্যা হয়। উত্তরদাতা প্রায় ৯৫ শতাংশ পুলিশ সদস্য মনে করেন, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে তাঁদের কাউন্সেলিং করার প্রয়োজন রয়েছে। পুলিশ সদস্যরাও মানুষ। কিন্তু বিদ্যমান আইন, আমাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতা অনেক সময় সেই সত্যকে পাশ কাটিয়ে যায়।অর্থাৎ আপনি দোষ না করলেও কেবল অভিযোগ ওঠার কারণেই আপনাকে শাস্তি পেতে হয়। অন্যদিকে একটি পত্রিকার গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদনে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান সদস্যসংখ্যা ২ লাখ ১২ হাজার।
বিভিন্ন অভিযোগে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ২ লাখ ৬৮ হাজার ৭২১টি ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের সাজা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২ লাখ ৪৫ হাজার ১৭১টি লঘুদণ্ড ও ২৩ হাজার ৫৫০টি গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে পুলিশের সাজার হার প্রায় ১২৭ শতাংশ।
এত বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্যের শাস্তির ঘটনা ভীতিকর। কিন্তু এখানে যে গুরুতর প্রশ্নটি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন, কেন পুলিশ সদস্যরা এত আইন ভাঙছেন? এর নেপথ্যের কারণগুলো আসলে কী?
তার জন্য আসলে কি ব্যক্তি পুলিশ সদস্য দায়ী, নাকি সিস্টেম? আসল কারণ চিহ্নিত না করে কেবল শাস্তি দিতে থাকলে অবস্থার উন্নতি হবে, এমনটা আশা করাও বাতুলতা।
বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যদের নানা ধরনের চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এসব চাপ চাকরির শুরুর দিন থেকে শুরু হয়, আজীবন যেন বয়ে বেড়াতে হয়। অথচ এই স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।
কয়েক দিন আগে পুলিশ সমর্থকদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে ব্যক্তিগতভাবে আমি একটি জরিপ করেছিলাম। তাতে বিভিন্ন পদমর্যাদার ২৯২ জন পুলিশ সদস্য অংশগ্রহণ করেন।
তাঁদের ৯৮ শতাংশ মনে করেন, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো না কোনো ধরনের তাঁরা মানসিক চাপে ভুগছেন। প্রায় ৯১ শতাংশ পুলিশ সদস্য মনে করেন, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে না পারার কারণে মানসিক চাপ অনুভব করেন।
প্রায় ৮৩ শতাংশ পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাতে ঘুমের সমস্যা হয়। উত্তরদাতা প্রায় ৯৫ শতাংশ পুলিশ সদস্য মনে করেন, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে তাঁদের কাউন্সেলিং করার প্রয়োজন রয়েছে।
পুলিশ সদস্যরাও মানুষ। কিন্তু বিদ্যমান আইন, আমাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতা অনেক সময় সেই সত্যকে পাশ কাটিয়ে যায়।
কিছু ঘটলেই আমরা যেভাবে দোষ দিই, তেমনিভাবে পুলিশের বিদ্যমান সমস্যাগুলো জেনে, সেগুলোর সমাধান করাও জরুরি। কারণ, ‘শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে’।
মো.
ইমরান আহম্মেদ পিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ; বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইকের পিএইচডি গবেষক।
ই–মেইল: [email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ প ল শ সদস য অন য ন য চ কর র র চ কর আম দ র র জন য পর ব র সমস য র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পদত্যাগ করলেন মীর স্নিগ্ধ
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের চতুর্থ বোর্ড সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
স্নিগ্ধ এখন এ ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।