চট্টগ্রামের আনোয়ারায় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) বিভিন্ন খাল পুনর্খনন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করিতে গিয়া বৃক্ষনিধনের যজ্ঞ চলিতেছে, উহা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। শনিবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদন বলিতেছে, উপজেলার চারটি খালের ৪০ কিলোমিটার পুনর্খনন করিতে গিয়া ইতোমধ্যে খালসমূহের দুই পার্শ্বের বিভিন্ন প্রজাতির পাঁচ সহস্রাধিক বৃক্ষ কাটিয়া ফেলা হইয়াছে। শুধু উহা নহে, খাল পুনর্খনন সম্পূর্ণ শেষ করিতে হইলে সেখানে আরও পাঁচ সহস্র বৃক্ষ কাটিতে হইতে পারে বলিয়া আশঙ্কা স্থানীয়দের। পরিহাসের বিষয় হইল, বিএডিসি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের অংশ হিসেবে উক্ত খাল খননের উদ্যোগ গ্রহণ করিয়াছে; অথচ উহার জন্য যে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত প্রয়োজন তাহা সম্ভব হয় কেবল প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক থাকিলে, যেখানে বৃক্ষের অবদান অপরিসীম। এহেন আয়োজনকে নাকের বদলে নরুন পাইবার আয়োজন বলিলে কি ভুল হইবে?
বিস্ময়কর হইলেও সত্য, খাল খননের কর্মে নিয়োজিত যান্ত্রিক খনক চলাচলের সুবিধার্থে নাকি দুই পাশের বৃক্ষসমূহ কাটা হইতেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই বিপুল অগ্রগতির যুগে এই সর্বনাশা কথা কতখানি গ্রহণযোগ্য? বাস্তবে ইহা প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের খামখেয়াল অথবা কাষ্ঠ ব্যবসায়ীদের সহিত উহাদের অশুভ কোনো আঁতাতের ফল কিনা তাহা খতাইয়া দেখা প্রয়োজন। প্রতিবেদন মতে, বিএডিসির এহেন সিদ্ধান্তের কারণে সংশ্লিষ্ট বৃক্ষমালিকরা বৃক্ষসমূহকে বিক্রয় করিয়া দিতে বাধ্য হইতেছেন।
অধিকতর বিস্ময়কর হইল, পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক বলিয়াছেন, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত নহেন। অথচ সরকারি-বেসরকারি যে কোনো প্রকল্পে বৃক্ষ কর্তন তো বটেই, অন্য পরিবেশগত জটিলতা এড়াইবার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণ করিতে হয়। অন্তত পরিবেশ আইনে উহাই বলা আছে। বন বিভাগ বা পরিবেশ অধিদপ্তরের এহেন কর্তব্যে অবহেলা এই প্রথম দেখা গেল তাহা নহে। অতীতে ইহার ভূরি ভূরি নজির রহিয়াছে। আমরা জানি, আন্তর্জাতিক নিয়মে পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষায় একটা রাষ্ট্রে মোট ভূখণ্ডের অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকিতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে আছে মাত্র ৯ শতাংশ বা তাহার কিছু কমবেশি। ইহাও জানিয়া রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশের এই বনভূমির একটা অংশ কথিত সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির অধীনে রোপিত বৃক্ষ, যাহা কোনো প্রকারেই প্রাকৃতিক বনের বিকল্প নহে। এহেন বৃক্ষ কর্তনের পরিণাম কী হইতে পারে তাহা নূতন করিয়া বলার কিছু নাই। জলবায়ু পরিবর্তনের যে নেতিবাচক প্রভাব লইয়া সমগ্র বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হইয়াছে, উহাতে পাইকারি বৃক্ষ কর্তনের ভূমিকা কম নহে। বাংলাদেশে বিশেষত গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা যে ইদানীং অসহনীয় হইয়া উঠিয়াছে, বিশেষজ্ঞরা উহার দায় বহু বৎসর ধরিয়াই অন্যান্য বিষয়ের সহিত বন ধ্বংস ও নির্বিচার বৃক্ষ কর্তনের উপরও দিয়া আসিতেছেন। দুর্ভাগ্যবশত, দেশের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে যদ্রূপ ইহাতে কর্ণপাত করিবার কোনো আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় না, তদ্রূপ মাঠ পর্যায়েও একই বিষয়ে সচেতনতা দৃশ্যমান নহে।
আলোচ্য খাল খনন কর্মসূচি যে গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত স্থানীয় কৃষি উৎপাদনের জন্য সহায়ক, তাহা লইয়া কোনো বিতর্ক নাই। কিন্তু এহেন একদেশদর্শী উন্নয়ন যে চূড়ান্ত বিচারে সমূহ ক্ষতি ঘটায় সেই জ্ঞানও থাকা প্রয়োজন। উন্নয়ন হইতে হইবে টেকসই উন্নয়ন, যেখানে পরিবেশ-প্রতিবেশের সংরক্ষণ একটা জরুরি বিষয়। তাহা না হইলে জনগণের বিপুল অর্থ ব্যয়ে হয়তো মাইলের পর মাইল খাল খনন হইতে পারে, সেই খালে হয়তো কিছুকাল পানিও থাকিতে পারে, এক পর্যায়ে সেই পানি শুকাইয়া যাইবে। তখন উক্ত প্রকল্পের পশ্চাতে ব্যয়িত অর্থ অপচয় বলিয়াই গণ্য হইবে। আমরা মনে করি, অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টিতে নজর দেবেন, সেচ প্রকল্পের নামে বৃক্ষ কর্তন শুধু বন্ধই নহে, এহেন অপকর্মের সহিত যুক্ত কর্মকর্তাদের আইনের আওতায়ও আনিবেন।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: খ ল খনন প রকল প পর ব শ
এছাড়াও পড়ুন:
মামদানির জয় থেকে ডেমোক্র্যাটরা কি শিক্ষা নেবেন
ডেমোক্রেটিক পার্টি এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। পার্টি চাইলে আগের মতোই এমন সব নীতি চালিয়ে যেতে পারে, যেসব নীতি বস্তাপচা ও পক্ষপাতদুষ্ট অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আঁকড়ে বসে আছে। চাইলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সেই ৬০ শতাংশ মানুষের কষ্টকে কোনো রকম পাত্তা না দিয়েও চলতে পারে, জীবন চালাতে হিমশিম খাওয়া যে মানুষগুলো সপ্তাহ শেষে বেতন পাওয়ার পরের দিনই পরবর্তী বেতনের জন্য দিন গোনে।
ডেমোক্র্যাটরা চাইলে সেই তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নকে অবহেলা করতে পারেন, যে প্রজন্ম সম্ভবত তাদের মা-বাবার চেয়েও খারাপ সময়ের মুখোমুখি হবে। তাঁরা চাইলে কোটি কোটি ডলার চাঁদা দেওয়া ধনকুবের আর বাস্তবতা না-জানা সেই পরামর্শকদের ওপর নির্ভর করে চলতে পারেন, যাঁরা লাখ লাখ ডলার খরচ করে দলের প্রচারে একঘেয়ে, ক্লিশে ও সাধারণ মানুষের কাছে গুরুত্বহীন ৩০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপন বানান।
ডেমোক্র্যাটরা চাইলে সেই ভয়াবহ বাস্তবতাকেও এড়িয়ে যেতে পারেন, যে বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের কোটি কোটি নাগরিক গণতন্ত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কারণ, তারা অনুভব করে না যে সরকার তাদের জীবনযন্ত্রণা বোঝে বা কোনো সমাধান দিতে চায়। অথবা ডেমোক্র্যাটরা চাইলে জোহরান মামদানির মঙ্গলবারের বিজয় থেকে একটি শিক্ষা নিতে পারেন। সেই শিক্ষা হলো, মানুষের মুখোমুখি হয়ে প্রকৃত অর্থনৈতিক ও নৈতিক সংকটগুলো সাহস করে তুলে ধরতে হবে। সেই সঙ্গে ধনিক শ্রেণির লোভ ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে এবং এমন একটি কর্মসূচির পক্ষে লড়তে হবে, যা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনকে উন্নত করতে পারে।
মোদ্দাকথা, ডেমোক্রেটিক পার্টির সামনে এখন দুটি রাস্তা। একটি হলো পুরোনো ভুল পথে চলতে থাকা; আরেকটি হলো, সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নতুন কিছু করা। অনেকে বলছেন, মামদানির বিজয় কেবল তাঁর ব্যক্তিত্ব আর ক্যারিশমার ফল। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তিনি এক চমৎকার প্রার্থীর উদাহরণ। কিন্তু শুধু ভালো প্রার্থী থাকলেই এমন বিজয় আসে না। জয়ের পেছনে থাকতে হয় অসাধারণ এক তৃণমূল আন্দোলন। হাজার হাজার মানুষ যদি আগ্রহ নিয়ে দরজায় দরজায় গিয়ে তাঁর পক্ষে প্রচার না করত, তবে এমন জয় সম্ভব হতো না।
বর্তমান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা মামদানির নির্বাচনী প্রচারণা থেকে শিক্ষা নেবেন কি না, সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। সম্ভবত নেবেন না। কারণ, তাঁদের অনেকেই এমন অবস্থায় আছেন, যেখানে তাঁরা নিজেরাই সেই ডুবতে থাকা জাহাজ ‘টাইটানিক’-এর ক্যাপ্টেন হয়ে থাকতে চান; কিন্তু দিক পরিবর্তন করতে চান না।আর এই আন্দোলন গড়ে ওঠে তখনই, যখন এর পেছনে থাকে এমন একটি অর্থনৈতিক কর্মসূচি, যা সাধারণ মানুষের প্রয়োজন আর কষ্টের কথা বলে। নিউইয়র্কের মানুষ এবং গোটা আমেরিকান জনতা জানে, এই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ হিসেবে পরিচিত একটি দেশে কারও জন্য শুধু খাওয়া, ঘরভাড়া দেওয়া বা ডাক্তার খরচ মেটাতে যুদ্ধ করার মতো কষ্ট করা উচিত নয়।
ডেমোক্রেটিক পার্টির পেইড কনসালট্যান্টরা হয়তো জানেনই না, এই সাধারণ মানুষগুলো আসলে কী চায়, তারা কোথায় থাকে। মামদানির ‘চরমপন্থী’ বা ‘অবাস্তব’ অর্থনৈতিক নীতির সমালোচনা হচ্ছে ঠিকই; কিন্তু তৃণমূল মানুষ জানে, এই নীতিগুলো আসলে তাদেরই কথা বলছে।
আজকের দুনিয়ায় যেখানে ধনী আর সাধারণ মানুষের মধ্যে আয় ও সম্পদের পার্থক্য ভয়াবহ রকম বেড়ে গেছে, সেখানে ধনী ব্যক্তি আর বড় করপোরেশনগুলোর উচিত তাদের ন্যায্য পরিমাণ কর দেওয়া। মামদানির মতো নেতাদের দাবি এটিই। যখন অনেক নিউইয়র্কবাসী আর সস্তায় ভাড়া বাসা খুঁজে পাচ্ছে না, তখন ভাড়া না বাড়ানোর জন্য একটি স্থগিতাদেশ দরকার—এটিও মামদানির দাবি। যখন একজন শ্রমিকের প্রতিদিন কর্মস্থলে যাওয়া-আসার পেছনে বেতনের একটি বড় অংশ চলে যায়, তখন গণপরিবহন বিনা মূল্যের হওয়া উচিত। এটিও মামদানির ভাবনা।
আরও পড়ুনজোহরান মামদানি যেভাবে ইতিহাস বদলে দেওয়ার পথে২৬ জুন ২০২৫যখন অনেক নিম্নবিত্ত ও খেটে খাওয়া পরিবার ভালো খাবার কিনতে পারছে না; তাদের জন্য সরকার পরিচালিত পাড়াভিত্তিক মুদিদোকান প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এই দাবিও এসেছে তাঁর পক্ষ থেকে। এসব দাবি শুনে অনেকেই বলবে ‘চরমপন্থী’। কিন্তু আসলে এগুলো খুবই সাধারণ মানুষের বাস্তব চাহিদা। হ্যাঁ, ধনীরা বা বড় দাতারা বা রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা হয়তো এসব চান না। কিন্তু সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ঠিক এই জিনিসগুলোই চায়। তাই হয়তো এখন সময় এসেছে এই মানুষগুলোর কথা শোনার।
মামদানির জয় কোনো তারকাখ্যাতির জন্য হয়নি। এটি হয়েছে সাধারণ মানুষের শক্তিতে। এই আন্দোলন মানুষকে আবার মনে করিয়ে দিয়েছে, গণতন্ত্র মানে কেবল ভোট নয়, বরং নিজের জীবনে যেসব সিদ্ধান্ত প্রভাব ফেলে, সেগুলো নিয়ে কথা বলার অধিকার দাবি করাও গণতন্ত্র। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, মামদানি সেই নৈতিক প্রশ্ন থেকে পালিয়ে যাননি, যা শুধু নিউইয়র্ক নয়, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে কোটি মানুষের মনে আঘাত দিচ্ছে। সেটি হলো ইসরায়েলের চরমপন্থী নেতানিয়াহুর সরকারের গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র যেন সামরিক সহায়তা না দেয়। গাজার শিশুদের অনাহারে মারা যাওয়া কেউ চোখ বন্ধ করে মেনে নিতে পারে না।
মামদানি জানেন, আসলেই, ইহুদিবিদ্বেষ (অ্যান্টিসেমিটিজম) একটি জঘন্য ও বিপজ্জনক চিন্তাধারা। কিন্তু নেতানিয়াহুর মতো একজন নেতার অমানবিক নীতির সমালোচনা করা মানেই ইহুদিবিদ্বেষ নয়। মামদানির নির্বাচনী লড়াই আমাদের শেখায়, শুধু ট্রাম্পের বা তাঁর ধ্বংসাত্মক নীতির সমালোচনা করলেই চলবে না; আমাদের দরকার একটি ইতিবাচক ভবিষ্যৎ চিন্তা। দরকার এ প্রশ্নের জবাব—এই পরিস্থিতি কেন হলো, কেন আজ অধিকাংশ আমেরিকান পিছিয়ে পড়ছে?
বর্তমান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা মামদানির নির্বাচনী প্রচারণা থেকে শিক্ষা নেবেন কি না, সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। সম্ভবত নেবেন না। কারণ, তাঁদের অনেকেই এমন অবস্থায় আছেন, যেখানে তাঁরা নিজেরাই সেই ডুবতে থাকা জাহাজ ‘টাইটানিক’-এর ক্যাপ্টেন হয়ে থাকতে চান; কিন্তু দিক পরিবর্তন করতে চান না। তবে তাঁরা কী ভাবছেন, সেটা এখন খুব একটা গুরুত্বপূর্ণও নয়। কারণ, মামদানির বিরুদ্ধে এই ‘সিস্টেম’-এর পক্ষ থেকে সবকিছুই মাঠে নামানো হয়েছিল। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের সুপার প্যাক অর্থায়ন, নামীদামি মানুষের সমর্থন, পক্ষপাতদুষ্ট গণমাধ্যম—সব নামানো হয়েছিল। তবু তাঁরা মামদানিকে হারাতে পারেননি।
● বার্নি স্যান্ডার্স মার্কিন সিনেটর এবং সিনেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শ্রম ও পেনশন-সংক্রান্ত কমিটির প্রধান সদস্যদের একজন
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ