দেশে কাঠামোগত সংস্কারের অভাবে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা শোনা গেছে। কিন্তু বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সে তুলনায় হয়নি। অন্যদিকে  বৈষম্য প্রকট হয়েছে। ‘বাংলাদেশ ২০৩০: অংশীদারিত্বমূলক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা এমন মত দিয়েছেন। গতকাল শনিবার রাজধানীর হোটেল শেরাটন, ঢাকায় এর আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই)। প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এতে প্রধান অতিথি ছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন পিআরআই চেয়ারম্যান জায়েদী সাত্তার।

অনুষ্ঠানে লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, ‘যেদিকে তাকাই না কেন, কোনো সিন্ডিকেটকে সক্রিয় দেখি। আমরা এসব জায়গায় কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে পারছি না। কারণ, আমলারা তাদের সুবিধাজনক কাঠামো ভাঙতে চান না। আবার অনেক ব্যবসায়ী কাঠামোগত পরিবর্তনের কথা বলেন। অথচ তারা নিজেরাই সুবিধা নেওয়ার তদবির করে থাকেন, যা পুরো পরিবর্তনের প্রয়াসকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। অর্থনীতির অবস্থা জানার শ্বেতপত্র এবং অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সুপারিশের আলোকে অনেক প্রতিষ্ঠানে সংস্কার আনা হয়েছে। এ বিষয়ে কাজ অব্যাহত আছে। 
প্রকাশিত গ্রন্থের লেখক এবং পিআরআইর ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ বলেন, দেশের জাতীয় উন্নয়নযাত্রা কিছু সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক শাসনের অভাব, দুর্নীতি, পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাব, আয় বৈষম্য বৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয় স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়নের জন্য হুমকি। এই গ্রন্থে এসব চ্যালেঞ্জের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড.

ফাহমিদা খাতুন বলেন, গত শাসন আমলে দেশে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এবং সামরিক-বেসামরিক  আমলাতন্ত্র মিলে একটি শক্তিশালী স্বার্থবাদী চক্র তৈরি করেছে। তাদের সুবিধা, নিরাপত্তা ও ক্ষমতা ভোগের জন্য সরকারি নীতি নেওয়া হয়েছে, যা অর্থনীতিকে সঠিকভাবে কার্যকর হতে দেয়নি। মূলত এ কারণেই কোনো ক্ষেত্রে কাঠামোগত সংস্কার  হয়নি। যদিও সংস্কারের কথাও বহুদিন ধরেই বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রভৃতি জায়গায় সেখানে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন দেখা যায়নি। পাশাপাশি সংসদ, বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। আবার  অর্থনীতির যতটুকু উন্নতি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি উন্নয়ন হতে পারত। যতটুকুই উন্নতি হয়েছে, তার মধ্যে অসমতা ছিল দৃষ্টিকটু পর্যায়ের। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, সংস্কারের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর অনাগ্রহ। দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষুদ্র পরিসরের কিছু সংস্কারে আগ্রহী হলেও বৃহৎ বা কাঠামোগত সংস্কারে রাজি থাকে না। এ প্রবণতা গত দুই দশক বা তারও বেশি সময় ধরে চলমান। এটি কোনো একক রাজনৈতিক দলের সমস্যা নয়, বরং প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলেরই বৈশিষ্ট্য। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নাগরিক সমাজ  কিংবা সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকেও জোরালো দাবি  তোলা  হয়নি। তিনি বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় গঠিত শ্বেতপত্র ও টাস্কফোর্সের সুপারিশগুলোও  বাস্তবায়ন হচ্ছে না, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। 

এপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, দেশে করব্যবস্থার সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হয়েছিল ২০১১ সালের দিকে। উচ্চ শুল্ক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় বাধা। আমরা এখন মুক্তবাণিজ্য চুক্তির কথা বলছি। কিন্তু এর জন্য অন্যতম বড় বাধা উচ্চ করহার। 
আইএফসির কান্ট্রি ম্যানেজার মার্টিন হল্টম্যান বলেন, মানবসম্পদ উন্নয়নে গুণগত শিক্ষা এবং কর্মমুখী শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে বাংলাদেশকে। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ক ঠ ম গত স স ক র র জন ত ক ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব জাতীয় অগ্রগতির পথে বাধা: আনিসুজ্জামান চৌধুরী

বাংলাদেশে বাজেট পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তার অভাব এবং নীতির সমন্বয়হীনতা জাতীয় অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। বাজেট তৈরি হয়, কিন্তু যথাযথ উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হয় না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বাজেট নিয়ে এক আলোচনায় এমন মত দিয়েছেন। 

সোমবার মেট্রোপলিটান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ঢাকা (এমসিসিআই) এবং গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত ‘বাজেট বিষয়ক উপলব্ধি: চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ’ শীর্ষক এ আলোচনায় তিনি প্রধান অতিথি ছিলেন। 

ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা জানতে হবে। পরিকল্পনা কত বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে এবং কীভাবে অর্থায়ন করবে– এসব প্রশ্ন তাদের করতে হবে। এগুলো ছাড়া বাজেট শুধু কিছু টুকরোর সমন্বয় হিসেবে থাকবে। 

রাজধানীর গুলশানে পুলিশ প্লাজায় এমসিসিআইর নিজস্ব কার্যালয়ে আলোচনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সভাপতি কামরান টি. রহমান। পিআরআইর চেয়ারম্যান ড. জাইদি সাত্তার সূচনা বক্তব্য দেন। পিআরআইর গবেষণা পরিচালক ড. বজলুল হক খন্দকার এবং এমসিসিআইয়ের শুল্ক ও কর বিষয়ক কমিটির সদস্য আদীব এইচ খান আলাদা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। 

ড. আনিসুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠী বিশাল। কিন্তু তাদের জন্য সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা নেই। ১৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সী মানুষ দেশের ৩০ শতাংশ। জাতীয় নেতৃত্বের গড় বয়স ৭৫ বছর। তারা তরুণদের আকাঙ্ক্ষা ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারেন? 

তিনি তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য একক জাতীয় সেবা চালুর ধারণা দেন। যেখানে তরুণদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ, আইটি প্রশিক্ষণ এবং সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক হবে। এতে মাদকাসক্তি কমবে, শ্রম উৎপাদনশীলতা বাড়বে এবং জাতীয় বাজেটের ওপর চাপও তুলনামূলকভাবে কমবে।

আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, দেশের ছেলেমেয়েরা যখন আন্তর্জাতিক মানের সফটওয়্যার বানাতে পারে, তখন বিদেশি সফটওয়্যার কেন লাগবে? সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশি সফটওয়্যার ব্যবহারের শর্ত থাকে, যার ফলে দেশীয় সক্ষমতা উপেক্ষিত হয়। আত্মনির্ভর হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হয়। জাতীয় তথ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়ে। 

তিনি বলেন, কোরিয়ার অর্থনৈতিক সংকটের সময় তাদের সাধারণ মানুষ স্বর্ণ দান করেছে। কারণ তারা বিশ্বাস করতো যে, জাতি আগে। আমাদের সমস্যা হলো, আমরা আশা হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের কোনো লক্ষ্য নেই, ঐক্য নেই। নিজেদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা না করে বিদেশে চিকিৎসা, শিক্ষা এবং টাকা পাচারকেই সমাধান ভাবী। অথচ থাইল্যান্ডের রাজা বিদেশে চিকিৎসা না নিয়ে নিজ দেশে আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল গড়েছেন, যার ফল তারা পাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক, পরিকল্পনা কমিশন, এনবিআর– সবার গবেষণা বিভাগ আছে। কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে সমন্বয় করে না। এক মন্ত্রণালয় যে রাস্তা বানায়, পরদিন আরেক মন্ত্রণালয় তা  কেটে ফেলে। এতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হয়। নীতির সংহতি ও সমন্বয় ছাড়া কোনো কার্যকর পরিকল্পনা সম্ভব নয়।  

আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রসঙ্গে ড. আনিসুজ্জামান বলেন, এটি নিখুঁত না হলেও ব্যবসাবান্ধব। সবাই কর ছাড় চায়। কিন্তু নিজে থেকে কর দিতে চায় না। অনেকে মনে করেন, বিদেশিরা ঋণ দিয়ে আমাদের উন্নয়ন করবে।  কিন্তু প্রকৃত অংশীদারিত্ব তখনই হয়, যখন কেউ এসে বিনিয়োগ করে এবং  প্রযুক্তি দেয়। বিদেশি সহায়তা নয়, বিদেশি বিনিয়োগ চাইতে হবে।

এমসিসিআই সভাপতি বলেন, বাজেটে টার্নওভার কর শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করায় যেসব প্রতিষ্ঠানের মুনাফার হার কম, তাদের টিকে থাকা কঠিন হবে।

পিআরআই চেয়ারম্যান জাইদি সাত্তার বলেন, আমাদের  যথাযথ ট্যারিফ নীতি নেই। তাহলে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা কী করে হবে?

বজলুল হক খন্দকার বলেন, কম রাজস্ব দুর্বল বাস্তবায়ন- এই হলো দেশের বাজেটের চরিত্র। এমন বাজেট দিয়ে বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান হয় না। 

আদিব এইচ খান বলেন, অতিরিক্ত কর পরিশোধ করলে পরের বছরে তা সমন্বয়ের সুযোগ এবারের বাজেটে রাখা হয়েছে। তবে কম মুনাফার কোম্পানি এ সুবিধা নিতে পারবে বলে মনে হয় না।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব জাতীয় অগ্রগতির পথে বাধা: আনিসুজ্জামান চৌধুরী
  • বিদেশি ঋণ থেকে বেরিয়ে আসা উচিত: আনিসুজ্জামান চৌধুরী