সীমান্ত অঞ্চলে উত্তেজনা কমানো ও যুদ্ধ ঠেকাতে চিরবৈরী দুই দেশ ইসরায়েল ও সিরিয়া একে অপরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তারা মুখোমুখি বৈঠকও করেছে। এ ব্যাপারে জানেন এমন পাঁচজন ব্যক্তি রয়টার্সকে এসব কথা বলেছেন।

এই যোগাযোগ মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে দুই বিপরীত মেরুর দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, দামেস্কের নতুন ইসলামপন্থী শাসকগোষ্ঠী ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলুক এবং ইসরায়েলও সিরিয়ায় তাদের বোমা হামলা কমাক।

দুজন সিরীয়, দুই পশ্চিমা সূত্র ও একটি আঞ্চলিক গোয়েন্দা সূত্র থেকে জানা যায়, গত ডিসেম্বরে ইসলামপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ সরকারকে উৎখাত করার পর থেকেই কিছু মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে গোপনে ইসরায়েল ও সিরিয়ার মধ্যে আলোচনা চলছিল। এখনকার এই সরাসরি যোগাযোগ সেই গোপন আলোচনারই পরবর্তী ধাপ।

আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না থাকা ইসরায়েল ও সিরিয়ার মধ্যকার বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় সূত্রগুলো নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন। এই সরাসরি আলোচনা ও এর সম্ভাবনা সম্পর্কে আগে কখনো প্রকাশ্যে কিছু জানানোও হয়নি।

১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় থেকে সিরীয় গোলান পাহাড় দখল করে নেয় ইসরায়েল। আর গত ডিসেম্বরে আসাদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তারা আরও কিছু জায়গা দখল করে নেয়। ইসরায়েলের দাবি, সিরিয়ার নতুন শাসকদের বিরুদ্ধে অতীতে উগ্রপন্থার অভিযোগ থাকায় নিরাপত্তার কারণে তারা এমনটা করেছে।

সূত্রগুলো বলেছে, সিরিয়ার পক্ষ থেকে এই যোগাযোগে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আহমাদ আল-দালাতি। আসাদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দালাতিকে কুনেইত্রা প্রদেশের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রদেশটির অবস্থান ইসরায়েল অধিকৃত গোলান উচ্চভূমির পাশে। এ সপ্তাহের শুরুর দিকে দালাতিকে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় সুইদা প্রদেশের নিরাপত্তার দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। সেখানে দ্রুজ সংখ্যালঘুরা বসবাস করে।

তবে সিরিয়ার সরকারি মালিকানাধীন ইখবারিয়া টিভিকে দেওয়া এক বিবৃতিতে দালাতি বলেছেন, ‘ইসরায়েলি পক্ষের সঙ্গে কোনো সরাসরি আলোচনায় অংশ নেওয়ার কথাটি আমি স্পষ্টভাবে অস্বীকার করছি।’

দালাতি আরও বলেন, ‘সিরিয়ার নেতারা সিরীয় জনগণের সুরক্ষা এবং দেশের সার্বভৌমত্ব ও ঐক্য রক্ষা করতে সব আইনসম্মত উপায় অবলম্বন করে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিচ্ছে।’

ইসরায়েলের পক্ষ থেকে কারা এ আলোচনায় অংশ নিয়েছে, তা নিশ্চিত হতে পারেনি রয়টার্স। তবে দুটি সূত্র বলেছে, ইসরায়েলের পক্ষ থেকে আলোচনায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা নিরাপত্তা কর্মকর্তা।

তিনটি সূত্র বলেছে, ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাসহ সীমান্ত অঞ্চলে কয়েক দফা সরাসরি বৈঠক হয়েছে।

এ ব্যাপারে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সিরিয়ার কর্মকর্তাদের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেছিল রয়টার্স। তবে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া পাওয়া যায়নি।

চলতি মাসের শুরুর দিকে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা ইসরায়েলের সঙ্গে তাঁর দেশের পরোক্ষ আলোচনা হয়েছে বলে স্বীকার করেন। তিনি তখন বলেছিলেন, উত্তেজনা প্রশমিত করার লক্ষ্যে এ আলোচনা হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এ ধরনের আলোচনায় মধ্যস্থতা করছে বলে রয়টার্সে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি এ কথা বলেন।

১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় থেকে সিরীয় গোলান পাহাড় দখল করে নেয় ইসরায়েল। আর গত ডিসেম্বরে আসাদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তারা আরও কিছু জায়গা দখল করে নেয়। ইসরায়েলের দাবি, সিরিয়ার নতুন শাসকদের বিরুদ্ধে অতীতে উগ্রপন্থার অভিযোগ থাকায় নিরাপত্তার কারণে তারা এমনটা করেছে।
ইসরায়েল সিরিয়ায় বিমান হামলা চালিয়েছে। এতে সিরিয়ার বেশির ভাগ সামরিক স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। একই সময়ে সিরিয়াকে দুর্বল করে রাখতে ওয়াশিংটনের কাছে তদবির করছে তারা।

যুক্তরাষ্ট্রের বহু দশকের সিরীয় নীতিকে পাশ কাটিয়ে ১৪ মে রিয়াদে আহমেদ আল-শারার সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের ডানপন্থী সরকারকে একটি বার্তা দেওয়া হয়। তা হলো, ইসরায়েলের উচিত শারার সঙ্গে বোঝাপড়ায় পৌঁছানোর জন্য কাজ করা।

তবে গত কয়েক সপ্তাহে বোমা হামলা ও সমালোচনা কমে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বহু দশকের সিরীয় নীতিকে পাশ কাটিয়ে ১৪ মে রিয়াদে আহমেদ আল-শারার সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের ডানপন্থী সরকারকে একটি বার্তা দেওয়া হয়। তা হলো ইসরায়েলের উচিত শারার সঙ্গে বোঝাপড়ায় পৌঁছানোর জন্য কাজ করা।

আঞ্চলিক এক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, শারার সঙ্গে ট্রাম্পের এই যোগাযোগ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে একটি বড় পরিবর্তনের অংশ। আর এই পরিবর্তন ইসরায়েলের আসাদ-পরবর্তী পরিকল্পনাকে ব্যাহত করেছে। কারণ, ইসরায়েল সিরিয়ার বিভক্ত পরিস্থিতিকে নিজেদের কাজে লাগাতে চেয়েছিল।

আরও পড়ুনসিরিয়ার শারার সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠক, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার শর্ত১৪ মে ২০২৫

শারার সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প ইঙ্গিত দেন, সিরিয়ার নতুন নেতা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে রাজি আছেন, যদিও সেটা সময়সাপেক্ষ হবে।

তবে শারা এ বিষয়ে সরাসরি কিছু বলেননি। শারা শুধু বলেছেন, তিনি ১৯৭৪ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্তে ফিরে যাওয়ার পক্ষে। ওই চুক্তির আওতায় গোলান মালভূমিতে জাতিসংঘের একটি বাফার জোন করার কথা ছিল।

সিরিয়ার নতুন শাসকগোষ্ঠী দেখাতে চাইছে যে তারা ইসরায়েলের জন্য কোনো হুমকি নয়। এ জন্য তারা দামেস্ক ও বিদেশে ইহুদি সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গে দেখা করেছে। তারা ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ নামের সংগঠনের দুই নেতাকে আটক করেছে। এ সংগঠনের সদস্যরা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের সঙ্গে মিলে ইসরায়েলে হামলা করেছিল।

আরও পড়ুনসিরিয়ায় দখল করা অঞ্চল ঘুরিয়ে দেখাতে পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরায়েলের১১ এপ্রিল ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স র য় র নত ন ত হওয় র পর আহম দ আল রয়ট র স আস দ প বল ছ ন সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

গলায় ছুরি ধরা ফিলিস্তিনিদের হাতে ব্যান্ডেজ দরকার নেই

২৭ মে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি রাফাহতে একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের দিকে ছুটে যায়। তারা মাসের পর মাস অনাহারে থাকার পর খাবারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু আতঙ্কিত বেসরকারি নিরাপত্তা ঠিকাদারদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। তাল আস-সুলতান ত্রাণকেন্দ্রে বিশ্ব যা দেখেছিল, তা কোনো ট্র্যাজেডি ছিল না। বরং এ ছিল উদ্ঘাটন। অর্থাৎ মানবিক সাহায্য সাম্রাজ্যের চেয়ে মানবতার সেবার জন্য টিকে আছে– এই ভ্রান্ত ধারণার চূড়ান্ত ও সহিংস উন্মোচন।

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক মর্যাদা ও নিরপেক্ষতার মডেল হিসেবে প্রচার করা গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশনের নতুন বিতরণ কেন্দ্রটি উদ্বোধনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়। কিন্তু এটি কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। ছিল সাজানো ব্যবস্থা অনুযায়ী এক ধরনের সমাপ্তি, যা ক্ষুধার্তদের পুষ্টি জোগাতে কাজ করে না; বরং তাদের নিয়ন্ত্রণ ও চার দেয়ালে আবদ্ধ করার জন্য তৈরি হয়েছিল।
গাজার ক্ষুধার্ত মানুষ প্রচণ্ড রোদের নিচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে। খাবারের একটি ছোট বাক্স পেতে তারা ধাতব পদার্থবেষ্টিত গলিতে আটকে থাকতে বাধ্য হয়। অবশেষে হতাশা নিয়ে এগিয়ে যায় এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। মার্কিন সমর্থিত ঠিকাদার নিযুক্ত নিরাপত্তাকর্মীরা পদদলিত হওয়া ঠেকাতে ব্যর্থ গুলি চালায়। তৎক্ষণাৎ মার্কিন কর্মীদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য ইসরায়েলি হেলিকপ্টার মোতায়েন করা হয় এবং জনতার ওপর সতর্কীকরণ গুলিবর্ষণ শুরু করে। বহুল প্রচারিত সাহায্য কেন্দ্রটি মাত্র কয়েক ঘণ্টা কাজ করার পরই সম্পূর্ণরূপে ধসে পড়ে।

মানুষকে যা দেওয়া হয়েছিল, তা বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট ছিল না; মানবিক মর্যাদা পুনরুদ্ধার তো দূরের কথা। বিতরণ করা বাক্সগুলোতে তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঠেকাতে পর্যাপ্ত ক্যালোরি ছিল। এগুলো পরিকল্পিত নিষ্ঠুরতা, যা মানুষকে কোনোমতে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সাজানো ঘটনা, যেখানে তাদের শরীর ধীরে ধীরে নিজেদের গ্রাস করে। এখানে পুষ্টির জন্য কোনো শাকসবজি নেই। রোপণের জন্য কোনো বীজ নেই। পুনর্নির্মাণের জন্য কোনো সরঞ্জাম নেই। শুধু প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, স্থায়ী সংকট বহালের জন্য জনসমাগম বজায় রাখতে তৈরি করা হয়েছিল। এভাবে চিরকাল তাদের ধ্বংসকারীদের করুণার ওপর নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে।

বিতরণ কেন্দ্রের ছবিগুলোতে ক্ষুধা, রোগ ও অবিরাম যুদ্ধের কারণে দৃশ্যত ক্লান্ত মানুষদের দেখানো হয়েছে। তারা গবাদি পশুর মতো ধাতব গলিতে আটকে আছে এবং বন্দুকের নলের দিকে তাকিয়ে থাকা অবশিষ্টাংশের জন্য অপেক্ষা করছে, যা গত শতাব্দীর কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে আসা দুর্ভোগ ও মৃত্যুর সুপরিচিত চিত্রগুলোর সঙ্গে তুলনা করা যায়। 
এই সাদৃশ্য আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। গাজার ‘সহায়তা বিতরণ কেন্দ্রগুলো’ আমাদের সময়ের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, যা ইউরোপীয় পূর্বসূরিদের মতোই; অবাঞ্ছিত জনগোষ্ঠীকে বেঁচে থাকতে 
সাহায্য করার পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণ করা, চালিত হতে বাধ্য করা এবং গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করার জন্য সাজানো হয়েছে।

অবশ্যই ফিলিস্তিনিদের ইতোমধ্যে কারামাহ বা মর্যাদা রয়েছে। এটি তাদের নির্মূল হতে অস্বীকৃতি জানানোর মধ্যেই টিকে আছে; তাদের মানুষ হিসেবে লড়াই করা ও তাদের জেদের মধ্যেই এটি বেঁচে আছে। যতক্ষণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সহজ সত্যটি বুঝতে না পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ইসরায়েল এবং তার মিত্ররা আধিপত্যের হাতিয়ারকে ত্রাণ হিসেবে ব্যবহার করতে থাকবে। আর আমরা বছরের পর বছর রাফাহতে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক দৃশ্যের সাক্ষী থাকব। সেখানে যা ঘটেছে তা সহায়তা প্রদানে ব্যর্থতা ছিল না। এটি ছিল এমন একটি ব্যবস্থার সাফল্য, যা অমানবিক করে তোলা, নিয়ন্ত্রণ করা এবং মুছে ফেলার জন্য তৈরি করার নকশা। যারা ফিলিস্তিনিদের গলায় ছুরি ধরেছে, তাদের হাতে আর ব্যান্ডেজের প্রয়োজন নেই।

আহমদ ইবসাইস: যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রথম প্রজন্মের ফিলিস্তিনি; আলজাজিরা থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম 
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ