সারা দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে থাকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বরে অবস্থিত এই দপ্তরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদ খালি গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে দপ্তরটির শীর্ষপদ সামলাচ্ছেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের (প্রতিষ্ঠান ও প্রতিবন্ধিতা অনুবিভাগ) অতিরিক্ত সচিব বিজয় কৃষ্ণ দেবনাথ।

প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়মিত ফাউন্ডেশনে আসেন না। মন্ত্রণালয়ে তাঁর অনেক কাজ রয়েছে। তাঁদের মত হলো, প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন ও মাঠপর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে তদারকির জন্য নিয়মিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক জরুরি।

অনেকেই হয়তো নিজের পছন্দের লোককে সরকারের শীর্ষপদে বসাতে চায়। সে কারণে নিয়োগে দেরি হচ্ছে। ফাঁকা থাকা সরকারের শীর্ষপদে দ্রুত নিয়োগ দিতে হবে।মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া, সাবেক অতিরিক্ত সচিব

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদও কয়েক মাস ধরে ফাঁকা।

সরকারের এমন অন্তত ২৫টি বিভাগ ও অধিদপ্তরের প্রধান পদ ফাঁকা। এর বাইরে তিনটি মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে কেউ নেই—মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাইরে আরও অন্তত ১০টি দপ্তরপ্রধানের পদ ফাঁকা রয়েছে। এসব পদে নিয়োগ দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। সব মিলিয়ে সরকারের অন্তত ৩৮টি দপ্তরের শীর্ষপদ ফাঁকা।

কোনো কোনো দপ্তরপ্রধানের পদ আট মাস, কোথাও পাঁচ মাস, কোথাও তিন মাস ধরে খালি। সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও শীর্ষপদে কাউকে দেওয়া হচ্ছে না। সচিব, চেয়ারম্যান ও মহাপরিচালক পদে রুটিন দায়িত্ব বা ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চালানো হচ্ছে। এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ ও নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না।

কোনো কোনো দপ্তরপ্রধানের পদ আট মাস, কোথাও পাঁচ মাস, কোথাও তিন মাস ধরে খালি। সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও শীর্ষপদে কাউকে দেওয়া হচ্ছে না।

এসব পদে মূলত নিয়োগ হয় অতিরিক্ত সচিব পদ থেকে। প্রশাসনে বর্তমানে অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা ৪২৪ বলে জানা গেছে। বিপরীতে পদ রয়েছে ২২২টি। প্রেষণসহ পদ ৩৯৫টি। মানে হলো, যথেষ্ট জনবল থাকার পরও বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষপদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ও অধিদপ্তরের শীর্ষপদ খালি থাকা মানে জনস্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। জনসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন গুরুত্বপূর্ণ পদ খালি পড়ে থাকার মাধ্যমে প্রশাসনের অদক্ষতা ফুটে উঠেছে বলে তাঁরা মনে করেন।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের (এপিডি) অতিরিক্ত সচিব এরফানুল হক ১৯ মে প্রথম আলোকে বলেন, ফাঁকা পদে যোগ্য কর্মকর্তাকে নিয়োগের চেষ্টা চলছে। এ জন্য সময় কিছুটা বেশি লাগছে।

সাধারণত সরকারের যেকোনো দপ্তরের শীর্ষপদে যেতে কর্মকর্তাদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা থাকে। তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকারের শীর্ষপদে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে জটিলতা দেখা দিচ্ছে।খালি যেসব সংস্থার শীর্ষপদ

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদ প্রায় পাঁচ মাস ধরে ফাঁকা। এর পাশাপাশি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব পদে দীর্ঘদিন ধরে কেউ নেই।

মহিলা অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো, শিশু একাডেমি, ডাক অধিদপ্তর, বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড (মিল্ক ভিটা), গণযোগাযোগ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ রাবার বোর্ড, জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, পল্লী উন্নয়ন একাডেমি গোপালগঞ্জ, টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা), বাংলাদেশ ওয়াক্‌ফ প্রশাসকের কার্যালয় এবং বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষপদ অনেক দিন ধরে খালি পড়ে আছে।

এর বাইরে বাংলাদেশ কেব্‌ল শিল্প লিমিটেড, টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তর, টেলিফোন শিল্প সংস্থা লিমিটেড, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিল ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের শীর্ষপদ অনেক দিন ধরে ফাঁকা।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এখন সরকার বিসিএস ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দিতে তোড়জোড় শুরু করেছে। যাতে এই ব্যাচ থেকে যোগ্যদের ফাঁকা থাকা পদে নিয়োগ দেওয়া যায়।শীর্ষপদ ফাঁকা থাকার যত কারণ

সাধারণত সরকারের যেকোনো দপ্তরের শীর্ষপদে যেতে কর্মকর্তাদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা থাকে। তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকারের শীর্ষপদে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে জটিলতা দেখা দিচ্ছে।

এ বিষয়ে কথা হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় দুই কর্মকর্তা ও সরকারের তিনজন নীতিনির্ধারকের সঙ্গে। তাঁরা মোটাদাগে তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেন।

প্রথমত, সরকারি দপ্তরের শীর্ষপদে নিয়োগে বিভিন্ন মহল থেকে তদবির আসছে। সব মহলই প্রভাবশালী। এতে কারও নামে সুপারিশ গেলে অন্যের আপত্তির কারণে ফাইল অনুমোদন না হয়ে ফেরত আসে। আবার নিয়োগের পর বিভিন্ন মহলের তীব্র সমালোচনার মুখে নিয়োগ বাতিল করতে হচ্ছে। এ কারণে কাউকে নিয়োগ না দিয়ে সেখানে কাউকে রুটিন দায়িত্ব দিয়ে ফেলে রাখা হচ্ছে।

যেমন অতিরিক্ত সচিব মতিউর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে নৌসচিব করার পর বিভিন্ন মহলের আপত্তির কারণে তাঁকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে সরকার। আবার আরেক অতিরিক্ত সচিব মো.

খায়রুল কবীর মেননকে গত ২ মার্চ বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে সমালোচনার মুখে তাঁকে সরিয়ে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের পরিবহন কমিশনার করা হয়।

শীর্ষপদ ফাঁকা থাকা একাধিক দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক কর্মকর্তাকে দিয়ে একাধিক দায়িত্ব পালন করানো হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, গত ৮ জানুয়ারি অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে জনপ্রশাসনবিষয়ক একটি কমিটি করা হয়েছে। জনপ্রশাসনে যুগ্ম সচিব থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বদলি, শৃঙ্খলা ও নিয়োগের ক্ষেত্রে এ কমিটির পরামর্শ নিতে হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন সচিব। কমিটির সদস্যসচিব তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কমিটির সুপারিশ নিতে গিয়ে অনেক সময় চলে যাচ্ছে।

তৃতীয়ত, সরকারি দপ্তরে শীর্ষপদে নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্য অতিরিক্ত সচিব পাওয়া যাচ্ছে না। যাঁদের নাম সামনে আসে, তাঁদের অন্য পক্ষ অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে তুলে ধরে। আবার অনেকেই আছেন, যাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এখন সরকার বিসিএস ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দিতে তোড়জোড় শুরু করেছে। যাতে এই ব্যাচ থেকে যোগ্যদের ফাঁকা থাকা পদে নিয়োগ দেওয়া যায়।

একজনকে একাধিক দায়িত্ব

শীর্ষপদ ফাঁকা থাকা একাধিক দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক কর্মকর্তাকে দিয়ে একাধিক দায়িত্ব পালন করানো হচ্ছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. শাহজাহান মিয়া একসঙ্গে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বর্তমান প্রশাসক। একই সঙ্গে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবেও অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। আবার স্থানীয় সরকার বিভাগের উন্নয়ন অনুবিভাগের দায়িত্বও পালন করছেন।

ঢাকা ওয়াসার পাশাপাশি রাজশাহী ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদেও কাউকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। সরকারের দুজন কর্মকর্তাকে দিয়ে ঢাকা ও রাজশাহী ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করানো হচ্ছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, একজন কর্মকর্তার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি দপ্তরের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়।

পূর্ণকালীন ও রুটিন সচিবের দায়িত্ব পালনে বেশ পার্থক্য রয়েছে। রুটিন সচিব, মহাপরিচালক বা চেয়ারম্যান তাঁদের মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিদপ্তরের শুধু দৈনন্দিন কাজ করবেন। এর বাইরে কোনো আইন সংশোধন, নতুন আইন প্রণয়ন, প্রকল্প গ্রহণ, অনুমোদন, আরেক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ, অন্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ—এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ রুটিন দায়িত্বে থাকা সচিব করতে পারেন না। এককথায় রুটিন দায়িত্বে থাকলে সচিব রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।

পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) মহাপরিচালকের পদটি গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে খালি। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান নিজ দায়িত্বের বাইরে ওয়ারপোর মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন আট মাস ধরে। ২০ মে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওয়ারপোর মতো প্রতিষ্ঠানে একজন নিয়মিত মহাপরিচালক থাকলে ভালো। তা ছাড়া দুই জায়গায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চাপও বেড়েছে।

‘দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি হবে ভয়াবহ’

সরকারি চাকরির বিধিবিধানের বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া ২০ মে প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের শীর্ষপদ খালি থাকলে জনস্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। জনসেবা ব্যাহত হয়। এসব পদ শূন্য থাকার তাৎক্ষণিক ক্ষতি হয়তো দেখা যাবে না। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এর ক্ষতি হবে ভয়াবহ।

ফিরোজ মিয়া বলেন, অনেকেই হয়তো নিজের পছন্দের লোককে সরকারের শীর্ষপদে বসাতে চায়। সে কারণে নিয়োগে দেরি হচ্ছে। ফাঁকা থাকা সরকারের শীর্ষপদে দ্রুত নিয়োগ দিতে হবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত দ র র কর মকর ত ক কর মকর ত কর মকর ত ক প রথম আল ক এক ধ ক দ ন মন ত র উপদ ষ ট সরক র ব এসব পদ পদ খ ল কম ট র জনস ব বলছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

ক্ষতিগ্রস্ত ১৪ জেলা, পানিবন্দি লাখো মানুষ

বাড়িঘরে হাঁটু থেকে কোমরপানি। গ্রামীণ সব সড়ক, ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ। ভেঙে গেছে বাঁধ। ভাঙছে নদী। বন্ধ নৌ চলাচল। বিদ্যুৎহীন লাখো মানুষ। সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে ভারী বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসে এমন অবস্থা দেশের অন্তত ১৪ উপকূলীয় জেলার।

এসব জেলার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। বিপর্যস্ত উপকূলীয় এলাকার জনজীবন। উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও সংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপ আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় এটি পটুয়াখালীর খেপুপাড়া দিয়ে উপকূল অতিক্রম করেছে। অমাবস্যা ও গভীর নিম্নচাপে উপকূলীয় জেলাগুলোতে জলোচ্ছ্বাস হয়েছে।

গত মঙ্গলবার সৃষ্ট লঘুচাপটি গতকাল গভীর নিম্নচাপে রূপ নেয়। ভোর থেকে শুরু হয় ভারী বৃষ্টি। মাঝেমধ্যে ছিল ঝোড়ো হাওয়া। ফুঁসতে থাকে নদনদী। গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। জোয়ারে ডুবেছে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা। ১ থেকে ৩ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে।

আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ বলেছেন, নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড় হওয়ার আশঙ্কা নেই। ২৪ মে টেকনাফ দিয়ে মৌসুমি বায়ুর প্রবেশ ঘটে। এটা অনেক সক্রিয়। এ সক্রিয়তা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে দেয়নি। তবে এমন বৃষ্টি থাকতে পারে শনিবার পর্যন্ত।

ছয় জেলায় বন্যার আভাস
ভারী বৃষ্টিতে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের ছয় জেলা– ফেনী, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরির আভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল এক বুলেটিনে জানায়, আগামী দু’দিন ফেনীর মুহুরী নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরির ঝুঁকি রয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ভারী বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম বিভাগের গোমতী, মুহুরী ও ফেনী নদীর পানি বাড়তে পারে।

আর মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। পরদিন এসব নদীর পানি কমে যাওয়ার আভাসও দিয়েছে পাউবো। সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের সারিগোয়াইন, যাদুকাটা, মনু, ধলই, খোয়াই ও সোমেশ্বরী নদীর পানি আগামী তিন দিন বাড়তে পারে এবং বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এ সময় সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলায় নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরির ঝুঁকি রয়েছে।

উপকূল পানির নিচে
স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ থেকে ৬ ফুট উচ্চতার জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে নোয়াখালীর নিম্নাঞ্চল। তলিয়ে গেছে নিঝুমদ্বীপসহ বেশ কিছু এলাকা। সাগর উত্তাল থাকায় হাতিয়ার সঙ্গে নৌ যোগাযোগ দু’দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আটকা পড়েছেন শতাধিক মানুষ। এ ছাড়া বুধবার রাত থেকে টানা বৃষ্টিতে নোয়াখালীর মাইজদীর বিভিন্ন সড়ক তলিয়ে গেছে। প্লাবিত হয়েছে শহরের ফ্ল্যাট রোড, শিল্পকলা একাডেমির পাশের সড়ক ও হাকিম কোয়ার্টার সড়ক। টানা বৃষ্টিতে মানুষের চলাচল কম দেখা গেছে।

জোয়ারের পানিতে ডুবে কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীতে দানু মিয়ার (৪০) মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুর ১টার দিকে কুতুবজোম ইউনিয়নের ঘটিভাঙায় এ ঘটনা ঘটে। মৃত দানু ওই এলাকার নুর হোসেনের ছেলে।

বরগুনায় অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে জোয়ার। পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। প্লাবিত হয়েছে বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তিন ঘণ্টা বন্ধ ছিল আমতলী-পুরাকাটা ও বড়ইতলা-বাইনচটকি ফেরি চলাচল। পায়রা নদীতে পানিতে আমতলী ও তালতলীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরের ২৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। দুর্ভোগে পড়েছেন দুই উপজেলার অর্ধলক্ষাধিক মানুষ।

ভোলাসংলগ্ন মেঘনার দৌলতখান ও তজুমদ্দিন, বিষখালীর ঝালকাঠি ও বরগুনার বেতাগী, পায়রার মীর্জাগঞ্জ, কচার উমেদপুর, বলেশ্বরের পিরোজপুর পয়েন্টে জোয়ারের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। ফলে নদনদীসংলগ্ন চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে। ডুবে গেছে ইন্দুরকানীর একাংশ, কালাইয়া, সাঊদখালী, বালিপাড়া, চরবলেশ্বর, চণ্ডিপুর, খোলপটুয়া ও কলারণ।

সাতক্ষীরার আশাশুনিতে জোয়ারে উপকূল রক্ষা বাঁধের ৬৮ নম্বর পোল্ডারের পাশে রিং বাঁধ ভেঙে প্রায় ৪০০ বিঘা আয়তনের চিংড়িঘের তলিয়ে গেছে। গত তিন দিনে ২০ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ঘের মালিকরা জানিয়েছেন।

লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। এ ছাড়া জোয়ারের পানিতে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীসহ নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। গতকাল দুপুরে জোয়ারের পানি বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। তলিয়ে যায় ঘরবাড়িসহ ফসলি জমি। বৃষ্টি ও জোয়ারে তলিয়ে গেছে পটুয়াখালী শহরের পুরাতন হাসপাতাল রোড, মহিলা কলেজ রোড, মুন্সেফপাড়া, জুবিলী স্কুল রোড ও লঞ্চঘাট। পিরোজপুরের ইন্দুরকানী, মঠবাড়িয়া উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। 

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ ও বৃষ্টির প্রভাবে বাগেরহাটের নদনদীর পানি বেড়েছে। সুন্দরবনের নদীগুলোতে স্বাভাবিকের  তুলনায় দুই-তিন ফুট উচ্চতায় জোয়ারের পানি প্লাবিত হয়েছে। দুবলার চর, করমজলসহ বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে গেছে। সুন্দরবনের শেলার চর থেকে নদীতে ভেসে যাওয়ার সময় হরিণ শাবক উদ্ধার করেছে বনরক্ষীরা। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে এটি বনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

ভোলার তজুমদ্দিন স্লুইসগেট এলাকার নির্মাণাধীন রিংবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। বিভিন্ন স্থানে গাছ পড়ে স্রোতের তোড়ে পাঁচটি কাঁচা ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভোলার সঙ্গে সব রুটে নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাটে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে মোবাইল নেটওয়ার্ক। চরফ্যাসনের চর কুকরী-মুকরী ইউনিয়নের চর পাতিলার দুই গ্রাম ও বাঁধের বাইরে পাঁচ শতাধিক পুকুর ও খামারের মাছ, গবাদি পশু ভেসে গেছে। ধসে পড়েছে পাকা সড়ক।

চট্টগ্রামের আনোয়ারায় শঙ্খ নদের বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ঢুকছে জোয়ারের পানি। এতে তলিয়েছে কৃষি জমি ও মৎস্যঘের।

বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে বৃষ্টি ও জোয়ারে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় হাঁটু সমান পানিসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের কাঁচা রাস্তা ভেসে গেছে। তলিয়ে গেছে শতাধিক মৎস্যঘের। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জনজীবন।

নৌ ও ফেরি চলাচল বন্ধ
নদী উত্তাল থাকায় দেশের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌপথে সব ধরনের যান চলাচল গতকাল থেকে বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। বৈরী আবহাওয়ার কারণে বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে।

বিরতিহীন বৃষ্টিতে রাজধানীতেও দুর্ভোগ
সকাল থেকে শুরু বৃষ্টি গভীর রাত পর্যন্ত হয়েছে। সন্ধ্যার পর বৃষ্টির জোর কিছুটা কমলেও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মূল সড়ক পানিতে ডুবেছে। ভোগান্তিতে পড়েন ঘরে ফেরা মানুষ। অনেক এলাকায় দোকানপাটে পানি ঢুকেছে। রাজধানীতে যানবাহনের চাপ ছিল কম। বাস, রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা এবং রাইড শেয়ারিংয়ের বাইক না থাকায় ঘরে ফেরা নিয়ে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। পথচারীদের অভিযোগ, বৃষ্টির কারণে রিকশা ভাড়া দ্বিগুণ-তিন গুণ চাওয়া হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, নিম্নচাপের প্রভাবে বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে অনেক এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। উপকূলে খাদ্য, চিকিৎসাসহ সব ব্যবস্থা রয়েছে।

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা)

সম্পর্কিত নিবন্ধ