সারা দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে থাকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বরে অবস্থিত এই দপ্তরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদ খালি গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে দপ্তরটির শীর্ষপদ সামলাচ্ছেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের (প্রতিষ্ঠান ও প্রতিবন্ধিতা অনুবিভাগ) অতিরিক্ত সচিব বিজয় কৃষ্ণ দেবনাথ।

প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়মিত ফাউন্ডেশনে আসেন না। মন্ত্রণালয়ে তাঁর অনেক কাজ রয়েছে। তাঁদের মত হলো, প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন ও মাঠপর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে তদারকির জন্য নিয়মিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক জরুরি।

অনেকেই হয়তো নিজের পছন্দের লোককে সরকারের শীর্ষপদে বসাতে চায়। সে কারণে নিয়োগে দেরি হচ্ছে। ফাঁকা থাকা সরকারের শীর্ষপদে দ্রুত নিয়োগ দিতে হবে।মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া, সাবেক অতিরিক্ত সচিব

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদও কয়েক মাস ধরে ফাঁকা।

সরকারের এমন অন্তত ২৫টি বিভাগ ও অধিদপ্তরের প্রধান পদ ফাঁকা। এর বাইরে তিনটি মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে কেউ নেই—মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাইরে আরও অন্তত ১০টি দপ্তরপ্রধানের পদ ফাঁকা রয়েছে। এসব পদে নিয়োগ দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। সব মিলিয়ে সরকারের অন্তত ৩৮টি দপ্তরের শীর্ষপদ ফাঁকা।

কোনো কোনো দপ্তরপ্রধানের পদ আট মাস, কোথাও পাঁচ মাস, কোথাও তিন মাস ধরে খালি। সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও শীর্ষপদে কাউকে দেওয়া হচ্ছে না। সচিব, চেয়ারম্যান ও মহাপরিচালক পদে রুটিন দায়িত্ব বা ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চালানো হচ্ছে। এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ ও নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না।

কোনো কোনো দপ্তরপ্রধানের পদ আট মাস, কোথাও পাঁচ মাস, কোথাও তিন মাস ধরে খালি। সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও শীর্ষপদে কাউকে দেওয়া হচ্ছে না।

এসব পদে মূলত নিয়োগ হয় অতিরিক্ত সচিব পদ থেকে। প্রশাসনে বর্তমানে অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা ৪২৪ বলে জানা গেছে। বিপরীতে পদ রয়েছে ২২২টি। প্রেষণসহ পদ ৩৯৫টি। মানে হলো, যথেষ্ট জনবল থাকার পরও বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষপদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ও অধিদপ্তরের শীর্ষপদ খালি থাকা মানে জনস্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। জনসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন গুরুত্বপূর্ণ পদ খালি পড়ে থাকার মাধ্যমে প্রশাসনের অদক্ষতা ফুটে উঠেছে বলে তাঁরা মনে করেন।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের (এপিডি) অতিরিক্ত সচিব এরফানুল হক ১৯ মে প্রথম আলোকে বলেন, ফাঁকা পদে যোগ্য কর্মকর্তাকে নিয়োগের চেষ্টা চলছে। এ জন্য সময় কিছুটা বেশি লাগছে।

সাধারণত সরকারের যেকোনো দপ্তরের শীর্ষপদে যেতে কর্মকর্তাদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা থাকে। তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকারের শীর্ষপদে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে জটিলতা দেখা দিচ্ছে।খালি যেসব সংস্থার শীর্ষপদ

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদ প্রায় পাঁচ মাস ধরে ফাঁকা। এর পাশাপাশি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব পদে দীর্ঘদিন ধরে কেউ নেই।

মহিলা অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো, শিশু একাডেমি, ডাক অধিদপ্তর, বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড (মিল্ক ভিটা), গণযোগাযোগ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ রাবার বোর্ড, জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, পল্লী উন্নয়ন একাডেমি গোপালগঞ্জ, টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা), বাংলাদেশ ওয়াক্‌ফ প্রশাসকের কার্যালয় এবং বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষপদ অনেক দিন ধরে খালি পড়ে আছে।

এর বাইরে বাংলাদেশ কেব্‌ল শিল্প লিমিটেড, টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তর, টেলিফোন শিল্প সংস্থা লিমিটেড, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিল ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের শীর্ষপদ অনেক দিন ধরে ফাঁকা।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এখন সরকার বিসিএস ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দিতে তোড়জোড় শুরু করেছে। যাতে এই ব্যাচ থেকে যোগ্যদের ফাঁকা থাকা পদে নিয়োগ দেওয়া যায়।শীর্ষপদ ফাঁকা থাকার যত কারণ

সাধারণত সরকারের যেকোনো দপ্তরের শীর্ষপদে যেতে কর্মকর্তাদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা থাকে। তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকারের শীর্ষপদে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে জটিলতা দেখা দিচ্ছে।

এ বিষয়ে কথা হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় দুই কর্মকর্তা ও সরকারের তিনজন নীতিনির্ধারকের সঙ্গে। তাঁরা মোটাদাগে তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেন।

প্রথমত, সরকারি দপ্তরের শীর্ষপদে নিয়োগে বিভিন্ন মহল থেকে তদবির আসছে। সব মহলই প্রভাবশালী। এতে কারও নামে সুপারিশ গেলে অন্যের আপত্তির কারণে ফাইল অনুমোদন না হয়ে ফেরত আসে। আবার নিয়োগের পর বিভিন্ন মহলের তীব্র সমালোচনার মুখে নিয়োগ বাতিল করতে হচ্ছে। এ কারণে কাউকে নিয়োগ না দিয়ে সেখানে কাউকে রুটিন দায়িত্ব দিয়ে ফেলে রাখা হচ্ছে।

যেমন অতিরিক্ত সচিব মতিউর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে নৌসচিব করার পর বিভিন্ন মহলের আপত্তির কারণে তাঁকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে সরকার। আবার আরেক অতিরিক্ত সচিব মো.

খায়রুল কবীর মেননকে গত ২ মার্চ বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে সমালোচনার মুখে তাঁকে সরিয়ে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের পরিবহন কমিশনার করা হয়।

শীর্ষপদ ফাঁকা থাকা একাধিক দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক কর্মকর্তাকে দিয়ে একাধিক দায়িত্ব পালন করানো হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, গত ৮ জানুয়ারি অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে জনপ্রশাসনবিষয়ক একটি কমিটি করা হয়েছে। জনপ্রশাসনে যুগ্ম সচিব থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বদলি, শৃঙ্খলা ও নিয়োগের ক্ষেত্রে এ কমিটির পরামর্শ নিতে হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন সচিব। কমিটির সদস্যসচিব তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কমিটির সুপারিশ নিতে গিয়ে অনেক সময় চলে যাচ্ছে।

তৃতীয়ত, সরকারি দপ্তরে শীর্ষপদে নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্য অতিরিক্ত সচিব পাওয়া যাচ্ছে না। যাঁদের নাম সামনে আসে, তাঁদের অন্য পক্ষ অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে তুলে ধরে। আবার অনেকেই আছেন, যাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এখন সরকার বিসিএস ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দিতে তোড়জোড় শুরু করেছে। যাতে এই ব্যাচ থেকে যোগ্যদের ফাঁকা থাকা পদে নিয়োগ দেওয়া যায়।

একজনকে একাধিক দায়িত্ব

শীর্ষপদ ফাঁকা থাকা একাধিক দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক কর্মকর্তাকে দিয়ে একাধিক দায়িত্ব পালন করানো হচ্ছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. শাহজাহান মিয়া একসঙ্গে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বর্তমান প্রশাসক। একই সঙ্গে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবেও অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। আবার স্থানীয় সরকার বিভাগের উন্নয়ন অনুবিভাগের দায়িত্বও পালন করছেন।

ঢাকা ওয়াসার পাশাপাশি রাজশাহী ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদেও কাউকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। সরকারের দুজন কর্মকর্তাকে দিয়ে ঢাকা ও রাজশাহী ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করানো হচ্ছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, একজন কর্মকর্তার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি দপ্তরের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়।

পূর্ণকালীন ও রুটিন সচিবের দায়িত্ব পালনে বেশ পার্থক্য রয়েছে। রুটিন সচিব, মহাপরিচালক বা চেয়ারম্যান তাঁদের মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিদপ্তরের শুধু দৈনন্দিন কাজ করবেন। এর বাইরে কোনো আইন সংশোধন, নতুন আইন প্রণয়ন, প্রকল্প গ্রহণ, অনুমোদন, আরেক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ, অন্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ—এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ রুটিন দায়িত্বে থাকা সচিব করতে পারেন না। এককথায় রুটিন দায়িত্বে থাকলে সচিব রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।

পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) মহাপরিচালকের পদটি গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে খালি। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান নিজ দায়িত্বের বাইরে ওয়ারপোর মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন আট মাস ধরে। ২০ মে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওয়ারপোর মতো প্রতিষ্ঠানে একজন নিয়মিত মহাপরিচালক থাকলে ভালো। তা ছাড়া দুই জায়গায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চাপও বেড়েছে।

‘দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি হবে ভয়াবহ’

সরকারি চাকরির বিধিবিধানের বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া ২০ মে প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের শীর্ষপদ খালি থাকলে জনস্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। জনসেবা ব্যাহত হয়। এসব পদ শূন্য থাকার তাৎক্ষণিক ক্ষতি হয়তো দেখা যাবে না। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এর ক্ষতি হবে ভয়াবহ।

ফিরোজ মিয়া বলেন, অনেকেই হয়তো নিজের পছন্দের লোককে সরকারের শীর্ষপদে বসাতে চায়। সে কারণে নিয়োগে দেরি হচ্ছে। ফাঁকা থাকা সরকারের শীর্ষপদে দ্রুত নিয়োগ দিতে হবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত দ র র কর মকর ত ক কর মকর ত কর মকর ত ক প রথম আল ক এক ধ ক দ ন মন ত র উপদ ষ ট সরক র ব এসব পদ পদ খ ল কম ট র জনস ব বলছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

জাতির স্বার্থে খোলামেলা আলোচনায় বসার আহ্বান জামায়াতের 

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ও জাতির স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খোলামেলা আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, সরকারসহ সব পক্ষ আন্তরিক হলে আলোচনার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সম্ভব।

মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) ভোরে বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন শফিকুর রহমান।

জাতীয় নির্বাচ‌নে দ‌লের চূড়ান্ত প্রার্থী তা‌লিকা সময়মতো ঘোষণা করা হ‌বে ব‌লে বলেও জানান তিনি। এছাড়া,  জোটবদ্ধ হ‌য়ে নির্বাচ‌নে অংশ নেওয়ার ইঙ্গিত দেন তি‌নি।

বিএন‌পির প্রার্থী তা‌লিকা ঘোষণা করা হ‌য়ে‌ছে, জামায়া‌তের তা‌লিকা ক‌বে ঘোষণা করা হ‌বে জান‌তে চাই‌লে দলের আমির ব‌লেন, “তারাও (বিএনপি) চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করেনি। আমি দেখেছি ২৩৭ টা আসনে তারা তালিকা প্রকাশ করেছেন, আবার এটিও চূড়ান্ত নয়। এরমধ্যেও পরিবর্তন আসতে পারে।” 

“আমরা কিন্তু এক বছর আগেই এই তালিকা আঞ্চলিকভাবে জানিয়ে দিয়েছি। চূড়ান্ত তালিকাটা সময়মতো আমরা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে ঘোষণা করব। তবে যেহেতু আমরা একা ইলেকশন করব না, আরো অনেককে আমরা ধারণ করব, দেশ এবং জাতির স্বার্থে সব দিক বিবেচনা করেই চূড়ান্তভাবে যথাসময়ে আমরা ইনশাআল্লাহ প্রার্থী ঘোষণা করব।” 

আসন্ন নির্বাচন যথাসম‌য়ে অনুষ্ঠা‌নের বিষ‌য়ে আশাবাদ ব‌্যক্ত ক‌রে জামায়া‌তের আমির বলেন, “ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন, আমরা আপনারা দেশবাসী সবাই দেখতে চাই।” 

মতানৈক্য গণতন্ত্রের সৌন্দর্য: রাজনী‌তি‌তে মতানৈক্য কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়া‌তের আমির বলেন, “আমি বুঝতে পেরেছি, আমাদের মধ্যে মতানৈক্য থাকবে, তবে দোয়া করেন মতবিরোধ যেন না হয়। মতের ভিন্নতা থাকবে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সব দল তো এক দল নয়। সবগুলো দল ভিন্ন ভিন্ন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও মতপার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক।” 

“আমরা সকলের মতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখি। তবে আমরা নিজেরা যে মতটা প্রকাশ করি আমরা চেষ্টা করি চিন্তাভাবনা করে জাতির স্বার্থেই সে মতগুলা প্রকাশ করা হয়। অতএব, মতানৈক্য এটা ডেমোক্রেসির সৌন্দর্য। এটার জন্য এখানে বিরোধ লেগে গেছে অথবা দেশ একেবারে অস্থির হয়ে গেছে আমরা এইটুকু চিন্তা করতে রাজি নই” বলেন তিনি।  

খোলামেলা আলোচনার আহ্বান:

জুলাই সনদ বাস্তবায়‌নে আদেশ জা‌রি ও গণ‌ভো‌টের বিষ‌য়ে শ‌ফিকুর রহমান ব‌লেন, “আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অলরেডি দিয়ে দিয়েছি।”

সরকার রাজনৈতিক দলসমূহকে সময় বেঁধে দিয়েছেন, এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “না, উনারা সময় বেঁধে দেই নাই; আমি শুনেছি ভাল করে। উনারা অনুরোধ করেছেন যে, এক সপ্তাহ সময়ের ভেতরে রাজনৈতিক দলগুলা বসে যদি একটা কনসেনসাসে পৌঁছাতে পারে, তাহ‌লে তারা সিদ্ধান্ত দি‌য়ে দে‌বে। সরকার ভালো কথাই ব‌লে‌ছে।” 

তি‌নি ব‌লেন, “আমরাই সবার আগে আহ্বান জানিয়েছি যে, আসুন, আমরা খোলামেলা আলোচনা করে জাতির স্বার্থে একটা সমাধানে পৌঁছি। আমরা আশা করি, অন্যরা আমাদের এই আহ্বানে সাড়া দেবেন।” 

এর আগে গতকাল সোমবার জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।

আমি ‘আমির’ নির্বাচিত হইনি:

আবারো দ‌লের আমির নির্বা‌চত হওয়া প্রস‌ঙ্গে শ‌ফিকুর রহমান ব‌লেন, “আমি ‘আমির’ নির্বাচিত হইনি। আমার সহকর্মীরা আমার ওপর একটা দায়িত্বের ভার অর্পণ করেছেন, এই দায়িত্বটা বড় ভারী। আপনারা দোয়া করবেন, দেশ এবং দ্বীনের জন্য এই দায়িত্ব পালনে আল্লাহ যেন আমাকে সাহায্য করেন। আর পাশাপাশি আমি আপনাদেরও সহযোগিতা চাই।”

সাংবাদিকদের উদ্দেশে জামায়া‌তের আমির ব‌লেন, “আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাবার আগে আরেকবার আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করব। আসলে আপনারা ব্যক্তিগতভাবে জাতির বিবেক আর আপনাদের হাউসগুলো দর্পণ। আমরা সমাজের এই দর্পণ এবং জাতির বিবেকের কাছে দেশ গড়ার অভিযাত্রায় জামায়াতে ইসলামী যেসব কর্মসূচি ঘোষণা করছে যা দেশ এবং জাতির কল্যাণে আমরা এই সবগুলোতে আপনাদেরও কাছে চাই। কারণ আপনারা এই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নন। আপনারা শুধু সাংবাদিক নন, আপনারা এই দেশের নাগরিকও বটে। অতএব, আমরা যারা নাগরিক অধিকারটা নিশ্চিত করে একটা মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাই, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাই, এই ক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা হবে অগ্রগণ্য, আমরা সেটা প্রত্যাশা রাখি। কারণ সাংবাদিকরা যখন জাতির কল্যাণে সিদ্ধান্ত নেন, জাতি তখন কল্যাণের পথ খুঁজে পায়।”

বি‌দেশ সফ‌রের কথা তু‌লে ধ‌রে শ‌ফিকুর রহমান ব‌লেন, “আপনারা হয়ত জানেন গত মাসের ১৯ তারিখ আমি ওমরা করার উদ্দেশ্যে দেশ থেকে বের হয়েছিলাম। তিন দিনে ওমরা সম্পন্ন করার পর ২২ তারিখ সকাল ৯টায় আমেরিকার জেএফকে এয়ারপোর্টে আমি আল্লাহর মেহেরবাণীতে সেখানে পৌঁছাই এবং সেখানে ৮ দিনব্যাপী বিভিন্ন স্তরে সরকারি বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা এবং ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হই। খুব অল্প সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৪টি শহরে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেখা করার সু‌যোগ হ‌য়ে‌ছে।”

“সেখান গুরুত্বপূর্ণ দুটি কথা দুটি মেসেজ তাদেরকে দিয়েছি। একটা হচ্ছে বাংলাদেশ আমাদের সকলের। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা এবং নিষ্পেশন ও ফ্যাসিবাদী শাসনের পর বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে। মুক্তির এই সংগ্রামে দেশবাসীর সাথে প্রবাসে যারা ছিলেন, তারাও সমানতালে লড়াই করেছেন। তাদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেই অবদানের জন্য তাদের ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। আর আমরা বলেছি, প্রবাসীদের সবচেয়ে বড় অধিকার ভোটাধিকার এত দিন ছিল না। এ দাবি সবার আগে আমরা তুলেছিলাম। আমরা এ দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও নির্বাচন কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল জায়গায় প্রবাসীদের হয়ে কথা বলেছি। আমরা সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই; এই প্রথমবারের মত ব্যাপক ভিত্তিক আমাদের প্রবাসীদেরকে ভোটার করার উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু সেখানে কিছু সমস্যা রয়ে গিয়েছে।”

ভোটার হওয়ার জন্য অক্টোবরের ৩০ তারিখ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “এ জন্য যে সফটওয়ার ইনস্টল করা হয়েছে তা প্রোপারলি ফাংশন করে নাই, যার কারণে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই ভোটার হতে পারেননি। আমাদের দাবি থাকবে নির্বাচন কমিশনের কাছে কমপক্ষে আরও ১৫ দিন এই সময় বর্ধিত করা হোক এবং যে জটিলতাগুলো রয়েছে- এগুলো সহজ করে তাদেরকে ভোটার হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হোক। আরও কিছু সমস্যা আছে; কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা বলব একজন নাগরিকের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য তার ন্যাশনাল আইডি কার্ড যথেষ্ট। পাশাপাশি তার যদি একটা ভ্যালিড পাসপোর্ট থাকে-তাহলে আর কিছুরই প্রয়োজন হয় না। এর বাই‌রে যে সব শর্ত তা যেন শিথিল ক‌রে দেয়।” 

তুরস্ক সফর সফল হ‌য়ে‌ছে জা‌নি‌য়ে দল‌টির আমির ব‌লেন,  “তুরস্কে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের আমার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছে। আর বাংলাদেশি যারা আছেন তাদের সঙ্গে আমার বসা হয়েছে, তাদের কথাও শোনার সুযোগ হয়েছে। আমি আসলে নিজের কোনো প্রয়োজনে দেশ থেকে বের হইনি। আমি বের হয়েছিলাম দেশ এবং জনগণের প্রয়োজনে। যেখানেই গিয়েছে জনগণের স্বার্থকে দেশের স্বার্থকে সামনে রেখেই কথা বলার চেষ্টা করেছি।” 

তিনি বলেন, “দুনিয়ার সকলের সাথেই আমরা সম্মানজনক সম্পর্ক চাই। এই সম্পর্কটা হবে মিউচুয়াল রেসপেক্ট এবং ইকিউয়িটির ভিত্তিতে।” 

সৌদি আরবে পবিত্র ওমরা পালন এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তুরস্ক সফর শেষে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান মঙ্গলবার ভো‌রে ঢাকায় ফেরেন।

এ সময় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে দ‌লের সি‌নিয়র নেতারা তা‌কে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান।

দ‌লের নায়েবে আমির সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সাবেক সংসদ সংসদ সদস্য মাওলানা আনম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, ড. হামিদুর রহমান আযাদ, মাওলানা আবদুল হালিম ও এড. মোয়াযযম হোসাইন হেলালসহ কেন্দ্রীয় আরো অনেক নেতাকর্মী বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ