টানা প্রবল বর্ষণে দেশের বিভিন্ন জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ। বাড়ছে নদনদীর পানি। তলিয়ে গেছে আমন ধানের বীজতলা। ভেসে গেছে মাছের ঘের। ভেঙে গেছে গ্রামীণ সড়ক। আশ্রয়হীন বহু মানুষ। দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অনেক এলাকা। কোথাও কোথাও বিদ্যুতের সংযোগও বন্ধ আছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন মানুষ।
সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে দেশের চার বিভাগে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাত আরও এক দিন অব্যাহত থাকতে পারে বলে আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। অতিভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে ভারী বর্ষণজনিত কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা মহানগরীর কোথাও কোথাও অস্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা তৈরি হতে পারে। সমুদ্রবন্দরগুলোয় ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত বহাল রাখা হয়েছে।
বৃষ্টি-জলে রাজধানীতে দুর্ভোগ
মঙ্গলবার রাতভর বৃষ্টির পর গতকাল বুধবার সারাদিন থেমে থেমে বৃষ্টি ঝরেছে রাজধানীতে। অফিসগামী মানুষ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ রাস্তায় বের হওয়া মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন। অনেক জায়গায় সময়মতো যানবাহন পাওয়া যায়নি। যানবাহন পেলেও বেশি ভাড়া গুনতে হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও যাত্রী সংকটে পড়েছে পরিবহনগুলো। আবার কোনো সড়ক ও অলিগলিতেও পানি জমার কারণে সেখানকার বাসিন্দারা পড়েন বিপাকে। ঢাকার মিরপুরের শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, ভাটারা, নতুন বাজার, নিউমার্কেট, খিলগাঁও, নিকেতনসহ কিছু এলাকার সড়কে পানি জমে। ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে সম্ভাব্য জলাবদ্ধতা দূর করতে প্রতিটি ওয়ার্ডে ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম গঠন ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
উপকূল বিপর্যস্ত
টানা তিন দিনের ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের ১৭টি স্থানে ভাঙন ধরেছে। প্লাবিত হয়েছে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার অন্তত ৩০ গ্রাম। উপজেলা দুটিতে বিদ্যুৎ না থাকায় বন্ধ রয়েছে ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন সংযোগও। এদিকে ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় গত মঙ্গলবার রাত থেকে ছোট-বড় সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে পরশুরাম উপজেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বন্যা মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন তৎপর রয়েছে।
ফেনী জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, বুধবার দুপুর পর্যন্ত তিন উপজেলার প্রায় ১১ হাজার ৫০০ মানুষ দুর্যোগকবলিত। এর মধ্যে তিন উপজেলায় ১১৫টি পরিবারের ৩৪৭ জন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন।
নোয়াখালীতে জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। অতিভারী বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় জেলা শহর মাইজদীর প্রধান সড়ক ছাড়া অধিকাংশ সড়কই ডুবে গেছে। পানি ঢুকে পড়েছে অনেক বাসাবাড়িতে। জলমগ্ন হয়ে রয়েছে শহরের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নোয়াখালীর সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া সদর, সুবর্ণচর, কবিরহাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ের সব স্কুল ও মাদ্রাসার চলমান অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা বুধ ও বৃহস্পতিবারের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাতে কুমিল্লা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে ডুবে গেছে নগরীর প্রধান সড়কসহ বহু অলিগলি। গোমতী নদীর পানি প্রতি ঘণ্টায় ১০ সেন্টিমিটার করে বাড়ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে নদীর বাঁধের ভেতরের জমি ও বসতি ডুবতে শুরু করেছে।
টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে রাঙামাটির লংগদুর সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। একই সঙ্গে খাগড়াছড়ির দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের নিচু এলাকার কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
চট্টগ্রামে টানা ভারী বর্ষণে নগরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে থেমে থেমে এবং কখনও অঝোর ধারায় বৃষ্টিতে নগরের জিইসি মোড়, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, পাঁচলাইশ, শুলকবহর, আগ্রাবাদ, বাদামতলী ও হালিশহরের বিভিন্ন সড়কে হাঁটু পরিমাণ পানি জমে যায়। দুপুরে জোয়ারের পানি মিশে জলাবদ্ধতা আরও তীব্র হয়। এতে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী ও কর্মজীবীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন।
সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা জানান, নিচু লিঙ্ক রোড ও ময়লা-আবর্জনায় ড্রেন বারবার ভরে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ, সিটি করপোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড মিলে প্রায় ১৪ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকার চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পগুলোর কাজ এখন শেষ পর্যায়ে।
বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বুধবার দুপুরে লামা উপজেলার মিরিঞ্জা এলাকায় সড়কে পাহাড় ধসে সাময়িকভাবে লামা-আলীকদম ও মিরিঞ্জা পর্যটন সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঘটনাস্থল তাৎক্ষণিক পরিদর্শন করে লামা উপজেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ায় কয়েক ঘণ্টা পরই যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
টানা ভারী বর্ষণে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বাড়ছে। পাশাপাশি জেলার অভ্যন্তরীণ নদনদীও ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করেছে। শরীয়তপুরের জাজিরার মাঝিকান্দি এলাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধে ভাঙন ঠেকাতে দু’দিন ধরে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলছে পাউবো। সেখানে ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে অন্তত ৭০০ পরিবার।
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে প্রবল বর্ষণে গত মঙ্গলবার তরফপুর ও লতিফপুর ইউনিয়ন রক্ষা পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ধসে গেছে। এতে দুই ইউনিয়নের সঙ্গে উপজেলা সদরের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
এ ছাড়া বরিশাল, ঝালকাঠি, শরীয়তপুর, বাগেরহাট, লক্ষ্মীপুর, মোংলা, রাজাপুর, মোরেলগঞ্জসহ দক্ষিণাঞ্চলের বহু এলাকা জলাবদ্ধ ও নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত। লক্ষ্মীপুর ও মোংলায় পানিতে ডুবে গেছে ঘর, স্কুল ও সড়ক।
চার বিভাগে ভারী বৃষ্টির আভাস, জলাবদ্ধতার সতর্কবার্তা
সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে দেশের চার বিভাগে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাত আরও এক দিন অব্যাহত থাকতে পারে বলে আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। গতকাল অধিদপ্তরের এক সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, বুধবার সকাল ১০টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হতে পারে। অতিভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে ভারী বর্ষণজনিত কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা মহানগরীর কোথাও কোথাও অস্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা তৈরি হতে পারে।
গতকাল দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে বান্দরবানে ২৭১ মিলিমিটার। এ ছাড়া উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীতে ১০৬, নোয়াখালীতে ২০২, লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে ১৫২, ফেনীতে ৮২, চট্টগ্রামে ১৬৯ ও বরিশালে ১৬০ মিলিমিটারসহ দেশের প্রায় সব জায়গায় কমবেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির বলেন, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপটি একই অবস্থানে আছে। ফলে সমুদ্রবন্দরগুলোয় ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত বহাল রেখেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
তিন বোর্ডের আজকের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত
বন্যা পরিস্থিতির কারণে কুমিল্লা, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন আজ বৃহস্পতিবারের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল রাতে শিক্ষা বোর্ডগুলো থেকে প্রকাশিত পৃথক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
গতকাল রাত পৌনে ১০টার দিকে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক রুনা নাছরীন সমকালকে বলেন, আমরা সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে বন্যা পরিস্থিতির বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অবহিত করার পর রাতে পরীক্ষা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত আসে। স্থগিত পরীক্ষার সময়সূচি পরবর্তী সময়ে জানানো হবে।
এদিকে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অনিবার্য কারণবশত ১০ জুলাই তারিখের আলিম ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা স্থগিত করা হলো।
অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অনিবার্য কারণবশত ১০ জুলাই তারিখের সব পরীক্ষা স্থগিত করা হলো।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বন য র প ন পর স থ ত ন এল ক য় উপজ ল র পর ক ষ এল ক র নগর র গতক ল
এছাড়াও পড়ুন:
ফলাফলে ধস নামলেও ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে এগিয়ে মেয়েরা
ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় পাশের হার ৫৮ দশমিক ২২ শতাংশ, যা গতবারের তুলনায় ২৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ কম। তবে পাশের হার ও জিপিএ-৫ উভয় ক্যাটাগরিতেই এগিয়ে রয়েছে মেয়েরা।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে ফলাফল প্রকাশ করেন বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল্লাহ।
ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেন ১ লাখ ৫৫৮ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন ৫১ হাজার ৪৪৬ জন পরীক্ষার্থী। ফলাফলে দেখা যায়, এবার ছাত্রদের পাশের হার ৫৫ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। অপরদিকে ছাত্রীদের পাশের হার ৬১ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
জিপিএ-৫ প্রাপ্তির দিক থেকেও ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে মেয়েরা। ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে মোট জিপিএ ৫ প্রাপ্ত পরীক্ষার্থী ১ হাজার ৬৭৬ জন। তার মধ্যে ছাত্র ৫২৫ জন ও ছাত্রী ১ হাজার ১৫১ জন। যা শতকরা হিসাবে ছাত্রদের ক্ষেত্রে ৪৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ ও ছাত্রীদের ক্ষেত্রে ৭০ দশমিক ১৯ শতাংশ।
এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, এ বছর তুলনামূলকভাবে পাশের হার কিছুটা কম। আমরা শিক্ষার্থী অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদেরকে বলেছি শিক্ষার্থীদের প্রতি যত্ন নিতে। যাতে করে আগামী বছর পাশের হার বৃদ্ধি পায়।
তবে, এবারের ফলাফলে মেয়েরা অনেক বেশি এগিয়ে। এ সময় তিনি ছেলেদেরকে পড়াশোনায় আরও আগ্রহ দেখাতে বলেন।
ফলাফল মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি সমকালকে বলেন, এই ফলাফলে আমি সন্তুষ্ট নই। আমরা সবসময় চাই, শিক্ষার্থীরা খুব ভালো ফলাফল করুক। শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবকরা সবাই মিলে চেষ্টা করলে সামনের বছর ফলাফল অনেক ভালো হবে।