পুলিশি রিমান্ডের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় ‘সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স’
Published: 31st, May 2025 GMT
পুলিশি রিমান্ডের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় একটি সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স (পদ্ধতিগত সহিংসতা)। আইন অনুযায়ী এখতিয়ার না থাকলেও বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি স্বীকারোক্তিই নির্যাতন করে আদায় করা হয়। এ পরিস্থিতির সমাধানে শুধু আইন ও কিছু এজেন্সি করলেই হবে না, দরকার পূর্ণাঙ্গ সংস্কার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে বৃহস্পতিবার এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি: ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় প্রক্রিয়াগত সহিংসতা হিসেবে পুলিশি রিমান্ড’ শিরোনামে এই সেমিনারের আয়োজন করে ‘ডি–কেইজ ইনিশিয়েটিভ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম।
সেমিনারে প্রধান বক্তা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মো.
কিন্তু বাস্তবতা আর সংবিধানের মধ্যে তফাৎ রয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, এসব বিষয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হলে সরকারের সংশ্লিষ্ট বাহিনী ও দায়িত্বশীল পুলিশ রিমান্ডের বিষয়টা অস্বীকার করে; কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে রিমান্ড মানেই পুলিশি নির্যাতন। এ বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেট আর সরকারের ভাষ্য মিলে যায়।
অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিকে ভলান্টারি (স্বেচ্ছায়) বলে সত্যায়ন করলে আদালত সেই স্বীকারোক্তিকে সত্য বলে ধরে নেন। তখন আসামিকে প্রমাণ করতে হয় যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সত্য নয়। তিনি বলেন, একজন আসামি তার শাস্তি জেনেও স্বেচ্ছায় অপরাধ স্বীকার করবে কেন, কখন করবে? এটা সম্ভব দুটি কারণে—অপরাধবোধ ও শাস্তি হ্রাস। বাইরের বিভিন্ন দেশে দ্রুত অপরাধ স্বীকার করলে শাস্তিও সেই অনুযায়ী কমে। অথচ বাংলাদেশে এমন কোনো আইন নেই।
১৬৪ ধারা কোনো বাইবেল নয়—এমন মন্তব্য করে এই ফৌজদারি অপরাধবিশেষজ্ঞ বলেন, দেখা যায় যে পুলিশের হেফাজতে যাওয়া ছাড়া কারও বিবেক জাগ্রত হয় না। প্রায় প্রতিটি স্বীকারোক্তিই নির্যাতনের ভিত্তিতে আদায় করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব এই ব্যাপারগুলো দেখভাল করা। সরকারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এটিকে অস্বীকার করে আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে। বিচার বিভাগও জানে, পুরো প্রক্রিয়াটা সিস্টেমেটিক ডিনায়াল অব ভায়োলেন্স (সহিংসতাকে পদ্ধতিগতভাবে অস্বীকার)।
অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, হেফাজতে নির্যাতনের দায় পুলিশের চেয়ে বেশি বিচার বিভাগের। অনেক দেশেই কনভিকশনের হার ৯০ শতাংশ। আমাদের এখানে কনভিকশনের প্রকৃত হার ১০ শতাংশের মতো। তার ওপর কনভিকশন ম্যানুফেকচারিং করা হয়, যদি নির্যাতন করে কিছু কনভিকশন বাড়ানো যায়!
বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতাকে আবার গৌরবান্বিত করা হয় বলেও অভিযোগ করেন অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান। সামগ্রিক এই পরিস্থিতির সমাধান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটি নির্দিষ্ট ‘কুলিং পিরিয়ড’ পার না হওয়া পর্যন্ত স্বীকারোক্তি নেওয়া যাবে না—এটা একটা ভালো প্রস্তাব। তবে তিনি বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ সংস্কার দরকার আমাদের, শুধু আইন ও কিছু এজেন্সি করলেই হবে না। সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের দরকার সহিংসতামুক্ত জুরিসপ্রুডেন্স (আইনশাস্ত্র) ও রাজনৈতিক ডিসকোর্স। এগুলো করলে নতুন আইন ছাড়াই সমস্যার সমাধান সম্ভব।’
সেমিনারে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসেন বলেন, অতিরিক্ত কাজের চাপ ন্যায়বিচারের পথে একটি বড় বাধা। যেমন ঢাকার ৫২টি থানায় ম্যাজিস্ট্রেট ৩৭ জন। জনবল এত কম থাকায় সব মামলায় যথেষ্ট সময় দেওয়া সম্ভব হয় না তাঁদের পক্ষে। পাশাপাশি রাজনৈতিক লবিং ও চাপ, দুর্বল প্রসিকিউশন—এসবও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা। এ ছাড়া দেশে ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশনের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। অধিকাংশই কার্যকারিতার দিক থেকে যথেষ্ট দুর্বল।
ঢাকার সিএমএম আদালতের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জিয়া উদ্দিন আহমেদ বলেন, পুলিশের মনস্তত্ত্ব হচ্ছে স্বীকারোক্তি নিতে পারলেই সে সফল। ১৬৪ ধারা কোনো বাইবেল নয়। এই ধারার গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া উচিত।
সেমিনারে অন্যদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হেলাল উদ্দিন মোল্লা, মানবাধিকারকর্মী মুশফিক জোহান, আইনজীবী জহিরুল ইসলাম মূসা, ২০০৫ সালে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের শিকার আনোয়ার শংকর প্রমুখ বক্তব্য দেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব ক র কর ন বল ন অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
যশোরে গাড়িচালকের পরিকল্পনাতেই ছিনতাই: পুলিশ
যশোরের মনিরামপুরে আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নগদের প্রাইভেট কার ঠেকিয়ে ৩৫ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। ছিনতাই হওয়া ৩২ লাখ টাকা উদ্ধার হয়েছে। নগদ ডিস্ট্রিবিউটরের প্রাইভেট কারচালকের যোগসাজশে এ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
আজ বুধবার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূর-ই-আলম সিদ্দিকী।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন– নগদ ডিস্ট্রিবিউটরের প্রাইভেট কারচালক ও যশোর শহরের পোস্ট অফিসপাড়ার ইউসুফ আলী সাজু, ঝিকরগাছার বাঁকড়া দিগদানা গ্রামের রনি গাজী, সুজন ইসলাম, ইমদাদুল গাজী, নাসিম গাজী, একই উপজেলার খোষালনগর গ্রামের সাগর হোসেন ও সোহেল রানা।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে যশোরের নগদ ডিস্ট্রিবিউটর রবিউল ইসলাম প্রাইভেট কারযোগে মনিরামপুর যাচ্ছিলেন। পথে জামতলা নামক স্থানে পেছনের দিক থেকে দুটি মোটরসাইকেলে আসা দুর্বৃত্তরা তাঁর গতিরোধ করে। তারা মোটরসাইকেল থেকে নেমে প্রাইভেট কারের কাচ ভাঙচুর এবং চাপাতি দিয়ে হত্যার হুমকি দেয়। একপর্যায়ে ডিস্ট্রিবিউটরকে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাঁর কাছে থাকা ৩৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। বিষয়টি রবিউল ইসলাম জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে কল করে জানান।
সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, ছিনতাইয়ের ঘটনার আগে ও পরের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করা হয়। ডিবিসহ জেলা পুলিশের একাধিক দল বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেলের সূত্র ধরে আসামি সাগর হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। সাগরের তথ্যের ভিত্তিতে বাকি আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়। ইমদাদুল গাজীর হেফাজত থেকে ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ৫০০ টাকা এবং সুজনের বাড়ি থেকে ১৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।
নূর-ই-আলম সিদ্দিকী আরও বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনার পর নগদের লোকজন টাকার পরিমাণ ৫৫ লাখ বলেছিলেন, যা সঠিক নয়। প্রকৃত টাকার পরিমাণ এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল বাশার, মনিরামপুর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার ইমদাদুল হক, ডিবির ওসি মঞ্জুরুল হক ভূঞা, মনিরামপুর থানার ওসি বাবলুর রহমান খান প্রমুখ।