ভারতের মুসলমানদের কেন বারবার দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে হয়
Published: 1st, June 2025 GMT
ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে গত এপ্রিলে পর্যটকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলার পর থেকে দেশটিজুড়ে একের পর এক মুসলিমবিদ্বেষী ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে।
ভারতের কবি ও গবেষক নাবিয়া খান ভারতে ইসলামবিদ্বেষ নিয়ে গত ২২ মে মিডল ইস্ট আইয়ে লেখা এক মতামত কলামে বলেন, গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের গুলিতে ২৬ জন নিহত হন। এর প্রায় দুই সপ্তাহের মধ্যে দিল্লিভিত্তিক সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অব সিভিল রাইটস’ দেশজুড়ে ১৮৪টি মুসলিমবিদ্বেষী ঘটনার তথ্য নথিভুক্ত করেছে। এর প্রায় অর্ধেক অভিযোগ বিদ্বেষমূলক বক্তব্যসংক্রান্ত। আর বাকি ঘটনাগুলোর মধ্যে ছিল ভয় দেখানো, হয়রানি, হামলা, ভাঙচুর, হুমকি, গালাগাল করা ও তিনটি হত্যার ঘটনা।
এখানে যে শুধু ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সহিংসতা হচ্ছে তা নয়; এর চেয়েও বিপজ্জনক এক পরিবর্তন ঘটছে। তা হলো, সন্দেহকে রাজনীতির মূলস্রোতে অন্তর্ভুক্ত করা ও ভারতে মুসলমান পরিচয়ের মানে কী, তা নতুনভাবে নির্ধারণ করা।
এখানে যে শুধু ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সহিংসতা হচ্ছে, তা নয়। এর চেয়েও বিপজ্জনক এক পরিবর্তন ঘটছে। তা হলো সন্দেহকে রাজনীতির মূলস্রোতে অন্তর্ভুক্ত করা ও ভারতে মুসলমান পরিচয়ের মানে কী, তা নতুনভাবে নির্ধারণ করা।পেহেলগামে হামলার ঘটনার পর ভারত সরকার ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামের অভিযান চালায়। এটি ছিল সামরিক অভিযান। লক্ষ্যবস্তু ছিল পাকিস্তানের কিছু জায়গা। ভারতের অভিযোগ, পেহেলগামে হামলার ঘটনায় পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতা আছে। যদিও এ অভিযোগ পাকিস্তান অস্বীকার করেছে। এ অভিযানকে সরকারিভাবে জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত উদ্যোগ হিসেবে দেখানো হলেও এর জেরে আঞ্চলিক উত্তেজনা অনেকখানি বেড়ে গেছে।
এ অভিযানের পর ভারতের ভেতরও এর প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে ভারতীয় মুসলমানদের নিয়ে মানুষের ভাবনা ও তাঁদের সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কট্টর জাতীয়তাবাদী অ্যাকাউন্টগুলো বিদ্বেষ ছড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। তারা ভারতীয় মুসলমানদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘দেশদ্রোহী’ বলে অপবাদ দিতে শুরু করেছে।
অপারেশন সিঁদুরকে ঘিরে আলোচনা খুব দ্রুত এমন দিকে মোড় নেয়, যেখানে মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ভারতীয় মুসলমানদের দেশপ্রেমের বিষয়টি। সরকারের জম্মু ও কাশ্মীরের নিরাপত্তাব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার বদলে মুসলমানদের প্রতি সন্দেহের বিষয়টিই আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। অথচ দেশটির মুসলমানরা পেহেলগাম হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
দশকের পর দশক ভারতের বহু মানুষ স্থানীয় মুসলমানদের পাকিস্তানি আখ্যা দিয়ে আসছেন। মুসলমানদের বসবাসের এলাকাগুলো ‘মিনি পাকিস্তান’ বলে ডাকা হয়। ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ হলে তাঁদের পাকিস্তানের সমর্থক বলে উপহাস করা হয়। এমনকি পাকিস্তানে চলে যাও—এ ধরনের কথাও তাঁদের প্রায়ই শুনতে হয়।হুসেন হায়েদ্রি, ভারতীয় লেখক মুসলমানদের মূল্য চোকাতে হয়ইতিহাস বলে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যখনই সামরিক বা কূটনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হয়, তখন ভারতীয় মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও মানসিকভাবে এর মূল্য চোকাতে হয়। এবারের পরিস্থিতিও এর ব্যতিক্রম নয়।
লেখক হুসেন হায়েদ্রি মিডল ইস্ট আই–কে বলেন, ‘দশকের পর দশক ভারতের বহু মানুষ ভারতীয় মুসলমানদের পাকিস্তানি বলে আখ্যা দিয়ে আসছেন। মুসলমানদের বসবাসের এলাকাগুলো ‘‘মিনি পাকিস্তান’’ বলে ডাকা হয়। ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ হলে তাঁদের পাকিস্তানের সমর্থক বলে উপহাস করা হয়। এমনকি ‘‘পাকিস্তানে চলে যাও’’—এ ধরনের কথাও তাঁদের প্রায়ই শুনতে হয়।’
হুসেন হায়েদ্রির মতে, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা চলাকালে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর হাতে দেশটির মুসলমানদের নানাভাবে ক্ষতির শিকার হওয়ার ঘটনায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, এই বৈষম্য ও সহিংসতার পেছনে যে সাংস্কৃতিক কাঠামো প্রয়োজন, তা দেশটিতে বহু আগেই গড়ে উঠেছে।
এবারের প্রতিক্রিয়াটা আরও তীব্র হয়েছে, যা সম্প্রতি আম্বালায় দেখা গেছে। সেখানে বেশকিছু মানুষ একসঙ্গে হয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়ে মুসলিম মালিকানাধীন দোকানগুলোয় আগুন দিয়েছেন। এটা কোনো আকস্মিক সাম্প্রদায়িক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল না। উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো প্রকাশ্যে ও সংগঠিতভাবে এ হামলায় অংশ নিয়েছিল।
এ ট্র্যাজেডি শুধু শারীরিক সহিংসতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; বরং সন্দেহ করার ধারাটি রাজনৈতিক মূলধারায় পরিণত হওয়ার পথে আছে। ভারতীয় মুসলমানদের নাগরিকত্বের ধারণাকে এমনভাবে বদলানো হচ্ছে, যেন তা শর্তসাপেক্ষ, দুর্বল ও সব সময় সন্দেহের চোখে দেখা হয়।
ভারতে চলতি মাসের শুরুতে স্থানীয় এক সাংবাদিক একজন মুসলিমকে ‘পাকিস্তানি’ হিসেবে দাবি করে নির্যাতন করার পর তিনি আত্মহত্যা করেন। ওই সাংবাদিক পরে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান। তাঁর মৃত্যু ভারতের ভেতরের এমন এক আবহকে প্রকাশ করছে, যেখানে শুধু সন্দেহ থেকেই কারও জীবন চলে যেতে পারে।এটি আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়; বরং বছরের পর বছর স্কুলের পাঠ্যপুস্তক, টেলিভিশন বিতর্ক, রাজনৈতিক বক্তৃতা, হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা ও অনলাইন প্রচারের মাধ্যমে তৈরি হওয়া ভাবধারারই ফল। পেহেলগামে হামলার ঘটনা ছিল অনেক দিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভ প্রকাশের একটি অজুহাতমাত্র।
ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনাগুলো এখন ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একধরনের অঘোষিত আনুগত্যের পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে। আর এ পরীক্ষা দিন দিন আরও স্পষ্ট ও প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে।
পেহেলগামে হামলার পরদিন ২৩ এপ্রিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা পেহেলগামের বাইসারান এলাকায় তল্লাশি অভিযান চালান.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক প রক শ র ঘটন ঘটন র
এছাড়াও পড়ুন:
কাজাকিস্তানের যাযাবর জাতির করুণ ইতিহাস
বিংশ শতাব্দীর আগে পৃথিবীর মানচিত্রে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান নামের এই পাঁচটি দেশ ছিলো না। মূলত ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই রাষ্ট্রগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। পরে চীনের সহায়তায় ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলগুলো বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল হিসেবে পুনরুত্থান হয়েছে। এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে, চীন কেন আবারও এই অঞ্চলগুলোকে শক্তিশালী করে তুলছে?
ঐতিহাসিকভাবে মধ্য এশিয়া অঞ্চল সিল্করোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো। যা চীনকে মধ্যপ্রাচ্য এবং রোমান সভ্যতার সাথে যুক্ত করেছিলো। বীজ গণিতের জনক আল খারিজমি, আবু সিনার মতো বিজ্ঞানীদের জন্ম হয়েছে এখানে। যাদের লেখা বই ইউরোপে শত শত বছর ধরে চিকিৎসা ও নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। চেঙ্গিস খানও এই অঞ্চলে তার সম্রাজ্যের নিদর্শন রেখে গেছেন। পাশাপাশি ঘোড়ার পিঠে আদিম যাযাবর জীবনের ঐতিহ্যও টিকে আছে এখানে।
আরো পড়ুন:
রাশিয়ার বিরুদ্ধে এবার রোমানিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ
রাশিয়ায় ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প, সুনামির সতর্কতা
রাজনৈতিক প্রভাব ও সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করেছিলো রুশরা। উপনিবেশিক শাসন এমনভাবে চালু করেছিলো, যা অনেকটা ব্রিটিশ বা ফরাসি সম্রাজ্যের মতো দেখতে।
রাজ্যগুলোকে শিল্পায়ন ও আধুনিকায়নের ফলে বিশাল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এমনকি যাযাবর জাতিকে যুদ্ধ যেতে বাধ্য করা হয়েছিলো। আর যাযাবর জাতিকে বসতি স্থাপনে বাধ্য করা হয়েছিলো। এরপর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে কাজাখ জনগোষ্ঠীর চল্লিশ শতাংশ অর্থাৎ ২৫ শতাংশ মানুষ অনাহারে মারা যায়। এবং যাযাবর জনগোষ্ঠীর যে অর্থনীতি, তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। কারণ সোভিয়েত আমলে কাজাখ যাযাবররা যে পশুপালন করতো তার নব্বই শতাংশই মারা যায়। ফলে বাধ্য হয়ে কাজাখদের যাযাবর জীবনযাত্রা ছেড়ে দিতে হয়। বলতে গেলে সোভিয়েত আমলে কাজাখ সভ্যতা ও সংস্কৃতির বেদনাদায়ক পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
১৯৯১ সালে সোভিয়েন ইউনিয়নের পতন হয়, সৃষ্টি হয় এই পাঁচটি স্বাধীন দেশের। এই দেশগুলো স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী বিশ্বে খাপ খাইয়ে নিতে তাদের ব্যাপক সংগ্রাম করতে হয়। তবে বিগত কয়েক দশক ধরে মধ্য এশিয়ার যাযাবর জাতিগুলো নিজস্ব সীমানার মধ্যে এক অনন্য পরিচয় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। যদিও তাদের ওপর বাইরের প্রভাবও রয়েছে। তুরস্ক এই অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতি আরও বেশি জানান দিচ্ছে। সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং ভাষাগত মিল আছে। এমনকি শিক্ষাগত কাঠামোতেও মিল রয়েছে। তুরস্ক মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার পণ্য রফতানির একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হিসেবেও বিবেচিত।
জিনজিয়াং প্রদেশে প্রায় এক কোটি উইঘুর বাস করেন। যাদের বেশিরভাগই মুসলিম। এদের নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া উইঘুর পরিচয় মুছে ফেলতে তাদের পুনঃশিক্ষা শিবিরে আটকে রাখার অভিযোগও আছে। যদিও চীন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
বৈশ্বিক অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর চীন মধ্য এশিয়ায় ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন করছে। এই অঞ্চলটিকে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করতে চাইছে, যা অনেকটা সিল্করুটের মতোই।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ উদ্যোগের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় প্রাচীন সিল্ক রোড পুনরুজ্জীবিত করার একটি সম্ভবনা দেখা দিয়েছে। এই রোড পুনরুজ্জীবিত হলে রাশিয়া আর চীনের প্রভাব বলয়ে থাকা এই অঞ্চলের ভূ রাজনৈতিক গুরুত্ব কতটা বাড়বে-সেটাও সময় বলে দেবে।
ঢাকা/লিপি