ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে গত এপ্রিলে পর্যটকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলার পর থেকে দেশটিজুড়ে একের পর এক মুসলিমবিদ্বেষী ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

ভারতের কবি ও গবেষক নাবিয়া খান ভারতে ইসলামবিদ্বেষ নিয়ে গত ২২ মে মিডল ইস্ট আইয়ে লেখা এক মতামত কলামে বলেন, গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের গুলিতে ২৬ জন নিহত হন। এর প্রায় দুই সপ্তাহের মধ্যে দিল্লিভিত্তিক সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অব সিভিল রাইটস’ দেশজুড়ে ১৮৪টি মুসলিমবিদ্বেষী ঘটনার তথ্য নথিভুক্ত করেছে। এর প্রায় অর্ধেক অভিযোগ বিদ্বেষমূলক বক্তব্যসংক্রান্ত। আর বাকি ঘটনাগুলোর মধ্যে ছিল ভয় দেখানো, হয়রানি, হামলা, ভাঙচুর, হুমকি, গালাগাল করা ও তিনটি হত্যার ঘটনা।

এখানে যে শুধু ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সহিংসতা হচ্ছে তা নয়; এর চেয়েও বিপজ্জনক এক পরিবর্তন ঘটছে। তা হলো, সন্দেহকে রাজনীতির মূলস্রোতে অন্তর্ভুক্ত করা ও ভারতে মুসলমান পরিচয়ের মানে কী, তা নতুনভাবে নির্ধারণ করা।

এখানে যে শুধু ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সহিংসতা হচ্ছে, তা নয়। এর চেয়েও বিপজ্জনক এক পরিবর্তন ঘটছে। তা হলো সন্দেহকে রাজনীতির মূলস্রোতে অন্তর্ভুক্ত করা ও ভারতে মুসলমান পরিচয়ের মানে কী, তা নতুনভাবে নির্ধারণ করা।

পেহেলগামে হামলার ঘটনার পর ভারত সরকার ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামের অভিযান চালায়। এটি ছিল সামরিক অভিযান। লক্ষ্যবস্তু ছিল পাকিস্তানের কিছু জায়গা। ভারতের অভিযোগ, পেহেলগামে হামলার ঘটনায় পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতা আছে। যদিও এ অভিযোগ পাকিস্তান অস্বীকার করেছে। এ অভিযানকে সরকারিভাবে জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত উদ্যোগ হিসেবে দেখানো হলেও এর জেরে আঞ্চলিক উত্তেজনা অনেকখানি বেড়ে গেছে।

এ অভিযানের পর ভারতের ভেতরও এর প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে ভারতীয় মুসলমানদের নিয়ে মানুষের ভাবনা ও তাঁদের সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কট্টর জাতীয়তাবাদী অ্যাকাউন্টগুলো বিদ্বেষ ছড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। তারা ভারতীয় মুসলমানদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘দেশদ্রোহী’ বলে অপবাদ দিতে শুরু করেছে।

অপারেশন সিঁদুরকে ঘিরে আলোচনা খুব দ্রুত এমন দিকে মোড় নেয়, যেখানে মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ভারতীয় মুসলমানদের দেশপ্রেমের বিষয়টি। সরকারের জম্মু ও কাশ্মীরের নিরাপত্তাব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার বদলে মুসলমানদের প্রতি সন্দেহের বিষয়টিই আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। অথচ দেশটির মুসলমানরা পেহেলগাম হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।

দশকের পর দশক ভারতের বহু মানুষ স্থানীয় মুসলমানদের পাকিস্তানি আখ্যা দিয়ে আসছেন। মুসলমানদের বসবাসের এলাকাগুলো ‘মিনি পাকিস্তান’ বলে ডাকা হয়। ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ হলে তাঁদের পাকিস্তানের সমর্থক বলে উপহাস করা হয়। এমনকি পাকিস্তানে চলে যাও—এ ধরনের কথাও তাঁদের প্রায়ই শুনতে হয়।হুসেন হায়েদ্রি, ভারতীয় লেখক মুসলমানদের মূল্য চোকাতে হয়

ইতিহাস বলে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যখনই সামরিক বা কূটনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হয়, তখন ভারতীয় মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও মানসিকভাবে এর মূল্য চোকাতে হয়। এবারের পরিস্থিতিও এর ব্যতিক্রম নয়।

লেখক হুসেন হায়েদ্রি মিডল ইস্ট আই–কে বলেন, ‘দশকের পর দশক ভারতের বহু মানুষ ভারতীয় মুসলমানদের পাকিস্তানি বলে আখ্যা দিয়ে আসছেন। মুসলমানদের বসবাসের এলাকাগুলো ‘‘মিনি পাকিস্তান’’ বলে ডাকা হয়। ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ হলে তাঁদের পাকিস্তানের সমর্থক বলে উপহাস করা হয়। এমনকি ‘‘পাকিস্তানে চলে যাও’’—এ ধরনের কথাও তাঁদের প্রায়ই শুনতে হয়।’

হুসেন হায়েদ্রির মতে, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা চলাকালে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর হাতে দেশটির মুসলমানদের নানাভাবে ক্ষতির শিকার হওয়ার ঘটনায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, এই বৈষম্য ও সহিংসতার পেছনে যে সাংস্কৃতিক কাঠামো প্রয়োজন, তা দেশটিতে বহু আগেই গড়ে উঠেছে।

এবারের প্রতিক্রিয়াটা আরও তীব্র হয়েছে, যা সম্প্রতি আম্বালায় দেখা গেছে। সেখানে বেশকিছু মানুষ একসঙ্গে হয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়ে মুসলিম মালিকানাধীন দোকানগুলোয় আগুন দিয়েছেন। এটা কোনো আকস্মিক সাম্প্রদায়িক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল না। উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো প্রকাশ্যে ও সংগঠিতভাবে এ হামলায় অংশ নিয়েছিল।

এ ট্র্যাজেডি শুধু শারীরিক সহিংসতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; বরং সন্দেহ করার ধারাটি রাজনৈতিক মূলধারায় পরিণত হওয়ার পথে আছে। ভারতীয় মুসলমানদের নাগরিকত্বের ধারণাকে এমনভাবে বদলানো হচ্ছে, যেন তা শর্তসাপেক্ষ, দুর্বল ও সব সময় সন্দেহের চোখে দেখা হয়।

ভারতে চলতি মাসের শুরুতে স্থানীয় এক সাংবাদিক একজন মুসলিমকে ‘পাকিস্তানি’ হিসেবে দাবি করে নির্যাতন করার পর তিনি আত্মহত্যা করেন। ওই সাংবাদিক পরে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান। তাঁর মৃত্যু ভারতের ভেতরের এমন এক আবহকে প্রকাশ করছে, যেখানে শুধু সন্দেহ থেকেই কারও জীবন চলে যেতে পারে।

এটি আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়; বরং বছরের পর বছর স্কুলের পাঠ্যপুস্তক, টেলিভিশন বিতর্ক, রাজনৈতিক বক্তৃতা, হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা ও অনলাইন প্রচারের মাধ্যমে তৈরি হওয়া ভাবধারারই ফল। পেহেলগামে হামলার ঘটনা ছিল অনেক দিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভ প্রকাশের একটি অজুহাতমাত্র।

ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনাগুলো এখন ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একধরনের অঘোষিত আনুগত্যের পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে। আর এ পরীক্ষা দিন দিন আরও স্পষ্ট ও প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে।

পেহেলগামে হামলার পরদিন ২৩ এপ্রিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা পেহেলগামের বাইসারান এলাকায় তল্লাশি অভিযান চালান.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক প রক শ র ঘটন ঘটন র

এছাড়াও পড়ুন:

আফগানিস্তানে মধ্যরাতে শক্তিশালী ভূমিকম্পের আঘাত

আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় হিন্দুকুশ অঞ্চলে ৬ দশমিক ৩ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। যুক্তরাষ্ট্র ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) এ তথ্য জানিয়েছে। দুই মাস আগেই দেশটিতে এক ভূমিকম্পে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

ইউএসজিএস জানায়, রোববার দিবাগত রাতে আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ অঞ্চলে মাজার-ই-শরিফ শহরের কাছে খোলম এলাকায় ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। স্থানীয় সময় রাত ১২টা ৫৯ মিনিটে আঘাত হানা এই ভূমিকম্পের গভীরতা প্রথমে ১০ কিলোমিটার বলা হয়। পরে তা সংশোধন করে গভীরতা ২৮ কিলোমিটার বলে জানায় সংস্থাটি।

আফগানিস্তানের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা জানিয়েছে, হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পরে জানানো হবে।

উল্লেখ্য, গত ৩১ আগস্ট আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্পটি আঘাত হেনেছিল। দেশটির পূর্বাঞ্চলে আঘাত হানা রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে ২ হাজার ২০০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান।

আরও পড়ুনআফগানিস্তানে ভূমিকম্পে নিহত বেড়ে ২২০৫, খোলা আকাশের নিচে মানুষ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আফগানিস্তানে প্রায়শই ভূমিকম্প আঘাত হানে। বিশেষ করে হিন্দুকুশ পর্বতমালা বরাবর, যেখানে ইউরেশীয় এবং ভারতীয় টেকটোনিক প্লেটগুলো মিলিত হয়েছে।

ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার ভূমিকম্পবিদ ব্রায়ান ব্যাপটির দেওয়া তথ্য মতে, ১৯০০ সাল থেকে উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার বেশি ১২টি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে।

আরও পড়ুন৩৫ বছরে আফগানিস্তানে ভয়াবহ যত ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ