২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি করা প্রসাধনী ও টয়লেট্রিজ পণ্যের ওপর ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর আরোপের প্রস্তাব এসেছে।

সরকারের ব্যাখ্যা হতে পারে, এই সিদ্ধান্ত দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেবে, আমদানি–নির্ভরতা কমাবে এবং রাজস্ব আয় বাড়াবে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ ধরনের নীতি শেষ পর্যন্ত বাজারের ভারসাম্য বিনষ্ট করে, উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করে এবং ভোক্তাদের কষ্ট বাড়ায়।

শুল্ক ও ভ্যাট বাড়ানোর সরাসরি প্রভাব পড়ে প্রতিযোগিতার ওপর। প্রতিযোগিতা যখন বাধাগ্রস্ত হয়, তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ভোক্তা, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি।

আরও পড়ুনবাঙালির গুজব কিন্তু ফেলনা নয়২৪ অক্টোবর ২০২৪

প্রতিযোগিতা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। চীনের ইলেকট্রিক গাড়ির শিল্প এ কথার জীবন্ত প্রমাণ। শত শত কোম্পানির মধ্যে প্রতিদিনের লড়াই, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের দৌড় আর ক্রমাগত মানোন্নয়ন—এসব মিলেই বিওয়াইডির মতো প্রতিষ্ঠান আজ টেসলার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।

ডিপসিকের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোও উন্নত মানে পৌঁছেছে একমাত্র প্রতিযোগিতার কারণে।

সরকার হয়তো ভাবছে, শুল্ক বাড়ালে বিদেশি পণ্যের প্রবেশ ঠেকবে, দেশীয় পণ্যের চাহিদা বাড়বে, উৎপাদন বাড়বে এবং রাজস্ব আয়ও বাড়বে। বাস্তবে এর উল্টোটা ঘটে।

যখন কোনো পণ্যের দাম আকস্মিকভাবে বেড়ে যায়, তখন সেটি বৈধ পথে আনা বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে চোরাচালান বাড়ে। সীমান্তবর্তী এলাকা, ব্যক্তিগত লাগেজ কিংবা অনলাইন কুরিয়ারের মাধ্যমে বিদেশি প্রসাধনী দেশে প্রবেশ করতে থাকে।

আরও পড়ুনবাজেট কি দুই বেদনা থেকে মুক্তির পথ দেখাবে০২ জুন ২০২৫

এর মানে, সরকার রাজস্ব হারায়, বাজার হয় অনিয়ন্ত্রিত, আর নিরাপত্তা ও মান নিয়ন্ত্রণের সুযোগ কমে যায়।

শুল্ক বৃদ্ধির ফলে দেশের ক্ষুদ্র ই-কমার্স উদ্যোক্তারাও বড় বিপদের মুখে পড়বেন। বর্তমানে অনেকে ফেসবুক পেজ, ইনস্টাগ্রাম কিংবা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিদেশি প্রসাধনী বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

দাম বাড়লে এই ব্যবসা তাঁদের জন্য অলাভজনক হয়ে যাবে। অনেক তরুণ-তরুণীর উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়বে। উদ্যোক্তাবান্ধব অর্থনীতির বদলে আমরা পাব একধরনের নিয়ন্ত্রিত, অচল বাজার।

আরও ভয়ংকর হলো, একচেটিয়া বাজারের জন্ম। যখন বিদেশি পণ্যের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন দেশীয় পণ্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রয়োজন পড়ে না। তারা জানে, পণ্যের মান যা–ই হোক, বিক্রি হবেই।

ফলাফল হয় নিম্নমানের পণ্য, উচ্চ মূল্য এবং ভোক্তার অসন্তুষ্টি। কেউ কেউ বলতেই পারেন, অন্তত দেশীয় শিল্প বাঁচবে। কিন্তু মানহীন শিল্প বাঁচিয়ে লাভ কী?

বাংলাদেশেও তৈরি পোশাক খাতের সাফল্য এসেছে প্রতিনিয়ত লড়াই আর মানোন্নয়নের মধ্য দিয়ে। সুরক্ষাবাদী নীতি সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা শিল্পকে দুর্বল করে, উদ্ভাবনকে থামিয়ে দেয় এবং ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা করে। প্রতিযোগিতা ছাড়া কোনো শিল্পই বিশ্বমানের হতে পারে না। আর প্রতিযোগিতা না থাকলে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন কেবল স্লোগানেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

এই সিদ্ধান্তের আরেকটি কুফল হলো মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ওপর বাড়তি চাপ। যাঁরা গুণগত প্রসাধনী ব্যবহার করতে চান, তাদের কাছে এগুলো হয়ে উঠবে হাতের বাইরের জিনিস।

একদিকে উচ্চবিত্ত মানুষ বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে বা কুরিয়ারে পণ্য আনিয়ে নেবেন, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে নকল বা নিম্নমানের পণ্য কিনবেন।

এই ব্যবধান ধীরে ধীরে সামাজিক বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দেবে।

দেশীয় শিল্প গড়ে তোলার জন্য বিকল্প পথ রয়েছে। সরকার চাইলে প্রযুক্তিগত সহায়তা, গবেষণা তহবিল, মান নিয়ন্ত্রণ, ডিজিটাল প্রশিক্ষণ, সহজ ঋণ ও কাঁচামালে শুল্ক হ্রাসের মাধ্যমে দেশীয় উদ্যোক্তাদের সক্ষম করে তুলতে পারে।

এতে তাঁরা শুধু দেশের ভেতরই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হবেন।

বিশ্বব্যাপী যারা উন্নত হয়েছে, তারা কেউই নিজের বাজারকে শুল্ক দিয়ে সুরক্ষিত রাখেনি। দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং, এলজি, জাপানের সনি কিংবা টয়োটার মতো কোম্পানিগুলো ক্রমে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের উন্নত করেছে।

বাংলাদেশেও তৈরি পোশাক খাতের সাফল্য এসেছে প্রতিনিয়ত লড়াই আর মানোন্নয়নের মধ্য দিয়ে।

সুরক্ষাবাদী নীতি সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা শিল্পকে দুর্বল করে, উদ্ভাবনকে থামিয়ে দেয় এবং ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা করে।

প্রতিযোগিতা ছাড়া কোনো শিল্পই বিশ্বমানের হতে পারে না। আর প্রতিযোগিতা না থাকলে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন কেবল স্লোগানেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

সরকারের উচিত বাজেট ঘোষণার আগেই এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা। তা না হলে এর পরিণতি বহুমাত্রিক ক্ষতির দিকে নিয়ে যাবে, যার বোঝা বইবে সাধারণ মানুষ, তরুণ উদ্যোক্তা এবং শেষ পর্যন্ত পুরো অর্থনীতি।

মহিবুল ইসলাম শিক্ষক, ইউল্যাব

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স রক ষ ন নয়ন সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ক্রিকেট ভালোবাসলে বুঝি ফুটবলকে ভালোবাসা যায় না

শূন্য আকাশে তারা খোঁজার ক্লান্তি ছিল বহুকাল। অদূরদর্শীতার কারণে ছিল শুধুই আত্মবিস্মৃতিও। সেখানে ফুটবলের সেই অভিমানের আকাশেই হঠাৎ হামজা, ফাহমিদুল, শমিতদের আগমন। অতীত দৃষ্টান্তে নাড়া দেওয়া মন যেমন চাইছিল শুধু মান রাখার বর্তমানে, তা পেয়েছে বাংলাদেশ ফুটবলের নতুন আকাশ। রাত জেগে ইউরোপিয়ান ফুটবল দেখা চোখ হামজাদের নতুন বাংলাদেশে দেখেছে সেই গতি, সেই ছন্দ, সেই শৈলী। যে ফুটবলে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল ক্রীড়াপ্রেমীরা এখনা তারাই বুদ লাল–সবুজের ফুটবল নিয়ে। কিন্তু এখানেই একটা চোরা বিভক্তি সর্বজনীন গৌরবের জায়গাটাতে ধাক্কা দিচ্ছে।

যাদের ফেসবুকের দেওয়ালে সারা বছর বাংলাদেশ ক্রিকেট থাকে, তারা কেন এখন হামজাদের ফুটবল নিয়ে প্রশংসা করবেন? তাদের কি সেই অধিকার আছে? ক্রিকেট মাঠের যে সমর্থককে মুখে বাঘের রঙ মেখে মিরপুরের গ্যালারিতে দেখা যায়, সে কেন আবার জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে গলা ফাটাবেন? লিটন দাস বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হয়ে কেন হামজাদের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে ফেস বুকে স্ট্যাটাস দেবেন?

ফুটবল আর ক্রিকেট নিয়ে ভালোবাসার এই ভাগাভাগি নতুন এক প্রতিদ্বন্দ্বীতার জন্ম দিচ্ছে। যেখানে একদল শুধুই ফুটবল হলে অন্য দল অবশ্যই ক্রিকেট! কিন্তু যেখানে ক্রিকেট কিংবা ফুটবল দুই দলই যখন লাল-সবুজের হয়ে খেলতে নামে, বুকে হাত রেখে জাতীয় সঙ্গীত গায় সেখানে দুই খেলাকেই এক সঙ্গে ভালোবাসলে কী ক্ষতি কে জানে।

তবে এটা সত্য যে ফুটবলের এই মধু মৌসুমে মৌমাছির আনাগোনা বেড়েছে। যে ক্রীড়া সাংবাদিককে বছরের পর বছর ফুটবলের সঙ্গে থেকে খেলার পাতায় সিঙ্গেল কলাম পাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করতে হয়েছে, তাকেই এখন তিনটির বেশি রিপোর্ট পাঠাতে হয়। খোঁজ নিতে হয় হামজার হবিগঞ্জের গ্রামের। এই ব্যস্ততা তার আনন্দের। সংবাদ সম্মেলনে তাই চেয়ার না পেয়ে মাটিতে বসে থাকতেও তার আপত্তি নেই।

এটাও অস্বিকার করার উপায় নেই যে, নব্বইয়ের দশকে ক্রিকেট যখন খেলার পাতার বেশির ভাগ জায়গা দখল করতে থাকে তখন থেকেই একটা অবহেলাও বুঝি ছিল ফুটবলের প্রতি। তা নিয়ে নিজেদের অজান্তেই একটা আত্মম্ভরী ভাব এসে গেছে কিছু ক্রিকেট লিখিয়ের মধ্যেও। অনেকেই ধরেই নিয়েছে ক্রিকেট দলের হার জিতের মধ্যেই তারও সাফল্য-ব্যার্থতা জড়িয়ে!

ওই সময়টাতে ক্রিকেটের জেট গতিতে এগিয়ে যাওয়ার কারণ যেমন ছিল তেমনি ক্লাব ফুটবলে ভাটার টানও ছিল। অঢেল অর্থে তখন অনেক প্রভাবশালী ক্লাবের সভাপতি পদ কিনে নিয়েছেন। আবাহনী-মোহামেডানের মতো সমর্থক গোষ্ঠিদের ক্লাব সেই সব হঠাৎ ‘বড় লোক’ হয়ে ওঠা ক্লাবের কাছে হেরে গেছে। সেই তারাই ক্রিকেটে এসেছিল জোয়ারের টানে। ক্রিকেটে এখন জাতীয় দল খারাপ সময় পার করছে, সমর্থকরাও ব্যথিত তা নিয়ে। ‘ক্রিকেটের দিন শেষ’- বলছেন তারা অভিমানে। তবে এটাও মানতে হবে যে ফুটবলে এখন যে জোয়ার এসেছে তা কেবলই জাতীয় দল কেন্দ্রীক। এর স্থায়িত্ব নির্ভর করছে ক্লাব ফুটবলের জনপ্রিয়তার ওপরই।

এক সময়ের রক্সি, সাব্বির, মুন্না, রুমি, আসলামরা জনপ্রিয় হয়েছিলেন ক্লাব ফুটবল খেলেই। হামজার আজ যে বৈশ্বিক পরিচিত তাও কিন্তু তার ক্লাব লেস্টার সিটি দিয়েই। বছরে জাতীয় দলের হয়ে পাঁচ-ছয়টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তারকারা। সেখানে ক্রিকেটে জাতীয় দলের খেলা থাকে অন্তত পনেরো থেকে কুড়িটা। এদিক থেকে ফুটবলের চেয়ে নিশ্চিত অ্যাডভান্টেজ ক্রিকেটের। তাহলে কী জাতীয় দলের ক’টি ম্যাচ ঘিরেই শুধু জোয়ার চলবে দেশীয় ফুটবলে?

এভাবে ভাবলে আবার রাগ, দুঃখ, অভিমান শেষে হতাশা বাসা বাধতে পারে। ফুটবলের প্রতি টান কখনোই কমেনি বাংলাদেশের ক্রীড়াপ্রেমীদের। যদি তাই হতো তাহলে মেসি-রোনালদোকে নিয়ে তর্ক করে একটি প্রজন্ম বুড়ো হয়ে যেতো না, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের সঙ্গে নিজেদের আবেগে জড়িয়ে পরতো না। আসলে ফুটবল কিংবা ক্রিকেটে, যে কোন ধরনের খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসার টান থেকেই তৈরি হয় কৃষ্টি। তাই ভালোবাসায় দ্বন্দ্বের আগুনে ঘি না ঢেলে তা চাপা দিয়ে রাখায় শ্রেয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ