প্রসাধনীতে উচ্চ ভ্যাট বসালে আসলেই কি রাজস্ব বাড়বে
Published: 3rd, June 2025 GMT
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি করা প্রসাধনী ও টয়লেট্রিজ পণ্যের ওপর ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর আরোপের প্রস্তাব এসেছে।
সরকারের ব্যাখ্যা হতে পারে, এই সিদ্ধান্ত দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেবে, আমদানি–নির্ভরতা কমাবে এবং রাজস্ব আয় বাড়াবে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ ধরনের নীতি শেষ পর্যন্ত বাজারের ভারসাম্য বিনষ্ট করে, উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করে এবং ভোক্তাদের কষ্ট বাড়ায়।
শুল্ক ও ভ্যাট বাড়ানোর সরাসরি প্রভাব পড়ে প্রতিযোগিতার ওপর। প্রতিযোগিতা যখন বাধাগ্রস্ত হয়, তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ভোক্তা, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি।
আরও পড়ুনবাঙালির গুজব কিন্তু ফেলনা নয়২৪ অক্টোবর ২০২৪প্রতিযোগিতা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। চীনের ইলেকট্রিক গাড়ির শিল্প এ কথার জীবন্ত প্রমাণ। শত শত কোম্পানির মধ্যে প্রতিদিনের লড়াই, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের দৌড় আর ক্রমাগত মানোন্নয়ন—এসব মিলেই বিওয়াইডির মতো প্রতিষ্ঠান আজ টেসলার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
ডিপসিকের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোও উন্নত মানে পৌঁছেছে একমাত্র প্রতিযোগিতার কারণে।
সরকার হয়তো ভাবছে, শুল্ক বাড়ালে বিদেশি পণ্যের প্রবেশ ঠেকবে, দেশীয় পণ্যের চাহিদা বাড়বে, উৎপাদন বাড়বে এবং রাজস্ব আয়ও বাড়বে। বাস্তবে এর উল্টোটা ঘটে।
যখন কোনো পণ্যের দাম আকস্মিকভাবে বেড়ে যায়, তখন সেটি বৈধ পথে আনা বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে চোরাচালান বাড়ে। সীমান্তবর্তী এলাকা, ব্যক্তিগত লাগেজ কিংবা অনলাইন কুরিয়ারের মাধ্যমে বিদেশি প্রসাধনী দেশে প্রবেশ করতে থাকে।
আরও পড়ুনবাজেট কি দুই বেদনা থেকে মুক্তির পথ দেখাবে০২ জুন ২০২৫এর মানে, সরকার রাজস্ব হারায়, বাজার হয় অনিয়ন্ত্রিত, আর নিরাপত্তা ও মান নিয়ন্ত্রণের সুযোগ কমে যায়।
শুল্ক বৃদ্ধির ফলে দেশের ক্ষুদ্র ই-কমার্স উদ্যোক্তারাও বড় বিপদের মুখে পড়বেন। বর্তমানে অনেকে ফেসবুক পেজ, ইনস্টাগ্রাম কিংবা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিদেশি প্রসাধনী বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
দাম বাড়লে এই ব্যবসা তাঁদের জন্য অলাভজনক হয়ে যাবে। অনেক তরুণ-তরুণীর উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়বে। উদ্যোক্তাবান্ধব অর্থনীতির বদলে আমরা পাব একধরনের নিয়ন্ত্রিত, অচল বাজার।
আরও ভয়ংকর হলো, একচেটিয়া বাজারের জন্ম। যখন বিদেশি পণ্যের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন দেশীয় পণ্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রয়োজন পড়ে না। তারা জানে, পণ্যের মান যা–ই হোক, বিক্রি হবেই।
ফলাফল হয় নিম্নমানের পণ্য, উচ্চ মূল্য এবং ভোক্তার অসন্তুষ্টি। কেউ কেউ বলতেই পারেন, অন্তত দেশীয় শিল্প বাঁচবে। কিন্তু মানহীন শিল্প বাঁচিয়ে লাভ কী?
বাংলাদেশেও তৈরি পোশাক খাতের সাফল্য এসেছে প্রতিনিয়ত লড়াই আর মানোন্নয়নের মধ্য দিয়ে। সুরক্ষাবাদী নীতি সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা শিল্পকে দুর্বল করে, উদ্ভাবনকে থামিয়ে দেয় এবং ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা করে। প্রতিযোগিতা ছাড়া কোনো শিল্পই বিশ্বমানের হতে পারে না। আর প্রতিযোগিতা না থাকলে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন কেবল স্লোগানেই সীমাবদ্ধ থাকবে।এই সিদ্ধান্তের আরেকটি কুফল হলো মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ওপর বাড়তি চাপ। যাঁরা গুণগত প্রসাধনী ব্যবহার করতে চান, তাদের কাছে এগুলো হয়ে উঠবে হাতের বাইরের জিনিস।
একদিকে উচ্চবিত্ত মানুষ বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে বা কুরিয়ারে পণ্য আনিয়ে নেবেন, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে নকল বা নিম্নমানের পণ্য কিনবেন।
এই ব্যবধান ধীরে ধীরে সামাজিক বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দেবে।
দেশীয় শিল্প গড়ে তোলার জন্য বিকল্প পথ রয়েছে। সরকার চাইলে প্রযুক্তিগত সহায়তা, গবেষণা তহবিল, মান নিয়ন্ত্রণ, ডিজিটাল প্রশিক্ষণ, সহজ ঋণ ও কাঁচামালে শুল্ক হ্রাসের মাধ্যমে দেশীয় উদ্যোক্তাদের সক্ষম করে তুলতে পারে।
এতে তাঁরা শুধু দেশের ভেতরই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হবেন।
বিশ্বব্যাপী যারা উন্নত হয়েছে, তারা কেউই নিজের বাজারকে শুল্ক দিয়ে সুরক্ষিত রাখেনি। দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং, এলজি, জাপানের সনি কিংবা টয়োটার মতো কোম্পানিগুলো ক্রমে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের উন্নত করেছে।
বাংলাদেশেও তৈরি পোশাক খাতের সাফল্য এসেছে প্রতিনিয়ত লড়াই আর মানোন্নয়নের মধ্য দিয়ে।
সুরক্ষাবাদী নীতি সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা শিল্পকে দুর্বল করে, উদ্ভাবনকে থামিয়ে দেয় এবং ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা করে।
প্রতিযোগিতা ছাড়া কোনো শিল্পই বিশ্বমানের হতে পারে না। আর প্রতিযোগিতা না থাকলে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন কেবল স্লোগানেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
সরকারের উচিত বাজেট ঘোষণার আগেই এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা। তা না হলে এর পরিণতি বহুমাত্রিক ক্ষতির দিকে নিয়ে যাবে, যার বোঝা বইবে সাধারণ মানুষ, তরুণ উদ্যোক্তা এবং শেষ পর্যন্ত পুরো অর্থনীতি।
মহিবুল ইসলাম শিক্ষক, ইউল্যাব
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
দাসত্বের সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি: শিক্ষা উপদেষ্টা
শিক্ষা উপদেষ্টা প্রফেসর ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেছেন, “বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিম যে দাসত্বের সংস্কৃতি চালু করেছিল আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছি। আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দলীয় লেজুরবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।”
বুধবার (৩০ জুলাই) সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিকৃবি) ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষের লেভেল-১, সেমিস্টার-১ এ ভর্তিকৃত নবীণ শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেন, “জুলাই ২৪ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা জাতি হিসেবে পুনর্জন্ম লাভ করেছি। গত ১৭ বছর আমরা আমাদের নাগরিকত্ব সপে দিয়েছিলাম একটি ফ্যাসিবাদ সরকারের কাছে। যারা পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে দাসত্বের চুক্তি করেছিল। আমরা কখনো ভাবিনি এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হবে।”
আরো পড়ুন:
কৃষি উপদেষ্টা-চীনা রাষ্ট্রদূত সাক্ষাৎ
আইএমও কাউন্সিল নির্বাচনে জিবুতির সমর্থন চাইল বাংলাদেশ
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “খুন, আয়নাঘর, বিচারহীনতার মধ্য দিয়ে চলছিল এই বাংলাদেশ। এর থেকে পরিত্রাণ তোমরাই দিয়েছো। ছাত্র-জনতার এই অর্জনকে ম্লান হতে দেওয়া যাবে না।”
“নতুন বাংলাদেশে তোমরা নিজেদেরকে আপন স্বকীয়তায় উপস্থাপন করবে, রাজনৈতিক দলগুলো কিভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবে তা তোমরা নির্ধারন করবে। তোমাদের ধৈর্যশীল ও রুচিশীলতার পাশাপাশি উন্নত মনের বিবেকবান ও সুন্দর মনের মানুষের পরিচয় দিতে হবে”, যোগ করেন তিনি।
উপদেষ্টা বলেন, “পেশিশক্তির ব্যবহার রোধ করতে হবে। সহনশীলতা ও সহমর্মিতার সংস্কৃতি চালু করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে সহশিক্ষার কার্যক্রমে গুরুত্বারোপের পাশাপাশি সমাজে পিছিয়ে পরাদের এগিয়ে নিতে সহায়তা করতে হবে।”
ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেন, “নবীন শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রমে নিজেদের সম্পৃক্ত করে মেলে ধরবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গ্লোবাল নলেজ বাড়ানোর জন্য বিশ্ব আঙ্গিকে লাইব্রেরিকে উপযুক্ত করতে হবে, যা গবেষণার কাজকে আরো ত্বরান্বিত করবে।”
ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সামিউল আহসান তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বক্তব্য রাখেন সিকৃবির ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মো. আলিমুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর ড. এ.টি.এম. মাহবুব-ই-ইলাহী।
এসময় উপস্থিত ছিলেন- ডিন কাউন্সিলের আহ্বায়ক প্রফেসর ড. মো. নজরুল ইসলাম, প্রভোস্ট কাউন্সিলের আহ্বায়ক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কাওছার হোসেন, প্রক্টর প্রফেসর ড. জসিম উদ্দিন আহাম্মদ, রেজিস্ট্রার (অ.দা) প্রফেসর ড. মো. আসাদ-উদ-দৌলা।
ঢাকা/নূর/মাসুদ