নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগে ‘জুলাই সনদ’ গুরুত্বপূর্ণ: নাহিদ ইসলাম
Published: 5th, June 2025 GMT
বাংলাদেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেছেন, টেকসই ও গণতান্ত্রিক পথ কেবল জন–আকাঙ্ক্ষা ও কাঠামোগত সংস্কারের ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তাই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের সঙ্গে আলোচনায় নাহিদ ইসলাম এ কথা বলেন। চীনের দূতাবাসের আমন্ত্রণে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির প্রতিনিধিদল গতকাল বুধবার দেশটির রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে। প্রতিনিধিদলে ছিলেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুব আলম ও যুগ্ম সদস্যসচিব তাহসীন রিয়াজ।
এনসিপির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা ও সংস্কারপ্রক্রিয়া ঘিরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিরাজমান আগ্রহ এবং বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল ও চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এনসিপির নেতারা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক রূপান্তর নিয়ে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করে, এমন কাঠামোগত চ্যালেঞ্জগুলোর কথাও তাঁরা তুলে ধরেছেন।
চীনে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলোচনায় এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, এনসিপি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, একটি টেকসই ও গণতান্ত্রিক পথ কেবল জন–আকাঙ্ক্ষা ও কাঠামোগত সংস্কারের ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগে জুলাই সনদ প্রণয়ন ও প্রকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘এই সনদ শুধু একটি নীতিগত দলিল নয়, বরং জুলাই আন্দোলনে যাঁরা রাস্তায় নেমে পরিবর্তনের স্বপ্নে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি আমাদের নৈতিক দায়বদ্ধতাও বটে।’ নাহিদ আরও বলেন, জুলাই সনদ জুলাই আন্দোলনের নির্বাচন সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক অংশগ্রহণের একটি সুস্পষ্ট ভিত্তি স্থাপন করবে এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতির পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে।
বাংলাদেশ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে উল্লেখ করে এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, এনসিপি সরকারের পদক্ষেপ ও অন্যান্য রাজনৈতিক পক্ষগুলোর কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এনসিপির আশা, জুলাই সনদ প্রণয়ন ও ঘোষণার প্রক্রিয়া আর বিলম্বিত না করে যথাযথ আন্তরিকতার সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে; যাতে শহীদদের আত্মত্যাগ ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতা পায়।
নাহিদ ইসলাম নির্বাচন কমিশনের কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, এনসিপি প্রকৃত অর্থে স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন চায়, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস ও আস্থা ফিরিয়ে আনবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং পরে গণপরিষদ ও আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি হলে সব পর্যায়ের জনগণের অংশগ্রহণ ও প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি নিশ্চিত হবে।
চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এনসিপির প্রতিনিধিদলের সামগ্রিক রাষ্ট্র ভাবনাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানান এবং তাঁদের চিন্তাশীল অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানান বলে এনসিপির বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, রাষ্ট্রদূত চীনের হস্তক্ষেপ না করার নীতি (নন-ইন্টারফেয়ারেনস) এবং বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযোগিতার ব্যাপারে চীনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। চীনের রাষ্ট্রদূত রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে ধারাবাহিক ও গঠনমূলক সংলাপের গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গঠনে তরুণদের ভূমিকাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন হ দ ইসল ম গণত ন ত র ক জ ল ই সনদ র জন ত ক ক ঠ ম গত এনস প র
এছাড়াও পড়ুন:
আইন যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার
এটা অনস্বীকার্য যে মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য আইন তৈরি করা হয়, অন্যভাবে বললে মানুষের অধিকার সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই আইনই মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের সহযোগী উপাদান বা হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে, বিশেষত আইন যখন এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়, যাতে অতিবিস্তৃত, অস্পষ্ট এবং অসংগতিপূর্ণ ধারা থাকে কিংবা আইনের দুর্বল এবং ‘সিলেকটিভ’ প্রয়োগ হয়; আইনকে ইচ্ছাকৃতভাবে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়, যা নির্বিচার আটকের ন্যায্যতা দেয়, মৌলিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে এবং বৈষম্যমূলক চর্চাকে উৎসাহিত করে।
আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে সেসব দেশে, যেখানে আইনের শাসন ভঙ্গুর, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সীমিত এবং গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকে। বাংলাদেশ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
২.
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন অধ্যায়, যেখানে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ঘটে। সরকারি চাকরিতে অন্যায্য কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলেও তৎকালীন সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়ন এবং সহিংস আক্রমণের ফলে পরবর্তীকালে তা গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। গণ-অভ্যুত্থানে সমাজের সব স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে এবং একটি স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন হয়।
জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, যার মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু। আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের বিগত সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা বিচারবহির্ভূত হত্যা, সহিংসতা, নির্বিচার আটক ও নির্যাতনের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে জড়িত ছিল।
আন্দোলন চলাকালীন হাজার হাজার আন্দোলনকারীকে নির্বিচার আটক করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে স্বীকৃত ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার এবং আটকের ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া (ডিউ প্রসেস) অনুসরণের যে বিধান, তার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গণগ্রেপ্তার অভিযানের সময় আটক হওয়া প্রায় ৮৫ শতাংশ ছিল শিক্ষার্থী এবং সাধারণ নাগরিক আর ১৫ শতাংশ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিল। হত্যা, নির্বিচার আটক এবং নির্যাতনের পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থানের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে মানুষের যোগাযোগের অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে।
এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা, আত্মরক্ষায় বলপ্রয়োগ কিংবা জনস্বার্থের মতো ‘অস্পষ্ট’ বিষয়ের কথা বলা হয়েছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিপীড়ন, হয়রানি ও নির্যাতনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এসব ক্ষেত্রে আইন সহযোগী উপাদান বা অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। যেমন, কারফিউ জারি, প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বা দেখামাত্রই গুলির নির্দেশকে ন্যায্যতা দিতে জননিরাপত্তা এবং জনস্বার্থের মতো বিষয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে মূলত আইন রাষ্ট্রের দমনমূলক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে সহায়তা করেছে, যা মানবাধিকারের মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
৩.
জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানেই নয়, বছরের পর বছর ধরে দেশের শাসনব্যবস্থায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার হিসেবে আইনকে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন বিগত সময়ে কিছু কঠোর ও দমনমূলক আইন প্রণয়ন করেছিল, যা স্পষ্টভাবে মানবাধিকারের পরিপন্থী। এই আইনগুলো ভিন্নমত দমন, নির্যাতন এবং নিপীড়ন করে কর্তৃতবাদী শাসন টিকিয়ে রাখতে সহায়ক ছিল। বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ছিল এমন একটি আইন (যা পূর্ববর্তী আইসিটি আইনের বিতর্কিত এবং দমনমূলক ৫৭ ধারার একটি পদচিহ্ন)। এ আইন বাংলাদেশে ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার ভুক্তভোগী ছিলেন অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, এমনকি সাধারণ নাগরিকও।
এই দমনমূলক ডিএসএ আইনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে আইনের অপব্যবহারের প্রয়োজন ছিল না, বরং আইনটি ব্যবহার করেই অর্থাৎ আইনের মধ্যে থেকেই মানুষকে হয়রানি এবং নির্যাতন করা সম্ভব ছিল। ডিজিটাল আইনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল ভীতি এবং সেলফ-সেন্সরশিপের সংস্কৃতি তৈরি করে ভিন্নমতকে দমন করা, যা সংবিধান প্রদত্ত বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে। লক্ষণীয়, নিপীড়নমূলক ডিজিটাল আইন প্রণয়নে এবং প্রয়োগে বিগত সরকার ডিজিটাল মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষার চেয়ে রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যখন ডিজিটাল মাধ্যমে মানবাধিকারের ধারণা ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে, বাংলাদেশে দমনমূলক ডিজিটাল আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে এবং বিরোধী কণ্ঠ দমন করে কর্তৃত্ববাদী শাসনকে পাকাপোক্ত করতে সহায়তা করেছে।
বিগত সরকারের আমলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়ে উঠেছিল ভিন্নমত দমনের বড় অস্ত্র