ঢাকা নগরীতে প্রতিদিন বাড়ি বাড়ি এডিস মশার সন্ধানে অনুসন্ধান চালায় একদল গবেষক। ঈদুল আজহার ছুটির আগের দুই সপ্তাহ ধরে চলা তাদের জরিপে দেখা যায়, প্রতি ১৫টি বাড়ির মধ্যে ৭ থেকে ৮টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা বা শূককীট পাওয়া গেছে। এডিস মশা ডেঙ্গু ছড়ায়।

লার্ভা জরিপে যে বিষয়টির ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেটি হলো লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপ করা। এ ক্ষেত্রে স্বীকৃত পদ্ধতি হলো ‘ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই)’। যদি এই ইনডেক্সের পরিমাণ ২০-এর বেশি হয়, তবে তা আশঙ্কাজনক বলে বিবেচিত হয়। এখন এই জরিপ অনুযায়ী, ব্রুটো ইনডেক্সের হার ৫০ থেকে ৬০।

এই জরিপের নেতৃত্ব দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার এডিস মশার বংশবৃদ্ধির হার মারাত্মক। মশার বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি মারাত্মক হতে পারে।’

দক্ষিণ ও উত্তর দুই সিটিতেই এডিস মশার প্রকোপ সমান হারে বাড়ছে বলে জানান কবিরুল বাশার।

চলতি বছর এখন পর্যন্ত যতজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন, এর সংখ্যা গতবারের চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার ডেঙ্গু বৃদ্ধির ‘আদর্শ’ পরিস্থিতি রয়েছে। কারণ হিসেবে আবহাওয়া পরিস্থিতি, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর তৎপরতার অভাব এবং সর্বোপরি সরকারের প্রস্তুতির অভাবকে তুলে ধরছেন বিশেষজ্ঞরা।

চলতি বছরের গতকাল সোমবার (৯ জুন) পর্যন্ত দেশে ৪ হাজার ৯৭৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সময় ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২৩ জন। গত বছর এ সময় দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৩১। এ সময় মারা গিয়েছিলেন ৩৭ জন। দেশে এযাবৎকালে ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয় ২০২৩ সালে। ওই বছরের ৮ জুন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছিলেন ২ হাজার ৮৫৪ জন। আর মারা গিয়েছিলেন ২১ জন। পুরো বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। আর মারা গিয়েছিলেন ১ হাজার ৭০৫ জন। দেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুতে নতুন করে প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। এরপর পরবর্তী ২৩ বছরে এত সংক্রমণ বা মৃত্যু হয়নি, যা ২০২৩ সালে হয়েছিল।

এখনকার আবহাওয়া পরিস্থিতি বড় সংক্রমণের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এবার থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। আবার ভ্যাপসা গরম। এটা ডেঙ্গুর এডিস মশা বৃদ্ধির একেবারে আদর্শ অবস্থা।

গত মে মাসে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৬৩ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। চলতি মাসেও থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে এবং এর সঙ্গে আবার তাপপ্রবাহও আছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বৃষ্টি বাড়তে পারে। এমনকি সাগরে আবারও নিম্নচাপ সৃষ্টির পূর্বাভাস আছে। যুক্তরাজ্যের কেইল ইউনিভার্সিটির মশাবাহিত রোগের গবেষক ও বাংলাদেশি বিজ্ঞানী নাজমুল হায়দার বলছিলেন, এডিসের বংশ বিস্তারে তাপমাত্রা ২৮ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উপযোগী। মে মাসে বিশেষ করে রাজধানীতে তাপমাত্রা কম থেকেছে, আবার বৃষ্টিও হয়েছে থেমে থেমে। এমন অবস্থা বংশ বিস্তারে সহায়ক হয়েছে।

শুধু এডিস নয়, বিশেষ করে রাজধানীতে এ বছর কিউলেক্স মশারও ব্যাপক বিস্তার ঘটে। গত মার্চে রাজধানীর গুলশানে মশার অবস্থা নিয়ে গবেষণা করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সাইফুর রহমান। তাঁর গবেষণা অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় সর্বনিম্ন ৯০০ থেকে ২ হাজার মশা পাওয়া যায় ওই এলাকায়।

সাইফুর রহমান বলেন, ২৪ ঘণ্টায় ২০০-এর মতো মশা পাওয়া অস্বাভাবিক ব্যাপার। মার্চ মাসের পর বৈশাখী ঝড়বৃষ্টির কারণে কিউলেক্স কিছু কমে আসে। কিন্তু এখন ডেঙ্গু এবং কিউলেক্স উভয়ই বেড়েছে। আবহাওয়া পরিস্থিতি এবার যেমন, তাতে ডেঙ্গুর একেবারে সহায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাগুলোর কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না।

চলতি বছর রাজধানীর চেয়ে বাইরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ অনেক বেশি। দেশের মোট আক্রান্তের ২৫ শতাংশ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। বিভাগের হিসাবে সর্বোচ্চ সংক্রমণ বরিশাল বিভাগে, ১ হাজার ৯৯৪ জন। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে গত বছর এ সময় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬০২, এ বছর ৭৭৭। উত্তরে সংখ্যা ছিল ৪৩৮, এবার ৪৬৯।

ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো.

জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আক্রান্তের সংখ্যা হয়তো বাড়তে পারে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের প্রস্তুতি আছে। বাজেটও আছে। ঈদের ছুটির জন্য তৎপরতা বন্ধ ছিল। আবার তা জোরেশোরে শুরু হবে।’

তবে মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনগুলোর তৎপরতায় খুব আশা দেখছেন না কীটতত্ত্বববিদ তৌহিদউদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলছিলেন, বর্তমানে রোগীর সংখ্যা এবং মশার বিস্তার বলে দিচ্ছে, সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো মোটেও সক্রিয় নয়। আগে তা-ও কিছু কাজ চোখে পড়ত, এখন নেই। এখন পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে পারে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম আল ক পর স থ ত স ক রমণ এ সময় করপ র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে এবার বাবা-ছেলের মৃত্যু

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে গোসলের একপর্যায়ে স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে বাবা-ছেলের মৃত্যু হয়েছে। আজ সোমবার বেলা দুইটার দিকে সৈকতের কলাতলী পয়েন্টে এ ঘটনা ঘটেছে। মৃত দুজন হলেন রাজশাহীর শাহিনুর রহমান (৫৮) ও তাঁর ছেলে সিফাত রহমান (২০)।

এর আগে গতকাল রোববার বিকেলে লাবণী পয়েন্টে গোসলে নেমে চট্টগ্রামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। শনিবার সৈকতের শৈবাল পয়েন্টে মাছ ধরতে গিয়ে এক পর্যটক ও স্থানীয় এক বাসিন্দা ভেসে যান। পরে দুজনের মরদেহ উদ্ধার করেন লাইফগার্ডের কর্মীরা।

আরও পড়ুনকক্সবাজারে সৈকতে ভেসে যাচ্ছিলেন বন্ধু, বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারালেন যুবক ১ ঘণ্টা আগে

এদিকে পুলিশ ও লাইফগার্ডের কর্মীরা জানান, গত দুই দিনে সমুদ্রের বিভিন্ন পয়েন্টে গোসলে নেমে তিন পর্যটকসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে।

কলাতলী সৈকতে পর্যটকদের উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত বেসরকারি সংস্থা ‘সি সেফ লাইফগার্ড স্টেশন’–এর লাইফগার্ড মোহাম্মদ শুক্কুর জানান, কয়েক দিন ধরে বঙ্গোপসাগর উত্তাল। বৈরী আবহাওয়ার প্রভাবে সাগরের বিভিন্ন পয়েন্টে একাধিক গর্তের (গুপ্তখাল) সৃষ্টি হয়েছে। সমুদ্রের পানিতে উল্টো স্রোতের টানও বেশি দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় গুপ্তখাল সৃষ্টি হওয়াটা বেশ ঝুঁকির। সৈকতে গোসলে নামতে নিষেধ করে লাইফগার্ড আওতাভুক্ত এলাকায় একাধিক নিশানা টাঙানো হয়েছে। কিন্তু লাইফগার্ডের আওতার বাইরে আজ দুপুরে বাবা-ছেলের মৃত্যু হয়েছে।

লাইফগার্ডের কর্মীরা জানান, আজ বেলা পৌনে দুইটার দিকে বাবা-ছেলে দুজন হোটেল সায়মান বিচ রিসোর্টের সামনে সৈকতে গোসলে নামেন। সেখানে লাল নিশানা টাঙানো ছিল। কিছুক্ষণ পর ঢেউয়ের ধাক্কায় বাবা-ছেলে ভেসে যেতে থাকেন। এ সময় সাঁতার কেটেও তাঁরা তীরের দিকে ফিরতে পারেননি। একপর্যায়ে তাঁরা স্রোতের টানে গুপ্তখালে আটকা পড়েন। ওই সময় লাইফগার্ডের কর্মীরা দ্রুতগতির জলযান ‘জেটস্কি’ নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন। সেখান থেকে তাঁদের মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়।

লাইফগার্ডের কর্মী আবদুল শুক্কুর বলেন, হাসপাতালে নেওয়ার পর বাবা-ছেলে রক্তবমি করেন। সম্ভবত ঢেউয়ের ধাক্কায় তাঁরা আঘাত পেয়েছিলেন। এর কিছুক্ষণ পর দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইলিয়াস খান বলেন, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে  সমুদ্রের বিপজ্জনক পয়েন্টে গোসলে নেমে বাবা-ছেলের মৃত্যু হয়েছে। সেখানে একাধিক গুপ্তখাল আছে বলে জানা গেছে। মরদেহ দুটি কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে তাঁদের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। গতকাল তাঁরা রাজশাহী থেকে সপরিবার কক্সবাজারে বেড়াতে আসেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে এবার বাবা-ছেলের মৃত্যু