ইন্দোনেশিয়ার ‘গ্রিন ইসলাম’-এর বার্তা
Published: 12th, June 2025 GMT
ইন্দোনেশিয়া, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলিম জনসংখ্যার দেশ, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরম ঝুঁকির মুখে। জাকার্তার কিছু অংশ প্রতিবছর ৬ থেকে ১০ ইঞ্চি সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে (বিশ্বব্যাংক, ২০২৫)। বন্যা, দাবানল আর পাম তেলের জন্য বন উজাড় করে পরিবেশ ধ্বংস করছে।
এই সংকটের মুখে ‘গ্রিন ইসলাম’ একটি শক্তিশালী আন্দোলন হয়ে উঠেছে। এর মূল কথা হলো, কোরআনের শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে পরিবেশ রক্ষাকে মুসলিমদের ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে প্রচার করা। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘বাগানের ফসলের হক সঠিক সময়ে আদায় করো, কিন্তু অপচয় করো না।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ১৪১)
এই শিক্ষা আজ জলবায়ু সংকটের প্রেক্ষাপটে নতুন অর্থ পেয়েছে।
বন্যা, দাবানল আর পাম তেলের জন্য বন উজাড় করে পরিবেশ ধ্বংস করছে। এই সংকটের মুখে ‘গ্রিন ইসলাম’ একটি শক্তিশালী আন্দোলন হয়ে উঠেছে।দারুল উলুম লিডো একটি ‘ইকো-বোর্ডিং স্কুল’, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন শেখে। নবম শ্রেণির ছাত্রী জিলদা নাফিজা গ্রিনহাউসে গাছের পরিচর্যা করে। তিনি বলেন, ‘পরিবেশের প্রতি সচেতনতা একজন মুসলিমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’
তার শিক্ষক ফাইজিন জুহরি একজন মুসলিম পণ্ডিত, কোরআনের পরিবেশবাদী শিক্ষা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘কোরআনের শিক্ষা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে, কিন্তু জলবায়ু সংকটের আগে আমরা এটিকে পরিবেশবাদী বার্তা হিসেবে দেখিনি।’
পঞ্চশীলের আদর্শ
ইন্দোনেশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ ১৯৪৫ সালে ‘পঞ্চশীল’ নামে পাঁচটি নীতি প্রতিষ্ঠা করেন—আল্লাহতে বিশ্বাস, মানবিকতা, জাতীয় ঐক্য, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচার। এই নীতির মূলমন্ত্র ‘ভিন্নেকা তুঙ্গল ইকা’ বা ‘বৈচিত্র্যে ঐক্য’ ইন্দোনেশিয়ার বহুসংস্কৃতির সমাজে সহাবস্থানের ভিত্তি। গ্রিন ইসলাম এই আদর্শের সঙ্গে মিলে সম্প্রদায়ভিত্তিক পরিবেশ আন্দোলন গড়ে তুলছে।
আরও পড়ুনইসলাম সহজ, কঠিন করবেন না০৫ মে ২০২৫জাকার্তার ইস্তিকলাল মসজিদ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম মসজিদ, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাংকের গ্রিন সার্টিফিকেশন পায় এটি। এখানে সৌর প্যানেল, ধীরগতির পানির কল এবং কোরআনের আয়াতসহ স্টিকার (‘যারা অপচয় করে, তারা শয়তানের আত্মীয়’; সুরা ইসরা: ২৭) পরিবেশ সচেতনতা বাড়ায়। মসজিদের স্থপতি হের প্রমতমা বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য অন্য মসজিদগুলোকে অনুপ্রাণিত করা।’
কোরআনের শিক্ষা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে, কিন্তু জলবায়ু সংকটের আগে আমরা এটিকে পরিবেশবাদী বার্তা হিসেবে দেখিনি।ফাইজিন জুহরি, শিক্ষক, দারুল উলুম লিডোইন্দোনেশিয়ার ওলেমা কাউন্সিল গত দশকে সাতটি ফতোয়া জারি করেছে, যার মধ্যে রয়েছে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নির্দেশ। ২০২৩ সালে তারা বলেছে, ‘পৃথিবী ও এর সবকিছু রক্ষা করা ইসলামের প্রতিফলন।’ এই ফতোয়াগুলো ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছায়, যাঁরা ইন্দোনেশিয়ায় সবচেয়ে বেশি সম্মানিত।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
ইন্দোনেশিয়ার জলবায়ু সংকট গভীর। পাম তেল উৎপাদনের জন্য গত দুই দশকে ৩০ দশমিক ৮ মিলিয়ন হেক্টর বন ধ্বংস হয়েছে, যা ইতালির সমান (ক্রিস্টিয়ান সায়েন্স মনিটর, ২০২৫)। নিকেল খনন, যা বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, বন ও সমুদ্রের ক্ষতি করছে।
আশ্চর্যজনকভাবে, ২০২০ সালের একটি ইউগভ জরিপে ইন্দোনেশিয়া জলবায়ু পরিবর্তন সংশয়বাদে প্রথম স্থানে ছিল, যেখানে ২০ শতাংশ মানুষ বলেছিল জলবায়ু পরিবর্তন বাস্তব নয়।
গ্রিন ইসলাম এই সংশয়বাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। ইকো-মসজিদ, ইকো-স্কুল এবং তৃণমূল উদ্যোগের মাধ্যমে এটি পরিবেশ সচেতনতা ছড়াচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টারের ডিন ফাখরুদ্দিন মঙ্গুনজায়া বলেন, ‘ধর্ম একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। আমরা একটি নৈতিক বার্তা দিচ্ছি।’
ইন্দোনেশিয়ার ওলেমা কাউন্সিল গত দশকে সাতটি ফতোয়া জারি করেছে, যার মধ্যে রয়েছে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নির্দেশ। ২০২৩ সালে তারা বলেছে, ‘পৃথিবী ও এর সবকিছু রক্ষা করা ইসলামের প্রতিফলন।’আরও পড়ুনইসলাম কি কোনো ধর্ম নাকি জীবনবিধান?১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫পরিবেশের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া
ইন্দোনেশিয়ার ১৭ হাজার দ্বীপে শতাধিক জাতিগোষ্ঠী ও ৭০০টির বেশি ভাষা রয়েছে। এই বৈচিত্র্য সত্ত্বেও দায়াক ও মাদুরিজদের মতো সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত ঘটেছে। পশ্চিম কালিমান্তানের অক্টাভিয়া শিন্তা আরিয়ানি, যিনি এই সংঘাতের সাক্ষী, এখন ইকো ভিন্নেকা নামে একটি আন্তধর্মী পরিবেশবাদী গ্রুপের নেতৃত্ব দেন। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই একটি নিরাপদ ইস্যু, যা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে সহায়ক।
ইকো ভিন্নেকা পন্টিয়ানাকে তরুণদের নিয়ে ‘ইকোস্পিক’ নামে আলোচনা সভার আয়োজন করে থাকে। এখানে মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ও হিন্দু তরুণেরা তাঁদের ধর্মগ্রন্থ থেকে পরিবেশবিষয়ক শিক্ষা শেয়ার করেন। দায়াক বাদিনেহ গোত্রের প্রোটেস্টান্ট রুপিনা জেসকি বলেন, তিনি আগে হিজাব পরা নারীদের ‘কট্টরপন্থী’ মনে করতেন। কিন্তু এই আলোচনা তাঁকে স্টিরিওটাইপ ভাঙতে সাহায্য করেছে।
গোতং রয়ং
ইন্দোনেশিয়ার সংস্কৃতিতে ‘গোতং রয়ং’ বা সম্মিলিত দায়িত্বের ধারণা গভীরভাবে প্রোথিত। চ্যারিটিসএইড ফাউন্ডেশনের মতে, এই মূল্যবোধের কারণে ইন্দোনেশিয়া সাত বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে দানশীল দেশ।
মসজিদের সৌর প্যানেলের জন্য অমুসলিমরাও অর্থ দিয়েছেন, কারণ, বিদ্যুৎ চলে গেলে মসজিদে আলো থাকে।ইয়োগিয়াকার্তার একটি ইকো-মসজিদে এলোক ফাইকোতুল মুতিয়া, যিনি পরিচ্ছন্ন শক্তির জন্য এন্টার নুসান্তারা নামে একটি সংস্থা পরিচালনা করেন, বলেন, ‘ইকো-মসজিদ বা ইকো-স্কুল–সমর্থিত হয়, কারণ, ইন্দোনেশিয়ানরা সম্প্রদায়কে সাহায্য করতে চায়।’
এই মসজিদের সৌর প্যানেলের জন্য অমুসলিমরাও অর্থ দিয়েছেন, কারণ, বিদ্যুৎ চলে গেলে মসজিদে আলো থাকে।
নতুন ভবিষ্যৎ
গ্রিন ইসলাম শুধু পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন নয়, এটি ইন্দোনেশিয়ার বৈচিত্র্যময় সমাজে ঐক্যের সেতু। তবে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। গ্রিন ইসলাম তরুণদের মাধ্যমে পরিবর্তন আনছে। দারুল উলুম লিডোর মতো প্রায় ৫০টি ইকো-স্কুল তরুণদের পরিবেশ সচেতন করে গড়ে তুলছে। ফাখরুদ্দিন মঙ্গুনজায়া বলেন, ‘তরুণদের শিক্ষা দেওয়া হৃদয় ও মন পরিবর্তনের দ্রুততম উপায়।’ এই আন্দোলন কেবল ইন্দোনেশিয়া নয়, বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্যও একটি আদর্শ হতে পারে।
পৃথিবী আমাদের আমানত। গ্রিন ইসলাম আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘পৃথিবীর প্রতি ভালো করো, পৃথিবী তোমার প্রতি ভালো করবে।’
সূত্র: সিএস মনিটর ডটকম
আরও পড়ুনবিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর গন্তব্য১৪ মে ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ র ন ইসল ম ইন দ ন শ য ল র জন য পর ব শ র ক রআন র জলব য মসজ দ
এছাড়াও পড়ুন:
মাদারীপুরের সাবেক দুই ডিসিসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান
শিবচরে পদ্মা সেতু রেললাইন সংযোগ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মাদারীপুরের সাবেক দুই জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন ও মো. ওয়াহিদুল ইসলামসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মাদারীপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় এ সংক্রান্ত নোটিশ মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, সাবেক দুই জেলা প্রশাসকসহ অভিযুক্তদের কাছে পাঠিয়েছে ।
দুদক সূত্র জানায়, পদ্মা রেললাইন সংযোগ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক দুই জেলা প্রশাসকসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানপূর্বক প্রতিবেদন জন্য দুদক মাদারীপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আখতারুজ্জামানকে দলনেতা ও উপ-সহকারী পরিচালক মো. সাইদুর রহমান অপুকে সদস্য করে একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে।
আরো পড়ুন:
খুকৃবির সাবেক উপাচার্যসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুবির নতুন ক্যাম্পাসের জমি ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ, তথ্য চেয়েছে দুদক
অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ১৯ ধারা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা, ২০০৭ এর বিধি ৮ অনুযায়ী ব্যবস্থাগ্রহণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্য এবং চাহিদাপত্র চেয়ে নোটিশ প্রদান করা হয়েছে তারা হলেন- মাদারীপুর সাবেক জেলা প্রশাসক মো. ওহিদুল ইসলাম, সাবেক জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সৈয়দ ফারুক আহম্মদ, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ঝোটন চন্দ্র, মাদারীপুরের সাবেক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মো. সাইফুদ্দিন গিয়াস।
মোহাম্মদ সুমন শিবলী, প্রমথ রঞ্জন ঘটক, আল মামুন, মো. নাজমুল হক সুমন, মাদারীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের কানুনগো (ভারপ্রাপ্ত) মো. নাসির উদ্দিন, মো. আবুল হোসেন, রেজাউল হক এবং মাদারীপুর কালেক্টরেট রেকর্ড রুম শাখার রেকর্ড কিপার মানিক চন্দ্র মন্ডল।
দুর্নীতি দমন কমিশন মাদারীপুরের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান বলেন, “মাদারীপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম ও ড. রহিমা খাতুনসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে তথ্য ও বিভিন্ন চাহিদাপত্র চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন মাদারীপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয় থেকে মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত নোটিশ অভিযুক্তদের কাছে পাঠানো হয়েছে।”
ঢাকা/বেলাল/মাসুদ