অপারেশন সিঁদুর: নারীর নামে পুরুষের যুদ্ধ
Published: 12th, June 2025 GMT
যখন ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর হিন্দু ও মুসলিম দুই নারী অফিসার ‘অপারেশন সিঁদুর’ ঘোষণা করার জন্য মঞ্চে হাজির হন, তখন সরকার এটি নারী-পুরুষ অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত বলে উদযাপন করে। সামনের সারিতে থেকে গণমাধ্যমের সামনে বক্তব্যকালে ইউনিফর্ম পরা নারীর ছবি, ২৬ জন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া এবং প্রতীকীভাবে বৈধব্যের সিঁদুর পুনরুদ্ধার জাতির সেবায় নারীবাদী প্রতীক হিসেবে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিল।
এই মুহূর্ত ঐতিহাসিক ঘটনার সাদৃশ্যপূর্ণ প্রতিধ্বনি। ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তার নির্ণায়ক ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হিন্দু যোদ্ধাদেবী দুর্গার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল, যিনি নারীশক্তি ও জাতীয়তাবাদী সংকল্পের প্রতীক। দুর্গার এই তুলনা কীভাবে ভারতীয় রাজনৈতিক শক্তি রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধর্মীয় প্রতীকবাদের সঙ্গে মিশ্রিত করে প্রায়ই নারী-পুরুষ চিহ্নজ্ঞাপক ও পৌরাণিক দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি করা হয়, তা আমাদের সামনে আনে।
কিন্তু যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী নারীরা কি মজ্জাগতভাবে নারীবাদী হয়ে উঠতে পারে? নারীবাদী পণ্ডিতরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন, জাতি গঠন কোনো লিঙ্গ-নিরপেক্ষ প্রকল্প নয়। এটি নারীদের এমন ভূমিকায় পুনর্গঠিত করে, যা তাদের লক্ষ্য হাসিল করে। যেমন ত্যাগী মা, শোকার্ত বিধবা অথবা জাতির সশস্ত্র কন্যাসন্তান। নীরা যুবাল-ডেভিসের মতো পণ্ডিতদের মতে, নারীদের জাতির সম্মান ও সাংস্কৃতিক খাঁটিত্বের প্রতীকী বাহক হিসেবে স্থান দেওয়া হয়, কিন্তু খুব কমই তাদের রাজনৈতিক এজেন্ট হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় প্রেক্ষাপটে সুমিতা সেন ও মৈত্রেয়ী চৌধুরীর মতো পণ্ডিতরা আমাদের মনে করিয়ে দেন, ঐতিহাসিকভাবে নারীর ভূমিকা জনপরিসরে স্বাধীন বা স্বায়ত্তশাসনের প্রেক্ষিতে নয়, বরং পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর প্রতি কর্তব্যের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে। অতএব, জনপরিসর কিংবা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই নারী-পুরুষের মধ্যে ন্যায্যতার তুলনা হয় না। উভয়ের প্রতিনিধিত্বের নিরপেক্ষতা কতটা কার্যকর, তা নিয়েও প্রশ্ন করা উচিত।
আজকের সামরিক ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান, যেখানে যুদ্ধক্ষেত্রে নারীরা দৃশ্যমান থাকে, তবুও পথ বদলায়নি। সামরিকতন্ত্রের পুরুষপ্রধান ও পুরুষতান্ত্রিক ভিত্তি অক্ষত রাখার মানে নারীদের ‘পুরুষদের মতো হওয়া’র ক্ষমতা উদযাপন করার মতো। এটি অপারেশন সিঁদুরে লক্ষ্য করা যায়, যেখানে ইউনিফর্ম পরিহিত দুই নারীকে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরা হয়েছে; যেখানে তারা যে চিত্রনাট্য পরিবেশন করেছেন, তা গভীরভাবে পুরুষতান্ত্রিক; যেখানে পুরুষতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে নারীদের যোগ্যতা প্রমাণের দাবি করা হয়।
নারীবাদী সংস্থা দাবি করে, নারীরা তাদের কর্মজীবনের শর্তাবলি নির্ধারণ করুক। এখানে এই পরিভাষাগুলো আরএসএস মতাদর্শের পিতৃতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ দ্বারা নির্ধারিত। দুই অফিসার লিঙ্গগত মানদণ্ড চ্যালেঞ্জ করেননি; তারা একটি পূর্বলিখিত স্ক্রিপ্টে পা রেখেছিলেন, যা নারীত্বকে জাতির প্রতি স্ত্রীত্বের কর্তব্যের সঙ্গে সমান করে দেখে। শীর্ষ পর্যায়ে তাদের সামরিক ভূমিকা সামরিকবাদকে স্বাভাবিক করে তোলে, যদিও এগুলো লিঙ্গ অগ্রগতি হিসেবে তুলে ধরা হয়। একজন মুসলিম অফিসারের অন্তর্ভুক্তি আকস্মিক নয়। দুর্গা বাহিনীর আদর্শিক জগতে অ-হিন্দু নারীদেরও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, যতক্ষণ না তারা হিন্দু ‘পরিবার’-কে রক্ষা করে। এই প্রতীকী অন্তর্ভুক্তি বহুত্ববাদের একটি বিভ্রমকে সমর্থন করে, অন্যদিকে মুসলিম নাগরিকদের পদ্ধতিগত প্রান্তিকীকরণ অবিরামভাবে অব্যাহত।
নারীবাদী আন্দোলনগুলো ঐতিহাসিকভাবে যুদ্ধের যুক্তিকেই চ্যালেঞ্জ করেছে; কেবল কে যুদ্ধ পরিচালনা করে, তা নয়। যদি আমরা স্বীকার করি– জাতি গঠন স্বভাবতই পুরুষতান্ত্রিক, তাহলে সমাধান কেবল পুরুষতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে আরও বেশি নারীকে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্যেই নিহিত থাকতে পারে না। পরিবর্তে আমাদের জাতীয় সম্মানের সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে, যা নারীর মূল্যকে স্ত্রীর প্রতীক এবং যুদ্ধে ত্যাগের সঙ্গে সমান করে দেখে।
যুদ্ধক্ষেত্রে নারীবাদী রাজনীতি কেন্দ্র থেকে সামরিকতন্ত্রকে সরিয়ে দিতে হবে, বেসামরিক সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা, পুনর্বাসন ও নীতিনির্ধারণে নারী নেতৃত্বকে স্বীকৃতি দিতে হবে– এটি এমন এক ক্ষেত্র, যেখানে বোমা বা সাহসিকতার মাধ্যমে সিঁদুরের অনুপস্থিতি দূর করা যায় না। জাতীয় নিরাপত্তায় প্রকৃত নারী-পুরুষ ক্ষেত্রে ন্যায্যতা ভিন্নমতাবলম্বী নারী নেত্রীদের এগিয়ে নিয়ে যাবে, যারা পিতৃতান্ত্রিক রূপকগুলো মেনে নিতে অস্বীকার; বিধবাদের বৈষয়িক সাহায্য এবং রাষ্ট্রীয় গুণাবলির প্রতীক হিসেবে বৈবাহিক প্রতীকবাদ প্রত্যাখ্যান করে।
অপারেশন সিঁদুর শক্তিশালী শিরোনাম হতে পারে। কিন্তু এতে নারীবাদী বিজয়ের মায়ার আড়ালে একটি পুরোনো পুরুষতান্ত্রিক লিপি লুকিয়ে আছে। যেমন নারীরা মাতৃভূমির রূপক হিসেবে শুধু তখনই মূল্যবান যখন তারা যুদ্ধকালীন চাহিদা পূরণ করে। মুক্তি সামরিকীকরণের মধ্যে নয়, বরং নারীদের জাতীয়তাবাদী রীতিনীতির সঙ্গে আবদ্ধ করে এমন লিঙ্গভিত্তিক রূপকগুলো ভেঙে ফেলার মধ্যে এবং যুদ্ধের মঞ্চের বাইরেও কর্তৃত্বের অর্থ প্রসারিত করার মধ্যে নিহিত।
nঅমৃতা দত্ত ও অরণী বসু যথাক্রমে বিলেফেল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের বিলেফেল্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুলের প্রভাষক এবং হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইডেলবার্গ সেন্টার ফর ট্রান্সকালচারাল স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক; আলজাজিরা থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত
এছাড়াও পড়ুন:
সংক্রমণ রোধে এখনই পদক্ষেপ নিন
চীন, থাইল্যান্ড ও ভারতে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আমাদেরও চিন্তিত হওয়ার কারণ আছে বৈকি। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করি।
সরকারের পক্ষ থেকে সব স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জনপরিসরে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে ঈদের ছুটি থেকে ফেরা যাত্রীদের মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু মাস্ক পরা বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে হবে না; প্রতিটি জনপরিসরে এটি কার্যকর করতে হবে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় অর্থাৎ গত রোববার সকাল আটটা থেকে গতকাল সোমবার সকাল আটটা পর্যন্ত চারজনের করোনা শনাক্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আর চলতি মাসে এ পর্যন্ত ২৬ জনের আক্রান্ত হওয়ার কথা জানা গেছে। পুরো মে মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫০। গত বৃহস্পতিবার দেশে করোনায় একজন মারা যান। করোনা সংক্রমণের কারণে স্বাস্থ্য বাতায়নের ১৬২৬৩ নম্বরে করোনাবিষয়ক কলের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এটা করোনা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়ারই নমুনা।
কিন্তু জনগণ সচেতন হলেই হবে না। করোনা পরীক্ষা ও টিকা সরবরাহের কাজটি করতে হবে সরকারকেই। জনস্বাস্থ্যবিদেরা করোনার সংক্রমণ রোধে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় পরীক্ষার কিটের মজুত থাকার কথা বললেও বাস্তবে তা নেই। প্রথম আলোর প্রতিবেদক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, সেখানে করোনা পরীক্ষার কিট নেই। রাজধানীর তিন বড় হাসপাতালের অবস্থা যখন এই, অন্যান্য হাসপাতালের চিত্র সহজেই অনুমেয়।
আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা যে কত দুর্বল, সেটা বিগত করোনা মহামারির সময় হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেছে। করোনা পরীক্ষা থেকে চিকিৎসার প্রতিটি ধাপে রোগীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। এবারও যাতে সে রকম পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সে বিষয়ে সরকারের আগাম প্রস্তুতি প্রয়োজন। আর কাজটি একা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নয়; জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব সংস্থা ও বিভাগকে এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) প্রোগ্রাম ম্যানেজার এ এফ এম শাহাবুদ্দিন খান প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের হাতে এখন ফাইজারের তৈরি ৩১ লাখ করোনার টিকা আছে। এর মধ্যে গত দুই মাসে ১৭ লাখ ১৬ হাজার ৯০০ ডোজ ফাইজারের টিকা সব জেলায় পাঠানো হয়েছে, যার মেয়াদ শেষ হবে ৬ আগস্ট। এখন হাতে আছে আসলে ১৪ লাখ টিকা।
করোনার সম্ভাব্য বিস্তার রোধে অবিলম্বে পরীক্ষার সরঞ্জাম সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি টিকাদান কর্মসূচি জোরদার করার বিকল্প নেই। স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের মতে, যাঁরা বয়স্ক, অন্তঃসত্ত্বা, ভিন্ন কোনো জটিল রোগে ভুগছেন, তাঁদের জন্য তো বটেই, এমনকি যেসব ব্যক্তির সর্বশেষ টিকা নেওয়ার মেয়াদ ছয় মাস পার হয়ে গেছে, তাঁদেরও করোনার টিকা নেওয়া উচিত।
আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ করোনার বিস্তার ঘটার আগেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। আর জনসচেতনতার কাজটি করতে হবে সর্বস্তরে, সব খানে। প্রচারমূলক কাজে সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি ব্যবহার করতে হবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেও।