পুরস্কারপ্রাপ্তির ফোন যখন পেলাম তখন আমি বাসন ধুচ্ছিলাম। কিছুদিন আগেই অনলাইনে ডিশওয়াশারের দাম দেখেছি, অত টাকা নেই হাতে। তাই হন্যে হয়ে হাউসহেল্প খুঁজে বেড়াচ্ছি। ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছি জেনে মনে হলো, এবার তাহলে একটা ডিশওয়াশার কিনে ফেলব নাকি? থালাবাসন ধুতে না হলে অনেকটা সময় বেঁচে যাবে। সেই সময়টুকুতে লেখালেখি করা যাবে। সৃজনশীল লেখালেখিটাকে সাহিত্য চর্চার মতন ভারী শব্দবন্ধ দিয়ে কেউ বলে না। পেশায় শিক্ষক হওয়ার জন্য আমার কাছ থেকে একাডেমিক লেখা আশা করা হয়, জব রিকোয়ারমেন্ট। প্রমোশন ইত্যাদি নির্ভর করে প্রকাশনা আর বাড়তি ডিগ্রির ওপর। সেই ক্ষেত্রে আমি শোচনীয়ভাবে পিছিয়ে আছি। ১৪ বছর চাকরি করার পর কোনোমতে সহযোগী অধ্যাপক হয়েছি। ওদিকে আমার সমবয়সীরা প্রফেসর ডক্টর হয়ে গেছেন। যতই আপনি বলেন না কেন, প্রতিযোগিতা কারও সঙ্গে কারও নয়, নিজের বেস্টটা করাই আসল কথা– একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হলে সেখানকার মান অনুযায়ী প্রত্যাশিত কর্মদক্ষতা দেখাতে পারতে হয়। ১৪ বছরে এমফিল-পিএইচডি না হলেও প্রকাশনা ইত্যাদি দিয়ে অ্যাসোসিয়েট হতে পারা একটা ন্যূনতম যোগ্যতা। আমার পেশা তো শিক্ষকতা, ওই করে খাই, রোজগার হালাল তো করতে হবে। ২০২২ সাল থেকে প্রতি বছর একটা করে ফিকশনের বই বের করতে পারছি আর যে কয়টি একাডেমিক জার্নাল প্রকাশ করতে হবে তা করতে পারছি না, এতে আমার সহকর্মীদের পর্যন্ত অস্বস্তি হচ্ছে। আমাকে কেউ সেভাবে বলেনি যে গল্প-উপন্যাস লেখা বাদ দিয়ে একাডেমিক পেপার লেখেন আপা, কিন্তু এই ফিকশন লেখার ভূত সিন্দাবাদের দৈত্যের মতন ঘাড়ে চেপে থাকলে এই জনমে প্রফেসর ডক্টর উম্মে ফারহানা হওয়া সুদূর পরাহত– তা বেশ টের পাচ্ছি। ক্যাম্পাস থেকে ফিরে বাচ্চাদের জন্য রান্নাবান্না করা আছে, বাজার সদাইটাও করতে হয় ছেলের বাবার ইন্তেকালের পর থেকে। সময়ের বড়ই টানাটানি। এখন প্রফেশনাল দিক থেকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা ফরজ হয়ে গেছে, বেতনটাও বাড়া দরকার। যেহেতু লেখালেখি থেকে আয়-রোজগারটা বেশ অনিশ্চিত একটা ব্যাপার। যেটুকু হয় তা দিয়ে শখ মেটানো যায়, জীবিকা নির্বাহ করা যায় না। মানে ভাত জোটানো বা বাসা ভাড়া দেওয়া যায় না। ঈদসংখ্যায় লিখে যখন টাকা পাই আমার বাচ্চারা বলে, চলো আমরা পিৎজা খাই। বাইরে খেতে যাবার জন্যও যেহেতু আমাদের উপলক্ষ খুঁজে বের করতে হয়, ঈদসংখ্যায় লেখা ছাপলে সেই উপলক্ষ ধরে নিয়ে বিলাসিতাগুলো মেটানো যায় সেই অর্থ দিয়ে।
এ বছর আমার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘বাতাসে ফুল ঝরে যায়’ প্রকাশিত হওয়ার দিন শিমুল সালাহউদ্দীন একটা ইন্টারভিউ করেছিল মেলার মাঠে মুখোমুখি নামের একটা সাক্ষাৎকার সিরিজের জন্য। সেখানে র্যাপিড ফায়ার রাউন্ডে শিমুল সাহিত্য পুরস্কারের কথা তুললে বলেছিলাম যে সাহিত্য পুরস্কার অপ্রয়োজনীয়। তাহলে কেউ বলতেই পারে আমি তাহলে এই পুরস্কারের জন্য বই জমা দিলামই-বা কেন? পুরস্কার পাবার পর ঠিক এই প্রশ্নটাই আমার মনে এসেছিল। আমি যদি মনেই করি সাহিত্য চর্চা কিংবা লেখালেখি একজন মানুষ শুধু নিজের আত্মার তাগিদ থেকেই করে, তাহলে পুরস্কারের প্রতিযোগিতায় নামার দরকারটা কী? এটা কি তাহলে সহকারী থেকে সহযোগী হওয়ার মতনই একটা ব্যাপার? কারও সঙ্গে প্রতিযোগিতা করব না, আমার প্রতিযোগী শুধুই আমি নিজে– নিজের বেস্টটা দেওয়াই আসল ব্যাপার। কিন্তু ভালো ক্লাস নিতে পারলে, নির্ভুলভাবে খাতা জমা দিতে পারলে, সময়মতো রেজাল্ট বের করে দিতে পারলে পরে শিক্ষক হিসেবে আত্মতুষ্টি পাওয়া গেলেও অন্তত বেতনটা বাড়ানোর জন্য হলেও আপগ্রেডেশনের জন্য আবেদন করতেই হয়– ঠিক তেমনই একটা যোগ্যতা প্রমাণের তাড়া কি আমার ছিল? নাকি ডিশওয়াশার কিনতে পারার সামর্থ্য অর্জন করার জন্য, উইশলিস্টে রাখা আরও দু-একটি শাড়ি কিংবা বুট অথবা লিপস্টিক কিনতে অনেকগুলো হিসাব করতে হবে না বলে খুশি হয়ে যাবার মতন ঘটনা?
অনুষ্ঠানে হাজির হবার জন্য ভেবেচিন্তে আমার প্রয়াত স্বামী রুবায়েতের শখ করে কিনে দেওয়া একটা কালো শাড়ি আর তাঁর জীবনের শেষ ঈদে উপহার দেওয়া একটা ব্লাউজ পরে ডাক্তারের নিষেধ অমান্য করে আড়াই ইঞ্চি উঁচু স্টিলেটো হিল জুতা নির্বাচন করলাম। বেশ নার্ভাসই লাগছিল। জীবনে প্রথম সাহিত্যের জন্য একটা পুরস্কার পাচ্ছি, আমার সব অদরকারি কাজ, শিক্ষকের দায়িত্ব থেকে বিভিন্নভাবে বের করে নেওয়া সময়ে, অনেক সম্পাদক আর প্রকাশক বন্ধুদের অনুরোধে লেখা গল্পগুলো জমিয়ে বই বের করার পাগলামিকেও কেউ মূল্য দিচ্ছে– এই ব্যাপারটা এক ধরনের শিহরনমিশ্রিত আনন্দ দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এখন থেকে আমি বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারব যে আমি একজন লেখক। এতদিন হয়তো নিজেকে বলতাম শিক্ষক এবং লেখক। এই স্বীকৃতি পাওয়ার পর পেশার পরিচয়টুকু না দিলেও একটি পরিচয় দাঁড়িয়ে গেল বোধ করি।
আমার শিক্ষক আর গুরু মোহাম্মদ রফিক অনেক আগেই বলেছিলেন, “লিখতে তোমাকে হবেই, লেখা ছাড়া তোমার মুক্তি নেই।” পুরস্কার নিয়ে স্যারেরও বহু নখরামি ছিল তা জানি। তবুও সাহিত্যিক জীবনের প্রথম সম্মাননাটি আমি মোহাম্মদ রফিককে উৎসর্গ করলাম। স্যার যদি না বলতেন, “গদ্য তোমার হাতে আছে”, আমি হয়তো কখনোই গল্প-উপন্যাস লেখার সাহস করতাম না। একই সঙ্গে এটি আমার ছেলের বাবা কাজী রুবায়েত ইসলামকেও উৎসর্গ করছি। আমার লেখার ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ ছিল অনন্য। প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদ তাঁর করা, চারটি বইয়ের অথর ফটো তাঁর তোলা। মহা ঝগড়াঝাঁটি চললেও এই জিনিসগুলো সময়মতো জমা দিতে কখনও গাফিলতি করেনি সে। আমরা আলাদা বাসায় থাকা শুরু করার পরে যেসব বই বের হয়েছে সেগুলোর জন্যও অথর ফটো সে তুলে দিয়েছিল। আমাদের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দাম্পত্য, ইংরেজিতে যাকে বলে ট্রাবল্ড ম্যারেজ, কখনোই আমার সাহিত্যযাত্রায় বাধা হয়নি।
পুরস্কারপ্রাপ্তির অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে অনেক ব্যক্তিগত গল্প বলে ফেললাম। আশা করি, পাঠক এই আবেগের আতিশয্যকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রস ক র প রস ক র র জন য প রক শ ব র কর আম র স
এছাড়াও পড়ুন:
চাঁদপুরে খতিবকে কুপিয়ে জখম
চাঁদপুর শহরের প্রফেসরপাড়া মোল্লাবাড়ি জামে মসজিদের খতিব মাওলানা নুরুর রহমানকে (৭৫) কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। এ ঘটনায় এলাকাবাসী অভিযুক্ত বিল্লাল হোসেনকে (৪০) ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন।
আহত মাওলানা নুরুর রহমানকে চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী মাসুদ মিয়া বলেন, শুক্রবার মাওলানা নুরুর রহমান জুমা শেষে মসজিদে অবস্থান করছিলেন। এ সময় মসজিদের পাশের সবজি দোকানি বিল্লালও সেখানে ছিলেন। হঠাৎ বিল্লাল একটি চাপাতি নিয়ে মাওলানা নুরুর রহমানের শরীরে এলোপাতাড়ি আঘাত করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় আশপাশের লোকজন বিল্লালকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেন।
এ ব্যাপারে মাওলানা নুরুর রহমানের ভায়রা অলিউর রহমান বলেন, জুমার নামাজের আগে আলোচনার সময় বিল্লাল হোসেন বাধার সৃষ্টি করেন। এরপর নামাজ শেষে এ হামলার ঘটনা ঘটে।
চাঁদপুর মডেল থানার ওসি মো. বাহার মিয়া বলেন, ‘আমরা অভিযুক্তকে আটক করেছি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’