Prothomalo:
2025-06-13@19:01:20 GMT

ইসলামে স্বপ্নের গুরুত্ব

Published: 13th, June 2025 GMT

আল্লাহর কাছে সব প্রকাশিত। তিনি সব জানেন ও দেখেন। কিন্তু আমাদের মধ্যে কতজন স্বপ্নকে গায়েবের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন? ইসলামে স্বপ্নের ব্যাখ্যাকে নবুওয়াতের ৪৬ ভাগের ১ ভাগ বলা হয়েছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭,০১৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,২৬৩)

স্বপ্ন একটি সর্বজনীন অথচ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, যার জন্য বিভিন্ন সংস্কৃতিতে সাধারণ ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। যেমন, সোনেনেকুইনাজি জনগোষ্ঠীর কাছে সাদা ঠোঁটের পেকারি স্বপ্নে দেখা মানে মাছ ধরার সমৃদ্ধ মৌসুম। মেক্সিকোতে দাঁত পড়ে যাওয়ার স্বপ্ন মৃত্যু বা অসুস্থতার ইঙ্গিত দিতে পারে। আপনার নিজের আত্মীয়রাও হয়তো আপনার স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে নিজস্ব মতামত শেয়ার করেছেন।

ইসলামে স্বপ্নের ব্যাখ্যাকে নবুওয়াতের ৪৬ ভাগের ১ ভাগ বলা হয়েছে।

ইসলামে স্বপ্নের জগৎ—চেতনা ও অবচেতনার সীমানা—গায়েবের অংশ। মহান আল্লাহ কোরআনে বলেন, ‘আল্লাহই মানুষের প্রাণ হরণ করেন তাদের মৃত্যুর সময় এবং যারা জীবিত, তাদের প্রাণ নিয়ে যান তাদের ঘুমের সময়। তারপর যাদের মৃত্যু নির্ধারিত হয়েছে, তাদের প্রাণ রেখে দেন, আর অন্যদের প্রাণ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ছেড়ে দেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা জুমার, আয়াত: ৪২)

মা’আরিফুল কোরআন-এর তাফসিরে মুফতি মুহাম্মদ শফি এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, আলী (রা.

) উল্লেখ করেছেন যে, ঘুমের সময় মানুষের আত্মা শরীর থেকে চলে যায়, কিন্তু আত্মার একটি রশ্মি বা সংযোগ শরীরে থেকে যায়, যার কারণে মানুষ জীবিত থাকে। এই সংযোগের মাধ্যমেই মানুষ স্বপ্ন দেখে।

লক্ষণীয় যে, ধর্ম-বিশ্বাস নির্বিশেষে সবার আত্মা এই গায়েবের জগতের সংস্পর্শে আসে। রাবাতার নির্বাহী পরিচালক শায়খা ড. তামারা গ্রে একটি সংক্ষিপ্ত কোর্সে বলেন, ‘আল্লাহ কাউকে গায়েব থেকে বিচ্ছিন্ন করেন না।’ যেমন আল্লাহ সবাইকে খাদ্য ও পানি দান করেন, তেমনি তিনি সবাইকে স্বপ্নের মাধ্যমে নিদর্শন দেন। এটি ইসলামে স্বপ্নের প্রতি শ্রদ্ধার একটি কারণ। নবীগণ (আ.) স্বপ্ন দেখেছেন, যা পরবর্তীতে সত্য হয়েছে।

আলী (রা.) উল্লেখ করেছেন যে, ঘুমের সময় মানুষের আত্মা শরীর থেকে চলে যায়, কিন্তু আত্মার একটি রশ্মি বা সংযোগ শরীরে থেকে যায়, যার কারণে মানুষ জীবিত থাকে। এই সংযোগের মাধ্যমেই মানুষ স্বপ্ন দেখে।আরও পড়ুনকোন স্বপ্ন দেখলে কী করবেন০৩ মার্চ ২০২৩

স্বপ্নের প্রকারভেদ

রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বপ্নের তিনটি প্রকার বর্ণনা করে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে সত্যবাদী, তাদের স্বপ্নও সবচেয়ে সত্য হয়। স্বপ্ন তিন প্রকার: সত্য স্বপ্ন, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ; শয়তানের পক্ষ থেকে দুঃখজনক স্বপ্ন; এবং নিজের মন থেকে উদ্ভূত স্বপ্ন। যদি কেউ এমন স্বপ্ন দেখে যা তার অপছন্দ, তবে সে যেন উঠে নামাজ পড়ে এবং এ বিষয়ে মানুষের সঙ্গে কথা না বলে।’ (সহিহ মুসলিম: ২,২৬৩)

সত্য স্বপ্নকে বলা হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ, তাতে রাসুল (সা.)-কে দেখার স্বপ্নও অন্তর্ভুক্ত। এই স্বপ্ন সবসময় সত্য হয় (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৫৯২, সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,২৬৬)।

উসমান (রা.) রোজার দিনে স্বপ্নে দেখেন যে রাসুল (সা.) তাকে বলছেন, ‘আজ রাতে আমাদের সঙ্গে ইফতার করো।’ সেই দিনই তিনি শহিদ হন। (দালাইল আন-নুবুওয়াহ লিল-বায়হাকি: ৭/৪৮)

যারা কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তারা প্রায়শই আল্লাহর পক্ষ থেকে সান্ত্বনার জন্য স্বপ্ন পান। কখনো কখনো আল্লাহ আসন্ন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে স্বপ্ন পাঠান। রাসুল (সা.) বলেছেন: “যখন সময় ঘনিয়ে আসবে, তখন মুসলিমের স্বপ্ন প্রায় মিথ্যা হবে না। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কথায় সত্যবাদী, তার স্বপ্নও অধিক সত্য হবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭,০১৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,২৬৩)

যদি কেউ এমন স্বপ্ন দেখে যা তার অপছন্দ, তবে সে যেন উঠে নামাজ পড়ে এবং এ বিষয়ে মানুষের সঙ্গে কথা না বলে। সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,২৬৩

কোরআনে স্বপ্নের উদাহরণ

কোরআনে সাতটি স্বপ্ন এবং তাদের ব্যাখ্যার উল্লেখ রয়েছে। এর মাধে ৪টি হলো সুরা ইউসুফে। ইউসুফ (আ.) স্বপ্নে দেখেন এগারোটি তারা, সূর্য ও চাঁদ তাকে সিজদা করছে (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৪)।

তার সঙ্গী কয়েদিদের স্বপ্নের ব্যাখ্যার উদাহরণ রয়েছে: ‘ইউসুফের সঙ্গে আরও দুজন কয়েদি কারাগারে গিয়েছিল। তাদের একজন বলল, ‘আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমি আঙ্গুরের রস তৈরি করছি।’ অন্যজন বলল, ‘আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমার মাথায় রুটি রয়েছে, যা থেকে পাখিরা খাচ্ছে।’ তারা বলল, ‘আমাদের এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলো, আমরা তোমাকে সৎকর্মশীলদের একজন মনে করি।’ (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৩৬)

ইউসুফ (আ.) ব্যাখ্যা করেন, ‘হে আমার কারাসঙ্গীরা, তোমাদের একজন তার মনিবকে মদ পরিবেশন করবে, আর অন্যজন ক্রুশবিদ্ধ হবে এবং পাখিরা তার মাথা থেকে খাবে। যে বিষয়ে তোমরা জিজ্ঞাসা করেছ, তা নির্ধারিত হয়ে গেছে।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৪১)

উল্লেখযোগ্য যে, ইউসুফ (আ.) স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেওয়ার আগে কয়েদিদের এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে উৎসাহিত করেন এবং তাঁর জ্ঞানের উৎস হিসেবে আল্লাহকে উল্লেখ করেন। একজন কয়েদি মুক্তি পাবে এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারবে, অন্যজনের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগে তাওবার সময় থাকবে।

এ ছাড়াও সেকালের মিশরের মন্ত্রী স্বপ্নে দেখেন, সাতটি দুর্বল গাভী এবং সাতটি স্থূল গাভী। (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৪৩-৪৪)

সুরা আল-আনফালে রয়েছে (আয়াত ৪৩) শত্রু সৈন্যের সংখ্যা কম দেখা। মক্কা বিজয়ের স্বপ্নে কথা আছে সুরা ফাতহের ২৭ নম্বর আয়াতে। ইবরাহিম (আ.)-এর স্বপ্নে ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করার বর্ণনাও কোরআনে। (সুরা আস-সাফফাত, আয়াত: ১০২-১০৫)

আরও পড়ুনস্বপ্ন দেখলে কী করবেন১৫ জানুয়ারি ২০২৫

স্বপ্নের ব্যাখ্যা: শিল্প ও বিজ্ঞান

সব স্বপ্ন সত্য হয় না, এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা একটি শিল্প ও বিজ্ঞান। ইসলামী ব্যাখ্যায় স্বপ্নদ্রষ্টার সংস্কৃতি (উরফ) বিবেচনা করা হয়। শায়খা ড. তামারা গ্রে ব্যাখ্যা করেন, যদি কেউ চাল নিয়ে স্বপ্ন দেখে, তবে পাকিস্তানে তা সমৃদ্ধির ইঙ্গিত দিতে পারে, কারণ চাল তাদের প্রধান খাদ্য। কিন্তু মরক্কোতে, যেখানে দরিদ্ররা চাল খায়, এটি দুর্দশার ইঙ্গিত হতে পারে। এটিই ‘সত্য স্বপ্ন’, যা আল্লাহ মানুষকে দান করেন, শুধু নবীদের নয়।

আজানের পদ্ধতিও একটি স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল (সুনান ইবনে মাজাহ: ৭০৬)। সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে জায়দ (রা.) স্বপ্নে একজন ব্যক্তিকে ঘণ্টা হাতে দেখেন। তিনি ঘণ্টাটি কিনতে চাইলে লোকটি জানতে চান, এটি দিয়ে কী করবেন। আবদুল্লাহ বলেন, নামাজের সময় ঘোষণার জন্য। লোকটি আজানের শব্দগুলো প্রস্তাব করেন।

জাগ্রত হয়ে তিনি রাসুল (সা.)-কে এই স্বপ্ন জানান এবং রাসুল (সা.) তাকে বিলাল ইবনে রাবাহ (রা.)-কে আজান শেখাতে বলেন। বিলাল আজান দিলে হযরত উমর (রা.) বলেন, তিনিও একই স্বপ্ন দেখেছিলেন। আজ, হাজার বছর পরেও আমরা এই স্বপ্নের উপর আমল করছি।

যদি কেউ চাল নিয়ে স্বপ্ন দেখে, তবে পাকিস্তানে তা সমৃদ্ধির ইঙ্গিত দিতে পারে, কারণ চাল তাদের প্রধান খাদ্য। কিন্তু মরক্কোতে, যেখানে দরিদ্ররা চাল খায়, এটি দুর্দশার ইঙ্গিত হতে পারে।শায়খা ড. তামারা গ্রে, নির্বাহী পরিচালক, রাবাতা

স্বপ্ন দেখার পর কী করবেন

রাসুল (সা.) স্বপ্নের পর কী করতে হবে তা নির্দেশ দিয়েছেন:

১. স্বপ্ন শুধু তাদের সঙ্গে শেয়ার করুন যারা আপনার কল্যাণ কামনা করে বা অভিজ্ঞ স্বপ্ন ব্যাখ্যাকারী (আল-মুস্তাদরাক আলা আস-সহিহাইন: ৮,১৭৭)। ভালো স্বপ্ন স্বপ্নে থাকা ব্যক্তিদের বা যারা আপনার জন্য দোয়া করবে তাদের সঙ্গে শেয়ার করুন। ‘ইস্তিখারা’র ক্ষেত্রে নিদর্শন পেলে তা গ্রহণ করুন।

২. দুঃস্বপ্ন দেখলে বাম দিকে তিনবার শুকনো থুথু ফেলে বলুন, ‘আউযু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম (আমি আল্লাহর কাছে শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি)।’ (সুনান ইবনে মাজাহ: ৩,৯১০)

৩. স্বপ্নের বিবরণ লিখে রাখুন। এটি আপনাকে আল্লাহর দেওয়া স্বপ্নের সত্যতা উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে।

ইসলামে স্বপ্ন গায়েবের একটি অংশ এবং আল্লাহর নিদর্শন। এটি সুসংবাদ, শয়তানের দুঃস্বপ্ন বা অবচেতন মনের প্রতিফলন হতে পারে। স্বপ্ন কেবল ঘুমের অভিজ্ঞতা নয়, বরং আল্লাহর সঙ্গে আমাদের আত্মার সংযোগের একটি মাধ্যম।

সূত্র: আমালিয়াহ ডটকম

আরও পড়ুনস্বপ্ন তিন প্রকার০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র উল ল খ প রক র র জন য আল ল হ র সময ইউস ফ র একট করব ন ইসল ম আপন র ক রআন

এছাড়াও পড়ুন:

নির্বাসিত, তবুও অপরাজিত

দেশে মেধার নিশ্চয়ই অভাব রয়েছে, কিন্তু তার অপচয়টা বড়ই মর্মান্তিক। এ দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া কেবল একালের ঘটনা নয়, বহুকালের; তবে একালে সেটা মর্মান্তিক, প্রায় অবিশ্বাস্য আকার ধারণ করেছে। মেধা অবশ্যই জাতীয় সম্পদ; এবং সেটাও সমানে পাচার হয়ে যাচ্ছে, নানাভাবে। দাউদ হায়দারের মৃত্যুসংবাদে ব্যক্তিগতভাবে যে অত্যন্ত পীড়িত হয়েছি সেই সত্যের সঙ্গে সমষ্টিগত ক্ষতির বোধটাও আমাকে মর্মাহত করেছে। 
দাউদ তো কেবল মেধাবান নয়, ছিল প্রতিভাবান। অতিঅল্প বয়সে সে অসাধারণ সব কবিতা লিখেছে। ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ পঙ্‌ক্তিটি তো ভুলবার মতো নয়। সেটাই তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম। যে-কবিতাটির একটি পঙ্‌ক্তির জন্য ৫১ বছর ধরে নির্বাসনে থেকে শেষ পর্যন্ত  বিদেশের মাটিতেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হলো সেটির শিরোনামটিও মনে দাগ কাটে; ‘বলো সূর্যের কালো জোৎস্নায় কালো বন্যায়।’ ১৯৭৪-এ লেখা। দেশ তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে, এবং স্বাধীনতার জন্য দেশবাসীকে যে মূল্য দিতে হয়েছে ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। কিন্তু প্রত্যাশিত ছিল যে মুক্তি সেটা আসেনি। বরং চতুর্দিকে দেখা গেছে সন্ত্রাস, লুণ্ঠন ও লোলুপতার অন্ধকার। দাউদরা সেই প্রজন্মের সন্তান, যুদ্ধের সঙ্গে যাদের প্রত্যক্ষ যোগ ছিল; হানাদারদের নৃশংসতা যারা সহ্য করেছে, দেখেছে এবং লড়েছেও। যুদ্ধ শেষে কবিতার চর্চাকেও দাউদ অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধেরই অপরিহার্য অংশ হিসেবে গণ্য করেছে। অত্যন্ত প্রাণবন্ত ছিল সে, টগবগ করছিল আবেগে, উত্তেজনায় এবং চিন্তায়। অনেক কিছু করা চাই, করা সম্ভব, ভাবছিল সে। সে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষ অনার্সের ছাত্র তখনই দায়িত্ব পেয়েছে দৈনিক সংবাদ-এর মতো জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতা সম্পাদনার। পাতাটিকে সে ভরপুর রাখত নবীন ও প্রবীণ লেখকদের প্রাণোচ্ছল নতুন নতুন লেখায়। নিজেও লিখত। এবং লিখেছিল ও ছেপেছিল অন্ধকার বিষয়ে নিজের ওই কবিতাটি, যার একটি পঙ্‌ক্তির জন্য সে প্রথমে কারাবন্দি ও পরে নির্বাসিত হয়। একটি মাত্র পঙ্‌ক্তির জন্য এমন কঠিন দুর্ভোগ সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল ঘটনা বৈকি। তাও ঘটল দেশ যখন মুক্ত হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছিল তখন। আমাদের দেশের ধর্মীয় মৌলবাদীরা কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক বলে সুপরিচিত নয়। তাও আবার দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতাতে ছাপা কবিতার। নিশ্চয়ই কেউ তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন; এবং যারা করেছিলেন তারা সেটা এমনি এমনি করেননি, উদ্দেশ্য ছিল। উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ইস্যুর খোঁজে ব্যস্ত ধর্মীয় মৌলবাদীরা একটি রাজনৈতিক ইস্যু পেয়ে গেছে, এবং সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ হট্টগোল শুরু করে দিয়েছে। বিব্রত হয়ে সরকার দাউদকে গ্রেপ্তার করেছে। ওই কাজটা করা কেবল যে সরকারের জন্য আবশ্যক ছিল তা নয়, দাউদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্যও প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। 
দাউদ প্রথমে জেলে গেল, তারপর সরকারই তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে ভারমুক্ত হলো। দাউদ কলকাতায় গেল। কিন্তু প্রতিভাবান ওই তরুণ ভেঙে পড়বার পাত্রটি ছিল না। কলকাতার এখানে-সেখানে সে আশ্রয় খুঁজে নিল। অন্নদাশঙ্কর রায়ের সহকারী হিসেবেও সে কাজ করেছে। কিন্তু নিজের অসমাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করার কথাটা ভোলেনি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয়ে যথারীতি অনার্স ও এমএ ডিগ্রি লাভ করে। এবং কলকাতার লেখকদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন এবং নিজের লেখালেখির কাজেরও কোনো বিরাম ঘটেনি। 
অন্নদাশঙ্কর রায়ের মাধ্যমে জার্মান ঔপন্যাসিক গুন্টার গ্রাসের সঙ্গে দাউদ হায়দারের পরিচয় ঘটে। সাহিত্যের জন্য তথ্য ও অভিজ্ঞতা সংগ্রহের জন্য ওই ঔপন্যাসিক তখন কলকাতায় ছিলেন। দাউদ যে একজন প্রতিভাবান তরুণ গুন্টার গ্রাসের পক্ষে সেটা টের পেতে বেশি সময় লাগেনি। গুন্টার গ্রাসের মধ্যস্থতাতেই দাউদ জার্মানিতে গেছে ১৯৮৭ সালে। সেখানে গিয়ে জার্মান বেতারের বাংলা বিভাগে তার কর্মসংস্থান ঘটেছে। ১৯৮৯-তেই হবে, গুন্টার গ্রাস ঢাকায় এসেছিলেন। ঢাকাস্থ জার্মান সংস্কৃতি কেন্দ্রের আগ্রহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদে তাঁর একটি বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। ঘটনাক্রমে আমি তখন কলা অনুষদের ডিন। ডিন অফিসে আলাপকালে তিনি দাউদের কথা উল্লেখ করেছিলেন। দাউদের ভাইরা ঢাকায় থাকে এবং সাহিত্যচর্চা করে বলে তিনি উল্লেখ করেছিলেন। 
তা দাউদের ভাইয়েরা সাহিত্যচর্চা করতেন বৈকি। এক পরিবারে একই সময়ে এতজন সাহিত্যচর্চাকারীর উপস্থিতি সচরাচর দেখা যায় না। 

জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জিয়া হায়দার ছিলেন নাট্যকার এবং নাট্যসংগঠক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স করে বিদেশে গিয়ে নাট্যকলায় ডিগ্রি নিয়ে আসেন। এমএ ক্লাসে পড়ার সময় আমার স্ত্রী প্রয়াত নাজমা জেসমিন তাঁর সহপাঠী ছিলেন। নাজমার মৃত্যুর পরে তাঁকে স্মরণ করে যে স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়, জিয়া হায়দার তাতে লিখেছেনও। নাজমার কাছে জিয়ার কথা শুনতাম। তবে জিয়ার সঙ্গে আমার নিজেরও ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এবং সেটাও ঘটেছে তাঁর সাহিত্যচর্চার কারণেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগ চালু হলে জিয়া তাতে যোগ দেন। আমাদের অনেকের আগ্রহ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও নাট্যকলা বিভাগ খোলা হোক, এবং জিয়া তাতে যুক্ত হোন। সে-বিভাগ শেষ পর্যন্ত খোলা হয়েছে, তবে অনেক বিলম্বে। ততদিনে জিয়া চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক জগতে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছেন, এবং ঢাকায় আসার ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। নাটক ও নাট্যসাহিত্যের বিষয়ে জিয়ার ছিল খুব বড় এক গ্রন্থ সংগ্রহ; জিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছানুসারে ওই সংগ্রহটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগকে অর্পণ করা হয়। জিয়া ছিলেন অত্যন্ত উদ্যোগী সংগঠক, নাগরিক নাট্যদল প্রতিষ্ঠার পেছনে জিয়ার কর্মোদ্যম সক্রিয় ছিল। ভাইবোন ও মা’কে ঢাকায় নিয়ে আসার ব্যবস্থাও তাঁর উৎসাহে উদ্যোগেই ঘটেছিল। জিয়ার ভাই রশীদ হায়দার, মাকিদ হায়দার, জাহিদ হায়দার, সবার সঙ্গেই আমার পরিচয় ও যোগাযোগ ঘটেছে। রশীদ ও মাকিদ আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। জাহিদ আছে। জাহিদও অন্য ভাইদের মতোই সাহিত্যচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ। হায়দার ভাইদের যে চারজন চলে গেছে তাদের প্রত্যেকের বিদায় আমাকে আঘাত করেছে। জাহিদ হায়দার যে আছে সেটি সুখ ও সান্ত্বনার বিষয়। ওদের ভগ্নিপতিদের একজন, ওবায়েদুল্লাহ সাগরও সাহিত্যের অধ্যাপক ও গবেষক। 
দাউদকে স্মরণ করতে গিয়ে অনেক স্মৃতিই জেগে উঠল। যা তার করবার ছিল, সে তা করতে পারেনি। এবং যে সম্ভাবনা নিয়ে সে জন্মগ্রহণ করেছিল তাও পূর্ণতা পেল না। মূল কারণ তার নির্বাসন। এমনটা ঘটবে আমরা কেউ ভাবিনি, সবচেয়ে কম ভেবেছে অবশ্য সে নিজে। সে যেমন ছিল প্রতিভাবান, তেমনি ছিল দুরন্ত ও দুঃসাহসী। সৃষ্টিশীলতা ও তারুণ্যের প্রতীক। বিদ্যমান ব্যবস্থা তাকে সহ্য করতে পারেনি। সে জন্যই তার নির্বাসন ঘটেছে। প্রবাসে থেকেও সে সাহিত্যের চর্চা করেছে। লিখেছে, লেখা পাঠিয়েছে। কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকার বাংলা সংস্করণে নিয়মিত লিখত। আমাদের ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত পত্রিকার জন্য তার পাঠানো লেখা পেয়েছি, এবং প্রকাশ করে আনন্দিত হয়েছি। কিন্তু এসব তো সান্ত্বনা বৈ নয়। তার কবিতার বই ‘সম্পন্ন মানুষ নই’ সে উৎসর্গ করেছে দু’জনকে, একজন হচ্ছেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অপরজন আমি। বছর দশেক আগে বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আমার একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছিল; দাউদ সেটি মনোযোগ দিয়ে শুনেছে, এবং শোনা শেষ করেই বার্লিন থেকে ফোন করে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। জাহিদ হায়দার একবার বার্লিনে গিয়েছিল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। ইউরোপীয় ধ্রুপদি সংগীতে আমার আগ্রহের বিষয়ে দাউদ জানত, জাহিদকে সে অনেকগুলো সিডি দিয়ে দায়িত্ব চাপিয়েছিল আমাকে পৌঁছে দেবার। সেগুলো পেয়ে এবং বাজিয়ে শুনে বারবার দাউদের বহুমুখিতার কথা মনে পড়েছে। রেকর্ডগুলো এখনও আমার সংগ্রহে আছে। নির্বাসিত দাউদ জার্মানি থেকে কমপক্ষে বিশবার কলকাতা পর্যন্ত এসেছে, কিন্তু একবারও ঢাকায় প্রবেশাধিকার পায়নি।
দাউদকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দাউদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করা হয়েছে, সাংস্কৃতিকভাবে ক্ষতি হয়েছে আমাদেরও। বিদেশে থাকলেও সবসময়ই সে বাংলাদেশেই ছিল। একটানা একান্ন বছর একজন মানুষের জীবনে কম সময় নয়; দীর্ঘ সেই সময় ধরে দেশছাড়া আপনজনছাড়া অবস্থায় দুঃসহ যন্ত্রণায় সে দগ্ধ হয়েছে, কাতর হয়েছে সে তার সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগাতে না-পেরে। কলকাতায় গিয়ে সে লিখেছিল, ‘মনে হয় মনুমেন্টের চূড়ায় উঠে/ চিৎকার ক’রে/ আকাশ ফাটিয়ে বলি;/ দেখো, সীমান্তের ওইপাশে আমার ঘর/ এইখানে আমি একা, ভীনদেশী।’ এই আর্তধ্বনি তার নিত্যসঙ্গী ছিল বলেই অনুমান করি। তবে এটাও জানি যে তার মনের জোর ছিল অসামান্য; যে জন্য সে নির্বাসিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পরাজিত হয়নি। তাকে ভুলবার কোনো উপায় নেই। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রক্ত দিলে মানবিক অনুভূতি জেগে ওঠে
  • বন্দরে মসজিদের ঈমামকে মুসল্লিদের রাজকীয় বিদায় 
  • হঠাৎ ওড়ার শক্তি হারায় উড়োজাহাজটি
  • মাগুরায় দুই মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে একজন নিহত
  • ‘ক্যাশবাক্সে যা আছে বের কর, নইলে গুলি করে মাইরা ফালব’
  • বান্দরবানে দুইদিনে মিলল দুই পর্যটকের লাশ, এখনো নিখোঁজ ১
  • উড়োজাহাজের সেলফিতে শেষ হাসি: চিকিৎসক দম্পতি ও তাঁদের তিন সন্তানের করুণ বিদায়
  • নিখোঁজের এক দিন পর নদ থেকে একজনের লাশ উদ্ধার
  • নির্বাসিত, তবুও অপরাজিত