আল্লাহর কাছে সব প্রকাশিত। তিনি সব জানেন ও দেখেন। কিন্তু আমাদের মধ্যে কতজন স্বপ্নকে গায়েবের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন? ইসলামে স্বপ্নের ব্যাখ্যাকে নবুওয়াতের ৪৬ ভাগের ১ ভাগ বলা হয়েছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭,০১৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,২৬৩)
স্বপ্ন একটি সর্বজনীন অথচ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, যার জন্য বিভিন্ন সংস্কৃতিতে সাধারণ ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। যেমন, সোনেনেকুইনাজি জনগোষ্ঠীর কাছে সাদা ঠোঁটের পেকারি স্বপ্নে দেখা মানে মাছ ধরার সমৃদ্ধ মৌসুম। মেক্সিকোতে দাঁত পড়ে যাওয়ার স্বপ্ন মৃত্যু বা অসুস্থতার ইঙ্গিত দিতে পারে। আপনার নিজের আত্মীয়রাও হয়তো আপনার স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে নিজস্ব মতামত শেয়ার করেছেন।
ইসলামে স্বপ্নের ব্যাখ্যাকে নবুওয়াতের ৪৬ ভাগের ১ ভাগ বলা হয়েছে।ইসলামে স্বপ্নের জগৎ—চেতনা ও অবচেতনার সীমানা—গায়েবের অংশ। মহান আল্লাহ কোরআনে বলেন, ‘আল্লাহই মানুষের প্রাণ হরণ করেন তাদের মৃত্যুর সময় এবং যারা জীবিত, তাদের প্রাণ নিয়ে যান তাদের ঘুমের সময়। তারপর যাদের মৃত্যু নির্ধারিত হয়েছে, তাদের প্রাণ রেখে দেন, আর অন্যদের প্রাণ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ছেড়ে দেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা জুমার, আয়াত: ৪২)
মা’আরিফুল কোরআন-এর তাফসিরে মুফতি মুহাম্মদ শফি এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, আলী (রা.
লক্ষণীয় যে, ধর্ম-বিশ্বাস নির্বিশেষে সবার আত্মা এই গায়েবের জগতের সংস্পর্শে আসে। রাবাতার নির্বাহী পরিচালক শায়খা ড. তামারা গ্রে একটি সংক্ষিপ্ত কোর্সে বলেন, ‘আল্লাহ কাউকে গায়েব থেকে বিচ্ছিন্ন করেন না।’ যেমন আল্লাহ সবাইকে খাদ্য ও পানি দান করেন, তেমনি তিনি সবাইকে স্বপ্নের মাধ্যমে নিদর্শন দেন। এটি ইসলামে স্বপ্নের প্রতি শ্রদ্ধার একটি কারণ। নবীগণ (আ.) স্বপ্ন দেখেছেন, যা পরবর্তীতে সত্য হয়েছে।
আলী (রা.) উল্লেখ করেছেন যে, ঘুমের সময় মানুষের আত্মা শরীর থেকে চলে যায়, কিন্তু আত্মার একটি রশ্মি বা সংযোগ শরীরে থেকে যায়, যার কারণে মানুষ জীবিত থাকে। এই সংযোগের মাধ্যমেই মানুষ স্বপ্ন দেখে।আরও পড়ুনকোন স্বপ্ন দেখলে কী করবেন০৩ মার্চ ২০২৩স্বপ্নের প্রকারভেদ
রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বপ্নের তিনটি প্রকার বর্ণনা করে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে সত্যবাদী, তাদের স্বপ্নও সবচেয়ে সত্য হয়। স্বপ্ন তিন প্রকার: সত্য স্বপ্ন, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ; শয়তানের পক্ষ থেকে দুঃখজনক স্বপ্ন; এবং নিজের মন থেকে উদ্ভূত স্বপ্ন। যদি কেউ এমন স্বপ্ন দেখে যা তার অপছন্দ, তবে সে যেন উঠে নামাজ পড়ে এবং এ বিষয়ে মানুষের সঙ্গে কথা না বলে।’ (সহিহ মুসলিম: ২,২৬৩)
সত্য স্বপ্নকে বলা হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ, তাতে রাসুল (সা.)-কে দেখার স্বপ্নও অন্তর্ভুক্ত। এই স্বপ্ন সবসময় সত্য হয় (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৫৯২, সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,২৬৬)।
উসমান (রা.) রোজার দিনে স্বপ্নে দেখেন যে রাসুল (সা.) তাকে বলছেন, ‘আজ রাতে আমাদের সঙ্গে ইফতার করো।’ সেই দিনই তিনি শহিদ হন। (দালাইল আন-নুবুওয়াহ লিল-বায়হাকি: ৭/৪৮)
যারা কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তারা প্রায়শই আল্লাহর পক্ষ থেকে সান্ত্বনার জন্য স্বপ্ন পান। কখনো কখনো আল্লাহ আসন্ন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে স্বপ্ন পাঠান। রাসুল (সা.) বলেছেন: “যখন সময় ঘনিয়ে আসবে, তখন মুসলিমের স্বপ্ন প্রায় মিথ্যা হবে না। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কথায় সত্যবাদী, তার স্বপ্নও অধিক সত্য হবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭,০১৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,২৬৩)
যদি কেউ এমন স্বপ্ন দেখে যা তার অপছন্দ, তবে সে যেন উঠে নামাজ পড়ে এবং এ বিষয়ে মানুষের সঙ্গে কথা না বলে। সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,২৬৩কোরআনে স্বপ্নের উদাহরণ
কোরআনে সাতটি স্বপ্ন এবং তাদের ব্যাখ্যার উল্লেখ রয়েছে। এর মাধে ৪টি হলো সুরা ইউসুফে। ইউসুফ (আ.) স্বপ্নে দেখেন এগারোটি তারা, সূর্য ও চাঁদ তাকে সিজদা করছে (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৪)।
তার সঙ্গী কয়েদিদের স্বপ্নের ব্যাখ্যার উদাহরণ রয়েছে: ‘ইউসুফের সঙ্গে আরও দুজন কয়েদি কারাগারে গিয়েছিল। তাদের একজন বলল, ‘আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমি আঙ্গুরের রস তৈরি করছি।’ অন্যজন বলল, ‘আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমার মাথায় রুটি রয়েছে, যা থেকে পাখিরা খাচ্ছে।’ তারা বলল, ‘আমাদের এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলো, আমরা তোমাকে সৎকর্মশীলদের একজন মনে করি।’ (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৩৬)
ইউসুফ (আ.) ব্যাখ্যা করেন, ‘হে আমার কারাসঙ্গীরা, তোমাদের একজন তার মনিবকে মদ পরিবেশন করবে, আর অন্যজন ক্রুশবিদ্ধ হবে এবং পাখিরা তার মাথা থেকে খাবে। যে বিষয়ে তোমরা জিজ্ঞাসা করেছ, তা নির্ধারিত হয়ে গেছে।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৪১)
উল্লেখযোগ্য যে, ইউসুফ (আ.) স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেওয়ার আগে কয়েদিদের এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে উৎসাহিত করেন এবং তাঁর জ্ঞানের উৎস হিসেবে আল্লাহকে উল্লেখ করেন। একজন কয়েদি মুক্তি পাবে এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারবে, অন্যজনের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগে তাওবার সময় থাকবে।
এ ছাড়াও সেকালের মিশরের মন্ত্রী স্বপ্নে দেখেন, সাতটি দুর্বল গাভী এবং সাতটি স্থূল গাভী। (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৪৩-৪৪)
সুরা আল-আনফালে রয়েছে (আয়াত ৪৩) শত্রু সৈন্যের সংখ্যা কম দেখা। মক্কা বিজয়ের স্বপ্নে কথা আছে সুরা ফাতহের ২৭ নম্বর আয়াতে। ইবরাহিম (আ.)-এর স্বপ্নে ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করার বর্ণনাও কোরআনে। (সুরা আস-সাফফাত, আয়াত: ১০২-১০৫)
আরও পড়ুনস্বপ্ন দেখলে কী করবেন১৫ জানুয়ারি ২০২৫স্বপ্নের ব্যাখ্যা: শিল্প ও বিজ্ঞান
সব স্বপ্ন সত্য হয় না, এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা একটি শিল্প ও বিজ্ঞান। ইসলামী ব্যাখ্যায় স্বপ্নদ্রষ্টার সংস্কৃতি (উরফ) বিবেচনা করা হয়। শায়খা ড. তামারা গ্রে ব্যাখ্যা করেন, যদি কেউ চাল নিয়ে স্বপ্ন দেখে, তবে পাকিস্তানে তা সমৃদ্ধির ইঙ্গিত দিতে পারে, কারণ চাল তাদের প্রধান খাদ্য। কিন্তু মরক্কোতে, যেখানে দরিদ্ররা চাল খায়, এটি দুর্দশার ইঙ্গিত হতে পারে। এটিই ‘সত্য স্বপ্ন’, যা আল্লাহ মানুষকে দান করেন, শুধু নবীদের নয়।
আজানের পদ্ধতিও একটি স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল (সুনান ইবনে মাজাহ: ৭০৬)। সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে জায়দ (রা.) স্বপ্নে একজন ব্যক্তিকে ঘণ্টা হাতে দেখেন। তিনি ঘণ্টাটি কিনতে চাইলে লোকটি জানতে চান, এটি দিয়ে কী করবেন। আবদুল্লাহ বলেন, নামাজের সময় ঘোষণার জন্য। লোকটি আজানের শব্দগুলো প্রস্তাব করেন।
জাগ্রত হয়ে তিনি রাসুল (সা.)-কে এই স্বপ্ন জানান এবং রাসুল (সা.) তাকে বিলাল ইবনে রাবাহ (রা.)-কে আজান শেখাতে বলেন। বিলাল আজান দিলে হযরত উমর (রা.) বলেন, তিনিও একই স্বপ্ন দেখেছিলেন। আজ, হাজার বছর পরেও আমরা এই স্বপ্নের উপর আমল করছি।
যদি কেউ চাল নিয়ে স্বপ্ন দেখে, তবে পাকিস্তানে তা সমৃদ্ধির ইঙ্গিত দিতে পারে, কারণ চাল তাদের প্রধান খাদ্য। কিন্তু মরক্কোতে, যেখানে দরিদ্ররা চাল খায়, এটি দুর্দশার ইঙ্গিত হতে পারে।শায়খা ড. তামারা গ্রে, নির্বাহী পরিচালক, রাবাতাস্বপ্ন দেখার পর কী করবেন
রাসুল (সা.) স্বপ্নের পর কী করতে হবে তা নির্দেশ দিয়েছেন:
১. স্বপ্ন শুধু তাদের সঙ্গে শেয়ার করুন যারা আপনার কল্যাণ কামনা করে বা অভিজ্ঞ স্বপ্ন ব্যাখ্যাকারী (আল-মুস্তাদরাক আলা আস-সহিহাইন: ৮,১৭৭)। ভালো স্বপ্ন স্বপ্নে থাকা ব্যক্তিদের বা যারা আপনার জন্য দোয়া করবে তাদের সঙ্গে শেয়ার করুন। ‘ইস্তিখারা’র ক্ষেত্রে নিদর্শন পেলে তা গ্রহণ করুন।
২. দুঃস্বপ্ন দেখলে বাম দিকে তিনবার শুকনো থুথু ফেলে বলুন, ‘আউযু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম (আমি আল্লাহর কাছে শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি)।’ (সুনান ইবনে মাজাহ: ৩,৯১০)
৩. স্বপ্নের বিবরণ লিখে রাখুন। এটি আপনাকে আল্লাহর দেওয়া স্বপ্নের সত্যতা উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে।
ইসলামে স্বপ্ন গায়েবের একটি অংশ এবং আল্লাহর নিদর্শন। এটি সুসংবাদ, শয়তানের দুঃস্বপ্ন বা অবচেতন মনের প্রতিফলন হতে পারে। স্বপ্ন কেবল ঘুমের অভিজ্ঞতা নয়, বরং আল্লাহর সঙ্গে আমাদের আত্মার সংযোগের একটি মাধ্যম।
সূত্র: আমালিয়াহ ডটকম
আরও পড়ুনস্বপ্ন তিন প্রকার০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র উল ল খ প রক র র জন য আল ল হ র সময ইউস ফ র একট করব ন ইসল ম আপন র ক রআন
এছাড়াও পড়ুন:
নিউ ইয়র্কে নিহত বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকর্তা সম্পর্কে যা জানা গেলো
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল ম্যানহাটনে একটি বহুতল অফিসে বন্দুক হামলায় নিহত হয়েছেন নিউ ইয়র্ক পুলিশের কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম (৩৬)। জানা গেছে, তিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অভিবাসী ছিলেন। খবর রয়টার্সের।
নিহত কর্মকর্তা দিদরুল ইসলামকে একজন ‘বীর বাংলাদেশি অভিবাসী’ হিসেবে উল্লেখ বর্ণনা করেছেন নিউ ইয়র্কের মেয়র এবং নিউ ইয়র্কের পুলিশ কমিশনার। তারা বলেছেন, ওই কর্মকর্তা নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে অন্যদের জীবন রক্ষা করেছিলেন।
সোমবার ম্যানহাটনের মিডটাউন অফিস টাওয়ারের ভেতরে এক বন্দুকধারী হামলা চালিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম (৩৬) সহ চারজনকে হত্যা করে। হামলাকারী পরবর্তীতে আত্মহত্যা করেছে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
আরো পড়ুন:
পুতিনকে এবার ১২ দিনের আল্টিমেটাম দিলেন ট্রাম্প
নিউ ইয়র্কে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত ৪
নিউ ইয়র্কের মেয়র এরিক অ্যাডামস এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “ভয়াবহ একটি বন্দুক সহিংসতার ঘটনায় আমরা চারটি প্রাণ হারিয়েছি, যার মধ্যে নিউ ইয়র্ক সিটি পুলিশ বিভাগের একজন সদস্য ‘অফিসার ইসলাম’ রয়েছেন।
অ্যাডামস জানান, নিহত অফিসার তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে নিউ ইয়র্ক পুলিশে কর্মরত ছিলেন এবং তিনি বাংলাদেশ থেকে আসা একজন অভিবাসী।
মেয়র বলেন, “হামলার সময় অফিসার ইসলাম অন্যদের জীবন রক্ষা করছিলেন, তিনি নিউ ইয়র্কবাসীদের রক্ষা করছিলেন। তিনি এই শহরকে ভালোবাসতেন এবং আমরা যাদের সাথে কথা বলেছি তারা সবাই বলেছেন যে, তিনি একজন সৎ মানুষ ও ঈশ্বরে বিশ্বাসী ব্যক্তি ছিলেন।”
মেয়র আরো জানিয়েছেন, সোমবার রাতে তিনি অফিসর ইসলামের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছেন।
মেয়র আরো বলেন, “আমি তাদেরকে বলেছি, অফিসার ইসলাম একজন একজন বীর এবং আমরা তার ত্যাগের প্রশংসা করি।”
নিউ ইয়র্কের পুলিশ কমিশনার জেসিকা টিশ সংবাদ সম্মেলনে জানান, অফিসার ইসলাম বিবাহিত ছিলেন এবং তার দুটি সন্তান ছিল। তার স্ত্রী তৃতীয় সন্তানের মা হতে চলেছেন।
পুলিশ কমিশনার বলেন, “অফিসার ইসলাম নিজেকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছিলেন। তিনি চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, তাকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।”
ঢাকা/ফিরোজ