ইসরায়েলকে মোকাবিলায় ইরানের আর কী কী উপায় আছে
Published: 16th, June 2025 GMT
টানা তিন দিন ধরে ইসরায়েলের হামলা মোকাবিলা করে যাচ্ছে ইরান। ইতিমধ্যে সামরিক নেতৃত্বের বেশ কয়েকজন সদস্যসহ ২৪০ জনের বেশি ইরানি নিহত হয়েছেন। তবে ইরান একক প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে যেভাবে পাল্টা আঘাত হেনেছে, তা ইসরায়েল আগে কখনো অনুভব করেনি। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের বৃহত্তম শহরগুলো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছে, যার মধ্যে আছে তেল আবিব ও হাইফার মতো শহরও।
ইসরায়েল-ইরান উভয় পক্ষ কে কার কতটা ক্ষতি করেছে এবং ঠিক কোন স্থানগুলোয় আঘাত হেনেছে, অনেক ক্ষেত্রে তা স্পষ্ট নয়। কারণ, সামরিক হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তথ্যগুলো যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সঠিকভাবে পাওয়া কঠিন। উভয় পক্ষের কাছে কত ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুত আছে এবং ইসরায়েল ও ইরান কত দিন এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে, তা–ও জানা কঠিন।
আমরা যা জানি, তা হলো ইরানের কাছে আছে মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি। যেখানে ধারণা করা হয়, তাদের কাছে বিভিন্ন পাল্লা ও গতির হাজার হাজার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।
বর্তমান হারে সম্ভবত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইসরায়েলে আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা রয়েছে ইরানের। ইসরায়েলের উল্লেখযোগ্য ক্ষতির কারণ হতে এটি যথেষ্ট সময়। দেশটির মানুষ এমন হামলা ও ক্ষতির সঙ্গে অভ্যস্তও নয়; বিশেষ করে গাজা উপত্যকা, লেবানন ও ইয়েমেনের দুর্বল সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আক্রমণ ছাড়া।
ইরান আরও প্রকাশ করছে—যেসব ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করা হয়েছে, সেগুলোর চেয়ে আরও উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র কতটা কার্যকর হতে পারে সেই সক্ষমতা। রোববার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলি প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছে।
ইসরায়েলের ফুটেজে স্পষ্ট দেখা গেছে, ইরান আগের আক্রমণগুলোয় যেসব পুরোনো ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছিল, সেগুলোর তুলনায় রোববার ব্যবহার করা ক্ষেপণাস্ত্রগুলো শক্তি ও গতিতে আরও উন্নত।
অবশ্য ইরানের কাছে উন্নত এসব ক্ষেপণাস্ত্রের বিশাল মজুত রয়েছে তা নয় এবং শেষ পর্যন্ত ব্যবহার করতে করতে এটি ফুরিয়ে যাবে। তবে এরপরও সাধারণ মানের ক্ষেপণাস্ত্র, হাজার হাজার ড্রোনসহ এসব উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলের ক্ষতি করার জন্য ইরানের যথেষ্ট সামরিক ক্ষমতা রয়েছে। যারা বিশ্বাস করে যে স্বল্প মেয়াদে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো শক্তি ইরানের নেই, তাদেরও ভুল প্রমাণ করতে পারবে তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ এড়ানোইরানের নিক্ষেপ করা ক্ষেপণাস্ত্রগুচ্ছ ইসরায়েলের আয়রন ডোমকে গুরুতরভাবে পরীক্ষার মুখে ফেলেছে। যে কারণে ইরানের আক্রমণ প্রতিরোধ–প্রতিহত করার জন্য ইসরায়েলকে তাদের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জোর দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে বর্তমান সংঘাতের পক্ষ নয়; বরং তিনি হুমকি দিয়েছেন, ইরান যদি মধ্যপ্রাচ্য মার্কিন স্বার্থে আঘাত হানে, তবে এর পরিণতি মারাত্মক হবে। মার্কিন স্বার্থের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা সামরিক ঘাঁটিগুলোও আছে।
মার্কিন ঘাঁটি বা কর্মীদের ওপর আক্রমণই সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি ডেকে আনবে ইরানের জন্য, যে কারণে এমন আক্রমণ তারা এড়াতে চায়। তাই এ ব্যাপারে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি সতর্ক পদক্ষেপ নিয়েছেন।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করতে চাইবেন না অথবা ইসরায়েলের আক্রমণের সঙ্গে মার্কিন সামরিক শক্তিগুলোও যুক্ত হোক—এমন অজুহাত তৈরি করতে চাইবেন না। একটি যৌথ ইসরায়েলি-মার্কিন আক্রমণ ইরানের সবচেয়ে সুরক্ষিত পারমাণবিক স্থানগুলো ধ্বংস করে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করবে। সেই সঙ্গে ইসরায়েলের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।
ইরানের সরকার ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছে, ইসরায়েল যদি তার আক্রমণ বন্ধ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনায় ফিরেও আসতে সম্মত হয়, এরপরও তারা প্রতিশোধ নেওয়া চালিয়ে যাবে।এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব ও তুরস্কের মতো দেশগুলোয় অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলো আক্রমণে যুক্ত হয়ে যেতে পারে, যেসব দেশ ইরানের প্রত্যক্ষ শত্রু নয় এবং তেহরান এই দেশগুলোকে সংঘাতে টানতে চাইবে না। এসব দেশ ইরানের জন্য সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু ইরানের অন্যান্য বিকল্প আছে। ইরান ও ওমানের মধ্যে অবস্থিত হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার বারবার হুমকি দিয়েছে তেহরান। প্রতিদিন লাখ লাখ ব্যারেল তেলের পরিবহন হয় এ প্রণালি দিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, এমন ঘটনা ঘটলে তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে ১০০ ডলার পর্যন্ত উঠে যাবে, যা গত শুক্রবার ব্যারেলপ্রতি ৭৮ ডলার পর্যন্ত উঠে আবার কমে গিয়েছে। হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা ইরানিদের হাতে শক্তিশালী একটি তাস। লড়াই চলতে থাকলে স্বল্প মেয়াদে হলেও হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার আশঙ্কা আছে।
আরও পড়ুনইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের পরিণতি কী৫ ঘণ্টা আগেথামার পথ কী হবেতবে শেষ পর্যন্ত ইরান যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পথ খুঁজবে। এর মধ্য দিয়ে পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশ ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্ভাব্য আঞ্চলিক বড় যুদ্ধের আশঙ্কার অবসান ঘটবে। নয়তো ইরানের নিজস্ব অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে এবং অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার মুখেও পড়তে হবে দেশটিকে। ইরানের আরও জানার কথা, ইসরায়েলের পক্ষে যুদ্ধ পরিস্থিতি সামলানোর সক্ষমতার একটা সীমা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের কারণে ইরানের চেয়েও আরও সহজে গোলাবারুদের মজুত পূরণ করার ক্ষমতা আছে তার।
ইরানের সরকার ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছে, ইসরায়েল যদি তার আক্রমণ বন্ধ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনায় ফিরেও আসতে সম্মত হয়, এরপরও তারা প্রতিশোধ নেওয়া চালিয়ে যাবে।
তবে এটি যুক্তরাষ্ট্র এবং তার কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ওপর নির্ভর করবে। ট্রাম্পকে ইসরায়েল এবং প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে থামানোর জন্য চাপ দিতে হবে এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট তা করতে ইচ্ছুক কি না, সেটি স্পষ্ট নয়। এ সংঘাতের বিষয়ে ট্রাম্পের বাগাড়ম্বর প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। একদিকে তিনি লড়াইয়ের অবসান ঘটানোর জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছেন, একই সঙ্গে ইরানকে হুমকিও দিয়েছেন।
ইরান আরও জানে যে ট্রাম্প এমন ব্যক্তি নন, যাঁকে বিশ্বাস করা বা যাঁর ওপর নির্ভর করা যায়। গত সপ্তাহে ইরানে ইসরায়েলের হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্র প্রতারণামূলক আচরণ করেছে। ইসরায়েল হামলা করার পরিকল্পনা করছে, তা গোপনে জানা সত্ত্বেও রোববার ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনা চলবে—এমন ভান করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
তবু যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় একটি চুক্তিই ইরানকে থামাতে সহায়তা করতে পারে। নয়তো ইরান এখন পর্যন্ত যে শক্তি প্রকাশ করেছে, তা বজায় রাখা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠবে।
দোরসা জাব্বারি ইরানি সাংবাদিক। আল–জাজিরা টিভি চ্যানেলে কর্মরত।
আলজাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: রাফসান গালিব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র ন র জন য পর স থ ত ব স কর ইসর য ক ষমত র ওপর ব যবহ
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানে পরমাণু দূষণের শঙ্কা
জাতিসংঘের পারমাণবিক শক্তি পর্যবেক্ষণ সংস্থার (আইএইএ) প্রধান বলেছেন, ইসরায়েলের বিমান হামলার পর নাতাঞ্জে ইরানের প্রধান পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ স্থাপনায় তেজস্ক্রিয় ও রাসায়নিক– উভয় দূষণের শঙ্কা রয়েছে। রাফায়েল গ্রোসি বলেন, প্রধান উদ্বেগ হলো ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লোরাইড নামক গ্যাস, যা সমৃদ্ধকরণের সময় ফ্লোরিন মিশ্রিত হয়ে সৃষ্টি হয়। এটি উদ্বায়ী। দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে ত্বক পুড়িয়ে ফেলতে পারে। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এ গ্যাস শরীরের ভেতরে গেলে তা হতে পারে বড় ক্ষতির কারণ।
গতকাল সোমবার আলজাজিরা এ খবর জানায়। আইএইএর প্রধান ওই স্থাপনা পরিদর্শনের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। এমন এক সময়ে তিনি এ উদ্বেগ প্রকাশ করলেন, যখন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলা জোরালো হচ্ছে। একে অন্যে সামরিক-বেসামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্যে পরিণত করছে।
ইসরায়েলের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে ইরান। রোববার রাতে এক দফা হামলা হয়। সোমবার ভোরে আরেক দফা হামলা ছিল এ পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ। ক্ষেপণাস্ত্রগুলো তেল আবিব, জেরুজালেম ও বন্দরনগরী হাইফার দিকে ছুটে যায়। এতে কমপক্ষে আটজন নিহত ও শতাধিক আহত হন। অনেক আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপরদিকে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর দাবি, তাদের হামলায় ইরানের রেভলিউশনারি গার্ডের গোয়েন্দা শাখার প্রধানসহ চার জেনারেল নিহত হয়েছেন।
গতকাল সন্ধ্যায় তেহরানে একাধিক বড় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। পশ্চিম তেহরানে সামরিক বাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা হয়েছে। সরাসরি সম্প্রচারের সময় হামলার শিকার হয়েছে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবন। হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। টেলিভিশন ভবনের বাইরে থেকে এক সাংবাদিক বলেন, তিনি জানেন না ভেতরে তাঁর কতজন সহকর্মী অবস্থান করছেন। তেহরানে
আইআরআইবি ভবনে হামলাকে ‘নোংরা যুদ্ধাপরাধ’ বলে বর্ণনা করেছে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ইসরায়েলকে ‘সত্যের সবচেয়ে বড় শত্রু’ বলেও সম্বোধন করা হয়।
এর আগে রোববার রাত ও সোমবার ভোরে ইরানের হামলা প্রসঙ্গে ইসরায়েলের জরুরি সেবা দপ্তর জানায়, হাইফায় নিখোঁজদের সন্ধান ও উদ্ধার অভিযান অব্যাহত আছে। সেখানে অন্তত ২৪ জন আহত হয়েছেন। বন্দরের কাছে বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। ভিডিও ফুটেজে তেল আবিবের আকাশে বিপুলসংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র দেখা গেছে। বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে জেরুজালেমেও। গতকাল ইসরায়েলে হামলা প্রসঙ্গে জাতিসংঘে ইরানের রাষ্ট্রদূত বলেন, তাঁর হামলা ছিল সমানুপাতিক ও প্রতিরক্ষামূলক। ইরানের গণমাধ্যমের দাবি, বিমানবাহিনী তাবরিজে ইসরায়েলের আরেকটি এফ-৩৬ ভূপাতিত করেছে।
তেল আবিবের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বেশ কয়েকটি আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে মার্কিন দূতাবাসের কাছাকাছি একটি হোটেল ও বাড়িঘরের কাচ ভেঙে পড়ে। ইসরায়েলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হুকাবি জানান, তাদের দূতাবাস ভবনের একাংশ সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে কেউ হতাহত হননি। দূতাবাস আপাতত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তেল আবিব বলছে, ইরান এ পর্যন্ত ৩৫০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের উদ্দেশে ছুড়েছে। প্রতিবার ৩০টি থেকে ৬০টি করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে।
ইরানের হামলার জেরে তেল আবিবসহ ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। লোকজনকে বারবার আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যেতে দেখা যায়। চারদিকে লোকজনের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। গণমাধ্যমে এক বাসিন্দার বর্ণনায় এ চিত্র ফুটে উঠেছে। স্থানীয় সময় ভোর ৪টায় সাইরেন বাজার আগ পর্যন্ত তেল আবিবের বাসিন্দা গাইদো টেলিবৌন নিজ বাসায়ই ছিলেন। তিনি বলেন, ‘সাইরেন বাজলে আমরা বের হয়ে সড়ক পেরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাই। যাওয়ার এক মিনিটের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রের দরজা (বিস্ফোরণের জেরে) ভেঙে যায়। এটি খুব ভয়ানক পরিস্থিতি ছিল। এভাবে কি দীর্ঘদিন চলতে থাকবে? জানি না। তবে আশা করি, পরিস্থিতি বদলে যাক।’
তেল আবিবের কাছে একটি জনপ্রিয় বাজার শুক হা কারমেলের কাছে ভোরে ইরানের একটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। ইরানের রেভলিউশনারি গার্ড দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের বহু ধাপের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে হামলা চালাতে নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করছে। তবে কেমন সেই নতুন পদ্ধতি– তার ব্যাখ্যা তারা দেয়নি। এ নিয়ে কোনো মন্তব্যও করেনি ইসরায়েল। এ অবস্থায় ‘তেহরানের বাসিন্দাদের মূল্য দিতে হবে’ বলে সতর্ক করেছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ।
ইরানের গোয়েন্দাপ্রধানকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী গতকাল সোমবার দাবি করে, তাদের হামলায় ইরানের চার জ্যেষ্ঠ গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ইরানের রেভলিউশনারি গার্ডের গোয়েন্দা শাখার প্রধান মোহাম্মাদ কাজেমি আছেন। পাশাপাশি ইরানের আকাশ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দাবি করে ইসরায়েল বলেছে, তারা ভূমি থেকে ভূমিতে ছোড়ার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপক ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, গত রোববার রাত ও গতকাল সোমবার ভোরে ইসরায়েলের উদ্দেশে দুই দফায় শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিব ও হাইফায় আঘাত হানে। চার দিনের লড়াইয়ে ইসরায়েলের ২৪ জন ও ইরানের ২২৮ জন নিহত হয়েছেন। হতাহতের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, রোববার রাতে ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় কারমানশাহ প্রদেশের ফারাবি হাসপাতালে হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
ইসরায়েল বলছে, তারা তেহরানে কুদস ফোর্সের সদরদপ্তরে হামলা চালিয়েছে। হামলা হয়েছে ইরানের ফোর্দু পরমাণু কেন্দ্রেও। বিবিসি জানায়, হামলা হয়েছে কেরমানশাহ শহরের ফরাবি হাসপাতালেও। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘাই বলেন, এটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
ঐক্যের ডাক পেজেশকিয়ানের
জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। সোমবার তিনি জনগণের উদ্দেশে বলেন, ‘যে কোনো বিভেদ এখন একপাশে রেখে গণহত্যামূলক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐকবদ্ধ থাকতে হবে।’
পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হচ্ছে ইরান
ইরান জানিয়েছে, তারা তাদের পার্লামেন্টে এমন একটি বিল তুলতে যাচ্ছে, যা তাদের নিউক্লিয়ার নন-প্রোলিফারেশন ট্রিটি (এনপিটি) থেকে বের হয়ে আসার অনুমোদন দেবে। এটি এমন একটি চুক্তি, যা কোনো দেশকে পরমাণু অস্ত্র বানানো থেকে বিরত রাখে। তবে ইরান বলেছে, তারা কোনো পরমাণু অস্ত্র বানাবে না। বিলটি পাস হতে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যেতে পারে। ধারণা করা হয়, ইসরায়েলের কাছে পরমাণু
অস্ত্র আছে, যদিও তারা এটা কখনও নিশ্চিত বা অস্বীকার করেনি। এনপিটি চুক্তিতে কখনও সই করেনি ইসরায়েল।
১৯৭৯ সালে ইসলামিক অভ্যুত্থানের পর গত সপ্তাহে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা সংকটে পড়ে ইরান। গোয়েন্দা সহযোগিতায় ইরানে ব্যাপক হামলা চালিয়ে শীর্ষ জেনারেলদের হত্যা করে ইসরায়েল। পাশাপাশি তারা দেশটির পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এ পরিস্থিতিতে উত্তেজনা কমার কোনো আভাস যখন মিলছে না, তখন কানাডায় গত রোববার থেকে শুরু হয়েছে জি৭ দেশগুলোর সম্মেলন। এদিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর বিষয়ে আশা প্রকাশ করেন। নির্বাচনী প্রচারণায় যুদ্ধ বন্ধের বার্তা দিয়ে প্রেসিডেন্ট হলেও ট্রাম্পের মেয়াদে নতুন এ সংঘাতের সূত্রপাত হলো। সম্মেলনে যোগ দিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছেন, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা নিরসন প্রয়োজন।
সপরিবারে বাঙ্কারে আলি খামেনি
ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার মুখে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি সপরিবারে উত্তর তেহরানের লাভিজানে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছেন। দুটি সূত্রের বরাত দিয়ে গতকাল সোমবার ইরান ইন্টারন্যাশনাল জানায়, তাঁর সঙ্গে ছেলে মোজতবাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। সূত্র আরও জানিয়েছে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চালানো দুটি অভিযান– ‘ট্রু প্রমিজ-১’ ও ‘ট্রু প্রমিজ-২’ চলাকালেও খামেনির পরিবার সেখানে ছিল।
মধ্যপ্রাচ্যের দিকে মার্কিন রণতরী
চলমান উত্তেজনার মধ্যে মার্কিন রণতরী ইউএসএস নিমিৎজ দক্ষিণ চীন সাগর ছেড়ে পশ্চিম দিকে রওনা করেছে। জাহাজের অবস্থান শনাক্তের ওয়েবসাইট ম্যারিন ট্র্যাফিকের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানায়, গতকাল সোমবার রণতরীটিকে পশ্চিমমুখী হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে এগোতে দেখা গেছে। ইরান ও ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জড়াবে কিনা– এমন উদ্বেগের মধ্যে এ পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
হামলার মধ্যে যুদ্ধবিরতির আলোচনা প্রত্যাখ্যান ইরানের
ইসরায়েলের হামলার মধ্যে কোনো যুদ্ধবিরতির আলোচনায় অংশ নেবে না ইরান। দেশটির এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্স জানায়, কাতার ও ওমানের মধ্যস্থতাকারীদের ইতোমধ্যে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছে তেহরান। দুই পক্ষ অনড় অবস্থানে থাকায় মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর যুদ্ধের আশঙ্কা বেড়েছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ইরান কাতার ও ওমানের মধ্যস্থতাকারীদের স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, ইসরায়েলের পূর্ববর্তী হামলার জবাব সম্পূর্ণ না দেওয়া পর্যন্ত তারা কোনো ধরনের আলোচনায় যাবে না।
মোসাদ এজেন্টের মৃত্যুদণ্ড, দু’জন গ্রেপ্তার
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এক এজেন্টের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে ইরান। দেশটির সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সোমবার সকালে এ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। প্রেস টিভি অনলাইন জানায়, এসমাইল ফেকরি নামের ওই এজেন্ট ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে আইআরজিসির এক কর্নেল হত্যায় গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহের অভিযোগ ছিল। গতকাল আরও দু’জন মোসাদ এজেন্ট গ্রেপ্তারের খবর দিয়েছে ইরান। তাদের কাছে বিস্ফোরক পাওয়া গেছে বলে জানানো হয়।
ইসরায়েল বিজয় অর্জনের পথে, দাবি নেতানিয়াহুর
ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষে ইসরায়েল ‘বিজয় অর্জন করতে যাচ্ছে’ বলে দাবি করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। গতকাল সোমবার ইসরায়েলের বিমানঘাঁটি পরিদর্শনকালে তিনি বলেন, ‘আমরা বিজয় অর্জনের পথে।’ এর আগে তেহরানের আকাশের ‘পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন’ করার দাবি করেন ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী কর্মকর্তারা। সেসঙ্গে তারা ইরানের মিসাইল লঞ্চার বা ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ যন্ত্রের ‘এক-তৃতীয়াংশ ধ্বংসের’ও দাবি করেন। নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমরা দুটি লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছি– পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র হুমকি নির্মূল করা।’
পরে নেতানিয়াহু দাবি করেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনিকে হত্যা করলে সংঘাতে সমাপ্তি ঘটবে। এবিসি নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি খামেনিকে লক্ষ্যে পরিণত করার কথাও উড়িয়ে দেননি।
ইরানের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করল পাকিস্তান
ইরান-ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলা অব্যাহত থাকায় আপাতত ইরানের সঙ্গে নিজেদের সীমান্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাকিস্তান। গতকাল সোমবার ইরানের সীমান্তঘেঁষা পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কাদির বখশ পিরকানি বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানান, ইরানের সঙ্গে তাদের প্রদেশের পাঁচটি সীমান্ত ক্রসিংয়ের সবগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সীমান্ত বন্ধ থাকবে।
‘আয়রন ডোমে’ ভরসা পাচ্ছেন না ইসরায়েলিরা
বিবিসি জানায়, ইসরায়েলি নাগরিকদের বড় অংশই নিজেদের অত্যাধুনিক ‘আয়রন ডোম’ বা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এতদিন ‘দুর্ভেদ্য’ বলে মনে করতে। কিন্তু গত তিন দিনের ইরানি হামলায়, তাদের সেই অনুভূতিতে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে, হামলায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আগের মতো আস্থা রাখতে পারছেন না। যদিও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের বহুস্তরযুক্ত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী। তবে ব্যবস্থাটি যে পুরোপুরি ‘নিখুঁত নয়’, সেটি স্বীকার করছেন কর্মকর্তারা।
ইরানের পাশে কেউ নেই, বললেন চ্যাথাম হাউস বিশ্লেষক
ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান সংঘাতে ইরান এককভাবেই লড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন লন্ডনভিত্তিক চ্যাথাম হাউস থিঙ্কট্যাঙ্কের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক লিনা খাতিব। তিনি বলেন, ‘ইরান এখন একাই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের পাশে কোনো আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক মিত্র নেই।’ আলজাজিরা জানায়, খাতিবের মতে, রাশিয়া ইরানকে সামরিকভাবে সাহায্য করবে না। গত বছর ইসরায়েল রাশিয়া-সরবরাহকৃত আকাশ প্রতিরক্ষা ধ্বংস করলেও মস্কো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে সরানো হলেও রাশিয়া সক্রিয় ছিল না।