ইরানের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক অস্ত্র কর্মসূচিতে ইসরায়েলের হামলায় দীর্ঘ মেয়াদে কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনা কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ হামলায় আগামী দিনগুলোতে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যদি ট্রাম্প প্রশাসনকে যুক্ত করতে পারেন, তবু এমন সম্ভাবনা ক্ষীণই থেকে যাবে।

গতকাল শনিবার দ্য গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে এসব তথ্য উঠে এসেছে। কূটনীতিক, সামরিক বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল ও এর প্রধানমন্ত্রী প্রচারণায় ক্রমবর্ধমান প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে পারেন। আর এসবের মধ্যেই পুরো অঞ্চল বিপজ্জনকভাবে অস্থিতিশীল হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিভেদকারী বিশাল বোমা ব্যবহারের ফলেও পাহাড়ের গভীরে তৈরি ইরানের ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করা সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ বাড়ছে। প্রশ্ন উঠছে, ইসরায়েলের দূরপাল্লার আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা নিয়েও। 

বিশেষজ্ঞরা ইরানের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলের আভিযানিক সাফল্য এবং তেহরানে শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন ও তার পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংসের কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে পার্থক্য করছেন।

 লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক টবি ডজ বলেন, ‘ইসরায়েলে জন্মলগ্ন থেকে একটি শক্তিশালী প্রবণতা আছে, যা তাদের রাজনীতিবিদদের কাছে এ বার্তা দিয়েছে যে, সহিংসতা (মূলত আগ্রাসন) রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান দেবে। আমার মনে হয়, ইরানের শাসন ব্যবস্থা যতটা বলা হয়েছে, তার চেয়েও স্থিতিশীল। আর যেহেতু প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণ ও পরমাণু বিস্তারের প্রতি ইরানের দীর্ঘ প্রতিশ্রুতির ইতিহাস আছে, তাই বোমা দিয়ে এটি দূর করা সম্ভব নয়।’

বিশ্লেষকরা ইসরায়েলের কৌশল নিয়েও বিভ্রান্ত। এ ছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন অত্যন্ত অসম্ভাব্য মার্কিন প্রেসিডেন্টকে যোগদানের জন্য চাপ দেওয়ার আশায় সংঘাত শুরুর কৌশলও এক ধরনের জুয়া বলে মনে করছেন তারা। ইসরায়েলের প্রত্যাশা, যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানে হামলায় জড়াতে পারলে তাদের বাঙ্কার ধ্বংসকারী বোমার অভাব পূরণ হবে।
বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন, ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনার উপরিভাগ কঠিন পাথর দ্বারা আচ্ছাদিত। এ কারণে স্থাপনা ধ্বংস করতে হয়তো বেশ কয়েকটি বোমা ব্যবহার করার প্রয়োজন হতে পারে। এটি একটি জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান হতে হবে, যার সাফল্যের নিশ্চয়তাও নেই। ফলে ইরান ওই অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটির বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলা শুরু করতে পারে। সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত তীব্রতর হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে।

ইসরায়েলে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল সি কার্টজার ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের একজন অভিজ্ঞ সদস্য স্টিভেন এন সাইমন এ সপ্তাহে ফরেন অ্যাফেয়ার্সে লেখেন, ফর্দোতে হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের নজরে পড়বে। ইরান প্রায় নিশ্চিতভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করে প্রতিশোধ নেবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রও প্রতিশোধ নিতে বাধ্য হবে। তিনি বলেন, পরে যা অবশিষ্ট থাকবে তা হলো, ইরানের শাসন ব্যবস্থার নেতৃত্বদানকারীরা। এতে যুক্তরাষ্ট্র আবার শাসন পরিবর্তনের ব্যবসায়ে নেমে পড়বে। এটি এমন এক ব্যবসা, যেখানে খুব কম মার্কিনিই জড়িত থাকতে চান।
ইসরায়েলের কর্মকর্তারা মনে করেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে হত্যার মাধ্যমে তারা শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারবেন। এ নিয়ে ইতোমধ্যেই ওই অঞ্চলে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। ইরাকের ধর্মগুরু গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ আলি আল-সিস্তানি এক বিরল বার্তায় মধ্যপ্রাচ্যের গভীর বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন।

 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

রক্তাক্ত ৪ আগস্ট: ফেনীতে গুলিতে ঝরে যায় ৭ তরুণের প্রাণ

৪ আগস্ট ২০২৪, শ্রাবণের শেষ বিকেল। ফেনীর মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে শান্তিপূর্ণ অবস্থান করছিলেন হাজারো ছাত্র-জনতা। তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনের কর্মসূচিতে তারা জড়ো হয়েছিলেন। হাতে ছিল লাল-সবুজের পতাকা, চোখে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন।

ফ্লাইওভার এলাকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। হঠাৎ বিকট শব্দে গর্জে ওঠে মহিপাল এলাকা। গুলিতে লুটিয়ে পড়েন ইসতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ, সরওয়ার জাহান মাসুদ, মো. সবুজ, ছাইদুল ইসলাম শাহী, জাকির হোসেন শাকিব ও ওয়াকিল আহম্মদ শিহাব। সেখানে তাদের মৃত্যু হয়। গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে ছিলেন শিক্ষার্থী মাহবুবুল হাসান মাসুম। ৭ আগস্ট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা যান।

মহিপাল এলাকায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সব স্তব্ধ হয়ে যায়। বাতাসে বারুদের গন্ধ, রাস্তায় রক্ত আর পড়ে থাকা জুতা-স্যান্ডেল হয়ে ওঠে নৃশংসতার নীরব সাক্ষ্য।

আরো পড়ুন:

‘এখন আমার মোবাইলে ওর ফোন আসে না’

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু

শহীদ ইসতিয়াক আহমেদ শ্রাবণের মা ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘‘ও মাথায় আমার ওড়না পেঁচিয়ে আন্দোলনে গিয়েছিল। এক বছর পরও আমরা তার মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। মেয়েটা (শ্রাবণের বোন) ভাইয়ের শোকে কারো সঙ্গে কথাও বলে না।’’ 

শহীদ ছাইদুল ইসলাম শাহীর মা রাহেনা বেগম বলেন, ‘‘শাহী বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ২৫ টাকা চেয়েছিল। বলেছিল শহর থেকে ফেরার ভাড়া লাগবে। কিন্তু আর ফেরেনি।’’

শহীদ ওয়াকিল আহম্মদ শিহাবের মা মাহফুজা আক্তার বলেন, ‘‘চুল কাটবে বলে ঘর থেকে বের হয়েছিল। হয়ত বুঝেছিল, এবারই শেষ দেখা। বুকের মধ্যে তিনটা গুলি লেগে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল আমার সন্তান।’’

মাহবুবুল হাসান মাসুমের ভাই মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘‘মামলায় কোনো অগ্রগতি নেই। যারা জামিনে বের হয়ে আসে, তাদের অনেকে প্রভাবশালীদের সহায়তায় বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে।’’ 
আহতদের একজন নূর হোসেন, তখন ফেনী ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আমি হাসপাতালে গিয়েও চিকিৎসা পাইনি। উল্টো হামলার মুখে পড়তে হয়।’’ 

ঘটনার দিন ফেনী শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নিষেধ করা হয়। ফেনী জেনারেল হাসপাতালে প্রথমে নেয়া হয় শ্রাবণের মরদেহ। একে একে আসতে থাকে অন্যদের মরদেহও। হাসপাতালে কান্নার রোল পড়ে যায়। মহিপালের হামলা ও হত্যার ঘটনায় মোট ২২টি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে ৭টি হত্যা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টার মামলা। এ সব মামলায় ২ হাজার ১৯৯ জনের নাম রয়েছে। আরো ৪ হাজার অজ্ঞাতনামা আসামির কথা উল্লেখ আছে। একমাত্র মাসুম হত্যা মামলায় ২২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ফেনীর দুই সাবেক সংসদ সদস্য। 

পুলিশ বলছে, ১৬৪ ধারায় ১১ জন আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অনেকে এখনো পলাতক। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে। 

৪ আগস্টে ফেনীর মহিপালে গুলি করার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। একাধিক ভিডিওতে দেখা গেছে, একজন যুবক মহিপাল প্লাজার সামনে রিকশা থেকে নেমে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। তার আশপাশে অনেকের হাতে তখন দেশীয় অস্ত্র ছিল। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা পিছু হটলেও গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়নি। নিহতদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল গুলিবিদ্ধ।

সেদিন সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে অনেক সাংবাদিকও মারধর ও লাঞ্ছিত হয়েছেন। অনেককে মোটরসাইকেল থামিয়ে মারধর করা হয়। ছিনিয়ে নেয়া হয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল। এ দিন অন্তত ১০ জন সাংবাদিককে ব্যাংক ভবনের দ্বিতীয় তলায় অবরুদ্ধ করে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ফেনী জেলা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মুহাইমিন তাজিম বলেন, ‘‘শহীদদের রক্তের ওপর এ সরকার গঠিত। অথচ এখনো বিচার হয়নি। আমরা দাবি করছি, বিচার দ্রুত সম্পন্ন হোক।’’ 

ফেনীর পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান জানান, জুলাই-আগস্টের ঘটনায় ২২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ আগস্টে ফেনীর মহিপালে নিহত মাহবুবুল হাসান মাসুম হত্যার ঘটনায় ২২১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও এমপি নিজাম হাজারীকে নির্দেশদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তারাই চার্জশিটে আছেন। এখানে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনায় আনা হয়নি। অনেক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা বিদেশে আছে, তাদের ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘‘ফেনীতে হতাহতের সংখ্যা অন্য জেলার তুলনায় বেশি ছিল। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তা দিতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। এখন পর্যন্ত সাড়ে ৫ কোটি টাকার সহায়তা দেয়া হয়েছে।’’ 

ঢাকা/সাহাব/বকুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ট্রুডো ও সোফি: জীবন থেমে থাকে না, হৃদয় আবার ডাকে
  • নাটকীয়তা আর রহস্যে মোড়ানো ফ্রেন সিলাকের জীবন
  • ভুল রেলস্টেশনে নামা তরুণীকে ধর্ষণের মামলায় একজন গ্রেপ্তার
  • পাবনায় মসজিদের নির্মাণকাজ নিয়ে সংঘর্ষে আহত আরও একজনের মৃত্যু
  • গয়নার দোকান থেকে গুজবের বাজার—তামান্না অবশেষে মুখ খুললেন রাজ্জাক প্রসঙ্গে
  • আবুল হাসানকে নিয়ে নতুন গল্পগাছা ও পূর্বাপর
  • সরকারের কাছ থেকে ভোট আদায় করেই ছাড়ব: মির্জা আব্বাস
  • অচলায়তন ভেঙে সক্রিয় হওয়ার অপেক্ষায় কোয়াব
  • রক্তাক্ত ৪ আগস্ট: ফেনীতে গুলিতে ঝরে যায় ৭ তরুণের প্রাণ
  • ইরান চাইছে আধুনিক যুদ্ধবিমান, চীনের সামনে বাধা অনেক…