মধ্যপ্রাচ্যে বুশের ভুলের পুনরাবৃত্তি করছেন ট্রাম্প
Published: 22nd, June 2025 GMT
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁর রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বীদের এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করে জয়ী হন। এর পেছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল এই– তিনি নাইন-ইলেভেন পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধগুলোকে ‘দুর্যোগ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। এর পর ২০২০ সালে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনিও মধ্যপ্রাচ্যের অবিরাম যুদ্ধের বিরোধিতাকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। গত নির্বাচনী প্রচারণায় ডোনাল্ড ট্রাম্প এসব বিষয়েই জোর দেন এবং তাঁর দল রিপাবলিকান পার্টি ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রতিরোধ’ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। অথচ এখন সেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের বেপরোয়া যুদ্ধে যোগ দিলেন। এর মাধ্যমে ট্রাম্প তাঁরই কূটনৈতিক কৌশলকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছেন, যদিও তা সফলতার মুখ দেখছিল। এই যুদ্ধ লাখ লাখ মার্কিন শ্রমজীবীর সঙ্গে বেইমানির শামিল, যারা বিদেশিদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য নয় বরং তাদের দেশকে পুনর্জীবন দেওয়ার জন্য তাঁকে ভোট দিয়েছিল।
আমরা দু’জন লেখক ক্যারিয়ারের দিক থেকে দুই মেরুর। একজন ডেমোক্রেটিক বিদেশনীতি নিয়ে কাজ করছেন এবং প্রগতিশীল এক আইনপ্রণেতার উপদেষ্টা। আরেকজন কনজারভেটিভ লেখক ও সম্পাদক। যুদ্ধের বিরুদ্ধে কেবল আমরাই নই; সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও রিপ্রেজেন্টেটিভ আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিয়া কর্টেজের মতো নেতাও সেন জোশ, মারজোরি টেলর গ্রিন, টাকার কার্লসন, স্টিফেন কে বেনন ও চার্লি কির্কের মতো মাগা (মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেন) ঘরানার রক্ষণশীলদের সঙ্গে যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। রিপাবলিকান যুদ্ধপন্থিদের চাপের মধ্যেও এদের কণ্ঠ উচ্চকিত।
সম্প্রতি আমেরিকায় ইউগভ জরিপে দেখা গেছে, মার্কিন নাগরিকদের মাত্র ১৬ শতাংশ ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিকভাবে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে সমর্থন জানিয়েছে। অন্যদিকে ৬০ শতাংশ এর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। ডেমোক্র্যাট (৬৫ শতাংশ), স্বতন্ত্র (৬১ শতাংশ) ও রিপাবলিকানদের (৫৩) অধিকাংশই যুদ্ধ চায় না। তারা ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার বিরোধিতা করেছে। মে মাসে করা ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের এক জরিপ দেখিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে যুদ্ধের পরিবর্তে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন দিয়েছে।
ট্রাম্পের মতে, ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে একটি হামলাই নাকি যথেষ্ট। এমন দাবি ২২ বছর আগে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশও করেছিলেন। ইরাক যুদ্ধকে তিনি বলেছিলেন ‘কেকওয়াক’ তথা খুব সহজে জয়লাভ করা যাবে। বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান যুদ্ধ এতটা সহজ হবে না। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা মেশিন সংঘাতের প্রথম কয়েক দিন কিছু সফলতা অর্জন করেছিল বটে, ইরাকে মার্কিন হামলার প্রথমদিকেও এমনটা দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু প্রথম দফার এই ধোঁয়াশা কাটার পর যা হবে, সমস্যা সেখানেই। সামরিক কৌশলবিদরা অনেক দিন ধরেই সতর্ক করে আসছিলেন, কেবল বিমান হামলায় লক্ষ্য অর্জন কল্পনামাত্র। যুক্তরাষ্ট্র ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান– তিনটি পরমাণু কেন্দ্রে বোমা মেরেছে। ইরান যেহেতু পাহাড়ের গভীরে এসব কেন্দ্র স্থাপন করেছে, সে জন্য বোমা হামলা নিচের দিকে কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, বলা মুশকিল।
এমনকি ট্রাম্প প্রশাসন হয়তো এই ভেবে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারে– একটি হামলাই যথেষ্ট। অথচ সেখানেই শেষ নয়। ইরানও তার প্রতিশোধ নিতে পারে। ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে, যেখান দিয়ে বিশ্বের তেলের ২০ শতাংশ পরিবহন করা হয় এবং তারা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাজুক ঘাঁটিগুলো টার্গেট করতে পারে। এমন হামলা হলে যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা আক্রমণ করতে পারে এবং এভাবে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বড় যুদ্ধ শুরু হতে পারে।
যুদ্ধকে পরবর্তী ধাপে নেওয়ার মতো সিদ্ধান্তে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। বিকল্প হলো, যেহেতু ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালিয়েছেন, এখন তাঁর উচিত হবে ইসরায়েলকে যুদ্ধ বন্ধ করতে আহ্বান জানানো। যুদ্ধের পরিবর্তে তাঁকে কূটনৈতিক পথ গ্রহণ করতে বলা। এই মুহূর্তে জরুরি হলো একটি চুক্তি করা, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ এবং নজরদারিতে আনা।
২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধেও এমন বিকল্প ছিল, কিন্তু তা ভেস্তে যায়। বুশ প্রশাসন কূটনৈতিক চেষ্টার পরিবর্তে যুদ্ধের পথ বেছে নেয়, যা শক্তিমত্তা নয় বরং ছিল দুর্বলতার প্রকাশক। ট্রাম্প নিশ্চয় সেই ভুল করবেন না। ২০০৩ সাল থেকে এবারের পার্থক্য হলো, তখন ভিন্ন কণ্ঠস্বর ছিল কম। এখন ডান-বাম উভয় পক্ষই যুদ্ধবিরোধী। বলা বাহুল্য, আমরা যদি এক হয়ে এর বিরুদ্ধে না দাঁড়াই, তবে যুদ্ধ মেশিন আমাদের সহজেই পরাজিত করবে।
ম্যাথু ডাস ও সোহরাব আহমারি: যথাক্রমে সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সের সাবেক বিদেশনীতি-বিষয়ক পরামর্শক ও আনহার্ডের যুক্তরাষ্ট্রবিষয়ক সম্পাদক; ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র র প বল ক ন ক টন ত ক ইসর য় ল
এছাড়াও পড়ুন:
মধ্যপ্রাচ্যে বুশের ভুলের পুনরাবৃত্তি করছেন ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁর রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বীদের এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করে জয়ী হন। এর পেছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল এই– তিনি নাইন-ইলেভেন পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধগুলোকে ‘দুর্যোগ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। এর পর ২০২০ সালে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনিও মধ্যপ্রাচ্যের অবিরাম যুদ্ধের বিরোধিতাকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। গত নির্বাচনী প্রচারণায় ডোনাল্ড ট্রাম্প এসব বিষয়েই জোর দেন এবং তাঁর দল রিপাবলিকান পার্টি ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রতিরোধ’ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। অথচ এখন সেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের বেপরোয়া যুদ্ধে যোগ দিলেন। এর মাধ্যমে ট্রাম্প তাঁরই কূটনৈতিক কৌশলকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছেন, যদিও তা সফলতার মুখ দেখছিল। এই যুদ্ধ লাখ লাখ মার্কিন শ্রমজীবীর সঙ্গে বেইমানির শামিল, যারা বিদেশিদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য নয় বরং তাদের দেশকে পুনর্জীবন দেওয়ার জন্য তাঁকে ভোট দিয়েছিল।
আমরা দু’জন লেখক ক্যারিয়ারের দিক থেকে দুই মেরুর। একজন ডেমোক্রেটিক বিদেশনীতি নিয়ে কাজ করছেন এবং প্রগতিশীল এক আইনপ্রণেতার উপদেষ্টা। আরেকজন কনজারভেটিভ লেখক ও সম্পাদক। যুদ্ধের বিরুদ্ধে কেবল আমরাই নই; সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও রিপ্রেজেন্টেটিভ আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিয়া কর্টেজের মতো নেতাও সেন জোশ, মারজোরি টেলর গ্রিন, টাকার কার্লসন, স্টিফেন কে বেনন ও চার্লি কির্কের মতো মাগা (মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেন) ঘরানার রক্ষণশীলদের সঙ্গে যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। রিপাবলিকান যুদ্ধপন্থিদের চাপের মধ্যেও এদের কণ্ঠ উচ্চকিত।
সম্প্রতি আমেরিকায় ইউগভ জরিপে দেখা গেছে, মার্কিন নাগরিকদের মাত্র ১৬ শতাংশ ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিকভাবে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে সমর্থন জানিয়েছে। অন্যদিকে ৬০ শতাংশ এর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। ডেমোক্র্যাট (৬৫ শতাংশ), স্বতন্ত্র (৬১ শতাংশ) ও রিপাবলিকানদের (৫৩) অধিকাংশই যুদ্ধ চায় না। তারা ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার বিরোধিতা করেছে। মে মাসে করা ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের এক জরিপ দেখিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে যুদ্ধের পরিবর্তে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন দিয়েছে।
ট্রাম্পের মতে, ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে একটি হামলাই নাকি যথেষ্ট। এমন দাবি ২২ বছর আগে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশও করেছিলেন। ইরাক যুদ্ধকে তিনি বলেছিলেন ‘কেকওয়াক’ তথা খুব সহজে জয়লাভ করা যাবে। বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান যুদ্ধ এতটা সহজ হবে না। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা মেশিন সংঘাতের প্রথম কয়েক দিন কিছু সফলতা অর্জন করেছিল বটে, ইরাকে মার্কিন হামলার প্রথমদিকেও এমনটা দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু প্রথম দফার এই ধোঁয়াশা কাটার পর যা হবে, সমস্যা সেখানেই। সামরিক কৌশলবিদরা অনেক দিন ধরেই সতর্ক করে আসছিলেন, কেবল বিমান হামলায় লক্ষ্য অর্জন কল্পনামাত্র। যুক্তরাষ্ট্র ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান– তিনটি পরমাণু কেন্দ্রে বোমা মেরেছে। ইরান যেহেতু পাহাড়ের গভীরে এসব কেন্দ্র স্থাপন করেছে, সে জন্য বোমা হামলা নিচের দিকে কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, বলা মুশকিল।
এমনকি ট্রাম্প প্রশাসন হয়তো এই ভেবে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারে– একটি হামলাই যথেষ্ট। অথচ সেখানেই শেষ নয়। ইরানও তার প্রতিশোধ নিতে পারে। ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে, যেখান দিয়ে বিশ্বের তেলের ২০ শতাংশ পরিবহন করা হয় এবং তারা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাজুক ঘাঁটিগুলো টার্গেট করতে পারে। এমন হামলা হলে যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা আক্রমণ করতে পারে এবং এভাবে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বড় যুদ্ধ শুরু হতে পারে।
যুদ্ধকে পরবর্তী ধাপে নেওয়ার মতো সিদ্ধান্তে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। বিকল্প হলো, যেহেতু ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালিয়েছেন, এখন তাঁর উচিত হবে ইসরায়েলকে যুদ্ধ বন্ধ করতে আহ্বান জানানো। যুদ্ধের পরিবর্তে তাঁকে কূটনৈতিক পথ গ্রহণ করতে বলা। এই মুহূর্তে জরুরি হলো একটি চুক্তি করা, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ এবং নজরদারিতে আনা।
২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধেও এমন বিকল্প ছিল, কিন্তু তা ভেস্তে যায়। বুশ প্রশাসন কূটনৈতিক চেষ্টার পরিবর্তে যুদ্ধের পথ বেছে নেয়, যা শক্তিমত্তা নয় বরং ছিল দুর্বলতার প্রকাশক। ট্রাম্প নিশ্চয় সেই ভুল করবেন না। ২০০৩ সাল থেকে এবারের পার্থক্য হলো, তখন ভিন্ন কণ্ঠস্বর ছিল কম। এখন ডান-বাম উভয় পক্ষই যুদ্ধবিরোধী। বলা বাহুল্য, আমরা যদি এক হয়ে এর বিরুদ্ধে না দাঁড়াই, তবে যুদ্ধ মেশিন আমাদের সহজেই পরাজিত করবে।
ম্যাথু ডাস ও সোহরাব আহমারি: যথাক্রমে সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সের সাবেক বিদেশনীতি-বিষয়ক পরামর্শক ও আনহার্ডের যুক্তরাষ্ট্রবিষয়ক সম্পাদক; ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক