নাগরিকদের প্রতি আইন স্বীয় হস্তে না তুলিয়া লইতে সরকারের পুনঃপুন আহ্বান সত্ত্বেও দেশে মবতন্ত্রের প্রতাপ যে হ্রাস পায় নাই, তাহারই প্রদর্শনী হইয়া গেল রাজধানীর উত্তরায়। এইবার বর্বরতার শিকার হইলেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। সোমবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, উত্তরার যেই গৃহে পরিবার লইয়া বসবাস করেন নূরুল হুদা, রবিবার সন্ধ্যায় এক দল লোক ঐখানে সমবেত হইয়া হইচই শুরু করে। এক পর্যায়ে তাহারা নূরুল হুদার গৃহে প্রবেশপূর্বক তাঁহাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা করে। সামাজিক মাধ্যমে বিস্তৃত ভিডিওতেও বিষয়টি স্পষ্ট হইয়াছে। এমনকি নূরুল হুদার প্রতি ডিম্ব নিক্ষেপ এবং তাহার কণ্ঠে ‘জুতার মালা’ পরাইবার চরম অবমাননাকর ঘটনাও ঘটে। অধিকতর ক্ষোভের বিষয় হইল, নূরুল হুদার উপর উক্ত মব সন্ত্রাস চলিয়াছে পুলিশের উপস্থিতিতে; যদিও এক পর্যায়ে পুলিশ ভুক্তভোগীকে তাহাদের হেফাজতে লইয়া যায়।
ইহা সত্য, নূরুল হুদার অধীনে ২০১৮ সালের চরম বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইয়াছিল, যথায় নির্ধারিত দিবসের ভোট পূর্বরাত্রিকালে সম্পন্ন হইবার গুরুতর অভিযোগ রহিয়াছে। উক্ত নজিরবিহীন ঘটনার দায় নূরুল হুদা উপেক্ষা করিতে পারেন না। আমরা জানি, ইতোমধ্যে শেরেবাংলা নগর থানায় উক্ত নির্বাচন জালিয়াতির ঘটনায় নূরুল হুদাসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হইয়াছে। উপরন্তু রবিবারই শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাংবাদিকদের উক্ত মামলায় তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ব্যক্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু মধ্যখানে ‘মব’-এর অভ্যুদয় কী প্রকারে? প্রতিবেদনে স্পষ্ট, সত্তরোর্ধ্ব নূূরুল হুদার উপর মব সহিংসতা পরিচালনাকারীরা উক্ত মামলাকারীরই দলভুক্ত। তদনুযায়ী আইন স্বীয় হস্তে তুলিয়া লইবার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদিগের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দায় উক্ত দলটির স্কন্ধেও পড়ে। তবে সরকার যথাসময়ে সক্রিয় হইলে যে আলোচ্য মব সন্ত্রাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিত না– উহাও স্বীকার্য ।
স্মরণ করা যাইতে পারে, গত বৎসর সেপ্টেম্বর মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে হত্যার পর এহেন বর্বরতার বিরুদ্ধে জনপরিসরে তীব্র ক্ষোভ সঞ্চারিত হইয়াছিল। ইহার পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার বিবৃতি দিয়া একদিকে প্রতিটি ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল, অপরদিকে নাগরিকদের প্রতি আইন স্বীয় হস্তে না তুলিবার আহ্বান জানানো হইয়াছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি, দুর্ভাগ্যবশত অদ্যাবধি নিছক অমৃত বচনেই রহিয়া গিয়াছে। এই কারণেই যেই দেশে গত কয়েক মাসে সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও ধর্মানুসারী, তৎসহিত ইসলাম ধর্মাবলম্বী হইবার পরও মাজারপন্থি অনেক মানুষ, বহু নারী ও সংস্কৃতিকর্মী মব সন্ত্রাসের শিকার হইয়াছেন– তাহাও অস্বীকার করা যাইবে না।
এইরূপ নহে যে, পুলিশ সকল ক্ষেত্রেই নিষ্ক্রিয়। গত কয়েক মাসে একাধিকবার শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন ধারার শিক্ষকদের মিছিলে পুলিশকে প্রায় বিগত সরকারের আমলের ন্যায় আমরা ঝাঁপাইয়া পড়িতে দেখিয়াছি। প্রাথমিক শিক্ষকদের সড়ক হইতে অপসারণ করিতে গিয়া যেইভাবে শিশুক্রোড়ে থাকা শিক্ষিকাদের দিকে জলকামান হইতে জল নিক্ষেপ করা হইয়াছে, তাহা সকল সচেতন মানুষকেই হতবাক করিয়াছে। শুধু মব সন্ত্রাসের বেলায়ই পুলিশের কথিত অসহায়ত্ব দেখা যায়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ একটা সরকারের জন্য তাহা আদৌ উত্তম কিছু নহে। তাই রবিবার ‘মব’ সৃষ্টির হোতাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের যেই প্রতিশ্রুতি ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার হইতে উচ্চারিত হইয়াছে, উহা দ্রুত প্রতিপালিত হইতে হইবে। শুধু প্রতিশ্রুতিতে শুষ্ক চিড়া সিক্ত হইবে না।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
শেখ হাসিনাকে কোনো অবস্থাতেই ফেরত পাঠাবে না ভারত: রাজনৈতিক বিশ্লেষ
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় ক্ষমতাচ্যুত পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। মামলার অপর আসামি সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দেওয়া হয়েছে পাঁচ বছরের সাজা।
গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ২০২৪ সালের আগস্টে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা এবং এরপর থেকে তিনি ভারত সরকারের আশ্রয়েই রয়েছেন। ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ শেখ হাসিনার অনুপস্থিতি তার বিচার পরিচালনা করে। আজ সোমবার রায় ঘোষণার সময় আসামিদের মধ্যে কেবল সাবেক পুলিশ প্রধান আবদুল্লাহ আল-মামুন আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় নিয়ে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়ান স্টাডিজের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত। তিনি বলেন, “হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতের এই রায় প্রত্যাশিত ছিল, কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে না ভারত।”
আলজাজিরাকে দেওয়া মন্তব্যে দত্ত আরো বলেন, “কোনো অবস্থাতেই ভারত তাকে প্রত্যর্পণ করবে না। গত দেড় বছরে আমরা দেখেছি যে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো অবস্থায় নেই এবং অনেক সময়ই ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে।”
দত্ত বলেন, “হাসিনার মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশিত ছিল।”
তিনি বলেন, “সবাই বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখেছেন। সবাই আশা করেছিলেন যে হাসিনার বিচার হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা একমত যে, বাংলাদেশে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম দেশের আইনি ব্যবস্থা অনুসরণ করেছে।”
দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক এই রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, “নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ সম্পর্কে কারো সন্দেহ নেই। স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সরাসরি গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।”
দত্তের ভাষ্যমতে, “আওয়ামী লীগ এখন একটি পাল্টা ব্যাখ্যা তৈরির তৈরি করার চেষ্টা করবে। কিন্তু বাংলাদেশিরা মূলত বিশ্বাস করেন যে- হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।”
ঢাকা/ফিরোজ