তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা। গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থানায় হামলা, অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া ও বিস্ফোরক আইনের তিনটি মামলার আসামি তিনি, আছেন কারাগারে। তবে বিএনপির একটি কর্মিসম্মেলন ঘিরে তাঁকে ‘বারবার কারা নির্যাতিত বিএনপি নেতা’ আখ্যা দিয়ে তাঁর পক্ষে বেশ বড়সড় শোভাযাত্রা হয়েছে। এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন কারাবন্দী ওই আওয়ামী লীগ নেতার ভাই। তিনিও উপজেলা শ্রমিক লীগের নেতা।

ঘটনাটি ঘটেছে গত রোববার দুপুরে ফরিদপুরের সালথা উপজেলায়। ওই দিন সালথা উপজেলা বিএনপির কর্মিসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় উপজেলা পরিষদের মাল্টিপারপাস মিলনায়তনে। সম্মেলনে অংশ নিতে গট্টি ইউনিয়ন বিএনপির ব্যানারে মোটর শোভাযাত্রা করা হয় উপজেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক ও বর্তমানে কারাবন্দী নুরুদ্দীন মাতুব্বরের (৫৫) পক্ষে। এতে নেতৃত্ব দেন তাঁর ভাই ও উপজেলা শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুনছুর মাতুব্বর (৪৫)।

গতকাল সোমবার বিকেলে শোভাযাত্রার একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ঘটনাটি আলোচনায় আসে।

নুরুদ্দীন মাতুব্বর ও তাঁর ভাই মুনছুর মাতুব্বর সালথা উপজেলার গট্টি ইউনিয়নের আড়ুয়াকান্দি গ্রামের বাসিন্দা প্রয়াত হাশেম মাতুব্বরের ছেলে। আওয়ামী সরকার পতনের পর ৫ আগস্ট সালথা থানায় হামলা, থানার অস্ত্র লুট ও বিস্ফোরক আইনে করা তিনটি মামলায় নুরুদ্দীনকে আসামি করা হয়। ২৯ মার্চ সালথা থানা-পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে তিনি ফরিদপুর জেলা কারাগারে আছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রোববার সকালে গট্টি ইউনিয়ন থেকে বিএনপির নামে শোভাযাত্রা শুরু হয়। নুরুদ্দীন মাতুব্বরকে ‘বারবার নির্যাতিত বিএনপি নেতা’ দাবি করে ব্যানার তৈরি ও স্লোগান দেওয়া হয় শোভাযাত্রা থেকে। সকাল ১০টায় শুরু হয়ে বিরতি দিয়ে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে এটি সম্মেলনস্থলে পৌঁছে। পরে শোভাযাত্রার অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা সম্মেলনে যোগ দেন।

শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত ব্যানারে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং ফরিদপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ওবায়দুর রহমানের ছবি ছিল। ব্যানারের মাঝখানে নুরুদ্দীন মাতুব্বর ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদের ছবি ছিল। ব্যানারে লেখা ছিল, ‘বারবার নির্যাতিত বিএনপি নেতা মো.

নুরুদ্দীন মাতুব্বরের পক্ষ থেকে শামা আপার হাতকে শক্তিশালী করতে ২২ জুন সালথা উপজেলা বিএনপির কর্মিসম্মেলন সফল হোক। প্রচারে: গট্টি ইউনিয়ন বিএনপি।’

এ সম্পর্কে মুনছুর মাতুব্বর বলেন, ‘আমার ভাই আজীবন বিএনপি করেছেন, এখনো করেন। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক নন।’ নিজেকে শ্রমিক লীগের নেতা হিসেবে অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এ কথা আমার জানা নেই, কোনো কাগজও দেখিনি।’

তাঁর এই দাবি নাকচ করে দিয়ে সালথা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক চৌধুরী সাব্বির আলী বলেন, নুরুদ্দীন মাতুব্বর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক এবং তাঁর ভাই মুনছুর উপজেলা শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।

সালথা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতাউর রহমান বলেন, নুরুদ্দীন উপজেলা আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক। তাঁর বিরুদ্ধে বিস্ফোরক, অস্ত্র ও থানায় হামলার একাধিক মামলা আছে।

ফরিদপুর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব এ কে এম কিবরিয়া বলেন, আওয়ামী লীগের কোনো নেতার বিএনপিতে আসার সুযোগ নেই। তাঁদের প্রতিহত করতে যা যা প্রয়োজন, তা–ই করা হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সালথা উপজেলা বিএনপির তিনজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নুরুদ্দীনের পক্ষে শোভাযাত্রায় সহযোগিতা করেছেন নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বাবুল তালুকদার। তিনি নগরকান্দা উপজেলার লস্করদিয়া ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা শামা ওবায়েদের এলাকার বাসিন্দা।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বাবুল তালুকদার আজ মঙ্গলবার সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নুরুদ্দীন মাতুব্বরকে আমি মদদ দিইনি। বিএনপির কোনো নেতা এমন অভিযোগ করে থাকলে তা প্রতিহিংসার রাজনীতির অংশ হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নুরুদ্দীন মাতুব্বরকে বিএনপিতে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন র দ দ ন ম ত ব বর ব এনপ র ক রহম ন উপজ ল আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

রাজনৈতিক দলগুলোকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংস্কারের প্রতি প্রতিশ্রুতি দেখাতে হবে

বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের অবনতির পর্বে, গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। এ জন্য সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারের প্রতি শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিশ্রুতি দেখাতে হবে।

চলতি মাসে বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়া ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক উপকমিটির প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করা হয়েছে।

গতকাল বুধবার ফ্রান্সের স্ত্রাসবুর্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের দপ্তরে প্রতিবেদনটি পেশ করা হয়েছে। প্রতিবেদন উপস্থাপনের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ সফরে আসা প্রতিনিধিদলের প্রধান মুনির সাতোরি।

মুনির সাতোরি বলেন, ‘আমাদের সফরের দুটি উদ্দেশ্য ছিল। একটি হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করা ও গণতান্ত্রিক উত্তরণে মানবাধিকারের গুরুত্ব তুলে ধরা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, প্রায় বিস্মৃত হতে যাওয়া রোহিঙ্গাদের পাশে থাকা। রোহিঙ্গা সংকট যাতে হারিয়ে না যায়, সে জন্য এটি ইইউর রাজনৈতিক এজেন্ডায় আবারও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারকাজ নিয়ে মুনির সাতোরি বলেন, ‘এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে আমরা সহযোগিতার প্রস্তাব করেছি।’

প্রতিনিধিদলের সদস্য ইজাবেল উইসেলার-লিমা বলেন, যখন বিশ্বে নাটকীয়ভাবে গণতন্ত্র অবনতির পথে, তখন বাংলাদেশ পথ পরিবর্তন করে দেখিয়েছে যে গণতন্ত্রের পথে যাওয়া যায়। তারা চেষ্টা করছে গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার। আর এ জন্য সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এটা আশা করা জরুরি যে সামনে নির্বাচন হবে এবং তা প্রতিযোগিতামূলক হবে, যা হওয়া উচিত। অন্তর্বর্তী সরকার এ জন্য চেষ্টা করছে।

রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে ইজাবেল বলেন, ‘কক্সবাজার বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজা সংকটের কারণে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি মানুষ ভুলে যাচ্ছে। এ সংকট আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠেছে। কারণ, মিয়ানমার তাদের দায়িত্ব নিচ্ছে না। আর বাংলাদেশও দরিদ্র দেশ। বাংলাদেশের নিজেরই বিশাল জনসংখ্যা রয়েছে। ফলে রোহিঙ্গাদের জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিয়ে নেওয়া তাদের জন্য সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা সংকটের এখনকার চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাংলাদেশ বর্তমানে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে অবস্থায় রয়েছে।’

প্রতিনিধিদলের আরেক সদস্য আরকাদিউজ মুলারজিক বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিবিরে সবচেয়ে বেশি মানবিক অনুদান আসে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো থেকে, যদিও আগে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা দিত। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রতিশ্রুতি খুবই নগণ্য, এটি আশ্চর্যজনক এবং গ্রহণযোগ্য নয়। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বদলে অনেক দূরে থাকা ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোকে এর দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বড় অংশগ্রহণকারী হওয়া উচিত ছিল। বিষয়টি নিয়ে ভারতের সঙ্গেও কথা বলা উচিত। কারণ, বর্তমানে আমরা ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি নিয়ে দর–কষাকষি করছি।’

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিনিধিদলের সদস্য ক্যাটারিনা ভিয়েরা বলেন, এটি পরিষ্কার যে বাংলাদেশ ইতিহাসে দেশটি বর্তমানে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটি একটি সুযোগ সত্যিকারের অগ্রগতির। শিগগিরই হয়তো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের ভেতরে গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সবাই নির্বাচনটি স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দেখতে চায়। এ বিষয়গুলো শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের থেকে আসেনি, এসেছে নাগরিক সমাজ, ছাত্র ও যুব আন্দোলনের পক্ষ থেকেও, যাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। তারা নিজেদের মধ্যে সংলাপের মধ্যে রয়েছে। যদিও অনুতাপের বিষয় হচ্ছে ধর্মীয়, লিঙ্গ ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু এবং নারীদের এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ নেই। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সমাজ গঠনে এখানে উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে।

আরকাদিউজ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে সংস্কারে উৎসাহ, যারা সংস্কারে কাজ করছেন, তাঁদের প্রতি সংহতি প্রকাশ ও গণতান্ত্রিক কাঠামোয় গঠনমূলক সহযোগিতা করে ইইউ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্ব যখন গণতন্ত্রের উল্টো পথে যাত্রা করছে, তখন বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের আশা করার অবকাশ রয়েছে। গণতন্ত্রের পথে আরও অনেক কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় বাংলাদেশ সামনে দিকে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেবে বলে মনে করি। এটি এখন নির্ভর করছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারের প্রতি শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিশ্রুতি দেখাতে হবে।’

১৬ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার উপকমিটির পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশ সফর করে। এ সময়ে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল, বেসরকারি সংস্থা, নাগরিক সমাজ সংগঠন, শ্রমিক প্রতিনিধি এবং মাঠপর্যায়ে কর্মরত বহুপক্ষীয় সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে।

এ ছাড়া প্রতিনিধিদলটি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরও পরিদর্শন করে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ