কোনো দলের কার্যালয় আসলে ভাতের হোটেল, কোনোটার ট্রাভেল এজেন্সি
Published: 24th, June 2025 GMT
রাজধানীর পুরানা পল্টনের ৫৪ নম্বর বাড়িটিকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে দেখিয়ে নিবন্ধনের আবেদন করেছে বাংলাদেশ তিসারী ইনসাফ দল নামে একটি রাজনৈতিক দল। কিন্তু সেই ঠিকানায় গিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের সাইনবোর্ড দেখা যায়নি। এখানে কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানেন না স্থানীয় লোকজনও।
পুরানা পল্টনের ‘আজাদ প্রোডাক্টসের গলি’ বলে পরিচিত ওই গলির ৫৪ নম্বর বাড়িটি মূলত তিনতলা। এর মধ্যে তৃতীয় তলা দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। তাঁরা আরও জানান, দ্বিতীয় তলায় ‘ভোজন রেস্তোরাঁ’ নামে একটি রেস্তোরাঁ থাকলেও গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে সেটি বন্ধ রয়েছে। আর নিচতলায় ‘মুসলিম হোটেল অ্যান্ড কাবাব ঘর’ নামে একটি খাবারের দোকান রয়েছে।
সরেজমিন ভবনের নিচতলার এক অংশে থাকা হোটেলটি খোলা পাওয়া গেলেও অপর অংশে থাকা লোহার গেট বন্ধ পাওয়া যায়। তবে ভেতরে কিছু মানুষ অবস্থান করছিলেন। বাংলাদেশ তিসারী ইনসাফ দল সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁরা বেশ অবাকই হন। এই ভবনে রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব রয়েছে—এমনটা তাঁরা কখনো শোনেননি বলে জানান। তাঁরা আরও জানান, গত বছরের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর থেকে ভবনের এ অংশ কার্যত বন্ধ রয়েছে। কাজেই রাজনৈতিক দলের কোনো কার্যালয় থাকার প্রশ্নই আসে না।
নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা দেওয়া আবেদনে দলটির চেয়ারম্যান হিসেবে মো.
মুসলিম হোটেল অ্যান্ড কাবাব ঘরের কর্মচারীদের দলটির বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তাঁরা কিছু বলতে পারেননি। তবে হোটেলের ব্যবস্থাপক মো. সোহাগ মিনহাজ প্রধানকে চিনতে পারেন। হোটেলের একটি কোণ দেখিয়ে সোহাগ বলেন, ‘তিনি এখানে আসেন নাশতা খেতে। রাজনীতি বিষয়ে কথাবার্তা বলেন। কিন্তু আমাদের হোটেলে রাজনৈতিক দলের কার্যালয় নেই। হোটেলে কীভাবে রাজনৈতিক দলের কার্যালয় হয়?’
জাতীয় ন্যায় বিচার পার্টি নামে আরেকটি রাজনৈতিক দল ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন করেছে। তারা নয়াপল্টনের ইসলাম টাওয়ারের সপ্তম তলাকে দলীয় কার্যালয় হিসেবে দেখিয়েছে। ইসলাম টাওয়ারের সপ্তম তলায় গিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেখানে ‘আল আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’সহ বেশ কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি ও অন্য চার-পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে।
ইসিতে জমা দেওয়া আবেদনে দলটির চেয়ারম্যান হিসেবে মো. কামরুজ্জামানের নাম উল্লেখ রয়েছে। আবেদনে উল্লেখিত মুঠোফোন নম্বরে কল করা হলে মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে তো সবকিছু সিস্টেম অনুযায়ী করতে হয়। সে জন্য আল আমিন ট্রাভেলসকে আমরা অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে দেখিয়েছি। নিবন্ধনের আবেদন করতে তাড়াতাড়ি এই ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে অফিস নেব।’
নয়াপল্টনের ডিআইটি এক্সটেনশন রোডের ৫৩ নম্বর বাড়িটিকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেখিয়ে ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন করেছে বাংলাদেশ ইউনাইটেড পার্টি নামে একটি দল। সেই ঠিকানায় গিয়ে পুরো ভবনে কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
নিবন্ধনের আবেদনে দলটির দপ্তর সম্পাদক হিসেবে মো. মাসুদ মিয়ার নাম উল্লেখ রয়েছে। এ বিষয়ে একাধিকবার তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। একেক সময় তিনি একেক কথা বলেছেন। প্রথমে তিনি বলেন, ভবনের ষষ্ঠ তলায় কেন্দ্রীয় কার্যালয় করার কাজ চলছে। এখনো শেষ হয়নি। আরেকবার বলেন, একটি কক্ষ তালাবদ্ধ রয়েছে, সেটিই কেন্দ্রীয় কার্যালয় হবে।
কমিটি গঠনসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে কি না, জানতে চাইলে মাসুদ মিয়া বলেন, ‘এখনো সব কাজ শেষ হয়নি। দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছি।’
ওই ভবনের ষষ্ঠ তলায় গিয়ে একটি কক্ষে সংস্কারকাজ চলতে দেখা গেছে। সেখানে মো. জিসান নামের একজন মাসুদ মিয়ার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে জানান, এখানে ট্রাভেল অ্যান্ড রিক্রুটিং এজেন্সির অফিস হবে। নাম অভি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। রাজনৈতিক দল হবে কি না, তা জানেন না।
দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সড়কের ১০২/৪ নম্বর বাড়ির পাঁচতলাকে দলের কার্যালয় দেখিয়ে ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন করেছে ‘জাস্টিস ফর হিউমিনিটি পার্টি’ নামে একটি দল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ভিন্ন পরিস্থিতি।
মূল সড়ক থেকে সরু গলির ভেতরে ঢুকে ৪-৫টি বাড়ি পেরোলে ১০২/৪ নম্বর বাড়িটি দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এটি সুউচ্চ নয়; বরং এটি একটি আধা পাকা একতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে ঝোলানো হোল্ডিং নম্বর দেখে ঠিকানা নিশ্চিত হওয়া গেছে। দুই কক্ষের এই বাড়িতে একটি পরিবার ভাড়া থাকে। তবে ভবনের সামনে রাজনৈতিক দলের কোনো সাইনবোর্ড নেই।
আবেদনে দলটির চেয়ারম্যান হিসেবে মো. শাহজালালের নাম উল্লেখ রয়েছে। সেখানে উল্লেখিত মুঠোফোন নম্বরে কল করা হলে শামীম নামের একজন রিসিভ করে বলেন, নতুন করে অফিস ভাড়া নেওয়ায় অনেকেই এ ঠিকানা জানেন না, তাঁকে চেনেনও না। তিনি অফিসের সামনে এসে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলবেন বলে ফোন রাখেন।
কিছুক্ষণ পর দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক পরিচয়ে দেলোয়ার হোসেন নামের একজন প্রতিবেদকের মুঠোফোনে কল করে জানালেন, তিনি উল্লেখিত ঠিকানায় এসে প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করবেন। তবে তিনি সেখানে না এসে মূল সড়কে দেখা করতে বলেন। এরপর তিনি প্রতিবেদককে নিয়ে মূল সড়কের ৩১/সি নম্বর বাড়ির পাঁচতলায় যান। সেখানে দুটি ছোট কক্ষে তিনটি অনলাইন ও দৈনিক পত্রিকার অফিসের কার্যক্রম চলে।
নিজেকে একটি পত্রিকার বিভাগীয় প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে দেলোয়ার হোসেন বলেন, সমাজসেবা করেন, এমন ব্যক্তিদের নিয়ে তাঁরা দল গঠন করেছেন। ক্ষমতায় যাওয়াই তাঁদের লক্ষ্য। ক্ষমতায় যেতে পারলে তাঁরা সমাজসেবার নজির স্থাপন করতে চান।
ভিন্ন পরিচয় ব্যবহার কেন, জানতে চাইলে দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘এটা আমাদের অস্থায়ী কার্যালয়। মূলত তাড়াহুড়া করতে গিয়ে আবেদনে ভুল হয়েছে। পরে সংশোধন করে ৩১/সি নম্বর বাড়িটিকে কার্যালয় হিসেবে উল্লেখ করব।’
আগে ১০২/৪ বাড়িতেই তাঁদের কার্যালয় ছিল বলে দাবি করেন দেলোয়ার হোসেন। তবে বাড়িটি নিজেদের বলে দাবি করেন সেখানে বসবাসকারী মো. রাব্বি। তিনি বলেন, ‘এই বাড়ির মালিক ইস্কান্দার শেখ, তিনি আমার বাবা। আমরা এ বাড়িতেই থাকি। এখানে কোনো রাজনৈতিক দলের অফিস কখনো ছিল না। যাঁরা এমনটি বলছেন, তাঁরা ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করেছেন।’
পুরানা পল্টনের শাওন টাওয়ারের দশম তলাকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেখিয়ে নিবন্ধনের আবেদন করেছে বাংলাদেশ আজাদী পার্টি। কিন্তু ওই ভবনের দশম তলায় পাঁচ-ছয়টি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ের দেখা মিললেও রাজনৈতিক দলের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ইসিতে করা আবেদনে দলটির চেয়ারম্যান হিসেবে নাম রয়েছে আবুল কালাম আজাদের। ফোন করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধরে নেন, আমাদের অফিস এখানে আছে। এর বেশি কিছু লেখার দরকার নেই। আমরা নতুন দল হিসেবে এখানে অস্থায়ী কার্যালয় দিয়েছি।’ কিন্তু কোন কক্ষটি অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছেন, জানতে চাইলে তিনি আমতা আমতা করেন।
৮৫/১/এ, পুরানা পল্টন লেন—এ ঠিকানাকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেখিয়ে ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন করেছে বাংলাদেশ নাগরিক পার্টি। কিন্তু পুরো ভবন খুঁজে কোনো রাজনৈতিক দল পাওয়া যায়নি। আবেদনে উল্লেখিত দলটির চেয়ারম্যান মো. আমজাদ হোসেন সজলের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
ভবনটির তত্ত্বাবধায়ক আলমগীর হোসেন জানান, ভবনটিতে ‘পিপলস পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয় ছিল। কিন্তু গত বছরের রমজানের পর ভবনটির মালিক তাদের বের করে দেন। এরপর নতুন করে কোনো রাজনৈতিক দল এখানে অফিস ভাড়া নেয়নি।
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে একটি দল ১১৬/১, নয়াপল্টন, বক্স কালভার্ট রোড ঠিকানাকে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেখিয়ে নিবন্ধনের আবেদন করেছে। কিন্তু সরেজমিন সেখানে মদিনা ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটি দোকানের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
রাজধানীর নয়াপল্টনের ইসলাম টাওয়ারের সপ্তম তলায় রাজনৈতিক কার্যালয় দেখিয়ে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে জাতীয় ন্যায় বিচার পার্টি। তবে সেখানে গিয়ে ‘আল আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’সহ বেশ কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি ও অন্য চার-পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় রয়েছেউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উল ল খ ত ন বন ধ আম দ র র অফ স ভবন র প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
শেখ হাসিনাকে কোনো অবস্থাতেই ফেরত পাঠাবে না ভারত: রাজনৈতিক বিশ্লেষ
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় ক্ষমতাচ্যুত পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। মামলার অপর আসামি সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দেওয়া হয়েছে পাঁচ বছরের সাজা।
গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ২০২৪ সালের আগস্টে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা এবং এরপর থেকে তিনি ভারত সরকারের আশ্রয়েই রয়েছেন। ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ শেখ হাসিনার অনুপস্থিতি তার বিচার পরিচালনা করে। আজ সোমবার রায় ঘোষণার সময় আসামিদের মধ্যে কেবল সাবেক পুলিশ প্রধান আবদুল্লাহ আল-মামুন আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় নিয়ে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়ান স্টাডিজের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত। তিনি বলেন, “হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতের এই রায় প্রত্যাশিত ছিল, কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে না ভারত।”
আলজাজিরাকে দেওয়া মন্তব্যে দত্ত আরো বলেন, “কোনো অবস্থাতেই ভারত তাকে প্রত্যর্পণ করবে না। গত দেড় বছরে আমরা দেখেছি যে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো অবস্থায় নেই এবং অনেক সময়ই ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে।”
দত্ত বলেন, “হাসিনার মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশিত ছিল।”
তিনি বলেন, “সবাই বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখেছেন। সবাই আশা করেছিলেন যে হাসিনার বিচার হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা একমত যে, বাংলাদেশে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম দেশের আইনি ব্যবস্থা অনুসরণ করেছে।”
দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক এই রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, “নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ সম্পর্কে কারো সন্দেহ নেই। স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সরাসরি গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।”
দত্তের ভাষ্যমতে, “আওয়ামী লীগ এখন একটি পাল্টা ব্যাখ্যা তৈরির তৈরি করার চেষ্টা করবে। কিন্তু বাংলাদেশিরা মূলত বিশ্বাস করেন যে- হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।”
ঢাকা/ফিরোজ