ইরানে টানা ১১ দিন বোমাবর্ষণ করে ইরান কী অর্জন করল? যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দেওয়ার সময় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, ইসরায়েলি লক্ষ্যগুলো অর্জন হয়েছে। কিন্তু তাঁর এই দাবি যে সমস্যাজনক, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

এই স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধের শুরুতে নেতানিয়াহু দুটি লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করেছিলেন। এক.

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি গুঁড়িয়ে দেওয়া। দুই. ইরানে শাসনব্যবস্থার বদল।

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি কি গুঁড়িয়ে দেওয়া গেল? উত্তরটা হবে, না। এটা মনে হচ্ছে যে ফার্দো পারমাণবিক স্থপানায় যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালানোর আগেই সেখান থেকে ফিউশনযোগ্য বা বিভাজ্য পদার্থ অন্যখানে সরিয়ে নিয়েছিল। ইউরেনিয়ামের এই মজুতই ইরানের হাতে থাকা পারমাণবিক কর্মসূচির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি গুঁড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যটি ব্যর্থ হয়েছে।

ইসরায়েল হামলা চালিয়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির যদি কোনো ক্ষতি করে থাকে, সেটা আসলে কী? এ প্রশ্নের উত্তর এখনো পরিষ্কার নয়। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বাংকার বাস্টার বোমা দিয়ে হামলা চালাতে যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করাতে সক্ষম হয় ইসরায়েল। কিন্তু এর বাইরে এই আক্রমণ অভিযানে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পেয়েছে খুব সামান্য।

আরও পড়ুনইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র—কে জিতল এই যুদ্ধে২৪ জুন ২০২৫

ইরান যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র নিরূপণ করা কঠিন।

ইসরায়েল কি ইরানে ‘সরকার পরিবর্তন’ ঘটাতে পেরেছে? এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো, উল্টো ফলটাই বেশি হয়েছে। ইরানের বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থায় নেতৃত্ব থাকা সামরিক নেতাদের হত্যা করে ইসরায়েল চেয়েছিল দেশটির শাসকদলের বিরুদ্ধে গণ–অভ্যুত্থান উসকে দিতে। এই কৌশল এসেছে ইসরায়েলিদের সেই দৃঢ় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে, যেখানে তারা মনে করে, শত্রুরাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার সেরা উপায় হলো জ্যেষ্ঠ নেতাদের হত্যা করা।

কিন্তু এই কৌশল কখনোই কাজ করেনি। একমাত্র সম্ভাব্য ব্যতিক্রম হতে পারে লেবাননে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহর হত্যার প্রভাব। তবে হিজবুল্লাহর দুর্বল হওয়ার পেছনে লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। অন্য সব ক্ষেত্রে নেতৃত্বকে নিকেশ করে দেওয়ার ইসরায়েলি এই কৌশল বড় কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছে।

ইরান যথেষ্ট শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পেরেছে। ফলে ট্রাম্প ইসরায়েলকে সতর্ক করে দেন যে যুদ্ধবিরতি তারা যেন ভঙ্গ না করে। ইরান এমন একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলো, যে শক্তি হিসেবে তারা দাঁড়াতে চেয়েছে। ইরান দৃঢ়ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। ভবিষ্যতের সম্ভাবনার কথা ইরান জানিয়ে দিয়েছে।

ইরানের ক্ষেত্রেও ইসরায়েলি এই কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডে সরকারের প্রতি ইরানি জনগণের সংহতি জোরালো হয়েছে। ইসরায়েল ইরানিয়ান রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) শীর্ষ কমান্ডারদের হত্যা করে। আইআরজিসি সম্ভবত ইরানি রাজনীতির ক্ষমতাধর শক্তি। একই সঙ্গে ইরানি জনগণ সবচেয়ে ঘৃণা করে, এমন একটি সংস্থা আইআরজিসি।

তা সত্ত্বেও অনেক ইরানি, যাঁরা ইসলামিক রিপাবলিক ও বিশেষ করে আইআরজিসির কট্টর বিরোধী, তাঁরাও ইসরায়েলের হামলার পর সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন। ইরানিরা ইসরায়েলের এই হামলাকে সরকারের ওপর হামলা নয়, গোটা ইরানের ওপর শত্রুর আক্রমণ হিসেবে দেখছেন।

আরও পড়ুনইরানে হামলা ইসরায়েলের জন্য কৌশলগত বিপর্যয় ডেকে আনবে ১৭ জুন ২০২৫

ইরানি ‘শাসকদের প্রতীকগুলোতে’ ইসরায়েলি বোমা হামলা কেবল পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে। এভিন কারাগারে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। রাজনৈতিক বন্দীদের দমন-পীড়নের জন্য এই কারাগারের কুখ্যাতি আছে। ইসরায়েল কারাগারটিতে হামলা চালিয়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ইরানি জনগণের সংগ্রামে সহায়তা দিতে চেয়েছিল। অথচ বাস্তবে এই হামলার ফলে বন্দীদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছে। কেননা কর্তৃপক্ষ অনেক বন্দীকে অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে নিয়েছে।

তেহরানে ‘ইসরায়েল ডুমসডে ক্লকে’ (এই ডিজিটাল ঘড়ি ইসরায়েলকে ধ্বংসের জন্য ইরানি প্রতিশ্রুতির প্রতীক বলে মনে করা হয়) বোমা হামলাটি ছিল নিতান্তই হাস্যকর।

ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার কেন্দ্র আইআরআইবিতে ইসরায়েলের বোমা হামলাও ছিল একেবারে উদ্ভট। ইসরায়েল দাবি করেছিল, ইরানি শাসকদের প্রোপাগান্ডা প্রচারের চেষ্টা রুখে দিয়েছে। এই বোমা হামলার পর অনেক ইসরায়েলি বলেছিলেন, এটি ইসরায়েলের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতেও হামলা চালানোর ক্ষেত্রে ইরানকে ন্যায্যতা দেবে।

ইসরায়েল যদি এর ঘোষিত যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন না-ই করতে পারে, তাহলে অন্তত বিশ্বজনমতকে কি তার পক্ষে টানতে পেরেছে? এটা সত্য যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এই হামলার মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক আইনের কয়েকটি গুরুতর নিয়ম লঙ্ঘন করেছে।

আরও পড়ুনইরান কিছুই ভুলবে না, সব মনে রাখবে১৮ ঘণ্টা আগে

এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। যা–ই হোক, ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প যুদ্ধে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু হামলার পরই যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বোমারু বিমান যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।

ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলার আগে ও পরে ট্রাম্প বারবার জোর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে চুক্তির বিষয়ে তাঁর আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছেন। সেখানে ইসরায়েলকেও অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইসরায়েলকে সহায়তা করেন তাঁর নিজের এবং উপসাগরীয় মিত্রদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে।

বিশ্বের বেশ কয়েকজন নেতা (সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ মের্ৎসে) খুব দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রের হামলার সমর্থন করেন। একই সঙ্গে তারা ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারে’ সমর্থন দেন। কিন্তু তাদের কেউই ইসরায়েলের কঠোর দাবির তালিকা গ্রহণ করেননি। ইসরায়েল যে সব দাবি করেছিল এর মধ্যে ছিল, ইরান যেন একেবারেই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে না পারে।

বিশ্ব আবার ‘কোনো পারমাণবিক অস্ত্র নয়’ সেই নীতিতে ফিরে গেছে। ইরান এরই মধ্যে এই নীতি মেনে চলার ব্যাপারে আগ্রহী বলে জানিয়েছে।

আরও পড়ুন২৫০০ বছরের পুরোনো দুশমনি: ইসরায়েল কি ‘মরদখাই’? ইরান কি ‘হামান’?১৭ জুন ২০২৫

মধ্যপ্রাচ্যের কার্যকর উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইরানকে বিশ্ব ব্যবসার জন্য একটি বৈধ অংশীদার হিসেবে মনে করছে। এটি ইসরায়েলের জন্য একটি পরাজয় এবং ইরানের জন্য একটি বিজয়।

ইসরায়েলের একেবারে কেন্দ্রে যে বাস্তব ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটাও বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এই যুদ্ধে ইসরায়েল খুব দ্রুতই ইরানের আকাশসীমায় নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং প্রায় ইচ্ছামতো হামলা চালাতে পেরেছিল। কিন্তু ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র বারবার ইসরায়েলের সুপ্রসিদ্ধ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ করে বারবার তেল আবিব, জেরুজালেমসহ একেবারে কেন্দ্রে এবং দেশের সর্বত্র আঘাত হানতে সক্ষম হয়। ইরানের এই হামলায় গোটা ইসরায়েল কার্যত অচল হয়ে পড়ে।

নজিরবিহীন হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে। ইসরায়েলের প্রতিরোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত ফুরিয়ে আসছিল, খুব দ্রুত সেই শূন্যস্থান পূরণের আশা ছিল না। অর্থনীতি দ্রুত ভেঙে পড়ার মুখে পড়ে। এটি ইরানের জন্য আরেকটি বিজয়।

আরও পড়ুনইসরায়েল হত্যা করে, মিথ্যা বলে, আর পশ্চিমা মিডিয়া তা বিশ্বাস করে০৮ এপ্রিল ২০২৫

ইরান যুদ্ধের ক্ষত ও বোমা হামলার মধ্য দিয়ে নতুন ইরানের জন্ম হয়। শত শত মানুষের প্রাণহানি এবং নির্বিচার বোমা হামলায় ইরানের ক্ষয়ক্ষতি ছিল বাস্তব। কিন্তু শক্তিশালী ইসরায়েলি বাহিনীর মুখোমুখি হয়েও ইরান মাথা নত করেনি।

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলিদের বাড়িঘরে আঘাত হেনেছে। কিন্তু তাতে ইরানের ভাবমূর্তিতে একটুও আঁচড় লাগেনি। কেননা বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ ইরানকে ইসরায়েলের আক্রমণের ভুক্তভোগী হিসেবে দেখেছে। ইরানের পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগগুলো তাই তীব্রভাবে বাধাগ্রস্ত হয়নি।

কাতারের মার্কিন ঘাটিতে প্রতিশোধমূলক হামলার কথা আগে থেকেই সতর্ক করে ইরান খুব সফলভাবে উত্তেজনা প্রশমন করতে পেরেছে।

ইরান যথেষ্ট শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পেরেছে। ফলে ট্রাম্প ইসরায়েলকে সতর্ক করে দেন যে যুদ্ধবিরতি তারা যেন ভঙ্গ না করে। ইরান এমন একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলো, যে শক্তি হিসেবে তারা দাঁড়াতে চেয়েছে। ইরান দৃঢ়ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। ভবিষ্যতের সম্ভাবনার কথা ইরান জানিয়ে দিয়েছে।

অরি গোল্ডবার্গ মধ্যপ্রাচ্য ও বিশেষ করে ইরান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র য় ইসর য় ল ইসর য় ল ক ইসর য় ল র ইসর য় ল য আইআরজ স র জন ত ন র জন র হত য এক ব র কর ছ ল লক ষ য র জন য সরক র সবচ য়

এছাড়াও পড়ুন:

নোয়াখালীতে আগুনে পুড়ল ১১টি দোকান ও একটি কারখানা

নোয়াখালীর সেনবাগে একটি কাঠের আসবাবপত্র তৈরির কারখানা, গোডাউনসহ অন্তত ১১টি দোকান আগুনে পুড়ে গেছে। শনিবার (৯ আগস্ট) রাত ১টার দিকে উপজেলার সেবারহাট বাজারে ঘটনাটি ঘটে। 

ফায়ার সার্ভিসের সেনবাগ, চৌমুহনী ও মাইজদীর পাঁচটি ইউনিট প্রায় সাড়ে ৬ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে রবিবার (১০ আগস্ট) সকাল সাড়ে ৭টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা জানায়, শনিবার রাত ১টার দিকে সেবারহাটে একটি আসবাবপত্র তৈরির কারখানা থেকে প্রথমে আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপর আগুন আশপাশের ১১টি দোকানে ছড়িয়ে পড়ে। আজ সকাল সাড়ে ৭টার দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। 

আরো পড়ুন:

নেত্রকোণার ধলাই নদীতে বাল্কহেড ডুবে ২ শ্রমিক নিখোঁজ

মানিকগঞ্জে প্লাস্টিক কারখানার আগুন, ৬০ কোটি টাকার ক্ষতি

আগুনে আসবাবপত্র তৈরির কারখানা, মেশিনারিজ সামগ্রী, থাই অ্যালুমিনিয়াম পণ্য বিক্রির দোকানসহ অন্তত ১১টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। আগুনে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের ৩৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।  

সেনবাগ ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ফায়ার ফাইটার মো.সাব্বির হোসেন বলেন, ‍“পাঁচটি ইউনিট প্রায় সাড়ে ৬ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ক্ষয়ক্ষতি ও অগ্নিকাণ্ডের কারণ তদন্ত শেষে বলা যাবে।” 

ঢাকা/সুজন/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ