ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সন্মুখে রাখিয়া ইসি তথা নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাইবার জন্য যেইভাবে নামসর্বস্ব দলগুলি ভিড় জমাইয়াছে তাহা আমাদের বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার দুর্বলতাকেই পুনরায় উন্মোচিত করিয়াছে। শনিবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত রবিবার নিবন্ধনের শেষ দিবস পর্যন্ত মোট ১৪৭টি রাজনৈতিক দল আবেদন করিয়াছে, যাহাদের সিংহভাগই নামসর্বস্ব, কোনো কোনোটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় নেতাদের বাসগৃহ, হোটেল-রেস্তোরাঁ, ট্রাভেল এজেন্সি কিংবা ভাড়াকৃত ছোট্ট কক্ষ। এমনকি ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করিয়াও অনেকে নিবন্ধনের আবেদন করিয়াছে। বাহারি নামের কোনো দল নিছক স্বামী-স্ত্রী মিলিয়া বানাইয়াছেন; যেইখানে তৃতীয় নেতা বা কর্মী নাই। নিবন্ধনের জন্য আবেদনের এহেন চিত্রটি প্রমাণ করে যে, রাজনীতি এখনও দেশের একাংশের নিকট নিছক ব্যবসায়। রাজনীতি যেই অধিকাংশ জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রের ন্যায় জটিল প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দক্ষতা অর্জনের বিষয়, ইহা নিবন্ধনপ্রত্যাশী কতিপয় দলের প্রতি তাকাইলে বোঝা যায় না। এই কারণেই উক্ত নিবন্ধনপ্রত্যাশীর হিড়িককে আমরা বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার দুর্বলতার প্রকাশ বলিয়াছি।
স্মরণ করা যাইতে পারে, অতীতে সামরিক শাসনকালে যখন নির্বাচন বা অন্য কোনো উপলক্ষে সংশ্লিষ্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত দলগুলির দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হইত তখনই এই ধরনের অভিনব দল ভেকছত্রের ন্যায় গজাইয়া উঠিত। সেই সময় বিশেষত নির্বাচনকালে এই সকল দলের নেতারা বিশেষত সরকার ও নির্বাচন কমিশনের নিকট হইতে বেশ কদর পাইত। ২০০৭-০৮ সালের বহুল আলোচিত এক-এগারোর
তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেও একই চিত্র দেখা গিয়াছিল। ২০০৮ সালে প্রণীত গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের নিয়ম চালু হইলে ১৯০টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে। দুর্ভাগ্যবশত, তখন এমন অনেক দলকেই নিবন্ধন প্রদান করা হয় যাহাদের আইনে বর্ণিত ন্যূনতম শর্ত পূরণেরও যোগ্যতা ছিল না। জনপরিসর তখন এই আলোচনায় বেশ সরগরম ছিল যে, তৎকালীন অনির্বাচিত সরকারের বিশেষ উদ্দেশ্যেই এহেন কাণ্ড ঘটিয়াছিল।
বিগত সরকারের সময় বিশেষত সর্বশেষ তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনেও অনুরূপ চিত্র পরিলক্ষিত হইয়াছে। ফলে এখন এই কথা উঠিয়াছে যে, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী নির্বাচনে বিশেষ কোনো সুবিধার আশায় ওই বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়াছে কিনা সেই সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকলের সতর্ক থাকা প্রয়োজন। ইহা সত্য, এইবার ইসির নিবন্ধন পাইবার শর্তগুলি বিশেষত ২০০৮ সাল অপেক্ষা অধিক শক্ত। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, নিবন্ধনের যোগ্য দলের সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও কেন্দ্রীয় কমিটি থাকিতে হইবে। এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলা ও ১০০টি উপজেলা বা মেট্রোপলিটন এলাকায় অফিসসহ প্রতিটিতে ২০০ জন ভোটার থাকিতে হইবে। কিন্তু নিয়মগুলি যদি কাগজেই থাকিয়া যায়, বাস্তবে যথাযথভাবে প্রয়োগ না করা হয় তাহা হইলে সকলই অতীতের ন্যায় অর্থহীন হইয়া পড়িবে।
নিঃসন্দেহে, রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ ইসির নিবন্ধনের উদ্দেশ্য হইতে পারে না। তবে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের প্রয়োজন অস্বীকার করা যাইবে না। বিশেষত নির্বাচনী রাজনীতিকে নিয়মকানুনের মধ্যে রাখিতে হইলে নিবন্ধন প্রক্রিয়ার কোনো বিকল্প নাই। সেই লক্ষ্যে ইসিকে নিবন্ধিত দলগুলির নিজস্ব গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনাও নিশ্চিত করিতে হইবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের সহিত পরামর্শক্রমে নিবন্ধিত দলের জন্য আরও কিছু নিয়ম চালু করা যাইতে পারে। জাতীয় দলের স্বীকৃতি ধরিয়া রাখিবার জন্য ভারতসহ বিভিন্ন দেশে নির্দিষ্টসংখ্যক ভোট প্রাপ্তির বিধান বহুদিন যাবৎ চালু রহিয়াছে। আমাদের দেশেও অনুরূপ নিয়ম করা যাইতে পারে। সর্বোপরি, রাজনীতিতে জনসমর্থনই যেহেতু সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রকৃত কোনো রাজনৈতিক দলেরই জন্য সেই পরীক্ষা এড়াইবার সুযোগ থাকিতে পারে না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন র জন র জন য অন য য় সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে নতুন করে সংশয়ে বিএনপি
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল লন্ডন বৈঠকের পর সেটা কেটেছে বলে মনে করা হচ্ছিল; কিন্তু দুই সপ্তাহ যেতে না যেতেই নতুন করে নির্বাচনকেন্দ্রিক সংশয় তৈরি হয়েছে বিএনপিতে। বিশেষ করে ভোটের বিষয়ে সরকারের দিক থেকে এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে স্পষ্ট কোনো বার্তা না দেওয়ায় এ নিয়ে জল্পনাকল্পনা বাড়ছে।
বিএনপির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, লন্ডন বৈঠকের কোনো প্রতিফলন নির্বাচনের কমিশনের কার্যক্রম তারা দেখছেন না। পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি ও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচনসহ কিছু বিষয় নতুন করে সামনে আনার চেষ্টা হচ্ছে। এটাকে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার উপাদান বলে মনে করছে বিএনপি।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন। তাঁরা দীর্ঘ সময় একান্তে কথা বলেন। বিএনপির নীতি–নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা ধারণা করেছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা বৃহস্পতিবার যমুনায় এই বৈঠকে সিইসিকে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর কথা বলবেন; কিন্তু সরকারের দিক থেকে এই বৈঠককে শুধু সৌজন্য সাক্ষাৎ বলা হয়েছে। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনও কোনো বক্তব্য দেয়নি। ফলে বিএনপি মনে করছে, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের বিষয়ে সিইসিকে স্পষ্ট কোনো বার্তা দেননি। যার ফলে প্রধান উপদেষ্টা ও সিইসির সাক্ষাতে কী আলাপ হয়েছে, তা পরিষ্কার করার আহ্বান জানায় বিএনপি। এ বিষয়ে গত শুক্রবার বিকেলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যদি উভয় পক্ষ থেকে জাতির সামনে বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়, তাহলে আমরা আশ্বস্ত হই।’
আরও পড়ুননির্বাচন বিলম্বিত বা না হওয়ার জন্য পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়া হচ্ছে: সালাহউদ্দিন আহমদ৯ ঘণ্টা আগেযারা স্থানীয় নির্বাচন ও আনুপাতিক হারে নির্বাচনের দাবি তুলছে, তাদের একটা উদ্দেশ্য থাকতে পারে; হয় নির্বাচন বিলম্বিত করা অথবা নির্বাচন না হওয়া।সালাহউদ্দিন আহমদ, স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিএনপিসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবারের ওই সাক্ষাতে প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন বিষয়ে কথোপকথনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংস্কারপ্রক্রিয়া কতটা এগিয়েছে এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে সিইসির কাছে জানতে চেয়েছেন। তবে কবে নাগাদ নির্বাচন আয়োজন করা হতে পারে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো আলোচনার কথা জানা যায়নি।
১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, সব প্রস্তুতি শেষ করা গেলে ২০২৬ সালে পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও (ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে) নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে বলে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন। সে ক্ষেত্রে ওই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, তাঁদের কাছে এখন পর্যন্ত সরকারের দিক থেকে লন্ডন বৈঠকের ওই ঘোষণার কোনো প্রতিফলন নেই; বরং রাজনীতিতে নতুন নতুন কিছু ইস্যু তৈরির চেষ্টা হচ্ছে, যা জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার উপাদান বলে মনে করছেন। এর মধ্যে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা এবং আগামী নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন (পিআর) পদ্ধতি প্রবর্তনের দাবি জোরদার করা হচ্ছে।
আরও পড়ুনপ্রধান উপদেষ্টা-সিইসির কী আলাপ হলো, পরিষ্কার করার আহ্বান সালাহউদ্দিনের২৭ জুন ২০২৫প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন। বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায়