সেদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ভদ্রলোক লিখেছেন, মহানবী (সা.)-এর জীবনী (সিরাত) থেকে একটি গল্প বলার পর তাঁর সন্তান হঠাৎ প্রশ্ন করছে, ‘বাবা, নবীজি কি চশমা পরতেন?’

যদিও এটি সরল বা হাস্যকর প্রশ্ন, কারণ চশমা তো অনেক পরে আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু প্রশ্নটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এতে বোঝা যায়, নবীজি (সা.) তার সন্তানদের কাছে ইতিহাসের কোনো বিমূর্ত চরিত্র নন, বরং একজন বাস্তব ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠছেন। এটা তাদের অবিচল মুসলিম হিসেবে গড়ে ওঠার যাত্রায় একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত।

দৃঢ়তা কেন গুরুত্বপূর্ণ

আজকের বিশ্বে মুসলিম হিসেবে বেঁচে থাকাই একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ কাজ। ইসলামের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ঐতিহ্যবাহী পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্রের সঙ্গে মেলে না। ইসলামের সামাজিক ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী এবং সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে মুসলমানেরা নমনীয় হলেও অধীনতা থেকে দূরে থাকে।

সন্তানদের তাই বাইরের বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন না রেখে তাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা এমন বিশ্বে অবিচল মুসলিম হিসেবে টিকে থাকতে পারে।

সন্তানদের দৃঢ়চেতা মুসলিম হিসেবে গড়ে তুলতে ৫টি পরামর্শ

সন্তানদের অটল ও অবিচল মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলা মানে তাদের ইসলামী পরিচয়, ইতিহাসের প্রতি গর্ব, নবীজি (সা.

)-এর সঙ্গে বাস্তব সংযোগ, উম্মাহর প্রতি ভালোবাসা এবং সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতার পার্থক্য শেখানো।

আরও পড়ুনদুনিয়ায় প্রত্যেক মুসলিমকে যেসব পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে০১ আগস্ট ২০২৫

১. শেখানো যে তাদের প্রথম পরিচয় মুসলিম

প্রতিটি শিশুর একাধিক পরিচয় থাকে—জাতীয়তা বা জাতিগত পরিচয়, সংস্কৃতি। কিন্তু কোন পরিচয়টি প্রাথমিক এবং কেন্দ্রীয়, তা না বুঝলে শিশুরা বিভ্রান্তির সমুদ্রে ভেসে যাবে। অনেকে তাদের সন্তানদের জাতীয়তা বা জাতিগত পরিচয়কে প্রাধান্য দেয়, কিন্তু এটি জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ বা ফ্যাসিবাদের মতো সমস্যার জন্ম দিতে পারে। যেমন, ‘আমেরিকান’ পরিচয় আজ এত বৈচিত্র্যময় যে এখন ‘আমেরিকান’ ধারণাটিই অস্পষ্ট হয়ে গেছে।

ইসলামকে প্রথম পরিচয় হিসেবে শেখানো হলে শিশু একটি শক্ত ভিত্তি পাবে। এটি তাদের বিশ্বকে একটি সুস্পষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে সাহায্য করে। তবে এটি ‘একমাত্র’ পরিচয় নয়। একজন কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম নারীর অভিজ্ঞতা একজন আরব মুসলিম পুরুষের থেকে ভিন্ন হবে এবং এই বৈচিত্র্যকে সম্মান করতে হবে।

২. ইসলামী ইতিহাসের প্রতি গর্ববোধ জাগানো

আত্মবিশ্বাসী শিশুদের জন্য রোল মডেল ও নায়কের প্রয়োজন। আধুনিক মিডিয়া পশ্চিমা নায়কদের—যেমন ক্যাপ্টেন আমেরিকা বা এলন মাস্ক—দিয়ে শিশুদের মন ভরিয়ে দেয়। কিন্তু মুসলিম শিশুদের জন্য আমাদের নিজস্ব ইতিহাসের নায়কদের কথা বলতে হবে।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবি, আল-বিরুনি, প্রাচীন বাগদাদের গল্প শিশুদের বলতে হবে, যাতে তারা তাদের ঐতিহ্যের প্রতি গর্বিত হয়। যদি আপনি নিজে ইসলামী ইতিহাস সম্পর্কে কম জানেন, তবে শিখুন। বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান ইসলামী ইতিহাস শিক্ষা দিচ্ছে। এই গল্পগুলো শিশুদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখায়।

৩. নবীজি (সা.)-কে তাদের কাছে বাস্তব করে তোলা

মহানবী (সা.) জুলিয়াস সিজার বা আলেকজান্ডারের মতো ঐতিহাসিক চরিত্র নন, যাদের সম্পর্কে আমরা কথা বলি কিন্তু যারা আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে না। নবীজি (সা.)-কে শিশুদের কাছে এমন একজন পরিবারের সদস্য হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে, যিনি এখন আমাদের মাঝে নেই কিন্তু যাঁর কথা, কাজ ও সম্মান আমাদের জীবনের কেন্দ্রে থাকবে।

ঘুমানোর আগে সিরাতের গল্প, তাঁর জীবনের ঘটনা বা তাঁর শিক্ষার কথা শিশুদের সঙ্গে শেয়ার করা তাঁকে তাদের কাছে বাস্তব করে তোলে।

আরও পড়ুনসন্তান প্রতিপালনে ধর্মের দাবি১৯ মে ২০২৫

৪. উম্মাহর প্রতি ভালোবাসা শেখানো

সন্তানদের উম্মাহর প্রতি ভালোবাসা শেখানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি স্বাভাবিকভাবে তৈরি হয় না। আমরা দেখি, মুসলিমরা বিশ্বজুড়ে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, শরণার্থীদের সাহায্য করতে অস্বীকার করে বা তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ করে। মিশরের রাবা মসজিদে শিশুদের গুলি করা, রোহিঙ্গাদের সমুদ্রে ফিরিয়ে দেওয়া বা লিবিয়ায় দাস শিবির চালানোর মতো ঘটনা আমাদের উম্মাহর প্রতি ভালোবাসার ঘাটতি দেখায়।

সন্তানদের শেখাতে হবে যেন তারা নিপীড়ক বা নিষ্ঠুর না হয়। তাদের ভালোবাসা শেখাতে হবে, ঘৃণা নয়। এই ভালোবাসা কেবল মুসলিমদের জন্য নয়, পুরো মানবজাতির জন্য। তবে নিজেকে ভালোবাসা না শিখলে অন্যকে ভালোবাসা সম্ভব নয়।

৫. সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতার পার্থক্য শেখানো

শিশুরা জীবনে অনেক কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হবে। তারা কি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য মদ্যপানে সম্মতি দেবে? তারা কি নির্দিষ্ট পোশাক বা চুলের স্টাইল গ্রহণ করবে? তাদের বিশ্বাস লুকিয়ে রাখবে কি বহিষ্কৃত হওয়ার ভয়ে?

তাদের সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতার পার্থক্য শেখাতে হবে। অন্যের ভিন্ন বিশ্বাস বা জীবনধারাকে সম্মান করা মানে তা অনুসরণ করা নয়। নিজের বিশ্বাস ধরে রাখা সত্ত্বেও সামাজিকভাবে মানিয়ে নেওয়া যায়। বরং, এই দৃঢ়তা প্রায়ই আরও বেশি সম্মান অর্জন করে। শিশুদের শেখাতে হবে যে তারা ভিন্নভাবে মানিয়ে নিতে পারে এবং এটি তাদের আরও শক্তিশালী করে।

জীবন তাদের উপর অনেক চ্যালেঞ্জ চাপিয়ে দেবে, কিন্তু আমরা তাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে পারি যাতে তারা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শক্তিশালী হয়। যেমন বলা হয়, ‘যে হাত দোলনায় দোলে, সে বিশ্ব শাসন করে।’

সূত্র: মুসলিম ম্যাটার্স

আরও পড়ুনশিশু সুরক্ষায় ইসলামের শিক্ষা১০ নভেম্বর ২০১৬

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ রহণয গ য র জন য আম দ র র জ বন ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

কামাল ও তাঁর তিন সন্তান দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, প্রতিদিন ‘যুদ্ধ করেও’ কূল খুঁজে পান না

ছয়জনের পরিবারে চারজনই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তাঁর মধ্যে পরিবারের প্রধান মো. কামাল হোসেন মাঝি নিজেও একজন। জন্ম থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষটির জীবনের শুরু হয়েছিল বড় একটি স্বপ্ন নিয়ে—ধর্মীয় বক্তা হবেন, মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে তিলাওয়াত করবেন, হামদ-নাথ গাইবেন, মানুষকে আলো দেখাবেন। মুখস্থ করেছিলেন ১৫ পারা কোরআন। কিছুদিন মাদ্রাসায়ও পড়েছেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়নি। অভাব আর দারিদ্র্য তাঁকে নামিয়ে এনেছে এমন এক বাস্তবতায়, যেখানে এখন তাঁর একমাত্র চাওয়া—দুবেলা খেতে পারা আর মাথার ওপর ছাউনি।

ভোলার সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের কন্দর্পপুর গ্রামে থাকেন কামাল। জনতাবাজার থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে তাঁর ঘর। বর্ষায় কর্দমাক্ত রাস্তা পেরিয়ে কোনো রিকশা যায় না, হাঁটতে হয়। গত শনিবার সন্ধ্যায় প্রতিবেশীর আধা মণ বীজধানের বস্তা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে কামাল পড়ে যান। পথচারীরা তুলে দিয়ে আবার বস্তা কাঁধে তুলে দেন। হয়তো এর বিনিময়ে কিছু টাকা পেয়েছেন। কিন্তু এত কষ্টের কাজ করেও পরিবারে তেমন কিছু যোগ হয় না।

কামালের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্ত্রী মোসাম্মৎ তানজিলা বেগম (৩৯) ও ছোট মেয়ে উম্মে হাবিবা (৭) ছাড়া পরিবারের সবাই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তাঁর বড় মেয়ে কামরুন নাহার (২৫), ছেলে আবুল বাশার (১৩), মেজ মেয়ে শশী আক্তার (১০)—তিনজনই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। এ ছাড়া দুই মেয়ের স্বামীও প্রতিবন্ধী। বড় জামাই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, মেজ জামাই শারীরিকভাবে অক্ষম। কারও তেমন উপার্জন নেই।

কামালের জন্ম উত্তর রাজাপুরের রামদাসপুর গ্রামে। বাবা চাষাবাদ করতেন। মেঘনার বারবার ভাঙনে সব হারিয়ে দক্ষিণ রাজাপুরে এসে সরকারি পতিত জমিতে ঘর তোলে পরিবার। কামাল ছোটবেলায় ওস্তাদের মুখে শুনে কোরআন মুখস্থ করেন। কিছুদিন দাখিল মাদ্রাসায় পড়লেও অর্থাভাবে পড়া থেমে যায়। সেই সময়েই বক্তা হওয়ার স্বপ্ন জাগে মনে। কিন্তু পরিবারের অভাব তাঁকে স্বপ্ন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

বিয়ের পর থেকে কামালের স্ত্রী তানজিলা ছোট ছোট কাজ করেন, শাকপাতা বিক্রি করে, হাঁস-মুরগি পুষে সংসার চালানোর চেষ্টা করেন। একসময় চারটি গরুর মালিকও হন। কিন্তু ২০২৪ সালে এক রাতে চারটি গরুই চুরি হয়ে যায়। এ খবর প্রকাশ হয় প্রথম আলোতেও। তানজিলা বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেছেন, গরুগুলো পাননি। মানুষের সহায়তায় একটি বাছুর কেনেন, আর মৎস্য বিভাগ আরও একটি দেয়। এখন সেগুলো বড় হচ্ছে। গরু দুটি এখন তাদের সম্বল।

কামাল বলেন, ‘এই বছর বিষ্টির শেষ নাই। আসমান দিয়াও পরে, বাড়িতদারের ইলশা নদীর জোয়ার ওডে ডোয়াদ্দারে। গরবিডি ডুবি যায়। বিষ্টিরসুম্ গরে-বাইরে একাকার। গরেও পানি, বাইরেও পানি। এই অবস্থা দেইকখা জনতাবাজারের জামাল ডাকতোর ৫১ হাজার টিয়ার (টাকা) টিন দিছে বাকিত্। কইছে টিয়া ছিরি ছিরি (অল্প অল্প) নিবো। কিন্তুক এহোন টিয়ারলাই চাপ দেয়।’

এমন করেই জীবন পার করছে কামাল মাঝির পরিবার। কামালের চাওয়া দিনে দুবেলা খেতে পাওয়া, একটু নিরাপদে থাকা। ছোট যে তিনটি ছেলে-মেয়ে আছে, তাদের স্বাবলম্বী করা। কিন্তু কোনো কূল খুঁজে পাচ্ছে না। স্ত্রী তানজিলা বলেন, ‘পুতেরে (পুত্র) একজন এট্টা ছাগল ছদকা (দান) দিছিল। হেইডা বেইচ্চা চালে টিন লাগাইছি। এহোনো ব্যারা ভাঙা।’

ভোলা জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান বলেন, খোঁজ নিয়ে তিনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মো. কামাল হোসেন মাঝির পরিবারকে যথাসাধ্য সাহায্য করবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • টের স্টেগেনের অধিনায়কত্ব কেড়ে নিল বার্সা, নতুন অধিনায়ক কে
  • সাংবাদিক ভাইদের জীবনের নিরাপত্তা কে দিবে, প্রশ্ন তমা মির্জার
  • কমল হাসানের পায়ের ধুলোরও যোগ্য নন শাহরুখ: লিলিপুট
  • যুদ্ধের মধ্যেও কোন গোপন ব্যবস্থায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন দিচ্ছে হামাস
  • কামাল ও তাঁর তিন সন্তান দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, প্রতিদিন ‘যুদ্ধ করেও’ কূল খুঁজে পান না
  • আমি নিজেকে অপমানিত হতে দিতে পারি না, ট্রাম্পের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে কথা প্রসঙ্গে লুলা
  • ব্রাজিলের কিছু পণ্যে ৫০ শতাংশ মার্কিন শুল্ক কার্যকর
  • স্বচ্ছতার দিক দিয়ে এই পুরস্কারই সেরা
  • রমজানের আগে নির্বাচন ভালো পদক্ষেপ, স্বাগত জানাল ৪টি দল