যুদ্ধের মধ্যেও কোন গোপন ব্যবস্থায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন দিচ্ছে হামাস
Published: 8th, August 2025 GMT
গাজা উপত্যকায় দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সামরিক সক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আর রাজনৈতিক নেতৃত্বও তীব্র চাপে রয়েছে।
তবু যুদ্ধ চলাকালেই হামাস নগদ অর্থভিত্তিক এক গোপন পরিশোধব্যবস্থা ব্যবহার করে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে ৩০ হাজার সরকারি কর্মচারীর বেতন পরিশোধ করছে তারা। মোট বেতন বাবদ এ অর্থের পরিমাণ ৭ মিলিয়ন (৭০ লাখ) ডলার (৫৩ লাখ পাউন্ড)।
বিবিসি গাজার তিনজন সরকারি কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলেছে। গত সপ্তাহেই প্রায় ৩০০ ডলার করে বেতন পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন তাঁরা।
ধারণা করা হচ্ছে, গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যাঁরা প্রতি ১০ সপ্তাহে যুদ্ধপূর্ব বেতনের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশের কিছু বেশি পাচ্ছেন, এই তিন কর্মচারী তাঁদের কয়েকজন।
বেগতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও লাগামছাড়া মূল্যস্ফীতির মধ্যে এই সামান্য বেতন, যা পূর্ণ বেতনের এক ভগ্নাংশ, দলের অনুগত কর্মীদের মধ্যেও ক্ষোভ বাড়াচ্ছে।
প্রতিবার বেতন তুলতে গেলে আমি স্ত্রী-সন্তানদের বিদায় জানাই। জানি হয়তো আর ফিরে আসব না। কয়েকবার ইসরায়েলি হামলা বেতন বিতরণস্থলে আঘাত করেছে। গাজা শহরের একটি ব্যস্ত বাজারে এমনই এক হামলায় আমি প্রাণে বেঁচেছিলামনাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হামাসের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মীগাজায় ভয়াবহ খাদ্যসংকট চলছে। এ নিয়ে ত্রাণ সংস্থাগুলো ইসরায়েলি অবরোধকে দায়ী করছে। তীব্র অপুষ্টির ঘটনাও বাড়ছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় গাজায় এক কেজি আটা বিক্রি হয়েছে ৮০ ডলারে, যা সর্বকালের সর্বোচ্চ।
গাজায় ব্যাংকিং ব্যবস্থা কার্যত বন্ধ থাকায় এ সামান্য বেতন তুলতেও জটিলতা ও ঝুঁকি রয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী নিয়মিত হামাসের বেতন বিতরণকারীদের নিশানা করে, যাতে সংগঠনটির শাসনক্ষমতা দুর্বল হয়।
পুলিশ থেকে শুরু করে কর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে নিজের বা স্ত্রী-স্বামীর মুঠোফোনে এনক্রিপটেড বার্তা পান। বার্তায় নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে গিয়ে ‘বন্ধুর সঙ্গে চা খাওয়ার’ আহ্বান জানানো হয়।
নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছালে একজন পুরুষ, কখনো নারী গোপনে একটি সিল করা খাম হাতে তুলে দেন, যাতে টাকা থাকে। এরপর কোনো কথা না বলে তিনি সরে পড়েন।
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ করতে না চাওয়া হামাসের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মী নিজের ঝুঁকির অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।
গাজায় ভয়াবহ খাদ্যসংকট চলছে। এ নিয়ে ত্রাণ সংস্থাগুলো ইসরায়েলি অবরোধকে দায়ী করছে। তীব্র অপুষ্টির ঘটনাও বাড়ছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় গাজায় এক কেজি আটা বিক্রি হয়েছে ৮০ ডলারে, যা সর্বকালের সর্বোচ্চ।এই কর্মী বলেন, ‘প্রতিবার বেতন তুলতে গেলে আমি স্ত্রী-সন্তানদের বিদায় জানাই। জানি, হয়তো আর ফিরে আসব না। কয়েকবার ইসরায়েলি হামলা বেতন বিতরণস্থলে আঘাত করেছে। গাজা শহরের একটি ব্যস্ত বাজারে এমনই এক হামলায় আমি প্রাণে বেঁচেছিলাম।’
‘আলা’(প্রকৃত নাম প্রকাশ করা হয়নি) হামাস পরিচালিত সরকারের একজন স্কুলশিক্ষক ও ছয় সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘আমি ১ হাজার শেকেল (প্রায় ৩০০ ডলার) পেয়েছি পুরোনো ও ছেঁড়া নোটে। কোনো ব্যবসায়ী তা নিতে রাজি হননি। মাত্র ২০০ শেকেল (ইসরায়েলি মুদ্রা) ব্যবহারযোগ্য। বাকিগুলো দিয়ে কী করব বুঝতে পারছি না।’
‘দুই-আড়াই মাসের ক্ষুধার পর আমাদের এভাবে ছেঁড়া টাকা দিয়ে বেতন দেওয়া হয়। শিশুদের মুখে খাবার তুলে দিতে আমি প্রায়ই সাহায্য বিতরণকেন্দ্রে যাই, হয়তো কিছু আটা পাব বলে। কখনো পাই, বেশির ভাগ সময়ই খালি হাতে ফিরি’, বলেন আলা।
দুই-আড়াই মাসের ক্ষুধার পর আমাদের এভাবে ছেঁড়া টাকা দিয়ে বেতন দেওয়া হয়। শিশুদের মুখে খাবার তুলে দিতে আমি প্রায়ই সাহায্য বিতরণকেন্দ্রে যাই, হয়তো কিছু আটা পাব বলে। কখনো পাই, বেশির ভাগ সময়ই খালি হাতে ফিরিআলা (ছদ্মনাম), হামাস পরিচালিত সরকারের একজন স্কুলশিক্ষকচলতি বছরের মার্চে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করে, তারা গাজার খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে হামলায় হামাসের আর্থিক বিভাগের প্রধান ইসমাইল বারহুমকে হত্যা করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি হামাসের সামরিক শাখায় তহবিল সরবরাহ করছিলেন।
কীভাবে প্রশাসনিক ও আর্থিক অবকাঠামোর বড় অংশ ধ্বংস হওয়ার পরও হামাস বেতন প্রদানের অর্থ জোগাচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়।
হামাসের আর্থিক কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত ও উচ্চপদে থাকা একজন জ্যেষ্ঠ কর্মী বিবিসিকে জানান, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামলার আগে হামাস গোপন সুড়ঙ্গে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন (৭০ কোটি) ডলার নগদ ও শত শত মিলিয়ন শেকেল মজুত করেছিল। ওই হামলার পর সেদিন থেকেই গাজায় নজিরবিহীন তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।
আরও পড়ুনত্রাণ নিতে গিয়েছিল শিশুটি, চোখে গুলি ছুড়ল ইসরায়েলি সেনারা ০৪ আগস্ট ২০২৫অভিযোগ অনুযায়ী, এই মজুত তদারক করতেন হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার ও তাঁর ভাই মোহাম্মদ। তাঁদের দুজনকেই পরবর্তী সময়ে ইসরায়েলি বাহিনী হত্যা করেছে।
হামাস বহুদিন ধরে গাজায় আমদানি পণ্য ও কর থেকে বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায় করে এসেছে। পাশাপাশি কাতার থেকেও মিলিয়ন ডলারের সহায়তা পেয়েছে।
হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জেদিন আল-কাসাম ব্রিগেডের জন্য আলাদা আর্থিক ব্যবস্থা রয়েছে, যা মূলত ইরান থেকে অর্থায়নকৃত।
বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ইসলামপন্থী সংগঠন মিসরের নিষিদ্ধ মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাঁদের বাজেটের প্রায় ১০ শতাংশ হামাসকে দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুনকঙ্কালসার ইসরায়েলি জিম্মির ভিডিও প্রকাশ করল হামাস০৩ আগস্ট ২০২৫নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছালে একজন পুরুষ, কখনো নারী গোপনে একটি সিল করা খাম হাতে তুলে দেন, যাতে টাকা থাকে। এরপর কোনো কথা না বলে তিনি সরে পড়েন।যুদ্ধ চলাকালীন রাজস্ব জোগাড় করতে হামাস ব্যবসায়ীদের ওপর কর ধার্য করা অব্যাহত রেখেছে এবং সিগারেটের বিশাল মজুত শতগুণ দামে বিক্রি করেছে। যুদ্ধের আগে ২০টি সিগারেটের প্যাকেটের দাম ছিল ৫ ডলার। এখন তা বেড়ে ১৭০ ডলারের বেশি হয়েছে।
নগদ অর্থ প্রদানের পাশাপাশি হামাস তাদের সদস্য ও পরিবারের কাছে খাদ্যসামগ্রীও বিতরণ করেছে স্থানীয় জরুরি কমিটির মাধ্যমে। এসব কমিটির নেতৃত্ব ইসরায়েলি হামলায় নিহত হওয়ার কারণে বারবার পরিবর্তিত হয়েছে।
হামাসের এ পদক্ষেপে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বেড়েছে। গাজার অনেক বাসিন্দা তাদের সমালোচনা করে বলেছেন, তারা শুধু নিজেদের সমর্থকদের কাছে সাহায্য পৌঁছে দিচ্ছে, বাকি জনগণকে বঞ্চিত করছে।
আরও পড়ুনজিম্মিদের কাছে ত্রাণ সরবরাহ করতে প্রস্তুত হামাস, আছে যেসব শর্ত০৪ আগস্ট ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল ব যবস থ র একজন আর থ ক ত কর ছ প রক শ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
দিনমজুর বাদশা মিয়াকে আমাদের সাধুবাদ
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের দিনমজুর বাদশা মিয়া তাঁর এলাকায় ‘গাছের বন্ধু বাদশা’ নামে পরিচিত। এই পরিচয় কোনো সরকারি পদক বা ধনাঢ্য প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি থেকে আসেনি; এসেছে বিগত ২০ বছর ধরে ৩০ হাজারের বেশি গাছ লাগিয়ে। তাঁর এ কাজ প্রমাণ করে, পরিবেশপ্রেম ও নিঃস্বার্থ সামাজিক দায়বদ্ধতা কোনো অর্থ বা ক্ষমতার মুখাপেক্ষী নয়, এটি গভীর মানবিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ।
৭২ বছর বয়সী বাদশা মিয়ার স্লোগান—এক মুঠো ভাত নয়, এক মুঠো অক্সিজেন চাই। আজকের পরিবেশ সংকটের যুগে এক শক্তিশালী দার্শনিক বার্তা। বাদশা মিয়ার গাছ লাগানোর গল্পটি কেবল সবুজায়নের নয়, এটি এক পিতার গভীর আবেগের গল্প। ২০০৪ সালের এক বিকেলে, টাকার অভাবে সন্তানদের আমের আবদার মেটাতে না পারার কষ্ট থেকে তিনি উপলব্ধি করেন, তাঁর মতো গরিব প্রতিবেশীর সন্তানেরাও ফল কিনতে পারে না। সেই ব্যক্তিগত বেদনা থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন—তিনি এমন কিছু করবেন, যা তাঁর নিজের ও দরিদ্র প্রতিবেশীদের সন্তানদের জন্য ফলের অধিকার নিশ্চিত করবে।
এই স্বপ্ন পূরণে বাদশা মিয়ার ত্যাগ ছিল হিমালয়সম। প্রাথমিক পুঁজি জোগাতে তিনি মেয়ের কানের সোনার রিং বিক্রি করে গাছের গোড়ায় খুঁটি দেন। এরপর সিদ্ধান্ত নেন, দিনমজুরি করে যা আয় করবেন, তার চার ভাগের এক ভাগ ব্যয় করবেন চারা লাগানো এবং পরিচর্যার পেছনে। একজন ভূমিহীন দিনমজুরের কাছে আয়ের এক-চতুর্থাংশ মানে জীবনধারণের সঙ্গে সরাসরি আপস করা। এই আত্মত্যাগই প্রমাণ করে, তাঁর কাছে এই গাছগুলো নিছক চারা নয়—গভীর মমতায় লালন করা এগুলো যেন তাঁর সন্তানের মতোই।
বাদশা মিয়ার কাজকে সমাজ প্রথম দিকে মোটেই সহজভাবে নেয়নি। উল্টো গ্রামের কিছু মানুষ তাঁকে ‘পাগল’ বলে উপহাস করেছে। গাছের চারা লাগাতে গিয়ে তিনি মানুষের বাধা পেয়েছেন, তাঁর লাগানো গাছ উপড়ে ফেলা হয়েছে এবং একপর্যায়ে তাঁকে মারধরও করা হয়েছে। কিন্তু সেই সমাজের মানুষই এখন বাদশা মিয়ার দীর্ঘ ত্যাগ ও পরিশ্রমের সুফল ভোগ করছে।
বাদশা মিয়ার এই উদ্যোগ কেবল একটি স্থানীয় গল্প নয়, এটি সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি শিক্ষা। কোটি কোটি টাকার বন সৃজন প্রকল্প যেখানে অনেক সময় লোকদেখানো বা অপচয়ের শিকার হয়, সেখানে একজন দিনমজুর দেখিয়ে দিলেন, ভালোবাসা ও সদিচ্ছা থাকলে সামান্য সম্পদ দিয়েই পরিবেশবিপ্লব ঘটানো সম্ভব।
উপজেলা প্রশাসন বাদশা মিয়াকে পুরস্কৃত করেছে, যা প্রশংসনীয়। আমরা আশা করব, স্থানীয় বন বিভাগ ও কৃষি বিভাগ বাদশাকে গাছ লাগানোর কাজে স্থায়ীভাবে সহযোগিতা করবে। বাদশা মিয়ারা আমাদের অনুপ্রেরণা। তাঁর প্রতি আমাদের অভিবাদন।