দাওয়াতের ভাষা হবে মিষ্টি ও সুন্দর
Published: 1st, October 2025 GMT
দাওয়াত মানে ডাকা বা আহ্বান করা। মানুষকে আল্লাহর পথে ডেকে আনা, দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তির দিকে আহ্বান করাই এর মূল উদ্দেশ্য। এটি কেবল একটি ধারণা নয়; বরং প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব ও কাজ।
যেমন ডাক্তারি বিদ্যা ছাড়া চিকিৎসা করলে রোগীর প্রাণহানি হতে পারে, তেমনি দাওয়াতের জ্ঞান ছাড়া ময়দানে নামলে মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
ভরা মজলিশে অশালীন ভাষা ব্যবহার বা কটু কথা বলা দাওয়াতের সঠিক পদ্ধতি নয়। এতে সাধারণ মুসলমান, বিশেষত কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণেরা ইসলাম ও আলেমদের থেকে দূরে সরে যেতে পারেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইসলামবিদ্বেষীরা সরল মুসলমানদের ইমান নিয়ে খেলতে পারে এবং নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে।
‘আপনার প্রভুর পথে দাওয়াত দিন জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সুন্দর নীতিসম্পন্ন উপদেশ দিয়ে। তাদের সঙ্গে বিতর্ক করো এমনভাবে, যা সবচেয়ে সুন্দর।সুরা নাহল, আয়াত: ১২৫আরও পড়ুননারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কী বলে ইসলাম২৮ আগস্ট ২০২৫পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা আমাদের দাওয়াতের পদ্ধতি স্পষ্টভাবে শিখিয়েছেন, ‘আপনার প্রভুর পথে দাওয়াত দিন জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সুন্দর নীতিসম্পন্ন উপদেশ দিয়ে। তাদের সঙ্গে বিতর্ক করো এমনভাবে, যা সবচেয়ে সুন্দর।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ১২৫)
এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, দাওয়াত মানে কেবল আহ্বান নয়; বরং শালীন, সদয় ও প্রজ্ঞাপূর্ণ ভাষায় মানুষকে আল্লাহর পথে আনা। ঝগড়া বা কটু ভাষার পরিবর্তে সৌজন্য ও সদাচার দাওয়াতকে কার্যকর করে।
রাসুল (সা.
হাদিসে তিনি বলেছেন, ‘সহজ করে দাও, কঠিন করো না। সুসংবাদ দাও, ভয় দেখিয়ে মানুষকে দূরে সরিও না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৯; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৭৩৪)
আরও পড়ুননিজেকে অযোগ্য মনে হলে ইসলাম কী বলে১৭ আগস্ট ২০২৫সহজ করে দাও, কঠিন করো না। সুসংবাদ দাও, ভয় দেখিয়ে মানুষকে দূরে সরিও না।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৯এ হাদিসে দাওয়াত ও শিক্ষা প্রদানের মূলনীতি শেখানো হয়েছে। মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতে হবে সহজ ও বোধগম্য ভাষায়, যাতে তারা আকৃষ্ট হয়। কঠোরতা, জটিল নিয়ম বা ভয় দেখিয়ে কাউকে দূরে ঠেলে দেওয়া ইসলামের শিক্ষা নয়। ভালোবাসা, দয়া ও আশার বার্তাই সফল দাওয়াতের প্রকৃত পথ।
আমাদের দাওয়াতি মজলিশ হোক ভালোবাসা ও প্রজ্ঞার আলোকধারা, যেখানে ছড়িয়ে পড়বে সহনশীলতা ও সৌজন্য, হিংসা-বিদ্বেষের কোনো ছাপ থাকবে না। কোমল ও মমতাভরা আহ্বানে মানুষ আকৃষ্ট হবে, হৃদয় উন্মুক্ত হবে আল্লাহর স্মরণে।
আসুন আমরা এমন দাওয়াতের পরিবেশ গড়ে তুলি, যাতে আমাদের ভালোবাসার পরশে দূরে সরে যাওয়া মানুষেরাও ফিরে আসে প্রতিপালকের পথে, ইসলামের পথে।
শাব্বির আহমাদ খান: শিক্ষার্থী, আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া মাখজানুল উলুম খিলগাঁও, ঢাকা।
আরও পড়ুনউপহার দেওয়া সম্পর্কে ইসলাম১৩ আগস্ট ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আহ ব ন আল ল হ আম দ র স ন দর ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
ঐহিক অমরতায় রণদা প্রসাদ সাহা
দানবীর রণদা প্রসাদ সাহাকে তাঁর গ্রামের ছোট–বড় সবাই ডাকে জেঠামনি। অবিভক্ত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া উপাধি ছিল রায়বাহাদুর। সে নামেও তাঁকে ডাকতেন অনেকে। কিন্তু তিনি সেই অভিজাত সম্বোধন পছন্দ করতেন না। তবে আর পি সাহা নামটিই ছিল সাধারণের মধ্যে অধিক পরিচিত। দাতা বা দানবীর এই মানুষটি মির্জাপুরবাসীর কাছে আজও জেঠামনি হিসেবেই যেন ঘরের মানুষ, প্রাণের ভালোবাসার মানুষটি। এক উচ্চতর মূল্যবোধের অধিকারী, বিস্ময়কর রকম শক্তিমান মানুষ ছিলেন দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা। তাঁর প্রাণশক্তি, শ্রমশক্তি ও চিন্তাশক্তি ছিল বিস্ময়কর। আর বোধের জায়গাটিতে—মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করাকে তিনি মানবীয় কর্তব্য মনে করতেন। পৃথিবীকে সবার জন্য সুখকর করে তোলা সম্ভব এই বিশ্বাসেই তিনি জনহিতকর কাজ করে যেতেন অক্লান্তভাবে। এই ব্রত থেকেই লাভ করেছিলেন ‘দানবীর’ অভিধা। তাঁর কীর্তির চেয়ে অনেক বড় ছিলেন তিনি।
রণদা প্রসাদ সাহার জন্ম ১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর, টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা নারায়ণগঞ্জের কুমুদিনী কম্পাউন্ড থেকে পুত্র ভবানী প্রসাদসহ তাঁকে রাতের গভীরে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তারপর তাঁদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি। ৭৪ বছরের কর্মময় জীবন রণদা প্রসাদ সাহার।
মির্জাপুর তখন একেবারেই অজপাড়াগাঁ। পিতা দেবেন্দ্র সাহার নির্দিষ্ট কোনো পেশা ছিল না। রুটিরুজির সন্ধানে বারবার তাঁকে পেশা বদল করতে হয়েছে। বেশির ভাগ সময়ে দলিল লেখকের কাজ করেছেন তিনি।
প্রসবকালে ধনুষ্টঙ্কারে অকালে মারা যান মা কুমুদিনী দেবী। তিনি রোগশয্যায় না পেয়েছেন এতটুকু ওষুধ-পথ্য, না পেয়েছেন সেবাযত্ন। শৈশবের এই অসহ্য স্মৃতি রণদা প্রসাদকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এমনভাবে যে পরবর্তীকালে তাঁকে তা একজন সেবকে পরিণত করেছিল। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুস্থ মানুষের সেবাপ্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী’।ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অতুলনীয় মাতৃভক্তির কথা আমরা সবাই জানি। রণদা প্রসাদ বিদ্যাসাগরের মতো মাতৃভক্তি দেখানোর সুযোগ পাননি। তিনি মাকে হারান মাত্র সাত বছর বয়সে। মায়ের স্নেহের আঁচল জড়িয়ে ধরতে না ধরতে তিনি বিদায় নেন। অভাবের সংসারে প্রসূতি মায়ের যত্ন দূরে থাকুক, উপযুক্ত আহারই সময়মতো জোটেনি। চিকিৎসার জন্য সারা গ্রাম খুঁজে একজন ডাক্তারও সেদিন মেলেনি কিংবা অর্থাভাবে কোনো ডাক্তার আনা যায়নি। প্রসবকালে ধনুষ্টঙ্কারে অকালে মারা যান মা কুমুদিনী দেবী। তিনি রোগশয্যায় না পেয়েছেন এতটুকু ওষুধ-পথ্য, না পেয়েছেন সেবাযত্ন। অশৌচের অসিলায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুই ছিল তখনকার দিনে মেয়েদের এক মর্মান্তিক নিয়তি। মায়ের এই মৃত্যুদৃশ্যের নীরব দর্শক ছিল সাত বছরের অবোধ বালক রণদা প্রসাদ। শৈশবের এই অসহ্য স্মৃতি রণদা প্রসাদের নিদ্রা-জাগরণের প্রতিটি মুহূর্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এমনভাবে যে পরবর্তীকালে তাঁকে তা একজন সেবকে পরিণত করেছিল। নিজের মায়ের জীবন দেখে তিনি নারী জীবনের অসহায়ত্ব উপলব্ধি করেন এবং নারী জাতির কল্যাণ্যে কিছু করার সংকল্প গ্রহণ করেন। সামর্থ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দুঃখ-স্মৃতিকে রূপ দিয়েছিলেন দুস্থ মানুষের সেবাপ্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী’তে—স্থাপন করেছিলেন মাতৃভক্তির এক অনন্য নজির।
রণদা প্রসাদ সাহা কোলাজ