Prothomalo:
2025-10-04@08:46:04 GMT

বুয়েটের গল্প, জীবনের গল্প

Published: 4th, October 2025 GMT

১৯৬৮ সালে আমি ছাত্র হিসেবে বুয়েটে পা রাখি। তখন এর নাম ছিল ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি। বছর পাঁচেক পর সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের সমাপ্তি ঘটে ২০১৬ সালে। মাঝে পিএইচডি করতে গিয়েছিলাম যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এই দীর্ঘ পথচলার প্রতিটি মোড়ে ছিল আনন্দ, সংগ্রাম, ত্যাগ আর অমূল্য স্মৃতি। তবে বুয়েটে শিক্ষকতার মধ্যে ছুটি নিয়ে কখনো মালয়েশিয়ার মাল্টিমিডিয়া ইউনিভার্সিটি, কখনো সৌদি আরবের দাহরানের কেএফইউপিএম, আবার কখনো যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্কসন ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছি।

পড়াশোনার সময়ই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। আমার ঘনিষ্ঠ সহপাঠী বুলবুল প্রায়ই বলত, ‘একদিন দেশ স্বাধীন হবে; তোরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসবি, কিন্তু তখন আমাকে আর পাবি না।’

কথাগুলো যেন ভবিষ্যদ্বাণীর মতোই সত্যি হলো। দেশ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হলো, কিন্তু প্রিয় বন্ধুটি আর ফিরে এল না।

এখন ভাবি, দেশের সমস্যাগুলো নিয়েও কাজ করা উচিত ছিল। পরে উপলব্ধি করেছি, গবেষণাই শেষ কথা নয়; শিক্ষকের দায়িত্ব আরও বড়। তাই উচ্চশিক্ষা, পাঠদানপদ্ধতি আর গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি—কীভাবে তারা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে, সে চিন্তা নিয়েই।

আমার ব্যক্তিগত জীবনেও এই ইতিহাসের ছাপ রয়েছে; সহধর্মিণীর বাবা, শহীদ বুদ্ধিজীবী এস এম এ রাশীদুল হাসান—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক—তাঁর আত্মত্যাগও সেই ইতিহাসেরই অংশ।

সময় বদলেছে, বুয়েটও বদলেছে। ৬টি স্নাতক প্রোগ্রাম নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠান আজ ১২টি স্নাতক প্রোগ্রামে পৌঁছেছে। ছাত্রসংখ্যা বেড়ে ৬৫০ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় হাজারে দাঁড়িয়েছে। তবে গ্র্যাজুয়েট ও পিএইচডি প্রোগ্রাম এখনো তেমন শক্ত ভিত গড়তে পারেনি। শত শত মেধাবী শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও বুয়েট আজও মূলত একটি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেই পরিচিত। প্রশ্ন থেকে যায়, এসব পরিবর্তন কি সমাজের চাহিদা পূরণ করতে পেরেছে? স্লাইড রুল থেকে ক্যালকুলেটর, তারপর কম্পিউটার-প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু পাঠদানের ধরন প্রায় অপরিবর্তিত—লেকচারভিত্তিক শিক্ষা আর মুখস্থের ওপর নির্ভরশীল একটি পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন। বুয়েটকেও সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে।

লিখতে বসলে কিছু টুকরা স্মৃতি ভেসে ওঠে। যেখানে এখন বুয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেখানে ছিল একটি পুরোনো দোতলা ভবন—আমাদের ক্লাব। একদিন এক সিনিয়র স্যার নীরবে নিচতলার কোণে বসে ছিলেন। আমরা তরুণ শিক্ষকেরা লনে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ একজন ফিসফিস করে বলল, ‘স্যার বউয়ের ধমক খেয়ে সকাল সকাল ক্লাবে চলে এসেছেন। ভালোই হয়েছে, ক্লাসে আমাদের কত না জ্বালাতেন!’

চাকরিজীবনে গবেষণায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। পুরস্কারও পেয়েছি—বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স গোল্ড মেডেল, চারবার ইউজিসি বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড আর আইইবি গোল্ড মেডেল।

আমি তখন নজরুল ইসলাম হলের প্রভোস্ট। একদিন এক ছাত্র এসে অভিযোগ করল, পাশের রুমে কেউ জোরে রেডিও শোনায় তার পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে। আমি তাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেশী ছাত্রকে সতর্ক করলাম। কয়েক দিন পর প্রভোস্টের কক্ষে বসে হঠাৎ শুনি দেয়ালে বল মারার শব্দ। গিয়ে দেখি, অভিযোগকারী ছাত্রটিই আসলে খেলায় মগ্ন। ডেকে বললাম, ‘তোমার সিট বাতিল করা হলো; এক ঘণ্টার মধ্যে হল ছাড়ো।’ পরে অনেক কাকুতি-মিনতির পর অন্য হলে তার থাকার ব্যবস্থা করেছিলাম। যখন আবরার হত্যার রোমহর্ষ কাহিনি পত্রিকায় পড়লাম, অজান্তে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, এ যেন আর আগের বুয়েট নয়।

চাকরিজীবনে গবেষণায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। পুরস্কারও পেয়েছি—বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স গোল্ড মেডেল, চারবার ইউজিসি বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড আর আইইবি গোল্ড মেডেল। কিন্তু এখন ভাবি, দেশের সমস্যাগুলো নিয়েও কাজ করা উচিত ছিল। পরে উপলব্ধি করেছি, গবেষণাই শেষ কথা নয়; শিক্ষকের দায়িত্ব আরও বড়। তাই উচ্চশিক্ষা, পাঠদানপদ্ধতি আর গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি—কীভাবে তারা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে, সে চিন্তা নিয়েই।

করোনার সময়ে ঘরে থেকেই লেখালেখির দিকে ঝুঁকে পড়ি। আমার প্রথম ম্যানুস্ক্রিপ্ট ‘প্রশ্ন’ নিয়ে নিউইয়র্কভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন শিল্পাঙ্গন একটি আলেখ্য তৈরি করে। সেখানে কণ্ঠ দেন নাট্যাঙ্গনের পরিচিত মুখ আফরোজা বানু। এরপর একে একে তৈরি হয় ‘ছিন্ন পাতা’, ‘পথের শেষ’, ‘নমি তোমারে’, ‘হে ত্যাগী হে গুণী’, ‘ভাবনা’ ইত্যাদি। নাট্যব্যক্তিত্ব শিরীন বকুল, আবৃত্তিকার লুৎফুন্নাহার প্রমুখও এতে যুক্ত হন। এখন আমি কাজ করছি ‘ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া’ শিরোনামে নতুন আলেখ্য নিয়ে, যেখানে সুপরিচিত নাট্যব্যক্তিত্ব খায়রুল আলম কয়েকটি পর্বে বর্ণনা করবেন। ঢাকা থেকেই আমি স্ক্রিপ্ট নিউইয়র্কে পাঠিয়ে দিই।

সন্ধ্যার অস্তগামী সূর্য বিদায়ক্ষণে সারা আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে দেয়। সূর্যটা আবার সকালে অন্য রূপে ফিরে আসবে বলে এই ক্ষণিকের তরে হারাতে তার ভালোই লাগে। কিন্তু মানুষের জীবনে ফিরে আসা নেই। তাই পড়ন্ত বেলায় অতীতের স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরি। ভাবি, হয়তো কিছু ভালো করেছি, হয়তো এভাবেই মনকে সান্ত্বনা দেওয়া যায়।

এম এম শহিদুল হাসান, সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

নিউইয়র্ক সফর শেষে দেশে ফিরেছেন প্রধান উপদেষ্টা

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগদান শেষে নিউইয়র্ক থেকে আজ বৃহস্পতিবার সকালে দেশে ফিরেছেন।

নয় দিনের নিউইয়র্ক সফর শেষে প্রধান উপদেষ্টা দেশে ফিরলেন। এমিরেটস এয়ারলাইনসের একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইট প্রধান উপদেষ্টা ও তাঁর সফরসঙ্গীদের নিয়ে আজ সকাল ৯টায় ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বাসসকে এই তথ্য জানান।

এর আগে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার রাত ১১টা ১০ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টা ও তাঁর সফরসঙ্গীরা যুক্তরাষ্ট্রের জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি সালাহউদ্দিন নোমান চৌধুরী ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তারেক এমদাদ আরিফুল ইসলাম বিমানবন্দরে প্রধান উপদেষ্টাকে বিদায় জানান।

সফরকালে গত ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা। ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি জাতিসংঘ সদর দপ্তরে আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা মুসলিম ও মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘুর পরিস্থিতিবিষয়ক’ উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনের উদ্বোধনী সম্মেলনে বক্তব্য দেন।

২৯ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁর অবস্থান করা হোটেলে সাক্ষাৎ করেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপো গ্রান্ডি। একই দিন জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশ, স্থলবেষ্টিত উন্নয়নশীল দেশ এবং ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রপুঞ্জবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল রাবাব ফাতিমাও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

নিউইয়র্ক সফরে মুহাম্মদ ইউনূস মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া সংবর্ধনায় যোগ দেন। তিনি ট্রাম্পকে সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।

এ ছাড়া মুহাম্মদ ইউনূস নেদারল্যান্ডস, পাকিস্তান, ভুটান, কসোভোসহ বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র-সরকারপ্রধানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন।

প্রধান উপদেষ্টা গত ২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সাংবাদিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ, বিমানবন্দরে আখতার-জারার সংবাদ সম্মেলন বর্জন
  • নিউইয়র্ক সফর শেষে দেশে ফিরেছেন প্রধান উপদেষ্টা