Prothomalo:
2025-11-19@07:29:11 GMT

বুয়েটের গল্প, জীবনের গল্প

Published: 4th, October 2025 GMT

১৯৬৮ সালে আমি ছাত্র হিসেবে বুয়েটে পা রাখি। তখন এর নাম ছিল ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি। বছর পাঁচেক পর সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের সমাপ্তি ঘটে ২০১৬ সালে। মাঝে পিএইচডি করতে গিয়েছিলাম যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এই দীর্ঘ পথচলার প্রতিটি মোড়ে ছিল আনন্দ, সংগ্রাম, ত্যাগ আর অমূল্য স্মৃতি। তবে বুয়েটে শিক্ষকতার মধ্যে ছুটি নিয়ে কখনো মালয়েশিয়ার মাল্টিমিডিয়া ইউনিভার্সিটি, কখনো সৌদি আরবের দাহরানের কেএফইউপিএম, আবার কখনো যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্কসন ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছি।

পড়াশোনার সময়ই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। আমার ঘনিষ্ঠ সহপাঠী বুলবুল প্রায়ই বলত, ‘একদিন দেশ স্বাধীন হবে; তোরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসবি, কিন্তু তখন আমাকে আর পাবি না।’

কথাগুলো যেন ভবিষ্যদ্বাণীর মতোই সত্যি হলো। দেশ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হলো, কিন্তু প্রিয় বন্ধুটি আর ফিরে এল না।

এখন ভাবি, দেশের সমস্যাগুলো নিয়েও কাজ করা উচিত ছিল। পরে উপলব্ধি করেছি, গবেষণাই শেষ কথা নয়; শিক্ষকের দায়িত্ব আরও বড়। তাই উচ্চশিক্ষা, পাঠদানপদ্ধতি আর গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি—কীভাবে তারা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে, সে চিন্তা নিয়েই।

আমার ব্যক্তিগত জীবনেও এই ইতিহাসের ছাপ রয়েছে; সহধর্মিণীর বাবা, শহীদ বুদ্ধিজীবী এস এম এ রাশীদুল হাসান—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক—তাঁর আত্মত্যাগও সেই ইতিহাসেরই অংশ।

সময় বদলেছে, বুয়েটও বদলেছে। ৬টি স্নাতক প্রোগ্রাম নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠান আজ ১২টি স্নাতক প্রোগ্রামে পৌঁছেছে। ছাত্রসংখ্যা বেড়ে ৬৫০ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় হাজারে দাঁড়িয়েছে। তবে গ্র্যাজুয়েট ও পিএইচডি প্রোগ্রাম এখনো তেমন শক্ত ভিত গড়তে পারেনি। শত শত মেধাবী শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও বুয়েট আজও মূলত একটি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেই পরিচিত। প্রশ্ন থেকে যায়, এসব পরিবর্তন কি সমাজের চাহিদা পূরণ করতে পেরেছে? স্লাইড রুল থেকে ক্যালকুলেটর, তারপর কম্পিউটার-প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু পাঠদানের ধরন প্রায় অপরিবর্তিত—লেকচারভিত্তিক শিক্ষা আর মুখস্থের ওপর নির্ভরশীল একটি পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন। বুয়েটকেও সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে।

লিখতে বসলে কিছু টুকরা স্মৃতি ভেসে ওঠে। যেখানে এখন বুয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেখানে ছিল একটি পুরোনো দোতলা ভবন—আমাদের ক্লাব। একদিন এক সিনিয়র স্যার নীরবে নিচতলার কোণে বসে ছিলেন। আমরা তরুণ শিক্ষকেরা লনে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ একজন ফিসফিস করে বলল, ‘স্যার বউয়ের ধমক খেয়ে সকাল সকাল ক্লাবে চলে এসেছেন। ভালোই হয়েছে, ক্লাসে আমাদের কত না জ্বালাতেন!’

চাকরিজীবনে গবেষণায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। পুরস্কারও পেয়েছি—বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স গোল্ড মেডেল, চারবার ইউজিসি বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড আর আইইবি গোল্ড মেডেল।

আমি তখন নজরুল ইসলাম হলের প্রভোস্ট। একদিন এক ছাত্র এসে অভিযোগ করল, পাশের রুমে কেউ জোরে রেডিও শোনায় তার পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে। আমি তাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেশী ছাত্রকে সতর্ক করলাম। কয়েক দিন পর প্রভোস্টের কক্ষে বসে হঠাৎ শুনি দেয়ালে বল মারার শব্দ। গিয়ে দেখি, অভিযোগকারী ছাত্রটিই আসলে খেলায় মগ্ন। ডেকে বললাম, ‘তোমার সিট বাতিল করা হলো; এক ঘণ্টার মধ্যে হল ছাড়ো।’ পরে অনেক কাকুতি-মিনতির পর অন্য হলে তার থাকার ব্যবস্থা করেছিলাম। যখন আবরার হত্যার রোমহর্ষ কাহিনি পত্রিকায় পড়লাম, অজান্তে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, এ যেন আর আগের বুয়েট নয়।

চাকরিজীবনে গবেষণায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। পুরস্কারও পেয়েছি—বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স গোল্ড মেডেল, চারবার ইউজিসি বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড আর আইইবি গোল্ড মেডেল। কিন্তু এখন ভাবি, দেশের সমস্যাগুলো নিয়েও কাজ করা উচিত ছিল। পরে উপলব্ধি করেছি, গবেষণাই শেষ কথা নয়; শিক্ষকের দায়িত্ব আরও বড়। তাই উচ্চশিক্ষা, পাঠদানপদ্ধতি আর গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি—কীভাবে তারা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে, সে চিন্তা নিয়েই।

করোনার সময়ে ঘরে থেকেই লেখালেখির দিকে ঝুঁকে পড়ি। আমার প্রথম ম্যানুস্ক্রিপ্ট ‘প্রশ্ন’ নিয়ে নিউইয়র্কভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন শিল্পাঙ্গন একটি আলেখ্য তৈরি করে। সেখানে কণ্ঠ দেন নাট্যাঙ্গনের পরিচিত মুখ আফরোজা বানু। এরপর একে একে তৈরি হয় ‘ছিন্ন পাতা’, ‘পথের শেষ’, ‘নমি তোমারে’, ‘হে ত্যাগী হে গুণী’, ‘ভাবনা’ ইত্যাদি। নাট্যব্যক্তিত্ব শিরীন বকুল, আবৃত্তিকার লুৎফুন্নাহার প্রমুখও এতে যুক্ত হন। এখন আমি কাজ করছি ‘ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া’ শিরোনামে নতুন আলেখ্য নিয়ে, যেখানে সুপরিচিত নাট্যব্যক্তিত্ব খায়রুল আলম কয়েকটি পর্বে বর্ণনা করবেন। ঢাকা থেকেই আমি স্ক্রিপ্ট নিউইয়র্কে পাঠিয়ে দিই।

সন্ধ্যার অস্তগামী সূর্য বিদায়ক্ষণে সারা আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে দেয়। সূর্যটা আবার সকালে অন্য রূপে ফিরে আসবে বলে এই ক্ষণিকের তরে হারাতে তার ভালোই লাগে। কিন্তু মানুষের জীবনে ফিরে আসা নেই। তাই পড়ন্ত বেলায় অতীতের স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরি। ভাবি, হয়তো কিছু ভালো করেছি, হয়তো এভাবেই মনকে সান্ত্বনা দেওয়া যায়।

এম এম শহিদুল হাসান, সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

ক্লাউডফ্লেয়ারের নেটওয়ার্কে বিপর্যয় এক্স, চ্যাটজিপিটিসহ সারা বিশ্বের ইন্টারনেটের সেবায় বিঘ্ন

ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা ও ইন্টারনেট ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য পরিচিত প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান ক্লাউডফ্লেয়ার জানিয়েছে, তাদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে সমস্যা দেখা দেওয়ায় বিশ্বের নানা দেশে ওয়েবসাইট ও অ্যাপ ব্যবহারে বিঘ্ন ঘটেছে। ক্লাউডফ্লেয়ারের সমস্যার কারণে এক্স (সাবেক টুইটার), অনলাইন গেম ‘লিগ অব লেজেন্ডস’, স্পটিফাই, ক্যানভা, গ্রাইন্ডার অ্যামাজন, চ্যাটজিপিটিসহ একাধিক অনলাইন সেবায় বিঘ্ন দেখা দেয় বলে জানিয়েছে ডাউনডিটেক্টর নামের অনলাইন ট্র্যাকার।

ক্লাউডফ্লেয়ারের এই ত্রুটির কারণে বিশ্বের ২০ শতাংশ ওয়েবসাইট বন্ধ (ডাউন) হয়ে যায়। বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদ পোর্টালসহ অনেক ওয়েবসাইটেও সমস্যা হচ্ছিল। বাংলাদেশের অসংখ্য ওয়েবসাইট বন্ধ হয়ে যায়। এসব প্ল্যাটফর্মে বিপুলসংখ্যক ব্যবহারকারী প্রবেশ করতে না পারায় ডাউনডিটেক্টরে অভিযোগ জমা পড়ে। ডাউনডিটেক্টর জানায়, ক্লাউডফ্লেয়ার–বিষয়ক অভিযোগ নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় সকাল আটটার দিকে প্রায় ৬০০–এ নেমে আসে। শুরুর দিকে অভিযোগ প্রায় পাঁচ হাজারে পৌঁছেছিল। ব্যবহারকারীদের জমা দেওয়া প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয় বলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা আরও বেশি বা কম হতে পারে।

নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় সকাল সাতটার কিছু আগে প্রকাশিত এক স্ট্যাটাস হালনাগাদে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ‘ক্লাউডফ্লেয়ার সম্ভাব্যভাবে বহু গ্রাহককে প্রভাবিত করতে পারে, এমন একটি সমস্যার বিষয়ে অবগত রয়েছে এবং তা তদন্ত করছে। আমরা পুরো বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করছি এবং দ্রুত সমস্যার সমাধানে কাজ করছি।’

প্রায় ২০ মিনিট পর দেওয়া আরেকটি হালনাগাদে ক্লাউডফ্লেয়ার জানায়, পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে সমস্যার উৎস এখনো তদন্তাধীন। নিউইয়র্ক সময় সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, তাদের কয়েকটি সেবায় ত্রুটির হার ‘আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে’, অন্য সেবাগুলো স্বাভাবিক করতে কাজ চলছে। ক্লাউডফ্লেয়ার সাইবার আক্রমণ ঠেকাতে ও ওয়েবসাইটের কনটেন্ট দ্রুত লোড করতে সহায়ক নানা সেবা দেয়। এক্স ও চ্যাটজিপিটি নির্মাতা ওপেনএআই এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য জানায়নি।

ইন্টারনেট সেবায় সাম্প্রতিক সময়ে একাধিকবার বড় ধরনের বিঘ্ন দেখা গেছে। গত মাসেও মাইক্রোসফট অ্যাজুরে ত্রুটি দেখা দেয়। এর আগে গত অক্টোবরে অ্যামাজনের ওয়েব সার্ভিসের সেবায় সমস্যা দেখা দিলে স্ন্যাপচ্যাট, রেডিটসহ হাজার হাজার ওয়েবসাইট ও জনপ্রিয় অ্যাপের সেবা বিশ্বজুড়ে ব্যাহত হয়। তখন অনেক অনলাইন সেবা বেশ কয়েক ঘণ্টা বন্ধ ছিল।

বিজনেস ইনসাইডারকে দেওয়া এক বিবৃতিতে ক্লাউডফ্লেয়ারের এক মুখপাত্র জানান, সকাল ৬টা ২০ মিনিটে তাদের একটি সেবায় ‘অস্বাভাবিক ট্রাফিক’ শনাক্ত করা হয়। তিনি বলেন, ‘এ অস্বাভাবিক ট্রাফিকের কারণ আমরা এখনো জানি না। তবে সব ধরনের ট্রাফিক যেন কোনো ত্রুটি ছাড়াই সার্ভ করা যায়, সে জন্য পূর্ণ সক্ষমতা দিয়ে কাজ চলছে। এরপর এ অস্বাভাবিক ট্রাফিকের কারণ অনুসন্ধানে মনোযোগ দেওয়া হবে।’

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, রয়টার্স, বিজনেস ইনসাইডার, দ্য গার্ডিয়ান

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ক্লাউডফ্লেয়ারের নেটওয়ার্কে বিপর্যয় এক্স, চ্যাটজিপিটিসহ সারা বিশ্বের ইন্টারনেটের সেবায় বিঘ্ন