‘পাহাড় যখন মেঘের মতো চলতে থাকবে’
Published: 4th, October 2025 GMT
কোরআনের আয়াত আমাদের জন্য প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের জানালাও বটে। সুরা নামলের ৮৮ নম্বর আয়াতটি তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ: ‘আর তুমি পাহাড়সমূকে দেখছ, সেগুলোকে তুমি স্থির মনে করছ। অথচ তা মেঘমালার ন্যায় চলতে থাকবে। (এটা) আল্লাহর কাজ, যিনি সবকিছু দৃঢ়ভাবে করেছেন। নিশ্চয় তোমরা যা করো, তিনি সে সম্পর্কে বিশেষভাবে অবহিত।’ (সুরা নামল, আয়াত: ৮৮)
আয়াতটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুফাসসির ও আলিমদের মনে প্রশ্ন জাগিয়েছে। কেউ বলেছেন এটি কিয়ামতের দৃশ্য, কেউ বলেছেন এটি পৃথিবীর গতিশীলতার ইঙ্গিত। আজকের বিজ্ঞানের আলোয় এটি পৃথিবীর গতি ও পাহাড়ের স্থিতিশীলতার এক অসাধারণ বর্ণনা বলে মনে হয়।
আর তুমি পাহাড়সমূকে দেখছ, সেগুলোকে তুমি স্থির মনে করছ। অথচ তা মেঘমালার ন্যায় চলতে থাকবে। (এটা) আল্লাহর কাজ, যিনি সবকিছু দৃঢ়ভাবে করেছেন।সুরা নামল, আয়াত: ৮৮আয়াতের পটভূমি: কিয়ামত, না পৃথিবীকোরআনের আয়াতটি সুরা নামলের শেষভাগে এসেছে, যা মানুষকে আল্লাহর নিদর্শনের দিকে ডাকে। আয়াতের আগের অংশে কিয়ামতের উল্লেখ আছে: ‘আর যেদিন শিঙায় ফোঁকা হবে, তখন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সবাই ভয়ভীত হয়ে যাবে, আল্লাহ যাকে চান তা ছাড়া।’ (সুরা নামল, আয়াত: ৮৭)
এই পটভূমিতে প্রাচীন মুফাসসিরগণ বলেছেন, আয়াতটি কিয়ামতের দৃশ্য বর্ণনা করছে। ইবনে কাসির এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে কিয়ামতে পাহাড়গুলোকে স্থির মনে হলেও তা মেঘের মতো চলে যাবে, যেমন সুরা তুরের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যেদিন আকাশ চলমান মেঘের মতো চলবে এবং পাহাড়গুলো চলমান নদীর মতো চলবে’ (সুরা তুর, আয়াত: ৯-১০)। (ইসমাইল ইবনে কাসির, তাফসিরুল কোরআনিল আজিম, ৬/২১৭, দার তাইবা, সৌদি আরব, ১৯৯৯ খ্রি.
ইবনে কাসির আরও উল্লেখ করেছেন সুরা ত্বহার আয়াত: ‘আর তারা তোমাকে পাহাড় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, বলো, আমার প্রতিপালক তা বাতাসে উড়িয়ে দেবেন এবং এটাকে সমতল ময়দান করে রাখবেন, যাতে তুমি এতে কোনো অসমতলতা বা উঁচু-নিচু দেখবে না।’ (সুরা ত্বহা, আয়াত: ১০৫-১০৭)
এ ছাড়া সুরা কাহফের আয়াতও উল্লেখ করেছেন: ‘আর যেদিন আমরা পাহাড়গুলোকে চালিয়ে দেব এবং তুমি পৃথিবীকে উন্মুক্ত দেখবে।’ (সুরা কাহফ, আয়াত: ৪৭)
এই ব্যাখ্যায় পাহাড়ের গতি কিয়ামতের ভয়াবহতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছে, যা মানুষকে আখিরাতের প্রতি সতর্ক করে।
আরও পড়ুনকোরআনের অনুপ্রেরণাদায়ী কয়েকটি আয়াত০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫কিন্তু এই ব্যাখ্যা সবাই মেনে নেননি। আধুনিক মুফাসসির ও আলিমরা বলেন, আয়াতটি পৃথিবীর দৃশ্য বর্ণনা করছে। এটি পৃথিবীর গতি ও তার চারপাশে ঘুরে বেড়ানোর ইঙ্গিত দেয়, যা নবীজির সময়ে অজানা ছিল। পাহাড়গুলোকে স্থির মনে হয়, কিন্তু আসলে তা পৃথিবীর সঙ্গে মেঘের মতো চলমান।
এই ব্যাখ্যা আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে এবং নিজের অক্ষে ঘোরে। মুহাম্মাদ জামালুদ্দিন আল-কাসিমি বলেছেন, এই আয়াত স্পষ্টভাবে পৃথিবীর গতির ইঙ্গিত দেয় এবং এটিকে কিয়ামতের সঙ্গে যুক্ত করা যায় না, কারণ কিয়ামতে বিশ্বের স্বাভাবিক নিয়ম ভঙ্গ হয়ে যাবে। (মুহাম্মাদ জামালুদ্দিন আল-কাসিমি, মাহাসিনুত তাওয়িল, ৭/৫০৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত)
বিজ্ঞানে কোরআনের অলৌকিকতাপ্রাচীন মুফাসসিরদের ব্যাখ্যা যতটা কিয়ামতকেন্দ্রিক, আধুনিক আলেমগণ ততটা বিজ্ঞানকেন্দ্রিক। তাঁরা বলেন, আয়াতটি পৃথিবীর গতির এক অলৌকিক বর্ণনা। আমরা পাহাড়গুলোকে স্থির মনে করি, কারণ আমরা পৃথিবীর গতি অনুভব করি না। কিন্তু বাস্তবে পাহাড়গুলো পৃথিবীর সঙ্গে মেঘের মতো চলমান। এই উপমা অসাধারণ, কারণ মেঘ নিজে থেকে চলে না, বাতাসের সাহায্যে চলে। একইভাবে পাহাড়গুলো নিজে থেকে চলে না, পৃথিবীর গতির সঙ্গে চলে।
প্রাচীন মুফাসসিরদের ব্যাখ্যা যতটা কিয়ামতকেন্দ্রিক, আধুনিক আলেমগণ ততটা বিজ্ঞানকেন্দ্রিক। তাঁরা বলেন, আয়াতটি পৃথিবীর গতির এক অলৌকিক বর্ণনা।শেখ মুহাম্মাদ মিতওয়ালি আশ-শা’রাউই বলেছেন, কোরআনের এই আয়াত বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলে যায় এবং এটা কিয়ামতের দৃশ্য নয়। (মু’জিজাতুল কোরআন, খণ্ড: ৫১, আল-মুখতারুল ইসলামি, কায়রো, ১৯৭৮ খ্রি.)
মুহাম্মাদ আত-তাহির ইবনে আশুরও প্রাচীন ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি বলেছেন, প্রাচীন মুফাসসিররা আয়াতের ভাষাগত সৌন্দর্য ও উপমার গভীরতা ব্যাখ্যা করতে পারেননি। আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা হলো পৃথিবীর গতির ইঙ্গিত, যা কোরআনের বিজ্ঞানীয় অলৌকিকতার প্রমাণ। (আত-তাহরির ওয়াত তানওয়ির, ২০/৫০, আদ-দারুত তিউনিসিয়া, তিউনিসিয়া, ১৯৮৪ হি.)
মানসুর হাসবুন নবী বলেছেন, কোরআনের এই আয়াত পৃথিবীর গতি ও সূর্যের চারপাশে ঘুরে বেড়ানোর ইঙ্গিত দেয়, যা নবীজির সময়ে অজানা ছিল (আল-কুন ওয়াল ইজাজুল ইলমি ফিত তাওরাতিল কারিম, পৃষ্ঠা: ১৫৬, দারুল ফিকরিল আরাবি, ১৯৯৬ খ্রি.)
এই ব্যাখ্যা আমাদের চিন্তা করতে বাধ্য করে যে কোরআন কীভাবে ১ হাজার ৪০০ বছর আগে এমন সত্য বলেছে, যা আজকের বিজ্ঞান স্বীকার করছে।
আরও পড়ুন“আল্লাহ ধনী, তোমরা দরিদ্র”০১ অক্টোবর ২০২৫ভাষাগত সৌন্দর্য: আয়াতের গভীরতাকোরআনের আয়াতগুলোর সৌন্দর্য শুধু অর্থে নয়, ভাষায়ও। আয়াতে ‘তারা’ (দেখবে) শব্দটি বর্তমান কালের, যা চলমানতা ও নতুনত্বের ইঙ্গিত দেয়। এটি মানুষের চিন্তা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বোঝার কথা বলে। ‘তাহ্সাবুহা জামিদা’ (স্থির মনে হয়েছে) শব্দটি মানুষের ভুল ধারণার ইঙ্গিত দেয়। এটি ‘তারা’র সঙ্গে যুক্ত, যা দেখার সঙ্গে ধারণার পার্থক্য দেখায়। (আহমাদ ইবরাহিম উবাবানা, আল-মুফ্রাদাতুল কুরআনিয়া ওয়া আসারুহা ফি তাওজিহিত তাফসিরিল ইলমি, পৃষ্ঠা: ২০২, মজল্লাতু জামিয়াতিশ শারিকা, ভলিউম: ১৫, সংখ্যা: ২, ২০১৮ খ্রি.)
মাহমুদ বিন উমর আজ-জামাখশারি বলেছেন, ‘জামিদা’ মানে স্থির, যা তার জায়গা থেকে সরে না। এই শব্দটি ‘তামুররু’ (চলে যাবে)–এর বিপরীত, যা গতির ইঙ্গিত দেয়। (আল-কাশশাফ আন হাকায়েকিল গায়াবি গুয়ামিজিত তাঞ্জিল ওয়া উয়ুনুল আকাওয়িল ফি উজুহিত তাওয়িল, ৩/৩৮, দারুত তুরাসিল আরাবি, লেবানন, ২০০৭ খ্রি.)
মুহাম্মাদ জামালুদ্দিন আল-কাসিমি বলেছেন, ‘তামুররু’ শব্দটি পৃথিবীর গতির স্পষ্ট ইঙ্গিত এবং এটি কিয়ামতের সঙ্গে যুক্ত করা যায় না (মাহাসিনুত তাওয়িল, ৭/৫১০, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত)।
আয়াতের শেষে ‘আল্লাহর সৃষ্টি, যিনি সবকিছুকে নিখুঁত করেছেন’ এই উল্লেখ সৃষ্টির নিখুঁততার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই ভাষাগত সৌন্দর্য আমাদের চিন্তা করতে বাধ্য করে যে কোরআন কীভাবে সাধারণ শব্দে গভীর সত্য প্রকাশ করে।
আমরা যখন পাহাড় দেখি, তখন স্থিরতার মধ্যে গতির রহস্য খুঁজি। এটি আমাদের বিশ্বাসকে বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত করে এবং জীবনের প্রতি একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়।কোরআনের অলৌকিকতা থেকে আমাদের শিক্ষাআয়াতের পটভূমিতে রাত্রিদিনের উল্লেখ আছে: ‘তারা কি দেখে না যে, আমরা রাত্রিকে তাদের জন্য বিশ্রামের জন্য এবং দিনকে দৃষ্টিসম্পন্ন করেছি? নিশ্চয় এতে ইমানদার সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা রুম, আয়াত: ২৩)
এই কোরআনীয় কৌশল, যেখানে দৃশ্যমান প্রকৃতির মাধ্যমে অদৃশ্য কিয়ামতের প্রমাণ দেওয়া হয়। সুরা আরাফের আয়াতে বলা হয়েছে: ‘আর তিনিই বায়ু পাঠান বর্ষার পূর্বসূচক হিসেবে... যতক্ষণ না ভারী মেঘগুলোকে এক মৃত ভূমির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়... এভাবে আমরা মৃতদের বের করি, যাতে তোমরা চিন্তা করো।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৫৭)
এখানে বৃষ্টির মতো দৃশ্যমান ঘটনা কিয়ামতের প্রমাণ হয়।
আয়াতের শেষে ‘তিনি তোমাদের কাজকর্মের খবর রাখেন’ বলে আমাদের আমলের প্রতি সতর্ক করা হয়েছে।
এই আয়াত আমাদের শিক্ষা দেয় যে প্রকৃতির প্রতিটি ঘটনা আল্লাহর সৃষ্টির সাক্ষ্য বহন করে। আমরা যখন পাহাড় দেখি, তখন স্থিরতার মধ্যে গতির রহস্য খুঁজি। এটি আমাদের বিশ্বাসকে বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত করে এবং জীবনের প্রতি একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়।
এই আয়াতের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, কোরআন কীভাবে মানুষের চিন্তাকে উদ্দীপ্ত করে। আমাদের দায়িত্ব হলো এই আয়াতগুলো পড়ে চিন্তা করা, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
আরও পড়ুন‘যারা জানে আর যারা জানে না, তারা সমান নয়’০৩ অক্টোবর ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প থ ব র গত র এই ব য খ য য ক ত কর স থ র মন ম ঘ র মত স ন দর য প রক ত র ক য় মত র ক রআন র এই আয় ত অল ক ক কর ছ ন বল ছ ন আয় ত র উল ল খ র জন য আম দ র আল ল হ ত র এক র আয় ত ল ইলম চলম ন
এছাড়াও পড়ুন:
রিকশাচালককে পিটিয়ে হত্যা, অভিযোগ ছাত্রদল নেতা ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে একজন রিকশাচালককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে তাঁর চাচাতো ভাই ও স্বজনদের বিরুদ্ধে। গতকাল শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে তাঁকে মারধরের ঘটনা ঘটে।
নিহত মো. খোকন মিয়ার (৪০) বাড়ি উপজেলার মগটুলা ইউনিয়নের করমা গ্রামে।
পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দা সূত্রে জানা গেছে, করমা গ্রামের কছিম উদ্দিন ও গিয়াস উদ্দিন নামের দুই ভাই ছিলেন। ৬-৭ বছর আগে গিয়াস উদ্দিনের মৃত্যুর পর জমি নিয়ে কছিম উদ্দিনের সঙ্গে গিয়াস উদ্দিনের ছেলেদের বিরোধ শুরু হয়। বিরোধের জেরে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনায় থানায় ইতিমধ্যে তিনটি মামলাও হয়। স্থানীয়ভাবে দুই পরিবারের বিরোধ মেটাতে কয়েক দফা উদ্যোগ নেওয়া হলে তা মানেননি কেউ।
স্থানীয় সূত্রের ভাষ্য, গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে রিকশা রেখে ঘর থেকে বের হন খোকন মিয়া। এ সময় গিয়াস উদ্দিনের ছেলে স্থানীয় মগটুলা ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি নজরুল ইসলাম ও তাঁর ভাই এবং পরিবারের সদস্যরা তাঁকে ধরে নিয়ে পিটিয়ে দুই হাত ও দুই পা ভেঙে দেন। এ সময় তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে ও মাথায় আঘাত করা হয়। পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের মাধ্যমে খবর পেয়ে রাত একটার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পরে পুলিশ উদ্ধার করে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক খোকনকে মৃত ঘোষণা করেন।
রিকশাচালককে পিটিয়ে হত্যায় অভিযুক্ত ছাত্রদল নেতা নজরুল ইসলাম