আবুল হায়াত বললেন, কাজেই আনন্দ, আনন্দেই জীবন
Published: 5th, October 2025 GMT
ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন, ‘বুঝলা, নিজের ঢাক নিজেই পিটাইবা। অন্য কাউরে দিলে ফাটায়া ফেলাইব’। অভিনেতা আবুল হায়াত শোনাচ্ছিলেন তাঁর জীবনের গল্প, ঋত্বিক ঘটকের প্রসঙ্গ আসায় তাঁর মুখে ফুটে ওঠে স্নিগ্ধ হাসি। কথা হচ্ছিল প্রথম আলোর আয়োজন ‘ক্রাউন সিমেন্ট’ অভিজ্ঞতার গল্প শীর্ষক ভিডিও সাক্ষাৎকারে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ আবুল হায়াতের সার্কিট হাউস রোডের ফ্ল্যাটে এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
তাঁর পুরো নাম খন্দকার মোহাম্মদ শামসুল আরেফীন আবুল হায়াত গোলাম মাহবুব। আর পিতা তাঁর প্রিয় কবির নামে রেখেছিলেন একটা ডাকনাম—রবি। জন্ম তাঁর ১৯৪৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, মুর্শিদাবাদে। বাবার চাকরি ছিল রেলওয়েতে। ১৯৪৭–এর পর তাঁর কর্মস্থল হলো চট্টগ্রাম। তিনি পরিবারসহ চলে গেলেন চট্টগ্রামে।
রবি কথা নামের একটা সুন্দর আত্মজীবনী লিখেছেন তিনি। সেখানে দেশভাগের বেদনার কথা আছে।তিন বছরের রবির সেই যাত্রার তিনটা জিনিস এখনো মনে আছে। মুনিষের কাঁধে চড়ে ট্রেনে উঠেছিলেন। আবুল হায়াত বলেন, ‘একটা কালো ইঞ্জিন একটা হুইসেল দিল, চিৎকার করে উঠলাম মায়ের কোলে। আর তিন নম্বর হলো স্টিমারে নদী পার হওয়া—গোয়ালন্দ থেকে চাঁদপুর।’
রবি কথা নামের একটা সুন্দর আত্মজীবনী লিখেছেন তিনি। সেখানে দেশভাগের বেদনার কথা আছে। অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছড়া থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো, তোমরা যেসব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো! তার বেলা?’
ছোটবেলার চট্টগ্রামের সৌন্দর্য এখনো তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সম্প্রতি তিনি গিয়েছিলেন টাইগারপাস কলোনিতে ছেলেবেলার জায়গাগুলো দেখতে। দেখে তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন। কোথায় সেই গাছগাছালি, বাগান, পাহাড়, তক্ষকের ডাকে ভরা সন্ধ্যাবেলা, যেখানে কুপিবাতির আলোয় পড়তে বসতে হতো।
আরও পড়ুনদুর্দান্ত প্রকৌশলী, প্রাণবন্ত মানুষ ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫চট্টগ্রামে তিনি পড়েছেন কলেজিয়েট স্কুলে। তারপর ক্লাস টেনে এসে আবার পাহাড়তলী স্কুল। তখন থেকেই নাটকের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা তাঁর। বাবা ছিলেন রেলওয়ের কর্মকর্তাদের প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক। ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউট নামের সে প্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর নাটক হতো। বিখ্যাত অভিনেতা অমলেন্দু বিশ্বাস নায়কের চরিত্র করতেন। সেসব নাটক মগ্ন হয়ে দেখতেন আবুল হায়াত। আবার ১০ বছর বয়সে মঞ্চে উঠেও পড়লেন অভিনয় করতে।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সতীর্থ গোলাম রব্বানী, সিরাজুল মজিদ মামুন, আবুল কাশেম—সারাক্ষণ একসঙ্গে চলেন, নাটক করেন। তাঁদের বন্ধুরা ডাকত ঘেটুর দল বলে।নাটকের চর্চা স্কুল ও কলেজজীবনে অব্যাহত রইল। ঢাকার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন ১৯৬২–তে। আরও বেশি করে নাটক করতে শুরু করলেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সতীর্থ গোলাম রব্বানী, সিরাজুল মজিদ মামুন, আবুল কাশেম—সারাক্ষণ একসঙ্গে চলেন, নাটক করেন। তাঁদের বন্ধুরা ডাকত ঘেটুর দল বলে।
তাঁর ভাষায়, ‘জীবন সুন্দর এবং জীবন হলো কাজ করার জায়গা। অন্য কথায় বলতে গেলে, আনন্দ করার জায়গা। যখন তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করবে, আনন্দটা করবেন কীভাবে? তখন আমি বলব যে কাজ করতে হবে। কাজেই আনন্দ, আনন্দেই জীবন।তারপরের গল্পটা তিনি শোনালেন এভাবে, ‘১৯৬৮-এর ফেব্রুয়ারিতে আমি ঢাকা ওয়াসায় জয়েন করলাম। তখন মেসে থাকতাম। সেখানে গোলাম রব্বানীও আমার সঙ্গে থাকতেন। উনি একদিন বললেন নাটক হবে, চল। ছাত্র ইউনিয়নের সংস্কৃতি সংসদের রক্তকরবী নাটক। সেটা কোথায় হবে? বাংলা একাডেমির মাঠে হবে। এটা নিয়ে আর্মির সঙ্গে প্রচুর ঝামেলা হয়েছে, পারমিশন দেবে না তো দেবে না। আমরা রিহার্সাল দিয়েই যাচ্ছি। একবার রেডি হয়ে যায়, ডেট ঠিক হয়ে যায়, আর্মি বন্ধ করে দেয়। আবার তার পেছনে পেছনে দৌড়ানো…প্রায় এক বছর রিহার্সাল দিয়ে আমরা নাটকটা নামিয়েছিলাম।’
১৯৬৮ সালে টেলিভিশনের জন্য মঞ্চস্থ হলো ইদিপাস। নাটকে তিনি অভিনয় করলেন।
১৯৭২ সালে আবুল হায়াত চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করলেন। তিতাস একটি নদীর নাম, পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। ওই সময়েই ঋত্বিক ঘটক তাঁকে বলেছিলেন নিজের ঢাক নিজে পেটানোর কথা। আর সহ–অভিনেত্রী রোজির হাতে সিনেমার গল্পের প্রয়োজনে মার খেয়ে শুনেছিলেন ঋত্বিকের মজার উক্তি। শুনুন তাঁর মুখেই, ‘পাঞ্জাবি তো ছিঁড়ে গেছে, রক্ত বেরোচ্ছে। আমি দাদার কাছে গিয়ে বললাম, দাদা, দেখেন রোজি কী করেছে! উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “শক্তিশালী অভিনেত্রী!’’’
আরও পড়ুনএত বিস্ময়কর, আনন্দময়, স্বপ্নে ভরা পৃথিবী! এইখানে আমি জন্মেছি: আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ১৯ জুলাই ২০২৫আবুল হায়াত অভিনয় করেছেন অনেকগুলো স্মরণীয় চলচ্চিত্রে। মঞ্চ আর টেলিভিশনে তাঁর অভিনয় তো তাঁকে বাংলাদেশের প্রতিটা ঘরের আপন মানুষ করে তুলেছে। তিনি নাটক রচনা করেছেন, পরিচালনাও করেছেন। পেয়েছেন একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং মেরিল–প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা।
তাঁর ভাষায়, ‘জীবন সুন্দর এবং জীবন হলো কাজ করার জায়গা। অন্য কথায় বলতে গেলে, আনন্দ করার জায়গা। যখন তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করবে, আনন্দটা করবেন কীভাবে? তখন আমি বলব যে কাজ করতে হবে। কাজেই আনন্দ, আনন্দেই জীবন।
কাজের মধ্যে আনন্দে থাকুন, প্রিয় আবুল হায়াত।
আনিসুল হক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক জ কর স ন দর র গল প আনন দ
এছাড়াও পড়ুন:
দুর্ঘটনায় মা হারানো শিশুটির কান্না থামছে না
‘রাতে হঠাৎ ঘুমঘুম চোখে কান্না শুরু করে। একবার কান্না শুরু হলে তা আর থামতেই চায় না। তখন মাঝরাতে তাকে বাইরে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না ঘুমায়, ততক্ষণ নিজের সঙ্গে রাখতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে কোনোরকমে মাকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করি। তবে কান্না থামাতে পারছি না।’
কথাগুলো বলছিলেন এক বছরের শিশু সাফওয়ান ইসলামের বাবা মো. ইমন ইসলাম। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সীতাকুণ্ড পৌর সদরের মৌলভীপাড়া এলাকায় রেললাইনে বিকল হয়ে পড়া একটি সিএনজি অটোরিকশাকে ধাক্কা দেয় একটি ট্রেন। এ সময় শিশু সাফওয়ানের মা সানজিদা সুলতানা (২৫) ও নানি মাহমুদা বেগমের (৪৫) মৃত্যু হয়। এর পর থেকে সাফওয়ানকে সারাক্ষণ নিজের কাছে রাখছেন তার বাবা ইমন।
ইমনের বাড়ি সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরা ইউনিয়নের ঘাটগড় এলাকায়। তিনি একটি রড তৈরির কারখানায় ট্রান্সপোর্ট সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত। যে জায়গাটিতে দুর্ঘটনা হয়েছিল তা ইমনের শ্বশুরবাড়ি থেকে মাত্র চার শ গজ দূরে। পুলিশ জানায়, রেলক্রসিংটি অবৈধ। ঘটনার দিন সেখানে কোনো গেটম্যানও ছিল না।
আমরা কত আনন্দ করে ছেলের জন্মদিন পালন করেছি। অথচ এক মাস না যেতেই আমার ছেলেটি তার মাকে হারাল। গোছানো সংসারটা যেন তছনছ হয়ে গেল।শিশু মো. ইমন ইসলামের বাবা।গতকাল শনিবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, ইমনের বাড়িতে স্বজনদের ভিড়। এক পাশে ছেলে সাফওয়ানকে কোলে নিয়ে বসে আছেন তিনি। অনেকেই ছেলের এ অবস্থা দেখে ইমনকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিচ্ছেন। সাফওয়ান চোখ মেলে আশপাশে তাকিয়ে দেখছে। আর কিছুক্ষণ পরপরই কান্না করছে।
ইমন প্রথম আলোকে বলেন, মা মারা যাওয়ার দিন বাড়িতে অনেক লোকের ভিড় থাকায় সাফওয়ান তেমন কান্না করেনি। তবে রাত হতেই মাকে না পেয়ে কান্না শুরু করে। এর পর থেকে প্রতি রাতেই কান্না করে। দিনের বেলায় বাড়িতে মানুষের ভিড় থাকায় তেমন কান্না করে না। তবে যখন বুকের দুধ খাওয়ার সময় হয়, তখন আর কান্না থামিয়ে রাখা যায় না।
ট্রেনের ধাক্কায় অটোরিকশাটি দুমড়ে মুচড়ে যায়। গত বৃহস্পতিবার বেলা দেড়টায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পৌর সদরের মৌলভী পাড়া এলাকায়