পবিত্র কোরআনের আয়াতগুলো কেবল জ্ঞানের উৎস নয়, এগুলো মানুষের হৃদয়ে ভয় ও সতর্কতার বীজ বপন করে, যাতে আমরা পথভ্রষ্টতা থেকে ফিরে আসি। সুরা বনি ইসরাইলে আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি কেবল ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নিদর্শনসমূহ পাঠাই।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৫৯)

আয়াতটি মক্কার লোকদের প্রশ্নের জবাবে অবতীর্ণ হয়েছে, যারা মহানবী মুহাম্মদ (সা.

)-কে বড় বড় অলৌকিক চিহ্ন দেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে আয়াতগুলোর উদ্দেশ্য ভয় দেখানো নয়, বরং সতর্ক করে ভবিষ্যতের বিপদ থেকে রক্ষা করা।

আজকের দুনিয়ায় যেখানে মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সামাজিক অস্থিরতা এবং নৈতিক পতনের মুখোমুখি, এই আয়াতের বার্তা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

মক্কাবাসীদের দাবি করা অলৌকিক নিদর্শন

মক্কাবাসীরা মহানবী (সা.)-কে বলেছিলেন, ‘যদি তুমি সত্যিকারের রাসুল হও, তাহলে আমাদের স্পষ্ট অলৌকিক চিহ্ন দেখাও। সাফা পর্বতকে সোনায় পরিণত করো, আগ্নেয় পর্বতগুলো সরিয়ে দাও যাতে আমরা চাষবাস করতে পারি, আমাদের জমিকে উর্বর করে দাও’।

এই দাবিগুলো ছিল তাদের অবিশ্বাসের প্রকাশ—তারা চাইছিল না সত্যিকারের হিদায়েত বরং অলৌকিকতার মোহে পড়ে নবীজির দাওয়াতকে পরীক্ষা করতে চাইছিল।

ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, মহানবীকে বলা হয়েছিল, ‘যদি তুমি চাও তাদের ধ্বংস করতে, তাহলে করো; না হলে তাদের দাবি মেনে নাও।’ কিন্তু মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমি তাদের দোয়া করব।’ ফলে এই আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ২,৩৩৩; আল-মুস্তাদরাক আলাস সাহিহাইন, হাদিস: ৩,৩৭৯)

আরও পড়ুনকোরআন যেভাবে মানুষের চেতনা পাল্টে দিয়েছে০২ অক্টোবর ২০২৫মক্কাবাসীরা মহানবী (সা.)-কে বলেছিলেন, ‘যদি তুমি সত্যিকারের রাসুল হও, সাফা পর্বতকে সোনায় পরিণত করো, আগ্নেয় পর্বতগুলো সরিয়ে দাও যাতে আমরা চাষবাস করতে পারি’।

এমন দাবি পূর্ববর্তী কওমও করেছিল। সামুদ কওম সালিহ (আ.)-কে উটনি দেখাতে বলেছিল, কিন্তু তারা অবিশ্বাস করায় ধ্বংস হয়েছে। ইবনে আশুর বলেছেন, সামুদের কথা বলা হয়েছে কারণ তাদের ধ্বংসের চিহ্ন মক্কাবাসীদের কাছে পরিচিত ছিল, যা তাদের যাত্রায় দেখা যেত। (আত-তাহরির ওয়াত তানওয়ির, ১৫/১৪৪, আদ-দারুত তিউনিস, তিউনিস, ১৯৮৪ হি.)

মক্কাবাসীরা চাইছিল অলৌকিকতা, কিন্তু আল্লাহ জানতেন যে এটি তাদের আরও অবিশ্বাসী করে তুলবে। ফলে আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি নিদর্শন প্রেরণ করা থেকে এ জন্য বিরত থাকি, কেননা, আগের লোকেরা তা মিথ্যা মনে করে প্রত্যাখ্যান করেছিল। আমি সামুদ জাতির নিকট উটনি পাঠিয়েছিলাম এক প্রত্যক্ষ নিদর্শন হিসেবে কিন্তু তারা তার প্রতি জুলুম করল; ভয় প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই কেবল আমি নিদর্শন পাঠিয়ে থাকি।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৫৯)

এই আয়াত মক্কাবাসীদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে অলৌকিকতা চাইলে তারা ধ্বংসের পথে যাবে, কারণ পূর্ববর্তীরা তাই করেছে।

এ ঘটনা আমাদের শেখায় যে ইমানের পথ অলৌকিকতার মোহ নয়, বরং হৃদয়ের পরিবর্তন। আজকের দুনিয়ায় আমরা প্রায়ই ‘চিহ্ন’ খুঁজি—যেমন অর্থনৈতিক সাফল্য বা সামাজিক স্বীকৃতি—কিন্তু কোরআন বলে, সত্যিকারের চিহ্ন হলো হৃদয়ের শান্তি এবং সঠিক পথে চলা। মক্কাবাসীদের দাবি আমাদের সতর্ক করে যে অলৌকিকতার খোঁজে বিশ্বাস হারিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক।

ভয় দেখানোর অর্থ কী

আয়াতের চূড়ান্ত অংশ ‘ওয়া মা নুরসিলু বিল আয়াতি ইল্লা তাখওয়িফা’ (ভয় প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই কেবল আমি নিদর্শন পাঠিয়ে থাকি)। এখানে ‘তাখওয়িফা’ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ। এর অর্থ শুধু ভয় দেখানো নয়, বরং সতর্ক করে ভবিষ্যতের বিপদ থেকে রক্ষা করা।

ইমাম তাবারি বলেছেন, ‘আমি এ জন্যই নিদর্শনসমূহ পাঠাই, যাতে মানুষ স্মরণ করে, উপদেশ নেয় এবং ফিরে আসে।’ (জামি’ বায়ানি আন তাওয়িল আয়াতিল কোরআন, ১৪/৬৩৫, দারু হিজর, রিয়াদ, ১৯৯৯ খ্রি.)

কাতাদা বলেছেন, ‘আল্লাহ যাকে চান তাদেরকে আয়াতগুলো দিয়ে সতর্ক করেন, যাতে তারা চিন্তা করে, উপদেশ নেয় বা ফিরে আসে।’

আরও পড়ুনকোরআন থেকে ইতিহাস ও বাস্তবতার নিয়ম বোঝা২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫উমর (রা.)-এর সময় মদিনায় ভূমিকম্প হলে তিনি বলেছেন, ‘এটি তোমাদের অপরাধের ফল। যদি আবার হয়, তাহলে কঠোর শাস্তি হবে’।

একবার কুফা নগরীতে ভূমিকম্প হলে ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, ‘হে লোকেরা, তোমাদের রব তোমাদের সতর্ক করছেন, তাই তাঁর প্রতি ফিরে এসো।’ (জামি’ বায়ানি আন তাওয়িল আয়াতিল কোরআন, ১৪/৬৩৫, দারু হিজর, রিয়াদ, ১৯৯৯ খ্রি.)

উমর (রা.)-এর সময় মদিনায় ভূমিকম্প হলে তিনি বলেছেন, ‘এটি তোমাদের অপরাধের ফল। যদি আবার হয়, তাহলে কঠোর শাস্তি হবে’।

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘সূর্য ও চাঁদের গ্রহণ আল্লাহর নিদর্শন। এগুলো কারও জন্ম বা মৃত্যুর জন্য হয় না। আল্লাহ এগুলো দিয়ে তাঁর বান্দাদের সতর্ক করেন। যখন দেখো, তখন তাঁর জিকির, দোয়া ও ক্ষমাপ্রার্থনায় মনোনিবেশ করো। হে মুহাম্মদের উম্মত, যদি তোমরা যা আমি জানি তা জানতে, তাহলে অল্প হাসতে এবং অধিক কাঁদতে।’ (সহিহ বুখারি, কিতাবুল কুসুফ; সহিহ মুসলিম, কিতাবুস সালাতুন নিসা–ই)

‘তাখওয়িফা’র অর্থ সতর্কবাণী। ইমাম জারকাশি বলেছেন, এটি কোরআনের আয়াত, অলৌকিকতা বা কসমীয় ঘটনা—সবকিছুর উদ্দেশ্য মানুষকে সতর্ক করা, যাতে তারা চিন্তা করে এবং ফিরে আসে। (আহকামুল কোরআন, ১৫/১৪৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৬ খ্রি.)

এই সতর্কবাণী আমাদের শেখায় যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সামাজিক অস্থিরতা আল্লাহর স্মারক। এগুলো থেকে আমরা উপদেশ নিয়ে ফিরে আসতে পারি। আজকের দুনিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তন বা মহামারির মতো ঘটনা আমাদের সতর্ক করে যে আমাদের কাজের ফল আমরাই ভোগ করব। কোরআনের এই বার্তা আমাদের দায়িত্বশীল করে তোলে।

আরও পড়ুন“আল্লাহ ধনী, তোমরা দরিদ্র”০১ অক্টোবর ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র উদ দ শ য ন য় পর আল ল হ বল ছ ন ব স কর আম দ র অল ক ক ক রআন আরও প

এছাড়াও পড়ুন:

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাসাভাড়া বেড়েছে, পরিপত্র জারি

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাসাভাড়া ৫০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে শিক্ষকেরা এখন থেকে দেড় হাজার টাকা বাসাভাড়া পাবেন। আজ রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ভাড়া বৃদ্ধির পরিপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রবিধি শাখার পরিপত্রে এ–সংক্রান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।

আরও পড়ুনসহকারী শিক্ষকের বেতন কম্পিউটার অপারেটরের সমান, কলেজ অধ্যাপকের যুগ্ম সচিবেরও নিচে৪ ঘণ্টা আগে

পরিপত্রে বলা হয়েছে, ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া ভাতা নিম্নোক্ত শর্তাদি পালন সাপেক্ষে ১ হাজার টাকা হতে বৃদ্ধি করে ১ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হলো।’ শর্তে বলা হয়েছে, ‘এ ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে যাবতীয় আর্থিক বিধিবিধান যথাযথভাবে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে; এ ভাতা–সংক্রান্ত ব্যয়ে ভবিষ্যতে কোনো অনিয়ম দেখা দিলে বিল পরিশোধকারী কর্তৃপক্ষ উক্ত অনিয়মের জন্য দায়ী থাকবেন।’ প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ জারির তারিখ থেকে ভাতা কার্যকর হবে। প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় কর্তৃক জিও জারি করে জিওর চার কপি অর্থ বিভাগে পৃষ্ঠাঙ্কনের জন্য পাঠাতে হবে।

আরও পড়ুনঅক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রি অনলাইন কোর্স, ঘরে বসেই শিখুন নতুন দক্ষতা৯ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ