পর্বত-দুহিতা খোয়াই নদী পরিসরে ছোট হলেও দুর্জয়–পরাক্রমশালী বলে তার খ্যাতি ছিল তখন। লোকমুখে এরই আদুরে নাম ক্ষেমা বা ক্ষেমঙ্করী। জনশ্রুত আছে, একবার এক ভিনদেশি বণিকের পানসি ভেড়ে এই নদীর কূলে। পার্শ্ববর্তী খাসিয়া জনপদে তখন বাজছে উৎসবের গীত। ভিনদেশি যুবক সেই বণিকের রূপে মুগ্ধ হয়ে এক খাসিয়া অভিজাত কন্যা প্রেমে অঙ্গার হলেও শেষাবধি মিলন না ঘটায় আত্মাহুতি দেয় সে। সেই থেকে নদীর সঙ্গে এই আদুরে নামটিও জুড়ে যায়। সমাসন্ন শীতের মতোই কোনো এক ঋতুপরবে খোয়াই নদীর জলে নিকটবর্তী সন্ধ্যায় কেউ নির্জলা কণ্ঠে গেয়ে চলে—

‘মন মাঝি তুই বৈঠা নে রে,
আমি আর বাইতে পারলাম না।
সারা জীবন উজান বাইলাম, ভাটির দেখা পাইলাম না
আমি আর বাইতে পারলাম না।’

বঙ্গজ ভূমির মৃত্তিকাসংলগ্ন সেই আদি সুর দীনেশচন্দ্র সেন শুনেছিলেন তাঁর মামাতো ভাই ফণীভূষণ সেনের বাড়ি হবিগঞ্জে থাকাকালীন। তখন মাত্র ৪০ টাকা বেতনে তিনি চাকরি করতেন হবিগঞ্জ স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষক পদে। পারিবারিক আবহ থেকে শুরু করে চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জনপদে ভ্রমণ তাঁর বঙ্গীয় লোকসাহিত্যের সঙ্গে বিশদভাবে পরিচয়ের যোগসূত্র তৈরি করেছিল। যা তাঁকে পরবর্তীকালে বাংলার ঐতিহ্যবাহী রীতির গবেষণা ধারায় উল্লেখযোগ্য আসনে অধিষ্ঠিত করে। মূলত এই খোয়াই নদীর মতোই বিপুল সৌকর্য নিয়ে ধেয়ে চলেছে আমাদের বাংলার হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস। সেই ইতিহাসের পাতায় বিধৃত যত নিদর্শন রয়েছে, তার প্রতি বিশ্বমহলের সুচিন্তিত দৃষ্টি নিবন্ধ করতে আজন্ম কাজ করে গেছেন দীনেশচন্দ্র সেন।

১৮৬৬ সালের ৩ নভেম্বর পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) মানিকগঞ্জ জেলার বগজুড়ি গ্রামে মামার বাড়িতে যমজ ভগ্নিসহ জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের মহান ইতিহাসকার দীনেশচন্দ্র সেন। ৯টি কন্যাসন্তানের পর বাবা ঈশ্বরচন্দ্র সেন ও মাতা রূপলতা দেবীর ঘর আলো করে এসেছিলেন তিনি। সেই আলোই যেন জীবনের প্রতিটি বাঁকে আরও অধিক উজ্জ্বলতা পেয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলা সাহিত্যের আঙিনায়। পিতার কর্মস্থল মানিকগঞ্জ, মামার বাড়ি বগজুড়ি গ্রাম এবং মানিকগঞ্জের সুয়াপুরে তাঁদের নিজ বাড়িতে পালাক্রমে দীনেশচন্দ্র সেনের বাল্যকাল কাটে। সন্তানকে যথার্থ শিক্ষানুরাগী করে গড়ে তুলতে ছোটবেলা থেকেই সচেষ্ট ছিলেন উকিল পিতা ঈশ্বরচন্দ্র সেন। তৎকালে ইংরেজি শিক্ষায় দীক্ষা লাভের ফলে পৌত্তলিকতাবিরোধী ‘ব্রাহ্ম’ ধর্মের প্রতি তিনি আকৃষ্ট ছিলেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে শিক্ষায় হাতেখড়ি লাভের পর সুয়াপুর গ্রামেই চলতে থাকে দীনেশচন্দ্র সেনের পাঠকর্মের প্রাথমিক পর্যায়। বড়দিদি দিগ্বসনী দেবীর কাছে কৃত্তিবাসী রামায়ণ শুনে অভ্যস্ততা তৈরি হয় তাঁর। শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায় শেষে সুয়াপুরের বিশ্বম্ভর সাহার পাঠশালায় ভর্তি হন। সেখানে দ্বিতীয় ভাগ পাঠ শেষে মানিকগঞ্জের মাইনর স্কুল থেকে ১৮৭৯ সালে মাইনর পরীক্ষায় পাস করেন দীনেশচন্দ্র সেন। মাইনর পরীক্ষায় পাস করার আগে মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। কুমিল্লা কালেক্টরির হেড ক্লার্ক উমানাথ সেনের কন্যা বিনোদিনী সেনের সঙ্গে বিয়ের পর পিতার আদেশ মোতাবেক কুমিল্লায় গিয়ে বসবাস শুরু করতে হয় তাঁকে। সেখানকার গভর্নমেন্ট স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও কিছুদিন পর ‘ফুল ফ্রি স্টুডেন্টশিপ’ নিয়ে ঢাকার জগন্নাথ স্কুলে চলে যান।

বঙ্গজ ভূমির মৃত্তিকাসংলগ্ন আদি সুর দীনেশচন্দ্র সেন শুনেছিলেন হবিগঞ্জে থাকাকালীন। তখন মাত্র ৪০ টাকা বেতনে তিনি চাকরি করতেন শিক্ষক পদে। পারিবারিক আবহ থেকে শুরু করে চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জনপদে ভ্রমণ তাঁর বঙ্গীয় লোকসাহিত্যের সঙ্গে বিশদভাবে পরিচয়ের যোগসূত্র তৈরি করেছিল।

মাত্র সাত বছর বয়সে পয়ার ছন্দে দেবী সরস্বতীর স্তব রচনার মধ্য দিয়ে দীনেশচন্দ্র সেনের সাহিত্যকর্মে হাতেখড়ি। এরপর কবিতার মাঠে পদচারণ। মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি মাসিক ‘ভারত-সুহৃদ’ পত্রিকায় ‘জলদ’ নামে একটি কবিতা লেখেন।

শৈশবে কবিতার মাধ্যমে হাতেখড়ি হলেও ক্রমেই দীনেশচন্দ্র সেন হয়ে উঠেছিলেন গবেষক, বাংলা সাহিত্যের একজন মহান ইতিহাসকার। প্রান্তিক জনপদের কাছে বহুল চর্চিত ও আলোচিত লোকসাহিত্য আমাদের সুধী সমাজে অনেককাল ধরে উল্লেখযোগ্য স্থান পায়নি। সেগুলোকে প্রবল উৎসাহে ও মর্যাদায় বিশ্বদরবারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এই দীনেশচন্দ্র সেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রচলিত নাট্যমূলক পরিবেশনা, যা ‘পালা’, ‘পালাগান’ বা পালানাট্য’ নামে সমধিক পরিচিত। এমন পরিবেশনাসমূহের সংকলন ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ এবং ইংরেজিতে ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল ব্যালাডস’। অত্র অঞ্চলের বাসিন্দা চন্দ্রকুমার দে কর্তৃক সংগৃহীত এসব পালাগান দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদনা করে প্রকাশ করে আমাদের লোক ঐতিহ্যের নতুন ভান্ডার সুধী সমাজের কাছে উন্মোচিত করেন। গীতিময়তার সঙ্গে নৃত্য ও বাদ্য–সহযোগে পরিবেশিত হয় বলে একে পালাগান হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবে দীনেশচন্দ্র সেন ইংরেজি ব্যালাডের সঙ্গে তুলনা করলেও তা সর্বৈব গ্রহণযোগ্য নয় বলে গবেষকদের অনেকেই মত দিয়েছেন। বাংলা জনপদের পরিবেশনা পাশ্চাত্যের চশমা দিয়ে দেখার যে বিড়ম্বনা, এখানেও তা–ই ঘটে। পরবর্তীকালে সেলিম আল দীন এ ধরনের ঐতিহ্যবাহী বাংলা পরিবেশনার মধ্যে নাট্যমূলক অভিজ্ঞান আছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। সেই সঙ্গে তিনি এসব পরিবেশনাকে পালানাট্য হিসেবেই চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। অধুনা শিক্ষক ও গবেষক ইউসুফ হাসান অর্ক তাঁর ‘দীনেশচন্দ্র সেন ও লোককাহিনির মঞ্চ-পরিবাহণ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘পরিবেশনার স্বকীয়তার গুণেই এগুলো “পালা” বা লোকসমাজে প্রচলিত অভিধা নিয়ে স্বকীয় শিল্প আঙ্গিকে পরিণত হয়েছে। পালাকে “পালা” বলে অভিহিত করাই সমীচীন। যেমনভাবে জাপানের “নো”-কে “নো”, “কাবুকি”কে “কাবুকি” নামেই ডাকে জাপানিরা। ভিনদেশি গবেষকেরা অনেকে “নো-থিয়েটার” বললেও তাতে জাপানিদের যথেষ্ট আপত্তি আছে।’

শৈশবে কবিতার মাধ্যমে হাতেখড়ি হলেও ক্রমেই দীনেশচন্দ্র সেন হয়ে উঠেছিলেন গবেষক, বাংলা সাহিত্যের একজন মহান ইতিহাসকার। প্রান্তিক জনপদের কাছে বহুল চর্চিত ও আলোচিত লোকসাহিত্য প্রবল উৎসাহে ও মর্যাদায় বিশ্বদরবারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এই দীনেশচন্দ্র সেন।

গ্রন্থটিতে ইউসুফ হাসান অর্ক ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’য় প্রকাশিত বা সহজ অর্থে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী ‘পালা’র শহুরে নাগরিকমঞ্চে পরিবেশনার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। যেখানে তিনি নগরকেন্দ্রিক পরিবেশনায় ‘ট্রান্সমিশনের’ প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। যেমনটি দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বঙ্গের লোকসাহিত্য’ গ্রন্থে (বক্তৃতামালাতে) বিশ্বসাহিত্যে লোককাহিনির প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ট্রান্সমিশনের ব্যাপারে ইঙ্গিত করেছেন। লোকসাহিত্যের এই ট্রান্সমিশনের কারণেই ‘হাউ মাউ খাউ মানুষের গন্ধ পাউ’ পাশ্চাত্যে গিয়ে হয়ে যায় ‘ফে–ফি–ফো–ফাম। আই স্মেল ব্লাড অব আ ব্রিটিশম্যান’।

দীনেশচন্দ্র সেন (৩ নভেম্বর ১৮৬৬—২০ নভেম্বর ১৯৩৯).

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ই দ ন শচন দ র স ন ম ন কগঞ জ বছর বয়স পর ব শ উল ল খ

এছাড়াও পড়ুন:

দীনেশচন্দ্র সেন: বাংলা সাহিত্যের মহান ইতিহাসকার

পর্বত-দুহিতা খোয়াই নদী পরিসরে ছোট হলেও দুর্জয়–পরাক্রমশালী বলে তার খ্যাতি ছিল তখন। লোকমুখে এরই আদুরে নাম ক্ষেমা বা ক্ষেমঙ্করী। জনশ্রুত আছে, একবার এক ভিনদেশি বণিকের পানসি ভেড়ে এই নদীর কূলে। পার্শ্ববর্তী খাসিয়া জনপদে তখন বাজছে উৎসবের গীত। ভিনদেশি যুবক সেই বণিকের রূপে মুগ্ধ হয়ে এক খাসিয়া অভিজাত কন্যা প্রেমে অঙ্গার হলেও শেষাবধি মিলন না ঘটায় আত্মাহুতি দেয় সে। সেই থেকে নদীর সঙ্গে এই আদুরে নামটিও জুড়ে যায়। সমাসন্ন শীতের মতোই কোনো এক ঋতুপরবে খোয়াই নদীর জলে নিকটবর্তী সন্ধ্যায় কেউ নির্জলা কণ্ঠে গেয়ে চলে—

‘মন মাঝি তুই বৈঠা নে রে,
আমি আর বাইতে পারলাম না।
সারা জীবন উজান বাইলাম, ভাটির দেখা পাইলাম না
আমি আর বাইতে পারলাম না।’

বঙ্গজ ভূমির মৃত্তিকাসংলগ্ন সেই আদি সুর দীনেশচন্দ্র সেন শুনেছিলেন তাঁর মামাতো ভাই ফণীভূষণ সেনের বাড়ি হবিগঞ্জে থাকাকালীন। তখন মাত্র ৪০ টাকা বেতনে তিনি চাকরি করতেন হবিগঞ্জ স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষক পদে। পারিবারিক আবহ থেকে শুরু করে চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জনপদে ভ্রমণ তাঁর বঙ্গীয় লোকসাহিত্যের সঙ্গে বিশদভাবে পরিচয়ের যোগসূত্র তৈরি করেছিল। যা তাঁকে পরবর্তীকালে বাংলার ঐতিহ্যবাহী রীতির গবেষণা ধারায় উল্লেখযোগ্য আসনে অধিষ্ঠিত করে। মূলত এই খোয়াই নদীর মতোই বিপুল সৌকর্য নিয়ে ধেয়ে চলেছে আমাদের বাংলার হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস। সেই ইতিহাসের পাতায় বিধৃত যত নিদর্শন রয়েছে, তার প্রতি বিশ্বমহলের সুচিন্তিত দৃষ্টি নিবন্ধ করতে আজন্ম কাজ করে গেছেন দীনেশচন্দ্র সেন।

১৮৬৬ সালের ৩ নভেম্বর পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) মানিকগঞ্জ জেলার বগজুড়ি গ্রামে মামার বাড়িতে যমজ ভগ্নিসহ জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের মহান ইতিহাসকার দীনেশচন্দ্র সেন। ৯টি কন্যাসন্তানের পর বাবা ঈশ্বরচন্দ্র সেন ও মাতা রূপলতা দেবীর ঘর আলো করে এসেছিলেন তিনি। সেই আলোই যেন জীবনের প্রতিটি বাঁকে আরও অধিক উজ্জ্বলতা পেয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলা সাহিত্যের আঙিনায়। পিতার কর্মস্থল মানিকগঞ্জ, মামার বাড়ি বগজুড়ি গ্রাম এবং মানিকগঞ্জের সুয়াপুরে তাঁদের নিজ বাড়িতে পালাক্রমে দীনেশচন্দ্র সেনের বাল্যকাল কাটে। সন্তানকে যথার্থ শিক্ষানুরাগী করে গড়ে তুলতে ছোটবেলা থেকেই সচেষ্ট ছিলেন উকিল পিতা ঈশ্বরচন্দ্র সেন। তৎকালে ইংরেজি শিক্ষায় দীক্ষা লাভের ফলে পৌত্তলিকতাবিরোধী ‘ব্রাহ্ম’ ধর্মের প্রতি তিনি আকৃষ্ট ছিলেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে শিক্ষায় হাতেখড়ি লাভের পর সুয়াপুর গ্রামেই চলতে থাকে দীনেশচন্দ্র সেনের পাঠকর্মের প্রাথমিক পর্যায়। বড়দিদি দিগ্বসনী দেবীর কাছে কৃত্তিবাসী রামায়ণ শুনে অভ্যস্ততা তৈরি হয় তাঁর। শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায় শেষে সুয়াপুরের বিশ্বম্ভর সাহার পাঠশালায় ভর্তি হন। সেখানে দ্বিতীয় ভাগ পাঠ শেষে মানিকগঞ্জের মাইনর স্কুল থেকে ১৮৭৯ সালে মাইনর পরীক্ষায় পাস করেন দীনেশচন্দ্র সেন। মাইনর পরীক্ষায় পাস করার আগে মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। কুমিল্লা কালেক্টরির হেড ক্লার্ক উমানাথ সেনের কন্যা বিনোদিনী সেনের সঙ্গে বিয়ের পর পিতার আদেশ মোতাবেক কুমিল্লায় গিয়ে বসবাস শুরু করতে হয় তাঁকে। সেখানকার গভর্নমেন্ট স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও কিছুদিন পর ‘ফুল ফ্রি স্টুডেন্টশিপ’ নিয়ে ঢাকার জগন্নাথ স্কুলে চলে যান।

বঙ্গজ ভূমির মৃত্তিকাসংলগ্ন আদি সুর দীনেশচন্দ্র সেন শুনেছিলেন হবিগঞ্জে থাকাকালীন। তখন মাত্র ৪০ টাকা বেতনে তিনি চাকরি করতেন শিক্ষক পদে। পারিবারিক আবহ থেকে শুরু করে চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জনপদে ভ্রমণ তাঁর বঙ্গীয় লোকসাহিত্যের সঙ্গে বিশদভাবে পরিচয়ের যোগসূত্র তৈরি করেছিল।

মাত্র সাত বছর বয়সে পয়ার ছন্দে দেবী সরস্বতীর স্তব রচনার মধ্য দিয়ে দীনেশচন্দ্র সেনের সাহিত্যকর্মে হাতেখড়ি। এরপর কবিতার মাঠে পদচারণ। মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি মাসিক ‘ভারত-সুহৃদ’ পত্রিকায় ‘জলদ’ নামে একটি কবিতা লেখেন।

শৈশবে কবিতার মাধ্যমে হাতেখড়ি হলেও ক্রমেই দীনেশচন্দ্র সেন হয়ে উঠেছিলেন গবেষক, বাংলা সাহিত্যের একজন মহান ইতিহাসকার। প্রান্তিক জনপদের কাছে বহুল চর্চিত ও আলোচিত লোকসাহিত্য আমাদের সুধী সমাজে অনেককাল ধরে উল্লেখযোগ্য স্থান পায়নি। সেগুলোকে প্রবল উৎসাহে ও মর্যাদায় বিশ্বদরবারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এই দীনেশচন্দ্র সেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রচলিত নাট্যমূলক পরিবেশনা, যা ‘পালা’, ‘পালাগান’ বা পালানাট্য’ নামে সমধিক পরিচিত। এমন পরিবেশনাসমূহের সংকলন ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ এবং ইংরেজিতে ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল ব্যালাডস’। অত্র অঞ্চলের বাসিন্দা চন্দ্রকুমার দে কর্তৃক সংগৃহীত এসব পালাগান দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদনা করে প্রকাশ করে আমাদের লোক ঐতিহ্যের নতুন ভান্ডার সুধী সমাজের কাছে উন্মোচিত করেন। গীতিময়তার সঙ্গে নৃত্য ও বাদ্য–সহযোগে পরিবেশিত হয় বলে একে পালাগান হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবে দীনেশচন্দ্র সেন ইংরেজি ব্যালাডের সঙ্গে তুলনা করলেও তা সর্বৈব গ্রহণযোগ্য নয় বলে গবেষকদের অনেকেই মত দিয়েছেন। বাংলা জনপদের পরিবেশনা পাশ্চাত্যের চশমা দিয়ে দেখার যে বিড়ম্বনা, এখানেও তা–ই ঘটে। পরবর্তীকালে সেলিম আল দীন এ ধরনের ঐতিহ্যবাহী বাংলা পরিবেশনার মধ্যে নাট্যমূলক অভিজ্ঞান আছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। সেই সঙ্গে তিনি এসব পরিবেশনাকে পালানাট্য হিসেবেই চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। অধুনা শিক্ষক ও গবেষক ইউসুফ হাসান অর্ক তাঁর ‘দীনেশচন্দ্র সেন ও লোককাহিনির মঞ্চ-পরিবাহণ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘পরিবেশনার স্বকীয়তার গুণেই এগুলো “পালা” বা লোকসমাজে প্রচলিত অভিধা নিয়ে স্বকীয় শিল্প আঙ্গিকে পরিণত হয়েছে। পালাকে “পালা” বলে অভিহিত করাই সমীচীন। যেমনভাবে জাপানের “নো”-কে “নো”, “কাবুকি”কে “কাবুকি” নামেই ডাকে জাপানিরা। ভিনদেশি গবেষকেরা অনেকে “নো-থিয়েটার” বললেও তাতে জাপানিদের যথেষ্ট আপত্তি আছে।’

শৈশবে কবিতার মাধ্যমে হাতেখড়ি হলেও ক্রমেই দীনেশচন্দ্র সেন হয়ে উঠেছিলেন গবেষক, বাংলা সাহিত্যের একজন মহান ইতিহাসকার। প্রান্তিক জনপদের কাছে বহুল চর্চিত ও আলোচিত লোকসাহিত্য প্রবল উৎসাহে ও মর্যাদায় বিশ্বদরবারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এই দীনেশচন্দ্র সেন।

গ্রন্থটিতে ইউসুফ হাসান অর্ক ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’য় প্রকাশিত বা সহজ অর্থে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী ‘পালা’র শহুরে নাগরিকমঞ্চে পরিবেশনার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। যেখানে তিনি নগরকেন্দ্রিক পরিবেশনায় ‘ট্রান্সমিশনের’ প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। যেমনটি দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বঙ্গের লোকসাহিত্য’ গ্রন্থে (বক্তৃতামালাতে) বিশ্বসাহিত্যে লোককাহিনির প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ট্রান্সমিশনের ব্যাপারে ইঙ্গিত করেছেন। লোকসাহিত্যের এই ট্রান্সমিশনের কারণেই ‘হাউ মাউ খাউ মানুষের গন্ধ পাউ’ পাশ্চাত্যে গিয়ে হয়ে যায় ‘ফে–ফি–ফো–ফাম। আই স্মেল ব্লাড অব আ ব্রিটিশম্যান’।

দীনেশচন্দ্র সেন (৩ নভেম্বর ১৮৬৬—২০ নভেম্বর ১৯৩৯)

সম্পর্কিত নিবন্ধ