Risingbd:
2025-11-21@04:23:59 GMT

পেটমোটা হটপট 

Published: 21st, November 2025 GMT

পেটমোটা হটপট 

গুলশান এক-এর মোড়ের রাস্তা ধরে, পরিপাটি চুলে সিঁথি কাটা ঘামে ভেজা বগল আর চকচকে নকল চামড়ার ব্যাগ আঙুলে পেঁচিয়ে, দুপুরের খাবার ভরা স্টিলের হটপট কাঁধে ঝুলিয়ে হনহন করে সকাল আটটা ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে হাঁটে যে মানুষগুলো, তাদের একজন দিপু। গুলশান এক-এর মোড় থেকে ঘুরে পকেট গলির ভাঁজ ধরে সা সা করে চোখের পলকে হারিয়ে যায় তারা। গুলশান এক দুই নম্বর কিংবা কামাল আতাতুর্কের কোনো ঝা চকচকে দালানে তাদের অফিস। তারা বড় অফিসের বড় কর্তা নয়, এ কথা দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলা যায়। বড় কর্তারা গুলশান এক-এর বড় রাস্তা ধরে সোনার মতন ঝকঝকে গাড়ির কাঁচের ভেতর থেকে হনহন করে হেঁটে যাওয়া মানুষদের ঘামে ভেজা শরীর দেখে মাপতে থাকে মনে মনে, ‘আজ গরমটা ভালোই পড়েছে!’ 

দিপু গুলশান দুইয়ের বিশাল পার্কওয়ালা রাস্তার পাশের এক উঁচু দালানের সাত তলায় এক বিদেশি এনজিওতে কাজ করে। কী কাজ করে বলা খুব কঠিন। কখনো বসের কাগজপাতি স্ক্যান করে দেয়, অফিসে কারো ইন্টারনেট সংযোগে ঝামেলা হলে তারটার নেড়েচেড়ে লাইন ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করে। অফিসের চা-কফি আর চকলেট কুকির মাসিক খরচের হিসাব রাখে। ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টের ডেটা এন্ট্রিতে সাহায্য করে, মাসের শুরুতে সবার মোবাইল বিলের হিসাব জমা করে। কোনো কাজে ‘না’ বলে না সে। নিজেকে এমন প্রয়োজনীয় করে তুলছে যে, দিপুর বিশ্বাস তাকে ছাড়া ‘ইনস্পিরেশন ইন্টারন্যাশনাল’ নামের এ দামি অফিস চলতে পারবে না। ফান্ড ফুরালেই বড় প্রজেক্টের বড় বড় অফিসারদের চাকরি চলে যায় যখন-তখন, কিন্তু গেল দুই বছর ধরে দিপুর চাকরি বহাল রয়েছে। দুই বছরে বেতন বেড়েছে আড়াই হাজার টাকা। সে যে টিকে আছে এ ভাবনা তাকে আরো একটু একটু করে বাঁচিয়ে রাখে।  

আরো পড়ুন:

‘লেখক হয়ে উঠতে পারা বড় সাধনার বিষয়’

বগুড়া লেখক চক্রের কবি সম্মেলন ও পুরস্কার ঘোষণা

দিপুর টিকে থাকা সংক্রান্ত এ ভাবনার খবর এ অফিসে কেউ জানে না; জানাটা জরুরিও নয়। অফিসের মানুষেরা সকাল নয়টায় অফিসে ঢুকে রিসিপশনের পাশে রাখা বাড়তি যে ডেস্ক, সেখানে দিপুকে দেখতে পায় প্রায় প্রতিদিনই। হিসাব করে দেখলে দুই মাসে একদিন সে সিক লিভ নেয়। সে হিসাব এইচআর-এর সিদ্দিক সাহেব ছাড়া আর কেউ রাখে বলে মনে হয় না। তবে দিপু যেদিন অফিসে আসে না, মনের ভুলে এ-ডেস্ক ও-ডেস্ক থেকে অনেকে ‘দিপু দিপু’ বলে ডেকে ওঠে। তারপর তারা দিপুর কথা ভুলে যায় সেদিনের জন্য।  দিপুর কথা ভাবলে প্রথমে সম্ভবত চোখে ভাসে তার হাসি মুখের কথা। সিদ্দিক সাহেব বলে, ‘দিপুর চেহারার জিওগ্রাফিটাই এমন, মনে হয় হাসি হাসি।’ আর নিশ্চিতভাবে সবার চোখে পড়ে তার পাশে রাখা ইয়া ধ্যাপসা স্টিলের হটপটটা। দুপুরের খাবার থাকে তাতে। কিন্তু সবার সাথে বসে দুপুরে সে খায় না। হটপট নিয়ে সে ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্কে চলে যায়। সেখানে বসে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার ফিরে আসে। অফিসে যেদিন ফিস্ট হয়, সেদিন সে সকলের সাথে বসে খায়, হটপট খোলে না। খাবার বন্ধ হটপট অমনি করেই বাড়ি নিয়ে যায় আবার। 

মনিরুজ্জামান হোসেন ওরফে দিপুকে নিয়ে আলাদা করে এতো কথা বলার প্রয়োজন হয়নি কখনও। কিন্তু আজ দুপুর থেকে ঘটনা খানিকটা পালটে গেল। দুপুরে মাইগ্রেশন ফাউন্ডেশন অফিসের লোকজন আসবে নতুন প্রজেক্ট সংক্রান্ত মিটিং করতে। ব্রশিউর কালার প্রিন্ট করতে হবে। স্পেশাল কেক আর সমুচা আনতে হবে। মেসেঞ্জার ছেলেটা জ্বরের জন্য আসেনি গত দুইদিন। দিপুর ওপর সব দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দিপু নেই। লাঞ্চ খেতে যেয়ে এতো সময় লাগে! রাগে কেঁপে কেঁপে ওঠে সিদ্দিক স্যার―‘লাঞ্চের সময় আর যদি কেউ বাইরে যায় তো খবর আছে! ফোন দেন ফাজিল পোলাটারে।’


দিপুর ফোন বন্ধ। আলিমা নামের যে মেয়েটা মেহমানদের চা-কফি বানিয়ে দেয় আর বড় স্যারের ফাইল আর মিটিংয়ের হিসাব রাখে, সে জানাল দিপুর হটপট তার ডেস্কেই আছে। তার মানে সে লাঞ্চে যায়নি। মাঝে মাঝে কবির নামের এক ছেলে আসে দিপুর কাছে, একই গ্রামে বাড়ি। অফিস শেষ হবার আগে আসে, রিসিপশনের পাশের সোফায় বসে অপেক্ষা করে। মাথা নিচু করে এক কাপ চা খায়। অফিস শেষে তারা একসাথে ফেরে। হয়তো আজ দিপু সেই ছেলের সাথে কোনো কারণে বেরিয়েছে। খারাপ খবর এসেছে নাকি বাড়ি থেকে? ডোনাররা আসার সময় হয়ে এসেছে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই।  

দিপুর কথা অফিসের দুই-তিনজনের মনে পড়ে পরদিন সকাল নয়টা পার হয়ে যাবার পর, দিপুর ডেস্ক ফাঁকা, টেবিলের উপর পেটমোটা হটপট। সিদ্দিক সাহেব আজ দিপুকে চাকরি ছাড়া করবে, সবাই তামাশা দেখবার অপেক্ষায়। কিন্তু দিপু এলো না। ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলে, দিপু কখনো এমন করে অফিস কামাই করেনি। কর্মচারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের ফাইল থেকে দিপুর ইমার্জেন্সি ফোন নম্বর খুঁজে বের করা হলো। নম্বরে ডায়াল করতে গিয়ে দেখা গেল একটি নম্বর কম দেওয়া― অসম্পূর্ণ মোবাইল নম্বর। ইচ্ছে করেই কি সে ভুল নম্বর দিয়েছিল? তবে দিপু যে  মিরপুর দশ নম্বরের কাজীপাড়ায় থাকে তা অফিসের অনেকেই জানে। তার ফাইলে কাজীপাড়ার একটা ঠিকানা দেওয়া আছে। ঠিক হলো আলিমা নামের মেয়েটা যেহেতু মিরপুরে থাকে, পরদিন অফিস আসবার পথে দিপুর বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসবে। দুপুর থেকে এক বোটকা গন্ধের ঝাঁঝে রিসিপশন এলাকায় টেকা যখন দায়, আলিমা বুদ্ধি করে দিপুর হটপট খুললো। নিশ্চিতভাবেই অসহ্য গন্ধটা সেখান থেকেই আসছে। হটপটে কী আছে দেখার জন্য একটা ছোট্ট জটলা তৈরি হলো দিপুর ডেস্কের পাশে। দুই টেবিল চামচ সমান ঢেড়শ ভাজি, এক চায়ের চামচ কাঁচকি মাছের চচ্চড়ি আর একটা রুটি। লাল আটার মোটা রুটিটা থেকে যে দমবন্ধ গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল, তা দূর করতে অফিস ল্যাভেন্ডার সুগন্ধি স্প্রে করতে হলো।  

আলিমা পরদিন দিপুর বাড়ি থেকে ফিরে এসে জানায়, দিপু যেখানে থাকে তাকে বাড়ি না বলে ঘর বললেই নাকি ভালো শোনায়। কাজীপাড়ার বড় রাস্তায় ডেলিকেসি নামের যে কেক-পেস্ট্রির দোকান তার পাশের রাস্তা ধরে এগোলে দ্বিতীয় বাম দিকের গলির শেষ মাথায় ডান হাতে যে চারতলা বাড়ি, তার এক তলায় থাকে দিপু। একতলায় চারটা খুপরি ঘর ভাড়া দেওয়া, তার একটিতে দিপু থাকে বা থাকত। দুইদিন ধরে সে বাসায় ফেরেনি। অফিস থেকে লোক এসেছে শুনে বাড়িওয়ালা ঢুকতে দিল সে ঘরে।  ঘরের দরজা খোলা ছিল, খোলাই নাকি থাকে। নেওয়ার মতন তেমন কিছু নেই। একটা খাট, পড়ার টেবিল, ট্রাঙ্কে কাপড়। পড়ার টেবিলে একটা বাটিতে একটু ঢেড়স ভাজি এবং একটা রুটি রাখা। সেই রুটি থেকে শরীর গুলিয়ে আসা এক বাসি ঘ্রাণ, ঠিক যেমনটা অফিসে রাখা হটপট থেকে আসছিল। বাড়িওয়ালা জানে না দিপুর গ্রামের বাড়ির ঠিকানা। চাঁপাইনবাবগঞ্জে দেশের বাড়ি, তা সকলে জানে। ঈদ পুজোর ছুটিতে বাড়ি যায়। মায়ের কথা গল্প করেছে কয়েকবার। বাবা, ভাই-বোন আছে কিনা কে জানে! বাড়িওয়ালা বলে, ‘কিছু বললে হেসে গড়িয়ে পরে ছেলেটা, নিজের সম্পর্কে তো কিছু বলে-টলে না। তা ছেলেটা মার্ডার-টার্ডার হয়ে যায় নি তো!’

মার্ডার-টার্ডার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অফিসের বড় স্যার সাত্তার সাহেব আর এইচআর-এর সিদ্দিক সাহেব মিটিঙে বসে। উন্নয়ন সংস্থাগুলোর এমন অর্থ সংকটের সময় কত যে জরুরি আলোচনায় বসতে হয় প্রতিদিন। সবকিছু পাশে সরিয়ে রেখে ত্রিশ মিনিট সময় খুঁজে খড়কুটোর মতন এসে ভেসে যাওয়া দিপুকে নিয়ে মিটিং করতে হচ্ছে দেখে বড় স্যারদের কপালে বিরক্তির ভাঁজ জমে আছে। মিটিংয়ের মাঝে বেরিয়ে এসে আলিমাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেল সিদ্দিক সাহেব। রফিকুল নামের মেসেঞ্জার ছেলেটা খেয়াল করেছে। আলিমা সমসময়ই দিপুর সাথে আলগা আলাপ করত, তার গা ঘেঁষে দাঁড়াত। বিকালে একসাথে অফিস থেকে বের হতেও দেখেছে কয়েকবার। সবার ডেস্কে সকালের চা দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে এই গোপন গরম খবরটাও জানিয়ে দিয়ে এল সে। 
আলিমাকে সারাদিন নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো―‘কি আলিমা তোমাকে ভেতরে নিয়ে স্যাররা কী বলল?’
‘দিপু ভাইয়ের কথা জানতে চাইল।’
‘কী কী?’
‘এই যে আমি তার বাড়িঘর কেমন দেখলাম, তার সম্পর্কে কী কী জানি?’
‘কী জানো? আমাদেরও বলো শুনি।’
‘তেমন কিছু তো জানি না, মাঝে মাঝে বাসে যেতাম একসাথে, মিরপুর দশে নামতাম। তখন টুকটাক কথা হতো।’ 

আলিমার থেকে এর বেশি কিছু জানা যায় না। বড় স্যারেরা সিদ্ধান্ত নিল যে এই বিষয়ে আর জলঘোলা করে লাভ নেই। মার্ডার কেস-টস হলে বাচাকুচো যে কয়জন ডোনার আছে এমন আকালের দিনে তারাও ভাগবে, কোম্পানিতে তালা পড়বে। এই ঘটনার ঠিক পাঁচদিন পর দুটো ঘটনা ঘটলো―সকালে আর বিকালে। বিকালের ঘটনাটা আগে শোনা যাক। মেসেঞ্জার রফিকুলের সাথে দিপুর দেখা হয়েছে দুপুরে মহাখালীর মোড়ে কলেরা হাসপাতালের সামনে। 

মেসেঞ্জার রফিকুলের মতে দিপুকে এক ঝলকে চিনতে কষ্ট হচ্ছিল। পাঁচদিনে সে শুকিয়ে কাঠ, গায়ের রং শ্যামলা থেকে আরো কালো হয়েছে। রফিকুলের ভাষায়, ‘পাতিলের তলার কালির লাহান ময়লা।’
দিপুই নাকি রফিকুলকে দেখে পেছন থেকে ডাক দিয়েছে।  
রফিকুল অবাক― ‘অরে দিপু ভাই, কই আছিলেন আপনি! খোঁজ নাই, খবর নাই, এমনে চাকরি থাকবে!’
তার উত্তরে ঘটনা যা বলল দিপু তা হলো এরকম। সেদিন তার রুটিটা বিচ্ছিরি রকমের পচে গিয়েছিল, প্রতি সপ্তাহেই একদিন এমন পচা রুটি তাকে খেতে হয়।  কিন্তু সেদিন বাইরে ঠা ঠা গরমের কারণে রুটিটা পচেগলে একাকার। সে ভাবলো পকেটে দুইশ আশি টাকা আছে, আজ সে ভালোমন্দ কিছু খাবে। গুলশান দুইয়ের মোড়ে সুলতান ডাইনের পিছে একটা ঠেলা গাড়িতে চাইনিজ খাওয়া বিক্রি করে। একশ বিশ টাকা দিয়ে একবার ফ্রাইড রাইস কিনলে, যতবার চাইবে রিফিল করে দেওয়া হবে। তার ছিল পেট ভর্তি খিদা। তিনবার সে রিফিল করে সেই রাইস খেয়েছে। তারপর হাসফাঁস ভাব কমাতে গুলশান এক-এর মোড়ে এসে একটা ডাব কিনে খেল। 
তারপর?
তারপর হঠাৎ কেমন বমি পেতে লাগলো দিপুর। পুরো রাস্তা সে বমি করলো, তারপর মাথা ঘুরে পরে গেল। আর কিছু মনে নাই। রাস্তার লোকজন ধরাধরি করে তাকে কলেরা হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। মাঝখান থেকে মোবাইল আর মানিব্যাগটা কে যেন নিয়ে গিয়েছে। ডায়রিয়া আর বমি কমতেই এই কয়দিন লাগল। আজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল আর পথেই রফিকুলের সাথে দেখা। 


রফিকুল ইনস্পিরেশন ইন্টারন্যাশনালে কাজ করে আজ সাত বছর। কোনো মানুষ সন্দেহের ঊর্ধ্বে না এই জ্ঞান সে লাভ করেছে এইচআর-এর সিদ্দিক সাহেবের কাছ থেকে। সিদ্দিক সাহেবকে সে তার গুরু মানে। এক আঙুলে ট্যাংরা মাছের পেট থেকে নাড়িভুঁড়ি বের করার মতন করে মানুষের ভেতরের কথা টেনে টেনে বের করে আনবার ক্ষমতা রয়েছে সিদ্দিক সাহেবের। সিদ্দিক স্যার থাকলে এমন পরিস্থিতিতে কী প্রশ্ন করতো ভাবতে ভাবতে, রফিকুল জিজ্ঞেস করল, ‘তা আপনার টাকা-পয়সা হাওয়া, মোবাইল নাই, হাসপাতালের টাকা দিলো কেডা?’
দিপুর মুখে উত্তর যেন তৈরি ছিল, ‘আব্বার নম্বর মুখস্থ ছিল ভাই। আব্বারে ফোন করে এক খালাতো ভাই মারফত টাকা ধার আনছি। কাল সকালেই অফিস যাবো ইনশাল্লাহ।’
চলে আসবার আগে রফিকুল শেষ প্যাচমারা প্রশ্ন করল, ‘তা আপ্নে ভাই গন্ধওয়ালা রুটি খান ক্যান? শরীল খারাপ করতাছেন।’
বিকেলে অফিসে ফিরে পুরো ঘটনার সাথে পচা রুটির গল্পটা যখন বললো, সিদ্দিক স্যারের পর্যন্ত চোখে এক বিন্দু জল ছলকে উঠলো।  

দিপু অবশ্য হাসি মুখেই ঘটনা ব্যাখ্যা করেছে। বাড়ির পাশে যে বিসমিল্লাহ হোটেল আছে সেখান প্রতিদিনের সকালে বানানো রুটিগুলো বিকেলে যখন বাসি হয়ে যায়, তা নামমাত্র দামে বিক্রি করে দেয়। অফিস থেকে ফেরার পথে সে দুটো রুটি কেনে। পরদিন সকালে আর দুপুরে সে রুটি খায়। আগেরদিন কেনা রুটিটা পরদিন দুপুরে শক্ত হয়ে গেলেও খেয়ে ফেলা যায়। মাঝে মাঝে রুটি হালকা পচে যায়, সে টের পায়। টাকা দিয়ে কেনা রুটি নষ্ট করার মানে হয়? একটু গন্ধ হলেও তো দিব্যি খেয়ে ফেলা যায়। 
‘আর রাতে?’ রফিকুল জানতে চেয়েছিল।  
ভীষণ নির্লিপ্ততায় দিপু নাকি বলেছিল, ‘রাতে তেমন খিদা লাগে না। চিড়া মুড়ি গুড় দিয়ে দিব্যি চলে যায়।’
অফিসের বড় স্যার মানে সাত্তার সাহেব সে গল্প শুনতে শুনতে ‘আহা আহারে’ বলে উঠলো কিন্তু তার মনে পড়ে গেল সকালে ঘটে যাওয়া ঘটনা। আজ সকালে যখন মাইগ্রেশন ম্যাটার্স থেকে ডোনার এসেছিল। কালো কফি খেতে খেতে বলল, ‘আপনাদের ওই ছেলেটা কই, শিপু না দিপু? ওকে বলেন না বিট লবণ দেওয়া সিঙ্গারাটা আনতে। কোথেকে লাস্ট দিন আনল, হেব্বি মজা!’
বড় সাহেব হাত কচলাতে কচলাতে বলেছিল, ‘দিপু তো নাই।’
‘ওহ, কই গেল। সাচ এ নাইস গাই!’
‘দুপুরে লাঞ্চ করতে বাইরে গেল, আর ফিরে আসেনি।’
‘ওহ মাই গড মিসিং কেস নাকি! পুলিশে রিপোর্ট করেছেন?’
ভুল একটা হয়ে গেছে বুঝে বড় স্যার একটা ঢোক গিলে সামাল দিল, ‘নাহ মানে দেশে চলে গেছে। মায়ের অসুখ শুনে আর ফিরে আসেনি, রিজাইন করেছে। একমাত্র ছেলে, মাকে শহরে এনে রাখারও তো উপায় নাই। কয়টা টাকা বেতন পায় বলেন!’


‘মারাত্মক প্লট। শুনেন সাত্তার সাহেব মাথায় প্ল্যান চলে আসছে। এই থার্টি থাউসেন্ড ডলার বেঁচে গেল প্রজেক্ট ফান্ড থেকে। হেডকোয়ার্টারে ফেরত পাঠানো আরেক হ্যাপা। একটা ডকুমেন্টারি করে ফেলেন। এই যে মাইগ্রেটেড এই ইয়ং পপুলেশন নিয়ে। মূল থিম হবে আরবানাইজেশন এন্ড মাইগ্রেশন। বুঝছেন? এই দিপু ছেলেটার গল্প মাথায় রেখে করবেন। এ শহরে কাজ করতে এসেছিল, মায়ের অসুখ শুনে কাউকে না জানিয়ে ফিরে গেল শহর ছেড়ে একেবারে। যে আশা নিয়ে শহরে এসেছিল, সে আশা অপূর্ন থেকে গেল, খালি হাতে গ্রামে ফিরে গেল। গ্রামেই হয়তো একটা খামার দিল, স্বনির্ভর হলো। এই থিম ধরে এগোবেন। এই শহরে স্ট্রাগল, মাইগ্রেশনের কারণ সব তুলে ধরবেন। পারবেন না?’
‘জি জি। কোনো ব্যাপারই না।’
‘ভালো একটা ডকুমেন্টারি বানালে নেক্সট ইয়ার এটা দেখিয়ে আরো কিছু ফান্ড মোবিলাইজ করা যাবে।’
এই দুর্যোগের দিনে ত্রিশ হাজার ডলার পাওয়া এক বিশাল সৌভাগ্য। এই সময় দিপুকে ফিরিয়ে আনা মানে তাকে নিয়ে বানানো গল্পটা মিথ্যে প্রমাণিত হয়। 


বিকেলে আলিমাকে টার্মিনেশন লেটার আর পুরোনো পেটমোটা হটপট নিয়ে দিপুর বাড়ি পাঠানো হলো।  
দিপু আর অফিসে আসেনি কোনো দিন। তবে ম্যাসেঞ্জার রফিকুল জানিয়েছে যে, আলিমা প্রায়ই দিপুর বাড়ি যায়। অফিসের পর সে কয়দিন আলিমের পিছু নিয়ে এই তথ্য জোগাড় করেছে। সেদিন সে দেখেছে আলিম এক কেজি তীর কোম্পানির ময়দা, রুটি বানানোর পিঁড়ি বেলুন কিনে বাড়ি ফিরছিল। নিশ্চিত সে দিপুর বাড়ি যাচ্ছিল। দিপুর সঙ্গে  যোগাযোগ রাখার অপরাধে আলিমার চাকরি খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এতো অল্প বেতনে এমন কাজ জানা লোক পাওয়া যাচ্ছে না বলে আপাতত সে টিকে আছে।   

দিপুর ডেস্কটা ঝেড়েমুছে পরিষ্কার করা হচ্ছে। বসের আত্মীয় ইন্টার্ন করতে আসছে এ অফিসে, এই ডেস্কে বসবে। নতুন ছেলেটা নাকি কালাচাঁদপুর থাকে, অনেক রাত পর্যন্ত অফিস করতে পারবে, সবার সুবিধাই হবে।  
কেউ যদি এসে দিপুর কথা জানতে চায়, তো অফিসের সকলে এক সুরে বলে, ‘ছেলেটা দুপুরে খেতে যেয়ে আর কখনো ফিরে আসেনি।’ 

ঢাকা/তারা//

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর বড় স য র ইন ট র অফ স র ক জ কর পরদ ন র মতন র একট ত রপর

এছাড়াও পড়ুন:

পেটমোটা হটপট 

গুলশান এক-এর মোড়ের রাস্তা ধরে, পরিপাটি চুলে সিঁথি কাটা ঘামে ভেজা বগল আর চকচকে নকল চামড়ার ব্যাগ আঙুলে পেঁচিয়ে, দুপুরের খাবার ভরা স্টিলের হটপট কাঁধে ঝুলিয়ে হনহন করে সকাল আটটা ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে হাঁটে যে মানুষগুলো, তাদের একজন দিপু। গুলশান এক-এর মোড় থেকে ঘুরে পকেট গলির ভাঁজ ধরে সা সা করে চোখের পলকে হারিয়ে যায় তারা। গুলশান এক দুই নম্বর কিংবা কামাল আতাতুর্কের কোনো ঝা চকচকে দালানে তাদের অফিস। তারা বড় অফিসের বড় কর্তা নয়, এ কথা দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলা যায়। বড় কর্তারা গুলশান এক-এর বড় রাস্তা ধরে সোনার মতন ঝকঝকে গাড়ির কাঁচের ভেতর থেকে হনহন করে হেঁটে যাওয়া মানুষদের ঘামে ভেজা শরীর দেখে মাপতে থাকে মনে মনে, ‘আজ গরমটা ভালোই পড়েছে!’ 

দিপু গুলশান দুইয়ের বিশাল পার্কওয়ালা রাস্তার পাশের এক উঁচু দালানের সাত তলায় এক বিদেশি এনজিওতে কাজ করে। কী কাজ করে বলা খুব কঠিন। কখনো বসের কাগজপাতি স্ক্যান করে দেয়, অফিসে কারো ইন্টারনেট সংযোগে ঝামেলা হলে তারটার নেড়েচেড়ে লাইন ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করে। অফিসের চা-কফি আর চকলেট কুকির মাসিক খরচের হিসাব রাখে। ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টের ডেটা এন্ট্রিতে সাহায্য করে, মাসের শুরুতে সবার মোবাইল বিলের হিসাব জমা করে। কোনো কাজে ‘না’ বলে না সে। নিজেকে এমন প্রয়োজনীয় করে তুলছে যে, দিপুর বিশ্বাস তাকে ছাড়া ‘ইনস্পিরেশন ইন্টারন্যাশনাল’ নামের এ দামি অফিস চলতে পারবে না। ফান্ড ফুরালেই বড় প্রজেক্টের বড় বড় অফিসারদের চাকরি চলে যায় যখন-তখন, কিন্তু গেল দুই বছর ধরে দিপুর চাকরি বহাল রয়েছে। দুই বছরে বেতন বেড়েছে আড়াই হাজার টাকা। সে যে টিকে আছে এ ভাবনা তাকে আরো একটু একটু করে বাঁচিয়ে রাখে।  

আরো পড়ুন:

‘লেখক হয়ে উঠতে পারা বড় সাধনার বিষয়’

বগুড়া লেখক চক্রের কবি সম্মেলন ও পুরস্কার ঘোষণা

দিপুর টিকে থাকা সংক্রান্ত এ ভাবনার খবর এ অফিসে কেউ জানে না; জানাটা জরুরিও নয়। অফিসের মানুষেরা সকাল নয়টায় অফিসে ঢুকে রিসিপশনের পাশে রাখা বাড়তি যে ডেস্ক, সেখানে দিপুকে দেখতে পায় প্রায় প্রতিদিনই। হিসাব করে দেখলে দুই মাসে একদিন সে সিক লিভ নেয়। সে হিসাব এইচআর-এর সিদ্দিক সাহেব ছাড়া আর কেউ রাখে বলে মনে হয় না। তবে দিপু যেদিন অফিসে আসে না, মনের ভুলে এ-ডেস্ক ও-ডেস্ক থেকে অনেকে ‘দিপু দিপু’ বলে ডেকে ওঠে। তারপর তারা দিপুর কথা ভুলে যায় সেদিনের জন্য।  দিপুর কথা ভাবলে প্রথমে সম্ভবত চোখে ভাসে তার হাসি মুখের কথা। সিদ্দিক সাহেব বলে, ‘দিপুর চেহারার জিওগ্রাফিটাই এমন, মনে হয় হাসি হাসি।’ আর নিশ্চিতভাবে সবার চোখে পড়ে তার পাশে রাখা ইয়া ধ্যাপসা স্টিলের হটপটটা। দুপুরের খাবার থাকে তাতে। কিন্তু সবার সাথে বসে দুপুরে সে খায় না। হটপট নিয়ে সে ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্কে চলে যায়। সেখানে বসে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার ফিরে আসে। অফিসে যেদিন ফিস্ট হয়, সেদিন সে সকলের সাথে বসে খায়, হটপট খোলে না। খাবার বন্ধ হটপট অমনি করেই বাড়ি নিয়ে যায় আবার। 

মনিরুজ্জামান হোসেন ওরফে দিপুকে নিয়ে আলাদা করে এতো কথা বলার প্রয়োজন হয়নি কখনও। কিন্তু আজ দুপুর থেকে ঘটনা খানিকটা পালটে গেল। দুপুরে মাইগ্রেশন ফাউন্ডেশন অফিসের লোকজন আসবে নতুন প্রজেক্ট সংক্রান্ত মিটিং করতে। ব্রশিউর কালার প্রিন্ট করতে হবে। স্পেশাল কেক আর সমুচা আনতে হবে। মেসেঞ্জার ছেলেটা জ্বরের জন্য আসেনি গত দুইদিন। দিপুর ওপর সব দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দিপু নেই। লাঞ্চ খেতে যেয়ে এতো সময় লাগে! রাগে কেঁপে কেঁপে ওঠে সিদ্দিক স্যার―‘লাঞ্চের সময় আর যদি কেউ বাইরে যায় তো খবর আছে! ফোন দেন ফাজিল পোলাটারে।’


দিপুর ফোন বন্ধ। আলিমা নামের যে মেয়েটা মেহমানদের চা-কফি বানিয়ে দেয় আর বড় স্যারের ফাইল আর মিটিংয়ের হিসাব রাখে, সে জানাল দিপুর হটপট তার ডেস্কেই আছে। তার মানে সে লাঞ্চে যায়নি। মাঝে মাঝে কবির নামের এক ছেলে আসে দিপুর কাছে, একই গ্রামে বাড়ি। অফিস শেষ হবার আগে আসে, রিসিপশনের পাশের সোফায় বসে অপেক্ষা করে। মাথা নিচু করে এক কাপ চা খায়। অফিস শেষে তারা একসাথে ফেরে। হয়তো আজ দিপু সেই ছেলের সাথে কোনো কারণে বেরিয়েছে। খারাপ খবর এসেছে নাকি বাড়ি থেকে? ডোনাররা আসার সময় হয়ে এসেছে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই।  

দিপুর কথা অফিসের দুই-তিনজনের মনে পড়ে পরদিন সকাল নয়টা পার হয়ে যাবার পর, দিপুর ডেস্ক ফাঁকা, টেবিলের উপর পেটমোটা হটপট। সিদ্দিক সাহেব আজ দিপুকে চাকরি ছাড়া করবে, সবাই তামাশা দেখবার অপেক্ষায়। কিন্তু দিপু এলো না। ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলে, দিপু কখনো এমন করে অফিস কামাই করেনি। কর্মচারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের ফাইল থেকে দিপুর ইমার্জেন্সি ফোন নম্বর খুঁজে বের করা হলো। নম্বরে ডায়াল করতে গিয়ে দেখা গেল একটি নম্বর কম দেওয়া― অসম্পূর্ণ মোবাইল নম্বর। ইচ্ছে করেই কি সে ভুল নম্বর দিয়েছিল? তবে দিপু যে  মিরপুর দশ নম্বরের কাজীপাড়ায় থাকে তা অফিসের অনেকেই জানে। তার ফাইলে কাজীপাড়ার একটা ঠিকানা দেওয়া আছে। ঠিক হলো আলিমা নামের মেয়েটা যেহেতু মিরপুরে থাকে, পরদিন অফিস আসবার পথে দিপুর বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসবে। দুপুর থেকে এক বোটকা গন্ধের ঝাঁঝে রিসিপশন এলাকায় টেকা যখন দায়, আলিমা বুদ্ধি করে দিপুর হটপট খুললো। নিশ্চিতভাবেই অসহ্য গন্ধটা সেখান থেকেই আসছে। হটপটে কী আছে দেখার জন্য একটা ছোট্ট জটলা তৈরি হলো দিপুর ডেস্কের পাশে। দুই টেবিল চামচ সমান ঢেড়শ ভাজি, এক চায়ের চামচ কাঁচকি মাছের চচ্চড়ি আর একটা রুটি। লাল আটার মোটা রুটিটা থেকে যে দমবন্ধ গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল, তা দূর করতে অফিস ল্যাভেন্ডার সুগন্ধি স্প্রে করতে হলো।  

আলিমা পরদিন দিপুর বাড়ি থেকে ফিরে এসে জানায়, দিপু যেখানে থাকে তাকে বাড়ি না বলে ঘর বললেই নাকি ভালো শোনায়। কাজীপাড়ার বড় রাস্তায় ডেলিকেসি নামের যে কেক-পেস্ট্রির দোকান তার পাশের রাস্তা ধরে এগোলে দ্বিতীয় বাম দিকের গলির শেষ মাথায় ডান হাতে যে চারতলা বাড়ি, তার এক তলায় থাকে দিপু। একতলায় চারটা খুপরি ঘর ভাড়া দেওয়া, তার একটিতে দিপু থাকে বা থাকত। দুইদিন ধরে সে বাসায় ফেরেনি। অফিস থেকে লোক এসেছে শুনে বাড়িওয়ালা ঢুকতে দিল সে ঘরে।  ঘরের দরজা খোলা ছিল, খোলাই নাকি থাকে। নেওয়ার মতন তেমন কিছু নেই। একটা খাট, পড়ার টেবিল, ট্রাঙ্কে কাপড়। পড়ার টেবিলে একটা বাটিতে একটু ঢেড়স ভাজি এবং একটা রুটি রাখা। সেই রুটি থেকে শরীর গুলিয়ে আসা এক বাসি ঘ্রাণ, ঠিক যেমনটা অফিসে রাখা হটপট থেকে আসছিল। বাড়িওয়ালা জানে না দিপুর গ্রামের বাড়ির ঠিকানা। চাঁপাইনবাবগঞ্জে দেশের বাড়ি, তা সকলে জানে। ঈদ পুজোর ছুটিতে বাড়ি যায়। মায়ের কথা গল্প করেছে কয়েকবার। বাবা, ভাই-বোন আছে কিনা কে জানে! বাড়িওয়ালা বলে, ‘কিছু বললে হেসে গড়িয়ে পরে ছেলেটা, নিজের সম্পর্কে তো কিছু বলে-টলে না। তা ছেলেটা মার্ডার-টার্ডার হয়ে যায় নি তো!’

মার্ডার-টার্ডার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অফিসের বড় স্যার সাত্তার সাহেব আর এইচআর-এর সিদ্দিক সাহেব মিটিঙে বসে। উন্নয়ন সংস্থাগুলোর এমন অর্থ সংকটের সময় কত যে জরুরি আলোচনায় বসতে হয় প্রতিদিন। সবকিছু পাশে সরিয়ে রেখে ত্রিশ মিনিট সময় খুঁজে খড়কুটোর মতন এসে ভেসে যাওয়া দিপুকে নিয়ে মিটিং করতে হচ্ছে দেখে বড় স্যারদের কপালে বিরক্তির ভাঁজ জমে আছে। মিটিংয়ের মাঝে বেরিয়ে এসে আলিমাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেল সিদ্দিক সাহেব। রফিকুল নামের মেসেঞ্জার ছেলেটা খেয়াল করেছে। আলিমা সমসময়ই দিপুর সাথে আলগা আলাপ করত, তার গা ঘেঁষে দাঁড়াত। বিকালে একসাথে অফিস থেকে বের হতেও দেখেছে কয়েকবার। সবার ডেস্কে সকালের চা দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে এই গোপন গরম খবরটাও জানিয়ে দিয়ে এল সে। 
আলিমাকে সারাদিন নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো―‘কি আলিমা তোমাকে ভেতরে নিয়ে স্যাররা কী বলল?’
‘দিপু ভাইয়ের কথা জানতে চাইল।’
‘কী কী?’
‘এই যে আমি তার বাড়িঘর কেমন দেখলাম, তার সম্পর্কে কী কী জানি?’
‘কী জানো? আমাদেরও বলো শুনি।’
‘তেমন কিছু তো জানি না, মাঝে মাঝে বাসে যেতাম একসাথে, মিরপুর দশে নামতাম। তখন টুকটাক কথা হতো।’ 

আলিমার থেকে এর বেশি কিছু জানা যায় না। বড় স্যারেরা সিদ্ধান্ত নিল যে এই বিষয়ে আর জলঘোলা করে লাভ নেই। মার্ডার কেস-টস হলে বাচাকুচো যে কয়জন ডোনার আছে এমন আকালের দিনে তারাও ভাগবে, কোম্পানিতে তালা পড়বে। এই ঘটনার ঠিক পাঁচদিন পর দুটো ঘটনা ঘটলো―সকালে আর বিকালে। বিকালের ঘটনাটা আগে শোনা যাক। মেসেঞ্জার রফিকুলের সাথে দিপুর দেখা হয়েছে দুপুরে মহাখালীর মোড়ে কলেরা হাসপাতালের সামনে। 

মেসেঞ্জার রফিকুলের মতে দিপুকে এক ঝলকে চিনতে কষ্ট হচ্ছিল। পাঁচদিনে সে শুকিয়ে কাঠ, গায়ের রং শ্যামলা থেকে আরো কালো হয়েছে। রফিকুলের ভাষায়, ‘পাতিলের তলার কালির লাহান ময়লা।’
দিপুই নাকি রফিকুলকে দেখে পেছন থেকে ডাক দিয়েছে।  
রফিকুল অবাক― ‘অরে দিপু ভাই, কই আছিলেন আপনি! খোঁজ নাই, খবর নাই, এমনে চাকরি থাকবে!’
তার উত্তরে ঘটনা যা বলল দিপু তা হলো এরকম। সেদিন তার রুটিটা বিচ্ছিরি রকমের পচে গিয়েছিল, প্রতি সপ্তাহেই একদিন এমন পচা রুটি তাকে খেতে হয়।  কিন্তু সেদিন বাইরে ঠা ঠা গরমের কারণে রুটিটা পচেগলে একাকার। সে ভাবলো পকেটে দুইশ আশি টাকা আছে, আজ সে ভালোমন্দ কিছু খাবে। গুলশান দুইয়ের মোড়ে সুলতান ডাইনের পিছে একটা ঠেলা গাড়িতে চাইনিজ খাওয়া বিক্রি করে। একশ বিশ টাকা দিয়ে একবার ফ্রাইড রাইস কিনলে, যতবার চাইবে রিফিল করে দেওয়া হবে। তার ছিল পেট ভর্তি খিদা। তিনবার সে রিফিল করে সেই রাইস খেয়েছে। তারপর হাসফাঁস ভাব কমাতে গুলশান এক-এর মোড়ে এসে একটা ডাব কিনে খেল। 
তারপর?
তারপর হঠাৎ কেমন বমি পেতে লাগলো দিপুর। পুরো রাস্তা সে বমি করলো, তারপর মাথা ঘুরে পরে গেল। আর কিছু মনে নাই। রাস্তার লোকজন ধরাধরি করে তাকে কলেরা হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। মাঝখান থেকে মোবাইল আর মানিব্যাগটা কে যেন নিয়ে গিয়েছে। ডায়রিয়া আর বমি কমতেই এই কয়দিন লাগল। আজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল আর পথেই রফিকুলের সাথে দেখা। 


রফিকুল ইনস্পিরেশন ইন্টারন্যাশনালে কাজ করে আজ সাত বছর। কোনো মানুষ সন্দেহের ঊর্ধ্বে না এই জ্ঞান সে লাভ করেছে এইচআর-এর সিদ্দিক সাহেবের কাছ থেকে। সিদ্দিক সাহেবকে সে তার গুরু মানে। এক আঙুলে ট্যাংরা মাছের পেট থেকে নাড়িভুঁড়ি বের করার মতন করে মানুষের ভেতরের কথা টেনে টেনে বের করে আনবার ক্ষমতা রয়েছে সিদ্দিক সাহেবের। সিদ্দিক স্যার থাকলে এমন পরিস্থিতিতে কী প্রশ্ন করতো ভাবতে ভাবতে, রফিকুল জিজ্ঞেস করল, ‘তা আপনার টাকা-পয়সা হাওয়া, মোবাইল নাই, হাসপাতালের টাকা দিলো কেডা?’
দিপুর মুখে উত্তর যেন তৈরি ছিল, ‘আব্বার নম্বর মুখস্থ ছিল ভাই। আব্বারে ফোন করে এক খালাতো ভাই মারফত টাকা ধার আনছি। কাল সকালেই অফিস যাবো ইনশাল্লাহ।’
চলে আসবার আগে রফিকুল শেষ প্যাচমারা প্রশ্ন করল, ‘তা আপ্নে ভাই গন্ধওয়ালা রুটি খান ক্যান? শরীল খারাপ করতাছেন।’
বিকেলে অফিসে ফিরে পুরো ঘটনার সাথে পচা রুটির গল্পটা যখন বললো, সিদ্দিক স্যারের পর্যন্ত চোখে এক বিন্দু জল ছলকে উঠলো।  

দিপু অবশ্য হাসি মুখেই ঘটনা ব্যাখ্যা করেছে। বাড়ির পাশে যে বিসমিল্লাহ হোটেল আছে সেখান প্রতিদিনের সকালে বানানো রুটিগুলো বিকেলে যখন বাসি হয়ে যায়, তা নামমাত্র দামে বিক্রি করে দেয়। অফিস থেকে ফেরার পথে সে দুটো রুটি কেনে। পরদিন সকালে আর দুপুরে সে রুটি খায়। আগেরদিন কেনা রুটিটা পরদিন দুপুরে শক্ত হয়ে গেলেও খেয়ে ফেলা যায়। মাঝে মাঝে রুটি হালকা পচে যায়, সে টের পায়। টাকা দিয়ে কেনা রুটি নষ্ট করার মানে হয়? একটু গন্ধ হলেও তো দিব্যি খেয়ে ফেলা যায়। 
‘আর রাতে?’ রফিকুল জানতে চেয়েছিল।  
ভীষণ নির্লিপ্ততায় দিপু নাকি বলেছিল, ‘রাতে তেমন খিদা লাগে না। চিড়া মুড়ি গুড় দিয়ে দিব্যি চলে যায়।’
অফিসের বড় স্যার মানে সাত্তার সাহেব সে গল্প শুনতে শুনতে ‘আহা আহারে’ বলে উঠলো কিন্তু তার মনে পড়ে গেল সকালে ঘটে যাওয়া ঘটনা। আজ সকালে যখন মাইগ্রেশন ম্যাটার্স থেকে ডোনার এসেছিল। কালো কফি খেতে খেতে বলল, ‘আপনাদের ওই ছেলেটা কই, শিপু না দিপু? ওকে বলেন না বিট লবণ দেওয়া সিঙ্গারাটা আনতে। কোথেকে লাস্ট দিন আনল, হেব্বি মজা!’
বড় সাহেব হাত কচলাতে কচলাতে বলেছিল, ‘দিপু তো নাই।’
‘ওহ, কই গেল। সাচ এ নাইস গাই!’
‘দুপুরে লাঞ্চ করতে বাইরে গেল, আর ফিরে আসেনি।’
‘ওহ মাই গড মিসিং কেস নাকি! পুলিশে রিপোর্ট করেছেন?’
ভুল একটা হয়ে গেছে বুঝে বড় স্যার একটা ঢোক গিলে সামাল দিল, ‘নাহ মানে দেশে চলে গেছে। মায়ের অসুখ শুনে আর ফিরে আসেনি, রিজাইন করেছে। একমাত্র ছেলে, মাকে শহরে এনে রাখারও তো উপায় নাই। কয়টা টাকা বেতন পায় বলেন!’


‘মারাত্মক প্লট। শুনেন সাত্তার সাহেব মাথায় প্ল্যান চলে আসছে। এই থার্টি থাউসেন্ড ডলার বেঁচে গেল প্রজেক্ট ফান্ড থেকে। হেডকোয়ার্টারে ফেরত পাঠানো আরেক হ্যাপা। একটা ডকুমেন্টারি করে ফেলেন। এই যে মাইগ্রেটেড এই ইয়ং পপুলেশন নিয়ে। মূল থিম হবে আরবানাইজেশন এন্ড মাইগ্রেশন। বুঝছেন? এই দিপু ছেলেটার গল্প মাথায় রেখে করবেন। এ শহরে কাজ করতে এসেছিল, মায়ের অসুখ শুনে কাউকে না জানিয়ে ফিরে গেল শহর ছেড়ে একেবারে। যে আশা নিয়ে শহরে এসেছিল, সে আশা অপূর্ন থেকে গেল, খালি হাতে গ্রামে ফিরে গেল। গ্রামেই হয়তো একটা খামার দিল, স্বনির্ভর হলো। এই থিম ধরে এগোবেন। এই শহরে স্ট্রাগল, মাইগ্রেশনের কারণ সব তুলে ধরবেন। পারবেন না?’
‘জি জি। কোনো ব্যাপারই না।’
‘ভালো একটা ডকুমেন্টারি বানালে নেক্সট ইয়ার এটা দেখিয়ে আরো কিছু ফান্ড মোবিলাইজ করা যাবে।’
এই দুর্যোগের দিনে ত্রিশ হাজার ডলার পাওয়া এক বিশাল সৌভাগ্য। এই সময় দিপুকে ফিরিয়ে আনা মানে তাকে নিয়ে বানানো গল্পটা মিথ্যে প্রমাণিত হয়। 


বিকেলে আলিমাকে টার্মিনেশন লেটার আর পুরোনো পেটমোটা হটপট নিয়ে দিপুর বাড়ি পাঠানো হলো।  
দিপু আর অফিসে আসেনি কোনো দিন। তবে ম্যাসেঞ্জার রফিকুল জানিয়েছে যে, আলিমা প্রায়ই দিপুর বাড়ি যায়। অফিসের পর সে কয়দিন আলিমের পিছু নিয়ে এই তথ্য জোগাড় করেছে। সেদিন সে দেখেছে আলিম এক কেজি তীর কোম্পানির ময়দা, রুটি বানানোর পিঁড়ি বেলুন কিনে বাড়ি ফিরছিল। নিশ্চিত সে দিপুর বাড়ি যাচ্ছিল। দিপুর সঙ্গে  যোগাযোগ রাখার অপরাধে আলিমার চাকরি খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এতো অল্প বেতনে এমন কাজ জানা লোক পাওয়া যাচ্ছে না বলে আপাতত সে টিকে আছে।   

দিপুর ডেস্কটা ঝেড়েমুছে পরিষ্কার করা হচ্ছে। বসের আত্মীয় ইন্টার্ন করতে আসছে এ অফিসে, এই ডেস্কে বসবে। নতুন ছেলেটা নাকি কালাচাঁদপুর থাকে, অনেক রাত পর্যন্ত অফিস করতে পারবে, সবার সুবিধাই হবে।  
কেউ যদি এসে দিপুর কথা জানতে চায়, তো অফিসের সকলে এক সুরে বলে, ‘ছেলেটা দুপুরে খেতে যেয়ে আর কখনো ফিরে আসেনি।’ 

ঢাকা/তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ