আর্সেনিক কমলে জীবন বাঁচে: দরকার নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থাপনা
Published: 20th, November 2025 GMT
বাংলাদেশে পানির আর্সেনিক সমস্যা নতুন নয়। তবে ১৭ নভেম্বর ২০২৫-এ প্রকাশিত নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ও কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষক দলের ‘জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (জেএএমএ)’ প্রবন্ধটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সত্য সামনে এনেছে।
দুই দশকের দীর্ঘ অনুসরণ থেকে স্পষ্ট দেখা গেছে, যেসব মানুষ তাদের আর্সেনিক এক্সপোজার কমাতে পেরেছে, তাদের দীর্ঘস্থায়ী রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি অর্ধেকের কাছাকাছি কমে গেছে। বিশেষ করে হৃদ্রোগ ও ক্যানসারের কারণে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
এ গবেষণা বাংলাদেশের জন্য শক্তিশালী একটি বার্তা দেয়—আর্সেনিক এক্সপোজার কমানো সম্ভব, আর কমাতে পারলে মানুষের জীবন বাঁচে।
কেন এই গবেষণা এত গুরুত্বপূর্ণগবেষণায় ১১ হাজারের বেশি মানুষের প্রস্রাবের আর্সেনিক ঘনত্ব ২০০০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত পাঁচবার পরিমাপ করা হয়েছে। দেখা গেছে, যাদের আর্সেনিক মাত্রা ধারাবাহিকভাবে কমেছে, তাদের মৃত্যুর হার সেই ব্যক্তিদের সমান হয়েছে, যারা শুরু থেকেই নিরাপদ পানির উৎস ব্যবহার করছিল। অন্যদিকে যাদের এক্সপোজার কমানো যায়নি বা বেড়েছে, তাদের ঝুঁকি উচ্চই রয়ে গেছে।
এই ফলাফল আমাদের সরাসরি বলে দেয় যে শক্তিশালী ও ধারাবাহিক আর্সেনিক মোকাবিলা কর্মসূচি মানুষকে মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে সক্ষম।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পটভূমিবাংলাদেশের ভূগর্ভে পানিতে আর্সেনিক উপস্থিতি একটি প্রাকৃতিক ভূরাসায়নিক প্রক্রিয়ার ফল। নদীভিত্তিক পলি স্তরে আটকে থাকা আয়রন-অক্সাইড থেকে আর্সেনিক ধীরে ধীরে মুক্ত হয়ে পানিতে মিশে যায়। ১৯৯০-এর দশকে জানা যায় যে নলকূপের পানি লাখ লাখ মানুষকে অজান্তেই দীর্ঘমেয়াদি আর্সেনিক ঝুঁকিতে ফেলছে। আজও প্রায় দু–তিন কোটি মানুষ নিয়মিতভাবে আর্সেনিক দূষিত পানি পান করে। এটি ধীরে ক্ষতি করে, কিন্তু ক্ষতি নিশ্চিত এবং দীর্ঘ মেয়াদে প্রাণহানির কারণও হতে পারে।
কেন মানুষ নিরাপদ আচরণ ধরে রাখতে পারে নাএটি শুধু অজ্ঞতার সমস্যা নয়। এখানে একটি সক্রিয় ব্যর্থতা রয়েছে—মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ কূপ ব্যবহার চালিয়ে যায়। আর এ সক্রিয় ব্যর্থতাকে চালিত করে কিছু লুকায়িত শর্ত। আর্সেনিক পরীক্ষার ফল ভুলে যাওয়া, নতুন টিউবওয়েলের গভীরতা সম্পর্কে নির্দেশনার অভাব, নিরাপদ কূপ ব্যবহার নিয়ে সামাজিক অস্পষ্টতা, নিয়মিত স্বাস্থ্যকর্মী পরিদর্শনের অভাব এবং কোন কূপ ব্যবহৃত হচ্ছে, তা জানার মতো মনিটরিং না থাকা—এসবই মানুষকে আবার ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেয়।
অর্থাৎ আর্সেনিক সমস্যা শুধু রাসায়নিক বা অবকাঠামোর সমস্যা নয়, এটি সিস্টেমের সমস্যা।
বন্যার মতো আর্সেনিক ও বাংলাদেশের ভূগর্ভে পরিবেশের একটি স্বাভাবিক বাস্তবতা। বন্যা যেমন ঠেকানো যায় না, আর্সেনিকও পুরোপুরি থামানো যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশ যেমন বন্যার সঙ্গে সহাবস্থান করতে শিখেছে, তেমনি আর্সেনিকের ক্ষেত্রেও আমাদের নিরাপদ সহাবস্থান গড়ে তুলতে হবে। আমরা সব পানি ব্যবহার করব, কিন্তু পানীয় জল হবে শুধু নিরাপদ, আর্সেনিকমুক্ত।
এই বাস্তবতার অংশ হিসেবে আমরা ১ জুলাই ২০২৫-এ iArsenic নামের একটি ওয়েব অ্যাপ উন্মুক্ত করি। এ অ্যাপ মানুষকে মাত্র কয়েকটি তথ্য দিয়ে তাদের নলকূপের সম্ভাব্য আর্সেনিক ঝুঁকি জানতে সাহায্য করে, যেখানে কোনো রাসায়নিক পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমরা আট স্তরের একটি সিস্টেম পদ্ধতি উপস্থাপন করি। একটি স্তর দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, কিন্তু সব কটি স্তর একসঙ্গে কাজ করলে ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে।
সমাধান: আট স্তরের সিস্টেম পদ্ধতিএই পদ্ধতি এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে প্রতিটি স্তর একটি দুর্বলতা মোকাবিলা করে এবং সব কটি স্তর মিলেই একটি কার্যকর নিরাপত্তাকাঠামো তৈরি করে।
১.
২. ব্যবহার মনিটরিং: কোন এলাকায় মানুষ আবার ঝুঁকিপূর্ণ কূপ ব্যবহার করছে, তা জানার সুযোগ থাকে। এটি দ্রুত প্রতিক্রিয়াকে সহজ করে।
৩. স্কুলভিত্তিক সচেতনতা: শিশুরা ঘরে গিয়ে পরিবারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদি আচরণ পরিবর্তনে সহায়ক।
৪. মসজিদভিত্তিক বার্তা: স্থানীয় ইমামের বার্তা মানুষ সহজে গ্রহণ করে, ফলে নিরাপদ পানির গুরুত্ব নিয়মিত মনে করিয়ে দেওয়া যায়।
৫. স্বাস্থ্যকর্মীর ফলোআপ: বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরামর্শ, পরিস্থিতি বোঝানো এবং প্রয়োজনে পরীক্ষা করা মানুষের আচরণ ধরে রাখে।
৬ সাইনবোর্ড: প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ গ্রামে স্কুল ও মসজিদের কাছে স্পষ্ট সাইনবোর্ড থাকতে হবে, যা প্রতিদিন মানুষকে স্মরণ করাবে কোন কূপ নিরাপদ, কোনটি নয়। সরকারি পর্যায়ে কিছু কার্যকর কূপের কার্যকারিতা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
৭. নিরাপদ কূপ ভাগাভাগি: আশপাশে নিরাপদ উৎস থাকলে সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাগাভাগি উৎসাহিত করা উচিত। এতে ঝুঁকিপূর্ণ কূপের ব্যবহার কমে।
৮. অবকাঠামো: কোন এলাকায় গভীর নলকূপ বা নতুন নিরাপদ উৎস স্থাপন করা উচিত, তা ডেটা ও মানচিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে।ডিজিটাল ব্যাকবোন হিসেবে iArsenic
এই পুরো সিস্টেমটি কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে একটি সমন্বিত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রয়োজন, যা iArsenic অ্যাপকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা যেতে পারে। এই প্ল্যাটফর্ম এক জায়গা থেকে চার ধরনের ব্যবহারকারীকে সংযুক্ত করবে। সাধারণ মানুষ সহজেই তাদের নিজস্ব নলকূপের সম্ভাব্য ঝুঁকি জানতে পারবে। স্বেচ্ছাসেবকেরা গ্রামের কূপগুলোর কার্যকারিতা, সমস্যা বা বিকল অবস্থার তথ্য দ্রুত রিপোর্ট করতে পারবেন।
ডিপিএইচই এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থা এ তথ্য ব্যবহার করে কোন এলাকায় মানুষ আবার ঝুঁকিপূর্ণ কূপ ব্যবহার করছে বা কোন কূপ অকার্যকর হয়ে পড়ছে, তা রিয়েল টাইমে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে এবং প্রয়োজনে অকার্যকর কূপ দ্রুত মেরামত বা আবার চালু করার জন্য সহায়তা পাঠাতে পারবে। নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনসাধারণও সার্বিক পরিস্থিতি দেখতে পারবে, ফলে কোন এলাকায় কী ধরনের পদক্ষেপ দরকার, তা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এককথায়, এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মটি পুরো সিস্টেমটিকে সমন্বিতভাবে চলতে সাহায্য করবে।
কেন এই পদ্ধতি কার্যকরএকটি বার্তা, একটি কূপ বা একটি টেস্ট মানুষকে দীর্ঘ মেয়াদে নিরাপদ রাখতে পারে না। কিন্তু যখন স্কুল, মসজিদ, স্বাস্থ্যকর্মী, ডেটা, অ্যাপ ও অবকাঠামো একসঙ্গে কাজ করে, তখন মানুষের দৈনন্দিন সিদ্ধান্ত বদলে যায়।
এটি ঠিক যেমন বাংলাদেশ বন্যার সঙ্গে বসবাস করা শিখেছে, তেমনি আর্সেনিক ঝুঁকির সঙ্গেও পরিকল্পিতভাবে বসবাস করা সম্ভব।
শেষ কথাজেএএমএ গবেষণা প্রমাণ করেছে যে আর্সেনিক এক্সপোজার কমালে মৃত্যুর ঝুঁকি কমে যায়। এখন বাংলাদেশকে এমন একটি স্থায়ী, বহুস্তরীয় সিস্টেম তৈরি করতে হবে, যা মানুষের পানি ব্যবহারের আচরণকে দীর্ঘ মেয়াদে নিরাপদ রাখবে। iArsenic এবং আট স্তরের পদ্ধতি সেই ভবিষ্যতের ভিত্তি তৈরি করছে, যেখানে পানির ব্যবহারে থাকবে স্বাধীনতা, কিন্তু পানীয় জলে থাকবে কঠোর নিরাপত্তা। আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এই প্রস্তাবকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের কোটি মানুষের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে এগিয়ে আসবে।
ড. মোহাম্মদ হক ইউনিভার্সিটি অব পোর্টসমাউথ (যুক্তরাজ্য)
ড. আশরাফ দেওয়ান কার্টিন ইউনিভার্সিটি (অস্ট্রেলিয়া)
ড. ইমরান হাসান অক্সফাম বাংলাদেশ
*মতামত লেখকদের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউন ভ র স ট ক প ব যবহ র ব যবহ র কর র আর স ন ক ক ন এল ক য ক র যকর ন র পদ সমস য র একট নলক প
এছাড়াও পড়ুন:
আর্সেনিক কমলে জীবন বাঁচে: দরকার নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশে পানির আর্সেনিক সমস্যা নতুন নয়। তবে ১৭ নভেম্বর ২০২৫-এ প্রকাশিত নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ও কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষক দলের ‘জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (জেএএমএ)’ প্রবন্ধটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সত্য সামনে এনেছে।
দুই দশকের দীর্ঘ অনুসরণ থেকে স্পষ্ট দেখা গেছে, যেসব মানুষ তাদের আর্সেনিক এক্সপোজার কমাতে পেরেছে, তাদের দীর্ঘস্থায়ী রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি অর্ধেকের কাছাকাছি কমে গেছে। বিশেষ করে হৃদ্রোগ ও ক্যানসারের কারণে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
এ গবেষণা বাংলাদেশের জন্য শক্তিশালী একটি বার্তা দেয়—আর্সেনিক এক্সপোজার কমানো সম্ভব, আর কমাতে পারলে মানুষের জীবন বাঁচে।
কেন এই গবেষণা এত গুরুত্বপূর্ণগবেষণায় ১১ হাজারের বেশি মানুষের প্রস্রাবের আর্সেনিক ঘনত্ব ২০০০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত পাঁচবার পরিমাপ করা হয়েছে। দেখা গেছে, যাদের আর্সেনিক মাত্রা ধারাবাহিকভাবে কমেছে, তাদের মৃত্যুর হার সেই ব্যক্তিদের সমান হয়েছে, যারা শুরু থেকেই নিরাপদ পানির উৎস ব্যবহার করছিল। অন্যদিকে যাদের এক্সপোজার কমানো যায়নি বা বেড়েছে, তাদের ঝুঁকি উচ্চই রয়ে গেছে।
এই ফলাফল আমাদের সরাসরি বলে দেয় যে শক্তিশালী ও ধারাবাহিক আর্সেনিক মোকাবিলা কর্মসূচি মানুষকে মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে সক্ষম।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পটভূমিবাংলাদেশের ভূগর্ভে পানিতে আর্সেনিক উপস্থিতি একটি প্রাকৃতিক ভূরাসায়নিক প্রক্রিয়ার ফল। নদীভিত্তিক পলি স্তরে আটকে থাকা আয়রন-অক্সাইড থেকে আর্সেনিক ধীরে ধীরে মুক্ত হয়ে পানিতে মিশে যায়। ১৯৯০-এর দশকে জানা যায় যে নলকূপের পানি লাখ লাখ মানুষকে অজান্তেই দীর্ঘমেয়াদি আর্সেনিক ঝুঁকিতে ফেলছে। আজও প্রায় দু–তিন কোটি মানুষ নিয়মিতভাবে আর্সেনিক দূষিত পানি পান করে। এটি ধীরে ক্ষতি করে, কিন্তু ক্ষতি নিশ্চিত এবং দীর্ঘ মেয়াদে প্রাণহানির কারণও হতে পারে।
কেন মানুষ নিরাপদ আচরণ ধরে রাখতে পারে নাএটি শুধু অজ্ঞতার সমস্যা নয়। এখানে একটি সক্রিয় ব্যর্থতা রয়েছে—মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ কূপ ব্যবহার চালিয়ে যায়। আর এ সক্রিয় ব্যর্থতাকে চালিত করে কিছু লুকায়িত শর্ত। আর্সেনিক পরীক্ষার ফল ভুলে যাওয়া, নতুন টিউবওয়েলের গভীরতা সম্পর্কে নির্দেশনার অভাব, নিরাপদ কূপ ব্যবহার নিয়ে সামাজিক অস্পষ্টতা, নিয়মিত স্বাস্থ্যকর্মী পরিদর্শনের অভাব এবং কোন কূপ ব্যবহৃত হচ্ছে, তা জানার মতো মনিটরিং না থাকা—এসবই মানুষকে আবার ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেয়।
অর্থাৎ আর্সেনিক সমস্যা শুধু রাসায়নিক বা অবকাঠামোর সমস্যা নয়, এটি সিস্টেমের সমস্যা।
বন্যার মতো আর্সেনিক ও বাংলাদেশের ভূগর্ভে পরিবেশের একটি স্বাভাবিক বাস্তবতা। বন্যা যেমন ঠেকানো যায় না, আর্সেনিকও পুরোপুরি থামানো যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশ যেমন বন্যার সঙ্গে সহাবস্থান করতে শিখেছে, তেমনি আর্সেনিকের ক্ষেত্রেও আমাদের নিরাপদ সহাবস্থান গড়ে তুলতে হবে। আমরা সব পানি ব্যবহার করব, কিন্তু পানীয় জল হবে শুধু নিরাপদ, আর্সেনিকমুক্ত।
এই বাস্তবতার অংশ হিসেবে আমরা ১ জুলাই ২০২৫-এ iArsenic নামের একটি ওয়েব অ্যাপ উন্মুক্ত করি। এ অ্যাপ মানুষকে মাত্র কয়েকটি তথ্য দিয়ে তাদের নলকূপের সম্ভাব্য আর্সেনিক ঝুঁকি জানতে সাহায্য করে, যেখানে কোনো রাসায়নিক পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমরা আট স্তরের একটি সিস্টেম পদ্ধতি উপস্থাপন করি। একটি স্তর দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, কিন্তু সব কটি স্তর একসঙ্গে কাজ করলে ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে।
সমাধান: আট স্তরের সিস্টেম পদ্ধতিএই পদ্ধতি এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে প্রতিটি স্তর একটি দুর্বলতা মোকাবিলা করে এবং সব কটি স্তর মিলেই একটি কার্যকর নিরাপত্তাকাঠামো তৈরি করে।
১. ব্যক্তিগত ঝুঁকি ধারণা তৈরি: iArsenic অ্যাপ তাৎক্ষণিকভাবে কূপের সম্ভাব্য ঝুঁকি জানায়, যা মানুষের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে বড় প্রভাব ফেলে।
২. ব্যবহার মনিটরিং: কোন এলাকায় মানুষ আবার ঝুঁকিপূর্ণ কূপ ব্যবহার করছে, তা জানার সুযোগ থাকে। এটি দ্রুত প্রতিক্রিয়াকে সহজ করে।
৩. স্কুলভিত্তিক সচেতনতা: শিশুরা ঘরে গিয়ে পরিবারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদি আচরণ পরিবর্তনে সহায়ক।
৪. মসজিদভিত্তিক বার্তা: স্থানীয় ইমামের বার্তা মানুষ সহজে গ্রহণ করে, ফলে নিরাপদ পানির গুরুত্ব নিয়মিত মনে করিয়ে দেওয়া যায়।
৫. স্বাস্থ্যকর্মীর ফলোআপ: বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরামর্শ, পরিস্থিতি বোঝানো এবং প্রয়োজনে পরীক্ষা করা মানুষের আচরণ ধরে রাখে।
৬ সাইনবোর্ড: প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ গ্রামে স্কুল ও মসজিদের কাছে স্পষ্ট সাইনবোর্ড থাকতে হবে, যা প্রতিদিন মানুষকে স্মরণ করাবে কোন কূপ নিরাপদ, কোনটি নয়। সরকারি পর্যায়ে কিছু কার্যকর কূপের কার্যকারিতা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
৭. নিরাপদ কূপ ভাগাভাগি: আশপাশে নিরাপদ উৎস থাকলে সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাগাভাগি উৎসাহিত করা উচিত। এতে ঝুঁকিপূর্ণ কূপের ব্যবহার কমে।
৮. অবকাঠামো: কোন এলাকায় গভীর নলকূপ বা নতুন নিরাপদ উৎস স্থাপন করা উচিত, তা ডেটা ও মানচিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে।
এই পুরো সিস্টেমটি কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে একটি সমন্বিত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রয়োজন, যা iArsenic অ্যাপকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা যেতে পারে। এই প্ল্যাটফর্ম এক জায়গা থেকে চার ধরনের ব্যবহারকারীকে সংযুক্ত করবে। সাধারণ মানুষ সহজেই তাদের নিজস্ব নলকূপের সম্ভাব্য ঝুঁকি জানতে পারবে। স্বেচ্ছাসেবকেরা গ্রামের কূপগুলোর কার্যকারিতা, সমস্যা বা বিকল অবস্থার তথ্য দ্রুত রিপোর্ট করতে পারবেন।
ডিপিএইচই এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থা এ তথ্য ব্যবহার করে কোন এলাকায় মানুষ আবার ঝুঁকিপূর্ণ কূপ ব্যবহার করছে বা কোন কূপ অকার্যকর হয়ে পড়ছে, তা রিয়েল টাইমে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে এবং প্রয়োজনে অকার্যকর কূপ দ্রুত মেরামত বা আবার চালু করার জন্য সহায়তা পাঠাতে পারবে। নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনসাধারণও সার্বিক পরিস্থিতি দেখতে পারবে, ফলে কোন এলাকায় কী ধরনের পদক্ষেপ দরকার, তা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এককথায়, এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মটি পুরো সিস্টেমটিকে সমন্বিতভাবে চলতে সাহায্য করবে।
কেন এই পদ্ধতি কার্যকরএকটি বার্তা, একটি কূপ বা একটি টেস্ট মানুষকে দীর্ঘ মেয়াদে নিরাপদ রাখতে পারে না। কিন্তু যখন স্কুল, মসজিদ, স্বাস্থ্যকর্মী, ডেটা, অ্যাপ ও অবকাঠামো একসঙ্গে কাজ করে, তখন মানুষের দৈনন্দিন সিদ্ধান্ত বদলে যায়।
এটি ঠিক যেমন বাংলাদেশ বন্যার সঙ্গে বসবাস করা শিখেছে, তেমনি আর্সেনিক ঝুঁকির সঙ্গেও পরিকল্পিতভাবে বসবাস করা সম্ভব।
শেষ কথাজেএএমএ গবেষণা প্রমাণ করেছে যে আর্সেনিক এক্সপোজার কমালে মৃত্যুর ঝুঁকি কমে যায়। এখন বাংলাদেশকে এমন একটি স্থায়ী, বহুস্তরীয় সিস্টেম তৈরি করতে হবে, যা মানুষের পানি ব্যবহারের আচরণকে দীর্ঘ মেয়াদে নিরাপদ রাখবে। iArsenic এবং আট স্তরের পদ্ধতি সেই ভবিষ্যতের ভিত্তি তৈরি করছে, যেখানে পানির ব্যবহারে থাকবে স্বাধীনতা, কিন্তু পানীয় জলে থাকবে কঠোর নিরাপত্তা। আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এই প্রস্তাবকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের কোটি মানুষের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে এগিয়ে আসবে।
ড. মোহাম্মদ হক ইউনিভার্সিটি অব পোর্টসমাউথ (যুক্তরাজ্য)
ড. আশরাফ দেওয়ান কার্টিন ইউনিভার্সিটি (অস্ট্রেলিয়া)
ড. ইমরান হাসান অক্সফাম বাংলাদেশ
*মতামত লেখকদের নিজস্ব