আমৃত্যু সক্রিয় থাকব, অবসর নেব না: হাসনাত আবদুল হাই
Published: 21st, November 2025 GMT
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে সিভিল সার্ভিসে দীর্ঘ ও সফল ক্যারিয়ার গড়েন হাসনাত আবদুল হাই। লিখছেন অবিরাম। বর্ণাঢ্য, বিস্তর এক সৃষ্টিশীল জগৎ তাঁর। জীবনকে মনে করেন একটি ‘যাত্রা’। বহু সম্মাননায় ভূষিত এই কথাসাহিত্যিক বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য পেয়েছেন একুশে পদক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অলাত এহ্সান ও রাহাত রাব্বানী
অলাত এহ্সান: রিসেন্টলি আপনার যে দু’তিনটে গল্প পড়লাম, একটা জিনিস দেখলাম, আপনি আপনার বয়সের মানুষের চরিত্র দিয়ে গল্পটা লিখছেন। মানে আপনি তরুণ বয়সে ফিরে যাচ্ছেন না, বা সময় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাবছেন না। আপনি কি এই বয়সটাকে বুঝে বা এটাকে এনজয় করে লিখতে পছন্দ করেন?
আরো পড়ুন:
ঘুমানোর অর্থ মৃত্যু আর জেগে ওঠা হলো জীবনের স্বপ্ন দেখা: হোর্হে লুই বোর্হেস
আওয়ামী লীগ ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে যা বললেন প্রধান উপদেষ্টা
হাসনাত আবদুল হাই: না, এটা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। আমি যদি ইয়াংম্যানদের, ৩০-এর ঘরের চরিত্রকে নিয়ে লিখি, তাহলে আমি ওদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, আমার বয়স দিয়ে দেখি না। আমি আমার বিষয়ের যে চরিত্র, বিষয়ের যে সময়, ওই সময়, সময়ের মেজাজ আর চরিত্রদের বয়স অনুযায়ী লিখি। যেমন জুলাই আন্দোলনের ওপরে আমার যে উপন্যাস, ‘জুলাই ক্যালাইডোস্কোপ’; এখানে আমার চরিত্ররা বয়সে বিশের কোঠায়। তারা টেলিভিশন চ্যানেলে ক্যামেরাম্যান, রিপোর্টার, মেয়েটাও তাই, ছেলেটাও তাই। তারপরে একজন হলো জার্নালিস্ট, আরেকজন চারুকলার ছাত্র, সে এখন পড়ায়―এ রকম। তার মানে ওরা বিশের কোঠায়, ত্রিশের না। ওদের চোখ দিয়ে আমি আন্দোলনটা দেখছি। আমার চোখ দিয়ে না। আমার চোখ দিয়ে করলে ওটা তো স্মৃতিকথা হয়ে গেল, তাহলে তো উপন্যাস হবে না।
রাহাত রাব্বানী: আমরা আসার সময় এ-নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আপনার বয়সের অন্যান্য লেখক-কবি যারা আছেন, তারা খুব একটা উৎসাহী হন স্মৃতিকথা লেখার জন্য।
হাসনাত আবদুল হাই: হ্যাঁ, এটা ঠিকই; সবাই পারে না। যেহেতু আমার চর্চাটা অব্যাহত আছে, এ জন্য বয়স আমাকে, আমার চিন্তাভাবনা, আমার সৃজনশীলতা গ্রাস করতে পারে নাই।
অলাত এহ্সান: এক সাক্ষাৎকারে আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, আপনি স্মৃতিচারণ করেন কি না বা এ রকম। আপনি বেশ শক্তভাবে বলেছিলেন, স্মৃতিচারণ অনেক বেশি কর্মহীন অবস্থার মতো। আপনার হাতে এখনও অনেক লেখা আছে এবং লেখা নিয়ে পরিকল্পনা আছে। সুতরাং স্মৃতিচারণ নিয়ে একেবারে মশগুল থাকাটা আপনার দ্বারা হয় না।
হাসনাত আবদুল হাই: না, ওটা আমি করতে চাই না। স্মৃতিচারণ তো তারাই করবে এখন যারা সক্রিয় না, যারা অবসর নিয়েছে। আমি তো অবসর নেই নাই ভাই। এবং আমি আশাকরি, আমৃত্যু আমি সক্রিয় থাকব, আমি অবসর নেব না।
অলাত এহ্সান: আপনার গল্পগুলোয় মানুষের ভেতরে ‘বিচ্ছিন্নতা’― এই জায়গাটা বেশি অ্যাড্রেস করেছে। যেহেতু মানুষের ভেতরে দূরত্ব, বিচ্ছিন্নতা, না বোঝা, বা ধরুন এই তো ‘ডাইনোসর’ নামে বড় গল্প লিখলেন ‘সিল্করুট’ ঈদ সংখ্যায়।
হাসনাত আবদুল হাই: হ্যাঁ, কল্পকাহিনি। কল্পকাহিনিও ঠিক না, ফিউচারিস্টিক। যেমন ধরো আমাদের এই এনভায়রনমেন্টাল পলিউশন, খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে ভেজাল―এগুলো যদি চলতেই থাকে, তাহলে দেখা যাবে ওই টিকটিকিটা বড় হতে হতে ডাইনোসর হয়ে গেল। এবং আমরা তখন রাস্তায় বেরুলে আমাদের অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে বেরুতে হবে। এটা সায়েন্স ফিকশন বলব না, এটা হলো ধরো আজ থেকে ৩০ বছর পরে বাংলাদেশে এ রকম হতে পারে; যে কোনো দেশে হতে পারে। আমরা যদি বায়ুদূষণ এবং খাওয়ার ভেজাল বন্ধ না করি, তাহলে আমাদের দুটো জিনিস হবে। এই সব কীটপতঙ্গ, এরা মিউটেট করবে। মিউটেশনের ফলে এরা আকারে অনেক বড় হয়ে যাবে। এখনই তো আমি দেখি, দেওয়ালে যে ইয়েগুলো, টিকটিকি, অনেক বড় দেখায়। হৃষ্টপুষ্ট। আগে আমরা ছেলেবেলায় যেমন দেখতাম, তার চাইতে তিন-চার গুন বড়। এটা একটা পরিবর্তন। আরেকটা পরিবর্তন দেখি, তেলাপোকা এখন আর বড় নাই, ছোট হয়ে গেছে। কেন হয়ে গেল?- ওই তেলাপোকাগুলো খেয়ে টিকটিকিগুলো বড় হয়েছে। ফুড চেইনটা উল্টে গেছে। আমি কেমিক্যাল ব্যবহার করলাম তেলাপোকা, উইপোকার হাত থেকে বাঁচার জন্য। ফলে ওদের মধ্যে একটা বায়োলজিক্যাল মিউটেশন হয়ে গেল। তো, এটার উপর ভিত্তি করেই আমি ‘ডাইনোসর’ লিখলাম।
অলাত এহ্সান: আমার কাছে প্রথম দিকে মনে হচ্ছিল, এটা কি ডেসটোপিয়ান ঘরানার.
হাসনাত আবদুল হাই: ডেসটোপিয়ান বটেই। যে ভবিষ্যৎটা খুব আশাব্যঞ্জক না, ওটাই তো ডেসটোপিয়ান। আর আশাব্যঞ্জক হলে ওটা ইউটোপিয়ান। তো এটা আশাব্যঞ্জক না। সুতরাং ডেসটোপিয়ান তো বটেই। এবং বুঝলে, এই যেমন দেওয়ালে এটা দেখে আমার আইডিয়াটা আসছে। টিকটিকি বড় হচ্ছে, তেলাপোকা ছোট হচ্ছে, আমরা ভেজাল খাচ্ছি। এ সব মিলিয়ে গল্পটা। তারপরে আমি চিন্তা করলাম―আচ্ছা এ রকম হতে পারে, আজ থেকে ৩০ বছর পরে আমি রাস্তায় বের হলে; আমাকে ঘরের মধ্যেও অক্সিজেন নিতে হয়। রাষ্ট্র এটা রেশন করছে যে, আমি কত পার্সেন্টেজ পাব। এমনকি আমি পার্কে যে যাব, পার্কেও আমি ডেইলি যেতে পারব না। কারণ পার্কে তো ন্যাচারাল অক্সিজেন। সেজন্য রাষ্ট্র অথবা সিটি কর্পোরেশন রেশন করছে যে, তুমি সপ্তাহে দুইদিন যেতে পারবে এবং সেটাও কয়েক ঘণ্টার জন্য। তো ওটা আমি দেখালাম না যে, ওই চরিত্র তো সবসময় যাচ্ছে না। তারপর ওরা একটা সমুদ্রের পাড়ে যাবে, সেটাও রেশন। ইচ্ছা করলেই যেতে পারবে না। আবার ওখানেও ঘুষ-টুষ আছে। এগুলো আছে গল্পটাতে।
অলাত এহ্সান: আপনার কি মনে হয় ডেসটোপিয়ান ধরনের এ রকম একটা এনভায়রনমেন্টাল ক্রাইসিসের মধ্যে আমরা পড়ে যাব?
হাসনাত আবদুল হাই: যাব মানে কি? আমরা তো পড়ে গেছি অলরেডি। এটা আরও ঘনীভূত হবে। আমরা তো এখন বায়ুদূষণে এক নম্বর। এবং ঢাকা সিটির যে টেম্পারেচার, এটা তো গত ৫০ বছরের হাইয়েস্ট!
অলাত এহ্সান: আপনার প্রথম বইয়ে একটা গল্প আছে ‘ইন্টারভিউ’ নামে। সেখানে একটা মেয়ের চাকরির ইন্টারভিউকে কেন্দ্র করে হুলস্থুল কাণ্ড হচ্ছে। এটা তো একটা ডকুমেনটেশন হয়ে গেছে। আপনি তো ’৬৫ থেকেই প্রশাসনিক কাজে যুক্ত হয়ে গেলেন, মানে আমলা। ওই সময় কি এমন ব্যাপার আরও বেশি ছিল?
হাসনাত আবদুল হাই: হ্যাঁ, ওই সময় তো অফিসে মেয়ে ছিল না। মেয়েদের কোটা ছিল না, কিছু ছিল না। মেয়েরা হয় স্কুল-কলেজের শিক্ষক, নার্স এগুলো; এবং ব্যাংকে বড় জোর কিছু আসে। আমি যখন চাকরিতে ঢুকি, কোনো সরকারি অফিসে তখন মেয়ে ছিল না, মতিঝিলের বাণিজ্যিক অফিসেও না। এই টেলিফোন অপারেটর, কারও প্রাইভেট সেক্রেটারি এসব হতো। যেমন ধরো, ‘পাকিস্তান অবজারভার’; ওই সময়ে খুব ইম্পর্টেন্ট পত্রিকা। এডিটর ছিল খুব নামকরা; এখন নামটা ভুলে গেলাম। উনি ইংরেজিতে পাস করা একজন মেয়ে রাখলেন উনার প্রাইভেট সেক্রেটারি। এ নিয়ে বিরাট হইচই― এডিটর প্রাইভেট সেক্রেটারি নিয়েছে মেয়ে লোক। খুবই সুন্দরী মেয়ে। ড. আন্দালিব সাদানী, উনি পার্সিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজের অধ্যাপক ছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে; তার মেয়ে। ইউনিভার্সিটিতে আর্টস বিল্ডিংয়ে তখন পঁচিশ-ত্রিশজন মেয়ে, সব বিভাগ মিলিয়ে। আর্টস বিল্ডিং তখন ছিল মেডিকেল কলেজের ওই দিকে। তো এ নিয়ে নানান হইচই―কী আলাপ করে প্রাইভেট সেক্রেটারির সঙ্গে, নানান রিউমার। এখন তো নিউজ পেপারে ফিফটি পারসেন্টেরও বেশি হবে কোথাও, টেলিভিশন অফিসে। সুতরাং এটা কোনো নিউজ না। কিন্তু ওই সময় বিরাট ব্যাপার। এইসব পরিবর্তন আমরা দেখেছি যেটা তোমরা দেখো নাই। এই যে সামাজিক পরিবর্তন, বিশেষ করে মেয়েদের, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ, এটা আমরা দেখলাম।
অলাত এহ্সান: এর বিরুদ্ধে কী ধর্মীয় সংগঠনগুলোর বক্তব্য ছিল― নারীদের নেয়া যাবে না, এটা করা যাবে না?
হাসনাত আবদুল হাই: না, এরকম কিছু ছিল না। আশ্চর্যের ব্যাপার বুঝলে, ওই সময়, ’৫০-এর দশক, ’৬০-এর দশক, তখন মেয়েরা শাড়ি পরে আসত, মাথায় ঘোমটা পর্যন্ত দিত না। ইউনিভার্সিটিতে খালি একটা জিনিস করত ওরা। ধরো, আমাদের ক্লাসে মাত্র দুটো মেয়ে, সব ক্লাসেই তাই। সব ইয়ারেই দুটো, বড়জোর তিনটা। ’৬০-এর পরে আস্তে আস্তে মেয়েরা বাড়তে লাগল। তো আমাদের সময়ে এই যে দুজন-তিনজন মেয়ে, ওরা ক্লাসে ঢুকত না। ক্লাসের প্রথম রো (সারি) ওদের জন্য ছিল। কিন্তু মেয়েরা আগে বসত না। ওরা দরজার বাইরে থাকত, টিচার আসলে ওদের নিয়ে বসত। ওরা যদি এসে বসতও, আমরা তাদের নিয়ে টিটকারি করা, এটা-ওটা করা, এগুলো করতাম না। সুতরাং মেয়েরা তখন খুব স্বচ্ছন্দে ঘুরতে পারত, এবং কেউ তাদের চলাফেরা, কাপড় পরা, এগুলো নিয়ে কোনো রকম মন্তব্য করে নাই।
আর্টস বিল্ডিংয়ে আমরা ৫ কি ৭ হাজার স্টুডেন্ট ছিলাম, এর মধ্যে মাত্র দুইটা পেয়ার (জুটি) প্রেম করত। আমরা তাদের নিয়ে কোনো রকমের সিনক্রিয়েট করিনি। তারা ওই আমগাছের নিচে বসে একসঙ্গে লাঞ্চ করতো কিংবা ছেলেটা সাইকেল চালিয়ে চালিয়ে যেত, মেয়েটা ওর পাশ দিয়ে ইউনিভার্সিটির সামনের রাস্তায় ইউক্যালিপটাস গাছ ভরা; তখন তো এত গাড়ি-ঘোড়াও ছিল না― যাচ্ছে। এটা দেখে আমরা কেউ তাদের পিছু নিতাম না। সুতরাং তুমি যেটা বললে যে, মেয়েদের ব্যাপারে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল কি না, মানে কোনো রকমের নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিমালা ছিল না। লিখিত তো না-ই, অলিখিতও ছিল না।
এই যে নভেরা, তাঁকে আমরা ইউনিভার্সিটিতে দেখলাম। চিটাগংয়ের মেয়ে। উনি এখানে এসে একটা ভাস্কর্যের এক্সিবিশন করলেন। ওই সূত্রে তাঁকে দেখলাম যে, মাথায় সন্ন্যাসিনীর মতো চুল বাঁধা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, (কপাল ইঙ্গিত করে) এখানে এরকম লম্বা একটা টিপ, কালো শাড়ি, এটা দেখলাম। এবং উনি বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এই যে ডেইলি স্টারের প্রথম সম্পাদক, যিনি মারা গেলেন, নামটা ভুলে গেছি, উনিও ছিলেন ওই সময়ে। তাঁর কয়েকটা বয়ফ্রেন্ড ছিল। কয়েকটা মানে এক সময়ে না, উনি একটা পর্বে। আমরা যখন দেখলাম, তখন নভেরার বয়ফ্রেন্ড ছিল, উনি আমাদের সৈয়দ মুজতবা আলীর আত্মীয়, এসএম আলী, তাঁর সঙ্গে নভেরাকে দেখতাম ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ নিয়ে আমরা কিংবা মুরুব্বিরা কোনো উচ্চবাচ্য করিনি যে― একটা অবিবাহিত মেয়ে, তাকে নিয়ে একটা পুরুষ এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে! এখন তো চিন্তাই করা যাবে না যে, মাথায় ঘোমটা দেয়নি, বোরকা পরেনি কিংবা হিজাব পরেনি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। তো এই দিক দিয়ে যদি চিন্তা করো, নারী প্রগতির দিক দিয়ে যদি চিন্তা করো, আমরা পিছিয়ে গিয়েছি। আমাদের সময়ে মেয়েরা যে স্বাধীনতা উপভোগ করেছে, এখন ওরা পাচ্ছে না। এবং আমাদের সময়ে ঢাকা শহরে তো বটেই, মফস্বলে, এমনকি গ্রামে কোনো ধর্ষণের খবর আমরা পাই নাই। এখন তো, মানে কি বলব? মেয়েদের অনেক অগ্রগতি হয়েছে, ওরা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করছে, এটা-ওটা করছে। কিন্তু নারী স্বাধীনতা বলতে যেটা বুঝি, ওটা ওরা পায় না। বেশ হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে।
অলাত এহ্সান: একটা জিনিস দেখছিলাম, আপনারা মানে যারা পরবর্তীতে লেখালেখিতে খ্যাতিমান হয়ে উঠলেন, তাঁদের অনেকেরই শুরু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে। আমরা মনে করি যে, লেখালেখির জন্য শিক্ষকতা পেশা খুব উপযোগী। তো আপনারা আবার প্রশাসনে চলে গেলেন―এর কারণ কী ছিল?
হাসনাত আবদুল হাই: আমাদের দেশের লেখকরা এসেছেন ট্র্যাডিশনালি দুই পেশা থেকে। সাংবাদিক আর হলো আমলাতন্ত্র। আমলাতন্ত্র না, শিক্ষক এবং পরে আমলাতন্ত্র। শিক্ষকরাই পরে আমলা হয়েছে। যেমন আমি শিক্ষক ছিলাম এক বছর, পরে আমলা হলাম। আমি বলব, সাংবাদিকতা আমাদের সাহিত্যের প্রধান উৎস। তুমি যদি সংখ্যা দিয়ে হিসাব করো, তাহলে দেখবা অধিকাংশ লেখক ছিলেন সাংবাদিক। তখনো তাই ছিল, এখনো তাই। এরপরেই হলো শিক্ষক, হাইফেন আমলা।
অলাত এহ্সান: তাহলে তখন মনে করলেন যে, আমলা হয়ে উঠলেও আপনার লেখালেখির কোনো ব্যাঘাত হবে না, বা আপনার প্যাশন কমে যাবে না―এরকম মনে হলো?
হাসনাত আবদুল হাই: না, এটা নির্ভর করছে তুমি কতটা সিরিয়াস লেখক হিসেবে। তুমি যদি সিরিয়াস না হও, এটা শখ হিসেবে নাও যে, আমি আমলা হওয়ার আগে শখে শখে আমি লিখলাম, লিখেছি, আমলা হয়ে আর ওটা থাকে না। যেমন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, উনি খুব ভালো কবি ছিলেন। শামসুর রাহমানের চাইতেও ভালো কবিতা লিখতেন। সরকারি চাকরিতে ঢুকে উনি তেমন লিখলেন না। লেখালেখি করলেন, কিন্তু নিয়মিতভাবে না। তার মানে হলো তাঁর কাছে সরকারি চাকরিটাই প্রধান হয়ে গিয়েছে, লেখাটা গৌণ। আমি এটা করি নাই। চাকরিতেও আমি সিরিয়াস ছিলাম, লেখালেখি, বই পড়া―সবসময়। আমি যখন যেখানে গিয়েছি, বই আমার সঙ্গে থাকত। আমি বই কিনেছি, পড়েছি। এবং যখন লেখা কমে গিয়েছে, যেমন ধরো পশ্চিম পাকিস্তানে আমি ছিলাম দুই বছর। ওখানে তো লেখালেখির পরিবেশ নাই। পরিবেশ মানে কোনো পত্রপত্রিকা নাই, আমাকে ফোন করে না যে―আমাকে একটা লেখা দেন। না চাইলে আমি লেখা কি দেব? দেব না। যেহেতু আমি ওই দুই বছর বই পড়েছি, সেই জন্য আমি লেখার জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তো, এটা নির্ভর করছে যে, আমলা হওয়ার পর সেই আমলা লেখাটাকে কি শখ হিসেবে দেখছে, নাকি এটাকে তার চাকরির মতো সমান গুরুত্ব দিচ্ছে? আমি দিয়েছি। আবদুশ শাকুরও দিয়েছেন। মীজানুর রহমান শেলী দেয় নাই। ও কিন্তু দারুণ একজন সাহিত্যিক হতে পারত। কথাসাহিত্যিক। আমরা যখন উপন্যাস লিখি নাই, যখন আমাদের উপন্যাস ছেপে বের হয় নাই, ও তখন লিখেছে এবং সে বই বেরিয়েছে। ‘পাতালে শর্বরী’ সেই সময়ে লিখেছে। এবং ওর উপন্যাসের গদ্য, ওর ছোটগল্পের গদ্য অতি-আধুনিক। কিন্তু ও চাকরিতে ঢোকার পর সাহিত্য নিয়ে আর থাকল না। এ জন্য ও লেখক হিসেবে পরিচিতিও পেল না। আমি মনে করি, ও আমার চাইতেও অনেক বেশি প্রতিভাবান। এ রকম প্রতিভাবান, তুমি যদি ঘরে ঢুকায়া দিয়ে বলবে যে, আপনি আজকে একটা উপন্যাস লেখেন। ও এক রাত্রের মধ্যে লিখে ফেলবে।
রাহাত রাব্বানী: লেখালেখিটা তাহলে প্রথম দিকে শখ হিসেবে হয়ে যাচ্ছিল?
হাসনাত আবদুল হাই: লেখালেখিটা বুঝলে, এটা একটা খুব, তোমার প্রেমিকার মতোন। যত সম্পর্ক গাঢ় হবে ততই তোমার ওপরে তার দাবি আসবে। এবং এই দাবি এমন, তোমার সময়ের ওপর তার দাবি। এমন দাবি যে চাকরিতে তুমি ফাঁকি দিতে পারছ না, কিন্তু তুমি সংসারে ফাঁকি দেওয়া শুরু করো। যেটা আমি দিয়েছি। আমার ওয়াইফকে যে টাইম দেওয়ার কথা আমি দেই নাই, আমার ছেলে-মেয়েকে যে টাইম দেওয়ার কথা আমি দেই নাই। অফিস থেকে এসে লেখা শুরু করছি। তো লেখালেখিটা খুব একটা স্বার্থপরের কাজ এবং এটা একটা পানিশমেন্ট। এবং এই পানিশমেন্টটা হলো সেলফ ইনফ্লিক্টেড। স্ব-আরোপিত। আমি নিজেকেই নিজে দিচ্ছি। আমার এটা থেকে বের হওয়ার উপায় নাই।
যেমন আমি কোনো অনুবাদ করি না। আমার যখন লেখার দরকার, আমি ডাইরেক্ট ইংরেজিতে লিখি। আমি একটা নিউজ পেপার ‘ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস’-এ মাসে চারটা কলাম লিখি। এখনো লিখি। কিন্তু আমি ইংরেজিতে গল্প-উপন্যাস লিখি না। অনুবাদও করি না।
অলাত এহ্সান: আপনার অনুবাদে কবিতার বই তো আছে।
হাসনাত আবদুল হাই: আমার ছেলের বউ ক্যানসারে ভুগল; আমার এত কষ্ট, আমি রাত্রে ঘুমাইতে পারি না, দিনে খাইতে পারি না। তাই একদিন এসে রাত দুইটায় এখানে বসলাম, দেখি টেবিলের ওপরে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এক বই। আমি যখন চিটাগংয়ে ছিলাম, বেলাল চৌধুরী ওকে নিয়ে গেছিল আমার বাসায়, আমাকে ও বইটা দিয়েছিল। ওই রাতে দেখি যে বইটা। আমার ঘুম আসছে না, আমি পড়লাম। আমাকে দিয়েছে ’৮২-তে, আমি পড়লাম ২০২০ সালে। ২৮ বছর পরে। ২৮ বছর বইটা আমার সঙ্গে আছে। তো পড়লাম। কিন্তু রাত কাটে না। ভাবলাম অনুবাদ করি তো! অনুবাদ করতে গিয়ে দেখি এত তন্ময় হয়ে যাই যে পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে কোনো জ্ঞানই নেই। ভোর হয়ে গেল, নাস্তা দিল। আমি ভাবলাম, আরে! অনুবাদ করলে তাহলে এই মানসিক কষ্টটা পাব না। অনুবাদ শুরু করলাম। তারপরে হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা, তাহলে এই অনুবাদটাকে একটা কমন সাবজেক্ট, একটা বিষয় কাঠামোর মধ্যে আনি। কী আনা যায়? কবিতা... প্রেমের কবিতা। না, প্রেমের কবিতা অনেক হয়েছে। তাহলে হাজার বছরের... তখন ‘হাজার বছরের বাঙলা কবিতা’। আমি বাংলার ছাত্র না, আমার কাছে কবিতার বই নাই, কিচ্ছু নাই। তারপরে কিসের পরে কী আসবে কিচ্ছু জানি না। চর্যাপদ কী, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী―কিচ্ছু না। কিন্তু আমার মাথার মধ্যে চেপে বসল―আমাকে লিখতে হবে। কেউ আমাকে বই দিয়ে সাহায্য করলো না। আমি বাংলাবাজার গিয়ে, নীলক্ষেতে গিয়ে মঙ্গলকাব্য, এটা-ওটা ধরলাম, কলকাতা থেকে আধুনিক কবিতার বই আনলাম প্রায় দুইশ। নিয়ে এসে আমি এই মোবাইল ফোনে, ফেইসবুকে নোট আছে, নোটে আমি ইংরেজি, বাংলা, অনুবাদ এবং অরিজিনাল কবিতা, ইন্ট্রোডাকশনসহ প্রায় ৯৫০ পৃষ্ঠা টাইপ করে পাঠাই। ও (প্রকাশক) আমাকে প্রুফ দেখার জন্য পাঠায়। আমার তখন ইয়ে (আগ্রহ) হয়েছে পুত্রবধূকে আমি এটা দেখাব― তোমার এই অসুখ আমাকে এই অনুবাদে নিয়ে এসেছে। এর আগেই তো সে মরে গেল। তো আমার এটা শেষ করতে ছয় মাস লাগে। এই ছয় মাস আমি তো আত্মীয়-স্বজন, ছেলে-মেয়ে এদের টাইম দেই নাই, নিজেকেও টাইম দেই নাই। এই অর্থে যে, আমি ঠিক সময়ে খাচ্ছি না, ঠিক সময়ে ঘুমাচ্ছি না, ঠিক সময়ে গোসল করছি না―এই রকম।
লেখক হতে গেলে তুমি যদি নিষ্ঠার সঙ্গে লেখক হও, তুমি যদি সৎ হও লেখায়, তাহলে এই পানিশমেন্ট তোমাকে পেতে হবে। শাস্তিটা কী? তোমার খাওয়া থাকবে না, ঘুম হবে না, বিশ্রাম হবে না, তুমি নিকটজন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবে না, কারো জন্য তুমি সময় দিতে পারবে না। এই শাস্তি তোমাকে পেতে হবে। এই শাস্তির মধ্যেও তৃপ্তি যে, একটা ভার কেটে যায়। যখন তুমি একটা বই শেষ করো, একটা মস্ত বড় ভার তোমার বুকের ওপর থেকে উঠে যায়। এটাই তোমার তৃপ্তি।
অলাত এহ্সান: আপনাদের সময় পর্যন্ত আমরা যে ক’জনের নাম বলতে পারি, তারপরে প্রশাসনিক ক্যাডার থেকে কিন্তু খুব বেশি লেখক পাচ্ছি না মনে হয়। ও-রকম ভালো লেখক পেয়েছি আর?
হাসনাত আবদুল হাই: আন্দালিব রাশদী; ও তো ভালো লেখে। ভালো অনুবাদও করে। (ফায়জুল ইসলাম ছিলেন। মারা গেছেন― অলাত)। আমলাদের মধ্যে আমি তাঁকে বলব এখন প্রথম সারির লেখক। আরেকজন ছিল, সে অবশ্য কবি, কামাল চৌধুরী। ভালো, সে ভালো কবিতা লেখে। আসাদ মান্নান, সেও ভালো কবিতা লেখে; আমলা ছিল। এ রকম কয়েকজন আছে। আমলা জীবনের একটা সুবিধা হলো যে, আমাদের অভিজ্ঞতা অর্জনের ক্ষেত্র অসীম, অপরিমেয়। সমাজের নানা শ্রেণির মানুষ আমরা দেখি। যারা সাংবাদিক, অতটা দেখে না। ডাক্তাররা দেখে। যারা ল’য়ার, তারাও দেখে। তাদের কাছে খুনি, বাটপার, চোর সবই যায়। যে দুর্নীতিবাজ, সেও যায়। এই কয়েকটা পেশা আছে, যেখানে সমাজবীক্ষণের বিরাট একটা সুযোগ। তার মধ্যে আমলাতন্ত্র একটা।
অলাত এহ্সান: কিন্তু আমলাতন্ত্রকে আমরা কমবেশি ‘সমাজ বিচ্ছিন্ন’ই তো ভাবি মনে হয়। মানে সাধারণের মধ্যে যে ভাবনাটা।
হাসনাত আবদুল হাই: না, সমাজ বিচ্ছিন্ন এ ভাবে যে, আমি যেরকম বললাম, দেখো, আমি সমাজকে আমার লেখায় নিয়ে আসছি, কিন্তু আমি তো সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারছি না। আমার তো টাইম নাই। আমি চাকরি করে অর্ধেক সময় যাচ্ছে, বাকি অর্ধেক সময় আমার লেখালেখিতে যাচ্ছে। তো আমি তো খুব সামাজিক না। যেজন্য লেখক হিসেবে আমার কোনো গোষ্ঠী নাই। আমি একটা লেখা লিখলে, ওই লেখা বেরুলে, বই বেরুলে, ওই বই নিয়ে যে আলোচনা করবে, এরকম কেউ নাই তো আমার।
অলাত এহ্সান: বই নিয়ে তো আমরা পড়ি, কিন্তু আলোচনা...।
হাসনাত আবদুল হাই: না, কিন্তু তোমরা কেউ আলোচনা করো না আমার বইয়ের। এখনো কেউ বলে―হ্যাঁ, আপনি ‘নভেরা’র লেখক। আরে ভাই! নভেরার পরে যে কত নাতি-পুতি বেরিয়ে গেছে। কত না লিখে ফেলেছি! এই যে জুলাইকে নিয়ে লিখলাম, কেউ লিখতে পারে নাই। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখলাম, কেউ লিখলো কিনা। কেউ লিখতে পারে নাই। আমি লিখেছি। আমি বলি, এটা এত বড় একটা ঘটনা, মুক্তিযুদ্ধের পরে এটা আমাদের জীবনে, জাতীয় জীবনে সবচাইতে বড় ঘটনা। এটা লিখতে হবে। একজন কথাসাহিত্যিক হিসেবে এটা আমি না লিখে পারবো না।
অলাত এহ্সান: আপনার উপন্যাসগুলোর সামাজিক চরিত্রায়ণ বা সামাজিকতা আছে। একটা সেন্ট্রাল দিকও আছে যে, চরিত্রগুলো কোনো না কোনোভাবে প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় যাচ্ছে এবং সেখানে গিয়ে তারা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে, যেটা দিয়ে আসলে সমাজ বাস্তবতাটাকে পাওয়া যায়। আপনার পেশাগত জীবনের কারণেই কি ক্যারেক্টার এরকমভাবে গড়ে উঠেছে?
হাসনাত আবদুল হাই: কিছুটা পেশাগত, কিছুটা আমার সমাজবীক্ষণ। কারণ লেখক হিসেবে, কথাসাহিত্যিক হিসেবে আমাকে তো দেখতে হয় সব কিছু। আমি ধরো চার-পাঁচটা নিউজ পেপার পড়ি। মফস্বল সংবাদ বেশি গুরুত্ব দিয়ে পড়ি। এই সংবাদে পুরো বাংলাদেশের খবর চলে আসে।
অলাত এহ্সান: মফস্বল সংবাদগুলোতে এখন আর প্রথম পাতার চাইতে কোনো ভিন্নতা, বিশেষত্ব নাই। আগে যে স্টোরিগুলো পাওয়া যেত, এখন আসে না।
হাসনাত আবদুল হাই: হ্যাঁ, স্টোরিগুলো আসে না―এটা ঠিক। মোনাজাতউদ্দিন যেভাবে মফস্বলের সংবাদ দিত ও রকম হয় না। কিন্তু আমি তো ঢাকায় বসে আছি, বাইরের সম্বন্ধে আমি কি করে জানব? একমাত্র এই নিউজ পেপার আর হলো সোশ্যাল মিডিয়া। ফেইসবুকে মাঝে মাঝে আসে, সবসময় আসে না। তো আমার যে দৃষ্টিভঙ্গি, আমার যে মতাদর্শ বলো, আমার যে মতবাদ, যেটা আমার লেখার মধ্যে দিয়ে এসেছে, সেটা আমার নিজের অভিজ্ঞতা, ডাইরেক্ট। আরেকটা হলো ইনডাইরেক্ট, যেটা আমি নিউজ পেপার পড়ে, লোকের মুখে শুনে― এটা।
অলাত এহ্সান: মতাদর্শের আলাপ থেকে মনে হলো, আপনি যখন বেড়ে উঠলেন ’৫০ এর দশকে। ’৬০ এর দশকে পেশাজীবন শুরু করলেন। এ সময় সবচাইতে স্মার্টনেস প্রকাশে একটা সহজ উপায় ছিল, বাম রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হওয়া। আপনারা, যেমন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রভাবিত ছিলেন, আবদুশ শাকুরও ছিলেন।
হাসনাত আবদুল হাই: না, উনি (আবদুশ শাকুর) ছিলেন না। উনি মাদ্রাসার ছাত্র। বামপন্থী ছিলেন না। (তিনি এ নিয়ে আগ্রহী ছিলেন, মানে এই আলাপটা নিয়ে―অলাত)। না, এটা তার কোনো লেখায় দেখা যায় না।
অলাত এহ্সান: রবীন্দ্র চর্চায় বামপন্থীদের ভূমিক নামে দীর্ঘ প্রবন্ধ আছে―‘রবীন্দ্রজীবনের অনুজ্জ্বল অঞ্চল’ বই।
হাসনাত আবদুল হাই: তাঁর গানের ব্যাপারে খুব আগ্রহ ছিল। গান আর গোলাপ চাষ। তাঁর আলাপ-আলোচনা সবই এ দুটাকে নিয়ে ছিল। ওর তো সমাজের এত ইয়ে ছিল না।
অলাত এহ্সান: চারপাশের প্রভাব কি এভাবে পড়েছিল আপনার উপর? বেড়ে উঠতে উঠতে?
হাসনাত আবদুল হাই: না। এখন শোনো, ইউনিভার্সিটিতে আমরা যখন ভর্তি হলাম, আমরা দেখলাম যে, যত ভালো ছাত্র, যারা স্ট্যান্ড করেছে পরীক্ষায় অথবা ভালো গায়ক, ভালো বক্তৃতা দেয়, ওরা সব স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন― অলাত) করে, মানে বামপন্থী। আমাদেরও চাইলো, কেউ গেল, কেউ গেল না। আমি কোনো দলে গেলাম না। আমি বললাম, না, আমরা কোনো দলে জয়েন করব না। তখন স্টুডেন্টস ইউনিয়ন প্রকাশ্যে ছিল না, ওদের কালচারাল ফ্রন্ট ছিল―সংস্কৃতি সংসদ। তখন স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বলে ক্যাম্পাসে কোনো অর্গানাইজেশন ছিল না। তারপর আওয়ামী লীগের ছিল ‘শিল্প ও সাহিত্য পরিষদ’, যার সভাপতি ছিল আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী। আমরা যখন ফার্স্ট ইয়ারে গেলাম, আমাদের রিক্রুট করার জন্য খুব এটা-ওটা করল। আমি ক্লাসফ্রেন্ডদের বললাম, দেখো, আমরা কোনো দলে যাব না। আমরা এভাবেই থাকব। আমার দলে ৩০ জন যদি থেকে থাকে, ঢাকা কলেজ থেকে গিয়েছিলাম। ঢাকা কলেজের ৩০ জনের মধ্যে ২৫ জনই হয়তো দুই দলে যোগ দিল। পাঁচজন আমরা নিরপেক্ষ থেকে গেলাম। আমি আর চারজন আমার বন্ধু, আমরা কোনো দলে ঢুকি নাই। আমরা এমএ পরীক্ষা পর্যন্ত এভাবেই ছিলাম। আমার জয়েন না করার একটা ছিল যে, আমরা চিহ্নিত হবো না, এক। আর দুই ছিল, ছাত্র ইউনিয়নে যাই নাই, ওদের মধ্যে একটা উন্নাসিকতা দেখলাম। ওরা একটা ভাব দেখালো যে, ওদের দলে না গেলে, জয়েন না করলে যেন আমি ভালো লেখক হতে পারব না, ভালো ছাত্র হতে পারব না, ভালো বক্তা হতে পারব না। এরকম একটা উন্নাসিকতা দেখাল যে, ওরা ব্রাহ্মণ, আমাকে একটা অনারারি পোস্ট দিচ্ছে― তুমি তো ব্রাহ্মণ না, তো তোমাকে আমরা অনারারি ব্রাহ্মণ করে নিচ্ছি। এই যে ব্রাহ্মণ্যবাদ, এটা আমি পছন্দ করি নাই। এ কারণে আমি যাই নাই। কিন্তু আমি বামপন্থী সব লেখকের লেখা পড়েছি এবং আমার লেখার মধ্যে বামপন্থী ব্যাপারও আছে।
আমার ‘তিমি’ উপন্যাস, এটা তো বামপন্থী মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে লেখা। আমি কি বামপন্থী? তুমি যদি কোনো আদর্শের প্রতি আমার দুর্বলতা বলো, আমার বামপন্থী আদর্শের প্রতি দুর্বলতা আছে। কারণ আমি একটা শোষণহীন সমাজ চাই। এবং সাম্যবাদের ভিত্তিতে সবাই মোটামুটি সমান, শোষণ হচ্ছে না, শোষক-শোষিত নাই, এরকম একটা সমাজ চাই। এটা করতে গেলে তোমাকে বামপন্থী আদর্শ ধারণ করতেই হবে। কিন্তু আমি কোনো মার্কসিস্ট গ্রুপে যাইনি। আমি যে রাশিয়ার ওপরে বইটা লিখলাম, সেখানে এটা বলেছি। তবে আমার দুঃখ লেগেছে এত লোকের, এত কষ্টের, এত আত্মত্যাগ, কত মৃত্যু, তারপরে এই বিপ্লবটা হলো। বিপ্লবের পরও ওখানে অনেক লোক মারা গেছে; এই করেছে, সেই করেছে এবং বিপ্লবের অনেক পর সাম্যবাদের যে প্রমিজ, প্রতিশ্রুতি, সেটা ওরা পেল। সেই প্রতিশ্রুতিটা কী? ফ্রি এডুকেশন, ফ্রি হেলথ কেয়ার। চাকরি মোটামুটি নিশ্চিত, কেউ বেকার থাকবে না। বাড়ি? তুমি হয়তো তিন কামরা ঘর পাবে না, অন্তত একটা মেস তুমি পাবে, তোমাকে রাস্তায় থাকতে হবে না। এই যে আহার, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, এগুলোর যে নিশ্চয়তা এটা রাশিয়া দিল, এটা কিন্তু দিয়েছে অনেক পরে। নিকিতা ক্রুশ্চেভ আসার পরে। ক্রুশ্চেভ আসা পর্যন্ত এইসব শুদ্ধি অভিযান, মার, কাট। স্টালিন পর্যন্ত খালি এইসব শুদ্ধি অভিযান চলেছে। হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে, সাইবেরিয়া পাঠাচ্ছে। সমাজতন্ত্রের ওই যে প্রতিশ্রুতি, যেটা ’৯১-এ শেষ হলো, গত ৩৫ বছর ধরে ওরা এইটা ধ্বংস করে দিল। বলে, ওরা চালাতে পারছিল না, এটা-ওটা।
আমার বক্তব্য হলো, ওরা তো সেই হিটলারের আক্রমণের সময় টিকেছিল। চার বছর যুদ্ধ করেছে। তখন তাদের সব ধ্বংস হয়ে গেছে, এত লোক মারা গেছে, তখনও তো তারা কমিউনিজম ফেলে দেয়নি, ত্যাগ করেনি। এখন কী হলো এমন? ওরা আমেরিকার সঙ্গে, পশ্চিমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে। ওরা যদি খরচ কমাতে চায়, ওদের আর্মি একটু ছোট করলেই হতো, ডিফেন্স এক্সপেন্ডিচার ছোট করলেই হতো। এই যে বাইরে থেকে লাখ লাখ বিদেশি ছাত্র নিয়ে যায় তারা; দরকার নাই, কমিয়ে দাও। ওদের ব্যয় সংকোচের, ব্যয় সাশ্রয় করার জন্য অনেক উপায় ছিল। তা না করে তারা কমিউনিজম ত্যাগ করল। আমার বইতে এই জিনিসটা খুব আক্ষেপের সঙ্গে ধরেছি যে, তারা জীবন দিয়ে প্রতিশ্রুতিটা রক্ষা করেছিল, শেষ পর্যায়ে এসে এভাবে নষ্ট করল! এটা নেতৃত্বের ব্যর্থতা। তো, যে কথা আসছিল যে, ছাত্রজীবনে আমি বামপন্থী কোনো দলে যোগ দেইনি কিন্তু বামপন্থী আদর্শ সবসময় আমার কাছে গুরুত্ব পেয়েছে, বামপন্থী লেখকদের লেখা পড়েছি।
অলাত এহ্সান: এখন তো বামপন্থীবিরোধী লেখকরাও পশ্চিমা পেট্রোনাইজড। তাদের একটা উত্থানও আছে। সেটা আপনি কীভাবে দেখবেন?
হাসনাত আবদুল হাই: বামপন্থীরা এখন একটা আপদকালীন টাইমের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। যেমন ধরো বাংলাদেশ হওয়ার পরপর বামপন্থীরা দেশে একটু ইয়ে করে উঠেছিল। এমনকি পাকিস্তান আমলেও তারা যেমন ছিল, জহির রায়হান-টায়হান তারা যারা বামপন্থী ছিল। তখনকার যারা লেখক শওকত আলী, এমনকি আমাদের হাসান আজিজুল হক, আবুবকর সিদ্দিক―সবই বামপন্থী ছিল। তখনকার কবি-সাহিত্যিক সবই, ৯০ শতাংশ বামপন্থী ছিল। এখন তো সেরকম দেখা যায় না, এখন তো বামপন্থী লেখক-টেখক দেখি না।
অলাত এহ্সান: আপনি যেভাবে দেশভাগ-পূর্ব সময়ে দাঙ্গা দেখেছেন, বিশ্বযুদ্ধে করুণ অবস্থা দেখেছেন, এগুলো কি আপনার ভেতরে ট্রমা তৈরি করেছিল দীর্ঘ সময় পর্যন্ত?
হাসনাত আবদুল হাই: অবশ্যই, অবশ্যই। যে কোনো লেখকই―সে কবি হোক, সাহিত্যিক হোক, খুব সেনসেটিভ। বাইরে যা কিছু ঘটছে, সাধারণ মানুষ একবার তাকাবে। লেখক কয়েকবার তাকাবে― লোকটাকে ফুটপাত থেকে নামিয়ে দিলো কেন? পুলিশ এসে গ্রেপ্তার করল কেন? এগুলো কয়েকবার দেখবে। ওর মধ্যে একটা গল্প তুমি দেখতে পাবে। সাধারণ লোক ওটা দেখবে না। সুতরাং যেসব ঘটনা আমি দেখেছি―যুদ্ধ, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, পার্টিশন, প্রত্যেকটা ঘটনা আমার ভেতরের যে লেখক সত্তা, এটা নির্মাণ করেছে; অনবরত নির্মাণের প্রক্রিয়ায় রেখেছে। এটাকে ফাইনাল কোনো শেপে আসতে দেয় নাই।
এখনো লেখক হিসেবে আমার যে সত্তা এটা নির্মীয়মান। কারণ এখনো আমি এই বাইরের অভিজ্ঞতা নিচ্ছি, গ্রহণ করছি এবং আমি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি। এই যেমন ধরো ‘জুলাই আন্দোলন’, এটাকে তো আমি গবেষকের দৃষ্টিতে দেখছি না। এটা আমাকে আঘাত করেছে। আমি রিঅ্যাক্ট করছি। এ জন্য আমি এই লেখাটা লিখেছি। আমি যদি গবেষকের দৃষ্টিতে দেখতাম, তাহলে একটা গবেষণামূলক লেখা, একটা প্রবন্ধের বই হতো। আমি সৃজনশীল লেখক। সৃজনশীল মানেই আমার একটা খুব স্পর্শ সংবেদনশীলতা রয়েছে। আমি সহজে বিচলিত হই, আলোড়িত হই। একটা ঘটনা, যেটা একজন দর্শক দেখে ভুলে যাবে, ওটা বাসায় আসার পরেও আমার মনের মধ্যে ঘুরতে থাকে। আমি ওটার মধ্যে একটা প্যাটার্ন খুঁজি। ওটার মধ্যে আমি একটা কার্যকারণ-সম্পর্ক খুঁজে বের করি। এটা আমি না শুধু, সবাই, প্রত্যেক লেখকই কাজটা করে। তুমি যে প্রসঙ্গ তুললে, এইসব ঘটনার প্রোডাক্ট আমি। যদি আমি শুধু মননশীল লেখক হতাম, তাহলে আমার পড়াশোনার যে বই, ওই বই এবং আমার যে মনন, সেগুলোর প্রোডাক্ট আমি। আমার অভিজ্ঞতা এখানে কাজ করত না। আমার ব্যক্তিজীবনের যে অভিজ্ঞতা, এটা আমার কথাশিল্পের জীবনে কাজে দেয়। এটা ভূমিকা রেখেছে, রাখছে এবং রাখবে।
রাহাত রাব্বানী: আপনি এক সময় এসে, এই যে জীবনীসাহিত্য লিখলেন। এটা কখন মনে হলো যে, ‘জীবনী উপন্যাস’ লেখা যায়?
হাসনাত আবদুল হাই: ব্যাপারটা কি, আমি সুলতানকে দেখলাম। আমার ইংরেজিতে পড়া ছিল ‘লাস্ট ফর লাইফ’, আরভিং স্টোনের ভ্যান গগের জীবন নিয়ে লেখা। দেশের ভেতর সমরেশ বসুর ‘দেখি নাই ফিরে’, রামকিঙ্কর বেইজকে নিয়ে লিখেছিলেন উপন্যাস; শেষ করতে পারেননি। ওটা আমি পড়েছি। জীবনী নিয়ে যে উপন্যাস করা যায়, এসব পড়ে আমি জানতে পেরেছি। তখনও আমার লেখার কোনো ইচ্ছা হয় নাই। কিন্তু যখন সুলতানকে সামনাসামনি দেখলাম―আরে বাবা! এত বড় মাপের মানুষ! এঁকে নিয়ে উপন্যাস করা যায়। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হওয়ার মতোই উনি। এ ভাবেই আইডিয়াটা আসলো। আমার কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না।
রাহাত রাব্বানী: আপনি তো লিখলেনই―গাঁজা খাচ্ছে, উড়াচ্ছে...।
হাসনাত আবদুল হাই: এই ব্যতিক্রমী জীবন, এটাতে তুমি উদ্বুদ্ধ হবেই। আমাকে আরও যেটা আকৃষ্ট করল লিখতে, সেটা হলো উনি শুধু ব্যতিক্রমী না, উনি নিজের শর্তে জীবনযাপন করলেন। উনি রাধা সাজবেন, ধুতি পরবেন, শাড়ি পরবেন, মাথায় ফুল গুঁঁজবেন, রাধা সাজবেন, নাচবেন, বাঁশি বাজাবেন, গাঁজা খাবেন―এগুলো করবেন। উনি নিজের শর্তে, সমাজের শর্তে না কিন্তু; শেষ পর্যন্ত তা-ই করেছেন। এটা তো একটা দিক, ঔপন্যাসিক হিসেবে, কথাসাহিত্যিক হিসেবে এখানে লেখার খোরাক আছে। এর চাইতেও যেটা আমাকে বেশি মুগ্ধ করল, এইসব পাগলামি সত্ত্বেও, উনি কিন্তু উনার শিল্পীসত্তা ভুলে যাননি। এঁকেছেন। যে জন্য আজকে জয়নুল ও সুলতান একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। আমরা আজ জয়নুল বললেই সুলতান বলি। প্রথম বললেই জয়নুল, সুলতান, কামরুল বলি―বলি না? এই তিনজন। আর তো কেউ তাঁর ধারেকাছে আসতে পারে না। এই তিনজনই আমাদের ত্রিরতœ।
অলাত এহ্সান: মুর্তজা বশীর...?
হাসনাত আবদুল হাই: না, ধারে-কাছেই নাই। এমন কি এই যে সফিউদ্দিন আহমদ, উনি অনেক বড় মাপের আর্টিস্ট। কিন্তু উনার ঠিক ইমেজটা এভাবে গড়ে ওঠেনি। ইমেজ কেউ ইচ্ছে করে গড়ে তুলতে পারে না। ইচ্ছে করে আমি একটা প্রোগ্রাম করলাম টেলিভিশনে, তোমাকে ডাকলাম ইন্টারভিউ নাও, এটা করে আমার একটা ইমেজ হবে? হবে না। কার যে ইমেজ হবে না-হবে, এটা কেউ বলতে পারে না, অ্যাক্সিডেন্টাল। কে যে স্টার হবে, কে যে সেলিব্রেটি―কেউ বলতে পারে না। এই যে আমাদের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। উনি তো অনেক বই লিখেছেন। উনার তো খালি ‘লালসালু’ ক্ল্যাসিক হয়ে গেছে। আর তো কোনোটা ক্ল্যাসিক হয় নাই। অথচ উপন্যাসের ফর্ম হিসেবে, শৈলী হিসেবে ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ ‘লালসালু’র চাইতে অনেক এগিয়ে। কিন্তু ‘লালসালু’টা বেস্টসেলার। ওটা ক্ল্যাসিক। ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ হয় নাই।
ঢাকা/লিপি
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইউন ভ র স ট ত আম দ র স র চর ত র আম র ল খ ব র হ মণ দ র সময় উপন য স ব মপন থ র প রথম অবসর ন ওই সময় জ বন র শ ষ কর আম র স অন ক ব দর শ র র ভ তর ইন ট র হয় ন ই আম র ক আম র ব প রব ন র জন য চ কর ত আম র য আম র চ করল ম ক সময় এখন ত র একট ট করল করল ন র বয়স হওয় র আপন র পড়ল ম ই সময় আদর শ এ রকম র ওপর ত রপর
এছাড়াও পড়ুন:
আমৃত্যু সক্রিয় থাকব, অবসর নেব না: হাসনাত আবদুল হাই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে সিভিল সার্ভিসে দীর্ঘ ও সফল ক্যারিয়ার গড়েন হাসনাত আবদুল হাই। লিখছেন অবিরাম। বর্ণাঢ্য, বিস্তর এক সৃষ্টিশীল জগৎ তাঁর। জীবনকে মনে করেন একটি ‘যাত্রা’। বহু সম্মাননায় ভূষিত এই কথাসাহিত্যিক বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য পেয়েছেন একুশে পদক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অলাত এহ্সান ও রাহাত রাব্বানী
অলাত এহ্সান: রিসেন্টলি আপনার যে দু’তিনটে গল্প পড়লাম, একটা জিনিস দেখলাম, আপনি আপনার বয়সের মানুষের চরিত্র দিয়ে গল্পটা লিখছেন। মানে আপনি তরুণ বয়সে ফিরে যাচ্ছেন না, বা সময় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাবছেন না। আপনি কি এই বয়সটাকে বুঝে বা এটাকে এনজয় করে লিখতে পছন্দ করেন?
আরো পড়ুন:
ঘুমানোর অর্থ মৃত্যু আর জেগে ওঠা হলো জীবনের স্বপ্ন দেখা: হোর্হে লুই বোর্হেস
আওয়ামী লীগ ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে যা বললেন প্রধান উপদেষ্টা
হাসনাত আবদুল হাই: না, এটা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। আমি যদি ইয়াংম্যানদের, ৩০-এর ঘরের চরিত্রকে নিয়ে লিখি, তাহলে আমি ওদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, আমার বয়স দিয়ে দেখি না। আমি আমার বিষয়ের যে চরিত্র, বিষয়ের যে সময়, ওই সময়, সময়ের মেজাজ আর চরিত্রদের বয়স অনুযায়ী লিখি। যেমন জুলাই আন্দোলনের ওপরে আমার যে উপন্যাস, ‘জুলাই ক্যালাইডোস্কোপ’; এখানে আমার চরিত্ররা বয়সে বিশের কোঠায়। তারা টেলিভিশন চ্যানেলে ক্যামেরাম্যান, রিপোর্টার, মেয়েটাও তাই, ছেলেটাও তাই। তারপরে একজন হলো জার্নালিস্ট, আরেকজন চারুকলার ছাত্র, সে এখন পড়ায়―এ রকম। তার মানে ওরা বিশের কোঠায়, ত্রিশের না। ওদের চোখ দিয়ে আমি আন্দোলনটা দেখছি। আমার চোখ দিয়ে না। আমার চোখ দিয়ে করলে ওটা তো স্মৃতিকথা হয়ে গেল, তাহলে তো উপন্যাস হবে না।
রাহাত রাব্বানী: আমরা আসার সময় এ-নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আপনার বয়সের অন্যান্য লেখক-কবি যারা আছেন, তারা খুব একটা উৎসাহী হন স্মৃতিকথা লেখার জন্য।
হাসনাত আবদুল হাই: হ্যাঁ, এটা ঠিকই; সবাই পারে না। যেহেতু আমার চর্চাটা অব্যাহত আছে, এ জন্য বয়স আমাকে, আমার চিন্তাভাবনা, আমার সৃজনশীলতা গ্রাস করতে পারে নাই।
অলাত এহ্সান: এক সাক্ষাৎকারে আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, আপনি স্মৃতিচারণ করেন কি না বা এ রকম। আপনি বেশ শক্তভাবে বলেছিলেন, স্মৃতিচারণ অনেক বেশি কর্মহীন অবস্থার মতো। আপনার হাতে এখনও অনেক লেখা আছে এবং লেখা নিয়ে পরিকল্পনা আছে। সুতরাং স্মৃতিচারণ নিয়ে একেবারে মশগুল থাকাটা আপনার দ্বারা হয় না।
হাসনাত আবদুল হাই: না, ওটা আমি করতে চাই না। স্মৃতিচারণ তো তারাই করবে এখন যারা সক্রিয় না, যারা অবসর নিয়েছে। আমি তো অবসর নেই নাই ভাই। এবং আমি আশাকরি, আমৃত্যু আমি সক্রিয় থাকব, আমি অবসর নেব না।
অলাত এহ্সান: আপনার গল্পগুলোয় মানুষের ভেতরে ‘বিচ্ছিন্নতা’― এই জায়গাটা বেশি অ্যাড্রেস করেছে। যেহেতু মানুষের ভেতরে দূরত্ব, বিচ্ছিন্নতা, না বোঝা, বা ধরুন এই তো ‘ডাইনোসর’ নামে বড় গল্প লিখলেন ‘সিল্করুট’ ঈদ সংখ্যায়।
হাসনাত আবদুল হাই: হ্যাঁ, কল্পকাহিনি। কল্পকাহিনিও ঠিক না, ফিউচারিস্টিক। যেমন ধরো আমাদের এই এনভায়রনমেন্টাল পলিউশন, খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে ভেজাল―এগুলো যদি চলতেই থাকে, তাহলে দেখা যাবে ওই টিকটিকিটা বড় হতে হতে ডাইনোসর হয়ে গেল। এবং আমরা তখন রাস্তায় বেরুলে আমাদের অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে বেরুতে হবে। এটা সায়েন্স ফিকশন বলব না, এটা হলো ধরো আজ থেকে ৩০ বছর পরে বাংলাদেশে এ রকম হতে পারে; যে কোনো দেশে হতে পারে। আমরা যদি বায়ুদূষণ এবং খাওয়ার ভেজাল বন্ধ না করি, তাহলে আমাদের দুটো জিনিস হবে। এই সব কীটপতঙ্গ, এরা মিউটেট করবে। মিউটেশনের ফলে এরা আকারে অনেক বড় হয়ে যাবে। এখনই তো আমি দেখি, দেওয়ালে যে ইয়েগুলো, টিকটিকি, অনেক বড় দেখায়। হৃষ্টপুষ্ট। আগে আমরা ছেলেবেলায় যেমন দেখতাম, তার চাইতে তিন-চার গুন বড়। এটা একটা পরিবর্তন। আরেকটা পরিবর্তন দেখি, তেলাপোকা এখন আর বড় নাই, ছোট হয়ে গেছে। কেন হয়ে গেল?- ওই তেলাপোকাগুলো খেয়ে টিকটিকিগুলো বড় হয়েছে। ফুড চেইনটা উল্টে গেছে। আমি কেমিক্যাল ব্যবহার করলাম তেলাপোকা, উইপোকার হাত থেকে বাঁচার জন্য। ফলে ওদের মধ্যে একটা বায়োলজিক্যাল মিউটেশন হয়ে গেল। তো, এটার উপর ভিত্তি করেই আমি ‘ডাইনোসর’ লিখলাম।
অলাত এহ্সান: আমার কাছে প্রথম দিকে মনে হচ্ছিল, এটা কি ডেসটোপিয়ান ঘরানার...।
হাসনাত আবদুল হাই: ডেসটোপিয়ান বটেই। যে ভবিষ্যৎটা খুব আশাব্যঞ্জক না, ওটাই তো ডেসটোপিয়ান। আর আশাব্যঞ্জক হলে ওটা ইউটোপিয়ান। তো এটা আশাব্যঞ্জক না। সুতরাং ডেসটোপিয়ান তো বটেই। এবং বুঝলে, এই যেমন দেওয়ালে এটা দেখে আমার আইডিয়াটা আসছে। টিকটিকি বড় হচ্ছে, তেলাপোকা ছোট হচ্ছে, আমরা ভেজাল খাচ্ছি। এ সব মিলিয়ে গল্পটা। তারপরে আমি চিন্তা করলাম―আচ্ছা এ রকম হতে পারে, আজ থেকে ৩০ বছর পরে আমি রাস্তায় বের হলে; আমাকে ঘরের মধ্যেও অক্সিজেন নিতে হয়। রাষ্ট্র এটা রেশন করছে যে, আমি কত পার্সেন্টেজ পাব। এমনকি আমি পার্কে যে যাব, পার্কেও আমি ডেইলি যেতে পারব না। কারণ পার্কে তো ন্যাচারাল অক্সিজেন। সেজন্য রাষ্ট্র অথবা সিটি কর্পোরেশন রেশন করছে যে, তুমি সপ্তাহে দুইদিন যেতে পারবে এবং সেটাও কয়েক ঘণ্টার জন্য। তো ওটা আমি দেখালাম না যে, ওই চরিত্র তো সবসময় যাচ্ছে না। তারপর ওরা একটা সমুদ্রের পাড়ে যাবে, সেটাও রেশন। ইচ্ছা করলেই যেতে পারবে না। আবার ওখানেও ঘুষ-টুষ আছে। এগুলো আছে গল্পটাতে।
অলাত এহ্সান: আপনার কি মনে হয় ডেসটোপিয়ান ধরনের এ রকম একটা এনভায়রনমেন্টাল ক্রাইসিসের মধ্যে আমরা পড়ে যাব?
হাসনাত আবদুল হাই: যাব মানে কি? আমরা তো পড়ে গেছি অলরেডি। এটা আরও ঘনীভূত হবে। আমরা তো এখন বায়ুদূষণে এক নম্বর। এবং ঢাকা সিটির যে টেম্পারেচার, এটা তো গত ৫০ বছরের হাইয়েস্ট!
অলাত এহ্সান: আপনার প্রথম বইয়ে একটা গল্প আছে ‘ইন্টারভিউ’ নামে। সেখানে একটা মেয়ের চাকরির ইন্টারভিউকে কেন্দ্র করে হুলস্থুল কাণ্ড হচ্ছে। এটা তো একটা ডকুমেনটেশন হয়ে গেছে। আপনি তো ’৬৫ থেকেই প্রশাসনিক কাজে যুক্ত হয়ে গেলেন, মানে আমলা। ওই সময় কি এমন ব্যাপার আরও বেশি ছিল?
হাসনাত আবদুল হাই: হ্যাঁ, ওই সময় তো অফিসে মেয়ে ছিল না। মেয়েদের কোটা ছিল না, কিছু ছিল না। মেয়েরা হয় স্কুল-কলেজের শিক্ষক, নার্স এগুলো; এবং ব্যাংকে বড় জোর কিছু আসে। আমি যখন চাকরিতে ঢুকি, কোনো সরকারি অফিসে তখন মেয়ে ছিল না, মতিঝিলের বাণিজ্যিক অফিসেও না। এই টেলিফোন অপারেটর, কারও প্রাইভেট সেক্রেটারি এসব হতো। যেমন ধরো, ‘পাকিস্তান অবজারভার’; ওই সময়ে খুব ইম্পর্টেন্ট পত্রিকা। এডিটর ছিল খুব নামকরা; এখন নামটা ভুলে গেলাম। উনি ইংরেজিতে পাস করা একজন মেয়ে রাখলেন উনার প্রাইভেট সেক্রেটারি। এ নিয়ে বিরাট হইচই― এডিটর প্রাইভেট সেক্রেটারি নিয়েছে মেয়ে লোক। খুবই সুন্দরী মেয়ে। ড. আন্দালিব সাদানী, উনি পার্সিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজের অধ্যাপক ছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে; তার মেয়ে। ইউনিভার্সিটিতে আর্টস বিল্ডিংয়ে তখন পঁচিশ-ত্রিশজন মেয়ে, সব বিভাগ মিলিয়ে। আর্টস বিল্ডিং তখন ছিল মেডিকেল কলেজের ওই দিকে। তো এ নিয়ে নানান হইচই―কী আলাপ করে প্রাইভেট সেক্রেটারির সঙ্গে, নানান রিউমার। এখন তো নিউজ পেপারে ফিফটি পারসেন্টেরও বেশি হবে কোথাও, টেলিভিশন অফিসে। সুতরাং এটা কোনো নিউজ না। কিন্তু ওই সময় বিরাট ব্যাপার। এইসব পরিবর্তন আমরা দেখেছি যেটা তোমরা দেখো নাই। এই যে সামাজিক পরিবর্তন, বিশেষ করে মেয়েদের, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ, এটা আমরা দেখলাম।
অলাত এহ্সান: এর বিরুদ্ধে কী ধর্মীয় সংগঠনগুলোর বক্তব্য ছিল― নারীদের নেয়া যাবে না, এটা করা যাবে না?
হাসনাত আবদুল হাই: না, এরকম কিছু ছিল না। আশ্চর্যের ব্যাপার বুঝলে, ওই সময়, ’৫০-এর দশক, ’৬০-এর দশক, তখন মেয়েরা শাড়ি পরে আসত, মাথায় ঘোমটা পর্যন্ত দিত না। ইউনিভার্সিটিতে খালি একটা জিনিস করত ওরা। ধরো, আমাদের ক্লাসে মাত্র দুটো মেয়ে, সব ক্লাসেই তাই। সব ইয়ারেই দুটো, বড়জোর তিনটা। ’৬০-এর পরে আস্তে আস্তে মেয়েরা বাড়তে লাগল। তো আমাদের সময়ে এই যে দুজন-তিনজন মেয়ে, ওরা ক্লাসে ঢুকত না। ক্লাসের প্রথম রো (সারি) ওদের জন্য ছিল। কিন্তু মেয়েরা আগে বসত না। ওরা দরজার বাইরে থাকত, টিচার আসলে ওদের নিয়ে বসত। ওরা যদি এসে বসতও, আমরা তাদের নিয়ে টিটকারি করা, এটা-ওটা করা, এগুলো করতাম না। সুতরাং মেয়েরা তখন খুব স্বচ্ছন্দে ঘুরতে পারত, এবং কেউ তাদের চলাফেরা, কাপড় পরা, এগুলো নিয়ে কোনো রকম মন্তব্য করে নাই।
আর্টস বিল্ডিংয়ে আমরা ৫ কি ৭ হাজার স্টুডেন্ট ছিলাম, এর মধ্যে মাত্র দুইটা পেয়ার (জুটি) প্রেম করত। আমরা তাদের নিয়ে কোনো রকমের সিনক্রিয়েট করিনি। তারা ওই আমগাছের নিচে বসে একসঙ্গে লাঞ্চ করতো কিংবা ছেলেটা সাইকেল চালিয়ে চালিয়ে যেত, মেয়েটা ওর পাশ দিয়ে ইউনিভার্সিটির সামনের রাস্তায় ইউক্যালিপটাস গাছ ভরা; তখন তো এত গাড়ি-ঘোড়াও ছিল না― যাচ্ছে। এটা দেখে আমরা কেউ তাদের পিছু নিতাম না। সুতরাং তুমি যেটা বললে যে, মেয়েদের ব্যাপারে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল কি না, মানে কোনো রকমের নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিমালা ছিল না। লিখিত তো না-ই, অলিখিতও ছিল না।
এই যে নভেরা, তাঁকে আমরা ইউনিভার্সিটিতে দেখলাম। চিটাগংয়ের মেয়ে। উনি এখানে এসে একটা ভাস্কর্যের এক্সিবিশন করলেন। ওই সূত্রে তাঁকে দেখলাম যে, মাথায় সন্ন্যাসিনীর মতো চুল বাঁধা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, (কপাল ইঙ্গিত করে) এখানে এরকম লম্বা একটা টিপ, কালো শাড়ি, এটা দেখলাম। এবং উনি বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এই যে ডেইলি স্টারের প্রথম সম্পাদক, যিনি মারা গেলেন, নামটা ভুলে গেছি, উনিও ছিলেন ওই সময়ে। তাঁর কয়েকটা বয়ফ্রেন্ড ছিল। কয়েকটা মানে এক সময়ে না, উনি একটা পর্বে। আমরা যখন দেখলাম, তখন নভেরার বয়ফ্রেন্ড ছিল, উনি আমাদের সৈয়দ মুজতবা আলীর আত্মীয়, এসএম আলী, তাঁর সঙ্গে নভেরাকে দেখতাম ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ নিয়ে আমরা কিংবা মুরুব্বিরা কোনো উচ্চবাচ্য করিনি যে― একটা অবিবাহিত মেয়ে, তাকে নিয়ে একটা পুরুষ এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে! এখন তো চিন্তাই করা যাবে না যে, মাথায় ঘোমটা দেয়নি, বোরকা পরেনি কিংবা হিজাব পরেনি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। তো এই দিক দিয়ে যদি চিন্তা করো, নারী প্রগতির দিক দিয়ে যদি চিন্তা করো, আমরা পিছিয়ে গিয়েছি। আমাদের সময়ে মেয়েরা যে স্বাধীনতা উপভোগ করেছে, এখন ওরা পাচ্ছে না। এবং আমাদের সময়ে ঢাকা শহরে তো বটেই, মফস্বলে, এমনকি গ্রামে কোনো ধর্ষণের খবর আমরা পাই নাই। এখন তো, মানে কি বলব? মেয়েদের অনেক অগ্রগতি হয়েছে, ওরা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করছে, এটা-ওটা করছে। কিন্তু নারী স্বাধীনতা বলতে যেটা বুঝি, ওটা ওরা পায় না। বেশ হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে।
অলাত এহ্সান: একটা জিনিস দেখছিলাম, আপনারা মানে যারা পরবর্তীতে লেখালেখিতে খ্যাতিমান হয়ে উঠলেন, তাঁদের অনেকেরই শুরু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে। আমরা মনে করি যে, লেখালেখির জন্য শিক্ষকতা পেশা খুব উপযোগী। তো আপনারা আবার প্রশাসনে চলে গেলেন―এর কারণ কী ছিল?
হাসনাত আবদুল হাই: আমাদের দেশের লেখকরা এসেছেন ট্র্যাডিশনালি দুই পেশা থেকে। সাংবাদিক আর হলো আমলাতন্ত্র। আমলাতন্ত্র না, শিক্ষক এবং পরে আমলাতন্ত্র। শিক্ষকরাই পরে আমলা হয়েছে। যেমন আমি শিক্ষক ছিলাম এক বছর, পরে আমলা হলাম। আমি বলব, সাংবাদিকতা আমাদের সাহিত্যের প্রধান উৎস। তুমি যদি সংখ্যা দিয়ে হিসাব করো, তাহলে দেখবা অধিকাংশ লেখক ছিলেন সাংবাদিক। তখনো তাই ছিল, এখনো তাই। এরপরেই হলো শিক্ষক, হাইফেন আমলা।
অলাত এহ্সান: তাহলে তখন মনে করলেন যে, আমলা হয়ে উঠলেও আপনার লেখালেখির কোনো ব্যাঘাত হবে না, বা আপনার প্যাশন কমে যাবে না―এরকম মনে হলো?
হাসনাত আবদুল হাই: না, এটা নির্ভর করছে তুমি কতটা সিরিয়াস লেখক হিসেবে। তুমি যদি সিরিয়াস না হও, এটা শখ হিসেবে নাও যে, আমি আমলা হওয়ার আগে শখে শখে আমি লিখলাম, লিখেছি, আমলা হয়ে আর ওটা থাকে না। যেমন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, উনি খুব ভালো কবি ছিলেন। শামসুর রাহমানের চাইতেও ভালো কবিতা লিখতেন। সরকারি চাকরিতে ঢুকে উনি তেমন লিখলেন না। লেখালেখি করলেন, কিন্তু নিয়মিতভাবে না। তার মানে হলো তাঁর কাছে সরকারি চাকরিটাই প্রধান হয়ে গিয়েছে, লেখাটা গৌণ। আমি এটা করি নাই। চাকরিতেও আমি সিরিয়াস ছিলাম, লেখালেখি, বই পড়া―সবসময়। আমি যখন যেখানে গিয়েছি, বই আমার সঙ্গে থাকত। আমি বই কিনেছি, পড়েছি। এবং যখন লেখা কমে গিয়েছে, যেমন ধরো পশ্চিম পাকিস্তানে আমি ছিলাম দুই বছর। ওখানে তো লেখালেখির পরিবেশ নাই। পরিবেশ মানে কোনো পত্রপত্রিকা নাই, আমাকে ফোন করে না যে―আমাকে একটা লেখা দেন। না চাইলে আমি লেখা কি দেব? দেব না। যেহেতু আমি ওই দুই বছর বই পড়েছি, সেই জন্য আমি লেখার জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তো, এটা নির্ভর করছে যে, আমলা হওয়ার পর সেই আমলা লেখাটাকে কি শখ হিসেবে দেখছে, নাকি এটাকে তার চাকরির মতো সমান গুরুত্ব দিচ্ছে? আমি দিয়েছি। আবদুশ শাকুরও দিয়েছেন। মীজানুর রহমান শেলী দেয় নাই। ও কিন্তু দারুণ একজন সাহিত্যিক হতে পারত। কথাসাহিত্যিক। আমরা যখন উপন্যাস লিখি নাই, যখন আমাদের উপন্যাস ছেপে বের হয় নাই, ও তখন লিখেছে এবং সে বই বেরিয়েছে। ‘পাতালে শর্বরী’ সেই সময়ে লিখেছে। এবং ওর উপন্যাসের গদ্য, ওর ছোটগল্পের গদ্য অতি-আধুনিক। কিন্তু ও চাকরিতে ঢোকার পর সাহিত্য নিয়ে আর থাকল না। এ জন্য ও লেখক হিসেবে পরিচিতিও পেল না। আমি মনে করি, ও আমার চাইতেও অনেক বেশি প্রতিভাবান। এ রকম প্রতিভাবান, তুমি যদি ঘরে ঢুকায়া দিয়ে বলবে যে, আপনি আজকে একটা উপন্যাস লেখেন। ও এক রাত্রের মধ্যে লিখে ফেলবে।
রাহাত রাব্বানী: লেখালেখিটা তাহলে প্রথম দিকে শখ হিসেবে হয়ে যাচ্ছিল?
হাসনাত আবদুল হাই: লেখালেখিটা বুঝলে, এটা একটা খুব, তোমার প্রেমিকার মতোন। যত সম্পর্ক গাঢ় হবে ততই তোমার ওপরে তার দাবি আসবে। এবং এই দাবি এমন, তোমার সময়ের ওপর তার দাবি। এমন দাবি যে চাকরিতে তুমি ফাঁকি দিতে পারছ না, কিন্তু তুমি সংসারে ফাঁকি দেওয়া শুরু করো। যেটা আমি দিয়েছি। আমার ওয়াইফকে যে টাইম দেওয়ার কথা আমি দেই নাই, আমার ছেলে-মেয়েকে যে টাইম দেওয়ার কথা আমি দেই নাই। অফিস থেকে এসে লেখা শুরু করছি। তো লেখালেখিটা খুব একটা স্বার্থপরের কাজ এবং এটা একটা পানিশমেন্ট। এবং এই পানিশমেন্টটা হলো সেলফ ইনফ্লিক্টেড। স্ব-আরোপিত। আমি নিজেকেই নিজে দিচ্ছি। আমার এটা থেকে বের হওয়ার উপায় নাই।
যেমন আমি কোনো অনুবাদ করি না। আমার যখন লেখার দরকার, আমি ডাইরেক্ট ইংরেজিতে লিখি। আমি একটা নিউজ পেপার ‘ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস’-এ মাসে চারটা কলাম লিখি। এখনো লিখি। কিন্তু আমি ইংরেজিতে গল্প-উপন্যাস লিখি না। অনুবাদও করি না।
অলাত এহ্সান: আপনার অনুবাদে কবিতার বই তো আছে।
হাসনাত আবদুল হাই: আমার ছেলের বউ ক্যানসারে ভুগল; আমার এত কষ্ট, আমি রাত্রে ঘুমাইতে পারি না, দিনে খাইতে পারি না। তাই একদিন এসে রাত দুইটায় এখানে বসলাম, দেখি টেবিলের ওপরে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এক বই। আমি যখন চিটাগংয়ে ছিলাম, বেলাল চৌধুরী ওকে নিয়ে গেছিল আমার বাসায়, আমাকে ও বইটা দিয়েছিল। ওই রাতে দেখি যে বইটা। আমার ঘুম আসছে না, আমি পড়লাম। আমাকে দিয়েছে ’৮২-তে, আমি পড়লাম ২০২০ সালে। ২৮ বছর পরে। ২৮ বছর বইটা আমার সঙ্গে আছে। তো পড়লাম। কিন্তু রাত কাটে না। ভাবলাম অনুবাদ করি তো! অনুবাদ করতে গিয়ে দেখি এত তন্ময় হয়ে যাই যে পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে কোনো জ্ঞানই নেই। ভোর হয়ে গেল, নাস্তা দিল। আমি ভাবলাম, আরে! অনুবাদ করলে তাহলে এই মানসিক কষ্টটা পাব না। অনুবাদ শুরু করলাম। তারপরে হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা, তাহলে এই অনুবাদটাকে একটা কমন সাবজেক্ট, একটা বিষয় কাঠামোর মধ্যে আনি। কী আনা যায়? কবিতা... প্রেমের কবিতা। না, প্রেমের কবিতা অনেক হয়েছে। তাহলে হাজার বছরের... তখন ‘হাজার বছরের বাঙলা কবিতা’। আমি বাংলার ছাত্র না, আমার কাছে কবিতার বই নাই, কিচ্ছু নাই। তারপরে কিসের পরে কী আসবে কিচ্ছু জানি না। চর্যাপদ কী, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী―কিচ্ছু না। কিন্তু আমার মাথার মধ্যে চেপে বসল―আমাকে লিখতে হবে। কেউ আমাকে বই দিয়ে সাহায্য করলো না। আমি বাংলাবাজার গিয়ে, নীলক্ষেতে গিয়ে মঙ্গলকাব্য, এটা-ওটা ধরলাম, কলকাতা থেকে আধুনিক কবিতার বই আনলাম প্রায় দুইশ। নিয়ে এসে আমি এই মোবাইল ফোনে, ফেইসবুকে নোট আছে, নোটে আমি ইংরেজি, বাংলা, অনুবাদ এবং অরিজিনাল কবিতা, ইন্ট্রোডাকশনসহ প্রায় ৯৫০ পৃষ্ঠা টাইপ করে পাঠাই। ও (প্রকাশক) আমাকে প্রুফ দেখার জন্য পাঠায়। আমার তখন ইয়ে (আগ্রহ) হয়েছে পুত্রবধূকে আমি এটা দেখাব― তোমার এই অসুখ আমাকে এই অনুবাদে নিয়ে এসেছে। এর আগেই তো সে মরে গেল। তো আমার এটা শেষ করতে ছয় মাস লাগে। এই ছয় মাস আমি তো আত্মীয়-স্বজন, ছেলে-মেয়ে এদের টাইম দেই নাই, নিজেকেও টাইম দেই নাই। এই অর্থে যে, আমি ঠিক সময়ে খাচ্ছি না, ঠিক সময়ে ঘুমাচ্ছি না, ঠিক সময়ে গোসল করছি না―এই রকম।
লেখক হতে গেলে তুমি যদি নিষ্ঠার সঙ্গে লেখক হও, তুমি যদি সৎ হও লেখায়, তাহলে এই পানিশমেন্ট তোমাকে পেতে হবে। শাস্তিটা কী? তোমার খাওয়া থাকবে না, ঘুম হবে না, বিশ্রাম হবে না, তুমি নিকটজন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবে না, কারো জন্য তুমি সময় দিতে পারবে না। এই শাস্তি তোমাকে পেতে হবে। এই শাস্তির মধ্যেও তৃপ্তি যে, একটা ভার কেটে যায়। যখন তুমি একটা বই শেষ করো, একটা মস্ত বড় ভার তোমার বুকের ওপর থেকে উঠে যায়। এটাই তোমার তৃপ্তি।
অলাত এহ্সান: আপনাদের সময় পর্যন্ত আমরা যে ক’জনের নাম বলতে পারি, তারপরে প্রশাসনিক ক্যাডার থেকে কিন্তু খুব বেশি লেখক পাচ্ছি না মনে হয়। ও-রকম ভালো লেখক পেয়েছি আর?
হাসনাত আবদুল হাই: আন্দালিব রাশদী; ও তো ভালো লেখে। ভালো অনুবাদও করে। (ফায়জুল ইসলাম ছিলেন। মারা গেছেন― অলাত)। আমলাদের মধ্যে আমি তাঁকে বলব এখন প্রথম সারির লেখক। আরেকজন ছিল, সে অবশ্য কবি, কামাল চৌধুরী। ভালো, সে ভালো কবিতা লেখে। আসাদ মান্নান, সেও ভালো কবিতা লেখে; আমলা ছিল। এ রকম কয়েকজন আছে। আমলা জীবনের একটা সুবিধা হলো যে, আমাদের অভিজ্ঞতা অর্জনের ক্ষেত্র অসীম, অপরিমেয়। সমাজের নানা শ্রেণির মানুষ আমরা দেখি। যারা সাংবাদিক, অতটা দেখে না। ডাক্তাররা দেখে। যারা ল’য়ার, তারাও দেখে। তাদের কাছে খুনি, বাটপার, চোর সবই যায়। যে দুর্নীতিবাজ, সেও যায়। এই কয়েকটা পেশা আছে, যেখানে সমাজবীক্ষণের বিরাট একটা সুযোগ। তার মধ্যে আমলাতন্ত্র একটা।
অলাত এহ্সান: কিন্তু আমলাতন্ত্রকে আমরা কমবেশি ‘সমাজ বিচ্ছিন্ন’ই তো ভাবি মনে হয়। মানে সাধারণের মধ্যে যে ভাবনাটা।
হাসনাত আবদুল হাই: না, সমাজ বিচ্ছিন্ন এ ভাবে যে, আমি যেরকম বললাম, দেখো, আমি সমাজকে আমার লেখায় নিয়ে আসছি, কিন্তু আমি তো সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারছি না। আমার তো টাইম নাই। আমি চাকরি করে অর্ধেক সময় যাচ্ছে, বাকি অর্ধেক সময় আমার লেখালেখিতে যাচ্ছে। তো আমি তো খুব সামাজিক না। যেজন্য লেখক হিসেবে আমার কোনো গোষ্ঠী নাই। আমি একটা লেখা লিখলে, ওই লেখা বেরুলে, বই বেরুলে, ওই বই নিয়ে যে আলোচনা করবে, এরকম কেউ নাই তো আমার।
অলাত এহ্সান: বই নিয়ে তো আমরা পড়ি, কিন্তু আলোচনা...।
হাসনাত আবদুল হাই: না, কিন্তু তোমরা কেউ আলোচনা করো না আমার বইয়ের। এখনো কেউ বলে―হ্যাঁ, আপনি ‘নভেরা’র লেখক। আরে ভাই! নভেরার পরে যে কত নাতি-পুতি বেরিয়ে গেছে। কত না লিখে ফেলেছি! এই যে জুলাইকে নিয়ে লিখলাম, কেউ লিখতে পারে নাই। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখলাম, কেউ লিখলো কিনা। কেউ লিখতে পারে নাই। আমি লিখেছি। আমি বলি, এটা এত বড় একটা ঘটনা, মুক্তিযুদ্ধের পরে এটা আমাদের জীবনে, জাতীয় জীবনে সবচাইতে বড় ঘটনা। এটা লিখতে হবে। একজন কথাসাহিত্যিক হিসেবে এটা আমি না লিখে পারবো না।
অলাত এহ্সান: আপনার উপন্যাসগুলোর সামাজিক চরিত্রায়ণ বা সামাজিকতা আছে। একটা সেন্ট্রাল দিকও আছে যে, চরিত্রগুলো কোনো না কোনোভাবে প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় যাচ্ছে এবং সেখানে গিয়ে তারা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে, যেটা দিয়ে আসলে সমাজ বাস্তবতাটাকে পাওয়া যায়। আপনার পেশাগত জীবনের কারণেই কি ক্যারেক্টার এরকমভাবে গড়ে উঠেছে?
হাসনাত আবদুল হাই: কিছুটা পেশাগত, কিছুটা আমার সমাজবীক্ষণ। কারণ লেখক হিসেবে, কথাসাহিত্যিক হিসেবে আমাকে তো দেখতে হয় সব কিছু। আমি ধরো চার-পাঁচটা নিউজ পেপার পড়ি। মফস্বল সংবাদ বেশি গুরুত্ব দিয়ে পড়ি। এই সংবাদে পুরো বাংলাদেশের খবর চলে আসে।
অলাত এহ্সান: মফস্বল সংবাদগুলোতে এখন আর প্রথম পাতার চাইতে কোনো ভিন্নতা, বিশেষত্ব নাই। আগে যে স্টোরিগুলো পাওয়া যেত, এখন আসে না।
হাসনাত আবদুল হাই: হ্যাঁ, স্টোরিগুলো আসে না―এটা ঠিক। মোনাজাতউদ্দিন যেভাবে মফস্বলের সংবাদ দিত ও রকম হয় না। কিন্তু আমি তো ঢাকায় বসে আছি, বাইরের সম্বন্ধে আমি কি করে জানব? একমাত্র এই নিউজ পেপার আর হলো সোশ্যাল মিডিয়া। ফেইসবুকে মাঝে মাঝে আসে, সবসময় আসে না। তো আমার যে দৃষ্টিভঙ্গি, আমার যে মতাদর্শ বলো, আমার যে মতবাদ, যেটা আমার লেখার মধ্যে দিয়ে এসেছে, সেটা আমার নিজের অভিজ্ঞতা, ডাইরেক্ট। আরেকটা হলো ইনডাইরেক্ট, যেটা আমি নিউজ পেপার পড়ে, লোকের মুখে শুনে― এটা।
অলাত এহ্সান: মতাদর্শের আলাপ থেকে মনে হলো, আপনি যখন বেড়ে উঠলেন ’৫০ এর দশকে। ’৬০ এর দশকে পেশাজীবন শুরু করলেন। এ সময় সবচাইতে স্মার্টনেস প্রকাশে একটা সহজ উপায় ছিল, বাম রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হওয়া। আপনারা, যেমন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রভাবিত ছিলেন, আবদুশ শাকুরও ছিলেন।
হাসনাত আবদুল হাই: না, উনি (আবদুশ শাকুর) ছিলেন না। উনি মাদ্রাসার ছাত্র। বামপন্থী ছিলেন না। (তিনি এ নিয়ে আগ্রহী ছিলেন, মানে এই আলাপটা নিয়ে―অলাত)। না, এটা তার কোনো লেখায় দেখা যায় না।
অলাত এহ্সান: রবীন্দ্র চর্চায় বামপন্থীদের ভূমিক নামে দীর্ঘ প্রবন্ধ আছে―‘রবীন্দ্রজীবনের অনুজ্জ্বল অঞ্চল’ বই।
হাসনাত আবদুল হাই: তাঁর গানের ব্যাপারে খুব আগ্রহ ছিল। গান আর গোলাপ চাষ। তাঁর আলাপ-আলোচনা সবই এ দুটাকে নিয়ে ছিল। ওর তো সমাজের এত ইয়ে ছিল না।
অলাত এহ্সান: চারপাশের প্রভাব কি এভাবে পড়েছিল আপনার উপর? বেড়ে উঠতে উঠতে?
হাসনাত আবদুল হাই: না। এখন শোনো, ইউনিভার্সিটিতে আমরা যখন ভর্তি হলাম, আমরা দেখলাম যে, যত ভালো ছাত্র, যারা স্ট্যান্ড করেছে পরীক্ষায় অথবা ভালো গায়ক, ভালো বক্তৃতা দেয়, ওরা সব স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন― অলাত) করে, মানে বামপন্থী। আমাদেরও চাইলো, কেউ গেল, কেউ গেল না। আমি কোনো দলে গেলাম না। আমি বললাম, না, আমরা কোনো দলে জয়েন করব না। তখন স্টুডেন্টস ইউনিয়ন প্রকাশ্যে ছিল না, ওদের কালচারাল ফ্রন্ট ছিল―সংস্কৃতি সংসদ। তখন স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বলে ক্যাম্পাসে কোনো অর্গানাইজেশন ছিল না। তারপর আওয়ামী লীগের ছিল ‘শিল্প ও সাহিত্য পরিষদ’, যার সভাপতি ছিল আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী। আমরা যখন ফার্স্ট ইয়ারে গেলাম, আমাদের রিক্রুট করার জন্য খুব এটা-ওটা করল। আমি ক্লাসফ্রেন্ডদের বললাম, দেখো, আমরা কোনো দলে যাব না। আমরা এভাবেই থাকব। আমার দলে ৩০ জন যদি থেকে থাকে, ঢাকা কলেজ থেকে গিয়েছিলাম। ঢাকা কলেজের ৩০ জনের মধ্যে ২৫ জনই হয়তো দুই দলে যোগ দিল। পাঁচজন আমরা নিরপেক্ষ থেকে গেলাম। আমি আর চারজন আমার বন্ধু, আমরা কোনো দলে ঢুকি নাই। আমরা এমএ পরীক্ষা পর্যন্ত এভাবেই ছিলাম। আমার জয়েন না করার একটা ছিল যে, আমরা চিহ্নিত হবো না, এক। আর দুই ছিল, ছাত্র ইউনিয়নে যাই নাই, ওদের মধ্যে একটা উন্নাসিকতা দেখলাম। ওরা একটা ভাব দেখালো যে, ওদের দলে না গেলে, জয়েন না করলে যেন আমি ভালো লেখক হতে পারব না, ভালো ছাত্র হতে পারব না, ভালো বক্তা হতে পারব না। এরকম একটা উন্নাসিকতা দেখাল যে, ওরা ব্রাহ্মণ, আমাকে একটা অনারারি পোস্ট দিচ্ছে― তুমি তো ব্রাহ্মণ না, তো তোমাকে আমরা অনারারি ব্রাহ্মণ করে নিচ্ছি। এই যে ব্রাহ্মণ্যবাদ, এটা আমি পছন্দ করি নাই। এ কারণে আমি যাই নাই। কিন্তু আমি বামপন্থী সব লেখকের লেখা পড়েছি এবং আমার লেখার মধ্যে বামপন্থী ব্যাপারও আছে।
আমার ‘তিমি’ উপন্যাস, এটা তো বামপন্থী মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে লেখা। আমি কি বামপন্থী? তুমি যদি কোনো আদর্শের প্রতি আমার দুর্বলতা বলো, আমার বামপন্থী আদর্শের প্রতি দুর্বলতা আছে। কারণ আমি একটা শোষণহীন সমাজ চাই। এবং সাম্যবাদের ভিত্তিতে সবাই মোটামুটি সমান, শোষণ হচ্ছে না, শোষক-শোষিত নাই, এরকম একটা সমাজ চাই। এটা করতে গেলে তোমাকে বামপন্থী আদর্শ ধারণ করতেই হবে। কিন্তু আমি কোনো মার্কসিস্ট গ্রুপে যাইনি। আমি যে রাশিয়ার ওপরে বইটা লিখলাম, সেখানে এটা বলেছি। তবে আমার দুঃখ লেগেছে এত লোকের, এত কষ্টের, এত আত্মত্যাগ, কত মৃত্যু, তারপরে এই বিপ্লবটা হলো। বিপ্লবের পরও ওখানে অনেক লোক মারা গেছে; এই করেছে, সেই করেছে এবং বিপ্লবের অনেক পর সাম্যবাদের যে প্রমিজ, প্রতিশ্রুতি, সেটা ওরা পেল। সেই প্রতিশ্রুতিটা কী? ফ্রি এডুকেশন, ফ্রি হেলথ কেয়ার। চাকরি মোটামুটি নিশ্চিত, কেউ বেকার থাকবে না। বাড়ি? তুমি হয়তো তিন কামরা ঘর পাবে না, অন্তত একটা মেস তুমি পাবে, তোমাকে রাস্তায় থাকতে হবে না। এই যে আহার, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, এগুলোর যে নিশ্চয়তা এটা রাশিয়া দিল, এটা কিন্তু দিয়েছে অনেক পরে। নিকিতা ক্রুশ্চেভ আসার পরে। ক্রুশ্চেভ আসা পর্যন্ত এইসব শুদ্ধি অভিযান, মার, কাট। স্টালিন পর্যন্ত খালি এইসব শুদ্ধি অভিযান চলেছে। হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে, সাইবেরিয়া পাঠাচ্ছে। সমাজতন্ত্রের ওই যে প্রতিশ্রুতি, যেটা ’৯১-এ শেষ হলো, গত ৩৫ বছর ধরে ওরা এইটা ধ্বংস করে দিল। বলে, ওরা চালাতে পারছিল না, এটা-ওটা।
আমার বক্তব্য হলো, ওরা তো সেই হিটলারের আক্রমণের সময় টিকেছিল। চার বছর যুদ্ধ করেছে। তখন তাদের সব ধ্বংস হয়ে গেছে, এত লোক মারা গেছে, তখনও তো তারা কমিউনিজম ফেলে দেয়নি, ত্যাগ করেনি। এখন কী হলো এমন? ওরা আমেরিকার সঙ্গে, পশ্চিমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে। ওরা যদি খরচ কমাতে চায়, ওদের আর্মি একটু ছোট করলেই হতো, ডিফেন্স এক্সপেন্ডিচার ছোট করলেই হতো। এই যে বাইরে থেকে লাখ লাখ বিদেশি ছাত্র নিয়ে যায় তারা; দরকার নাই, কমিয়ে দাও। ওদের ব্যয় সংকোচের, ব্যয় সাশ্রয় করার জন্য অনেক উপায় ছিল। তা না করে তারা কমিউনিজম ত্যাগ করল। আমার বইতে এই জিনিসটা খুব আক্ষেপের সঙ্গে ধরেছি যে, তারা জীবন দিয়ে প্রতিশ্রুতিটা রক্ষা করেছিল, শেষ পর্যায়ে এসে এভাবে নষ্ট করল! এটা নেতৃত্বের ব্যর্থতা। তো, যে কথা আসছিল যে, ছাত্রজীবনে আমি বামপন্থী কোনো দলে যোগ দেইনি কিন্তু বামপন্থী আদর্শ সবসময় আমার কাছে গুরুত্ব পেয়েছে, বামপন্থী লেখকদের লেখা পড়েছি।
অলাত এহ্সান: এখন তো বামপন্থীবিরোধী লেখকরাও পশ্চিমা পেট্রোনাইজড। তাদের একটা উত্থানও আছে। সেটা আপনি কীভাবে দেখবেন?
হাসনাত আবদুল হাই: বামপন্থীরা এখন একটা আপদকালীন টাইমের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। যেমন ধরো বাংলাদেশ হওয়ার পরপর বামপন্থীরা দেশে একটু ইয়ে করে উঠেছিল। এমনকি পাকিস্তান আমলেও তারা যেমন ছিল, জহির রায়হান-টায়হান তারা যারা বামপন্থী ছিল। তখনকার যারা লেখক শওকত আলী, এমনকি আমাদের হাসান আজিজুল হক, আবুবকর সিদ্দিক―সবই বামপন্থী ছিল। তখনকার কবি-সাহিত্যিক সবই, ৯০ শতাংশ বামপন্থী ছিল। এখন তো সেরকম দেখা যায় না, এখন তো বামপন্থী লেখক-টেখক দেখি না।
অলাত এহ্সান: আপনি যেভাবে দেশভাগ-পূর্ব সময়ে দাঙ্গা দেখেছেন, বিশ্বযুদ্ধে করুণ অবস্থা দেখেছেন, এগুলো কি আপনার ভেতরে ট্রমা তৈরি করেছিল দীর্ঘ সময় পর্যন্ত?
হাসনাত আবদুল হাই: অবশ্যই, অবশ্যই। যে কোনো লেখকই―সে কবি হোক, সাহিত্যিক হোক, খুব সেনসেটিভ। বাইরে যা কিছু ঘটছে, সাধারণ মানুষ একবার তাকাবে। লেখক কয়েকবার তাকাবে― লোকটাকে ফুটপাত থেকে নামিয়ে দিলো কেন? পুলিশ এসে গ্রেপ্তার করল কেন? এগুলো কয়েকবার দেখবে। ওর মধ্যে একটা গল্প তুমি দেখতে পাবে। সাধারণ লোক ওটা দেখবে না। সুতরাং যেসব ঘটনা আমি দেখেছি―যুদ্ধ, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, পার্টিশন, প্রত্যেকটা ঘটনা আমার ভেতরের যে লেখক সত্তা, এটা নির্মাণ করেছে; অনবরত নির্মাণের প্রক্রিয়ায় রেখেছে। এটাকে ফাইনাল কোনো শেপে আসতে দেয় নাই।
এখনো লেখক হিসেবে আমার যে সত্তা এটা নির্মীয়মান। কারণ এখনো আমি এই বাইরের অভিজ্ঞতা নিচ্ছি, গ্রহণ করছি এবং আমি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি। এই যেমন ধরো ‘জুলাই আন্দোলন’, এটাকে তো আমি গবেষকের দৃষ্টিতে দেখছি না। এটা আমাকে আঘাত করেছে। আমি রিঅ্যাক্ট করছি। এ জন্য আমি এই লেখাটা লিখেছি। আমি যদি গবেষকের দৃষ্টিতে দেখতাম, তাহলে একটা গবেষণামূলক লেখা, একটা প্রবন্ধের বই হতো। আমি সৃজনশীল লেখক। সৃজনশীল মানেই আমার একটা খুব স্পর্শ সংবেদনশীলতা রয়েছে। আমি সহজে বিচলিত হই, আলোড়িত হই। একটা ঘটনা, যেটা একজন দর্শক দেখে ভুলে যাবে, ওটা বাসায় আসার পরেও আমার মনের মধ্যে ঘুরতে থাকে। আমি ওটার মধ্যে একটা প্যাটার্ন খুঁজি। ওটার মধ্যে আমি একটা কার্যকারণ-সম্পর্ক খুঁজে বের করি। এটা আমি না শুধু, সবাই, প্রত্যেক লেখকই কাজটা করে। তুমি যে প্রসঙ্গ তুললে, এইসব ঘটনার প্রোডাক্ট আমি। যদি আমি শুধু মননশীল লেখক হতাম, তাহলে আমার পড়াশোনার যে বই, ওই বই এবং আমার যে মনন, সেগুলোর প্রোডাক্ট আমি। আমার অভিজ্ঞতা এখানে কাজ করত না। আমার ব্যক্তিজীবনের যে অভিজ্ঞতা, এটা আমার কথাশিল্পের জীবনে কাজে দেয়। এটা ভূমিকা রেখেছে, রাখছে এবং রাখবে।
রাহাত রাব্বানী: আপনি এক সময় এসে, এই যে জীবনীসাহিত্য লিখলেন। এটা কখন মনে হলো যে, ‘জীবনী উপন্যাস’ লেখা যায়?
হাসনাত আবদুল হাই: ব্যাপারটা কি, আমি সুলতানকে দেখলাম। আমার ইংরেজিতে পড়া ছিল ‘লাস্ট ফর লাইফ’, আরভিং স্টোনের ভ্যান গগের জীবন নিয়ে লেখা। দেশের ভেতর সমরেশ বসুর ‘দেখি নাই ফিরে’, রামকিঙ্কর বেইজকে নিয়ে লিখেছিলেন উপন্যাস; শেষ করতে পারেননি। ওটা আমি পড়েছি। জীবনী নিয়ে যে উপন্যাস করা যায়, এসব পড়ে আমি জানতে পেরেছি। তখনও আমার লেখার কোনো ইচ্ছা হয় নাই। কিন্তু যখন সুলতানকে সামনাসামনি দেখলাম―আরে বাবা! এত বড় মাপের মানুষ! এঁকে নিয়ে উপন্যাস করা যায়। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হওয়ার মতোই উনি। এ ভাবেই আইডিয়াটা আসলো। আমার কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না।
রাহাত রাব্বানী: আপনি তো লিখলেনই―গাঁজা খাচ্ছে, উড়াচ্ছে...।
হাসনাত আবদুল হাই: এই ব্যতিক্রমী জীবন, এটাতে তুমি উদ্বুদ্ধ হবেই। আমাকে আরও যেটা আকৃষ্ট করল লিখতে, সেটা হলো উনি শুধু ব্যতিক্রমী না, উনি নিজের শর্তে জীবনযাপন করলেন। উনি রাধা সাজবেন, ধুতি পরবেন, শাড়ি পরবেন, মাথায় ফুল গুঁঁজবেন, রাধা সাজবেন, নাচবেন, বাঁশি বাজাবেন, গাঁজা খাবেন―এগুলো করবেন। উনি নিজের শর্তে, সমাজের শর্তে না কিন্তু; শেষ পর্যন্ত তা-ই করেছেন। এটা তো একটা দিক, ঔপন্যাসিক হিসেবে, কথাসাহিত্যিক হিসেবে এখানে লেখার খোরাক আছে। এর চাইতেও যেটা আমাকে বেশি মুগ্ধ করল, এইসব পাগলামি সত্ত্বেও, উনি কিন্তু উনার শিল্পীসত্তা ভুলে যাননি। এঁকেছেন। যে জন্য আজকে জয়নুল ও সুলতান একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। আমরা আজ জয়নুল বললেই সুলতান বলি। প্রথম বললেই জয়নুল, সুলতান, কামরুল বলি―বলি না? এই তিনজন। আর তো কেউ তাঁর ধারেকাছে আসতে পারে না। এই তিনজনই আমাদের ত্রিরতœ।
অলাত এহ্সান: মুর্তজা বশীর...?
হাসনাত আবদুল হাই: না, ধারে-কাছেই নাই। এমন কি এই যে সফিউদ্দিন আহমদ, উনি অনেক বড় মাপের আর্টিস্ট। কিন্তু উনার ঠিক ইমেজটা এভাবে গড়ে ওঠেনি। ইমেজ কেউ ইচ্ছে করে গড়ে তুলতে পারে না। ইচ্ছে করে আমি একটা প্রোগ্রাম করলাম টেলিভিশনে, তোমাকে ডাকলাম ইন্টারভিউ নাও, এটা করে আমার একটা ইমেজ হবে? হবে না। কার যে ইমেজ হবে না-হবে, এটা কেউ বলতে পারে না, অ্যাক্সিডেন্টাল। কে যে স্টার হবে, কে যে সেলিব্রেটি―কেউ বলতে পারে না। এই যে আমাদের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। উনি তো অনেক বই লিখেছেন। উনার তো খালি ‘লালসালু’ ক্ল্যাসিক হয়ে গেছে। আর তো কোনোটা ক্ল্যাসিক হয় নাই। অথচ উপন্যাসের ফর্ম হিসেবে, শৈলী হিসেবে ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ ‘লালসালু’র চাইতে অনেক এগিয়ে। কিন্তু ‘লালসালু’টা বেস্টসেলার। ওটা ক্ল্যাসিক। ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ হয় নাই।
ঢাকা/লিপি