এনসিপির ১৫০ আসনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে: নাসীরুদ্দীন
Published: 6th, October 2025 GMT
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ১৫০টি আসনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মন্তব্য করেছেন দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।
সোমবার (৬ অক্টোবর) বিকেলে নির্বাচন কমিশনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন তিনি।
আরো পড়ুন:
শাপলা প্রতীকেই নির্বাচন করব, অন্য অপশন নেই: সারজিস
শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়া ছাড়া প্রত্যাশিত আচরণ পাবে না ভারত: সারজিস
বিকেলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে এনসিপির তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল।
পরে সংবাদ ব্রিফিংয়ে এনসিপি নেতা নাসীরুদ্দীন বলেন, “আমাদের যে সার্ভেগুলো করেছি তাতে দেখেছি যে ১৫০ আসনে এনসিপির জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমরা সেগুলো নিয়ে কথা বলতে সব জেলার সমন্বয়কারীদের ঢাকায় ডেকেছিলাম।আমরা তাদের মাঠে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য কথা বলেছি।”
তিনি বলেন, “আমরা ৩০০ আসনে প্রার্থী দেব। আমরা বলেছিলাম ৩০০ আসনে জয়ের জন্য আমরা চেষ্টা চালাব। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনায় আমরা বলেছিলাম যে আমাদের ১৫০টি আসনে জয়ী হওয়ার সিচুয়েশন আছে। কিন্তু আমরা ৩০০ আসনে জয়ের জন্যই লড়ব।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বিএনপি ৫০-১০০ আসনের বেশি যাবে না। আপনারা বাস্তব সিনারিও দেখতে পাচ্ছেন, কোন দিকে তলানিতে যাচ্ছে যে।”
“আমরা দেখেছি প্রত্যেকটা প্রজেকশনে এনসিপি ১৫০টি আসন পেতে যাচ্ছে।”
বিএনপি ও জামায়াতের উদ্দেশ্যে এনসিপি নেতা নাসীরুদ্দিন পাটওয়ারী বলেন, “আমরা দুটি দলের কর্মী-সমর্থক-নেতৃবৃন্দকে আহ্বান জানাব, আপনারা জাতির দিকে তাকিয়ে হলেও ভণ্ডামি বাদ দেন। নির্বাচনের মধ্যে এসে জনগণকে আপনারা মুক্তি দেন।”
“আমরা এই দুটি দলকে আহ্বান জানাব, আপনারা নির্বাচনের ক্ষেত্রে জুলাই সনদে দ্রুত সাইন করুন। এটাকে এক্সিকিউশন লিগ্যাল ওয়েতে নিয়ে দ্রুত নির্বাচন প্রক্রিয়া অংশগ্রহণ করে জনগণকে ভোগান্তি থেকে মুক্তি দিন,” যোগ করেন তিনি।
গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে এনসিপি একীভূত হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, “দলের নাম এনসিপি থাকবে। এনসিপির প্রতীক থাকবে। অন্য দলের নাম-মার্কা ডিজলভ হবে এবং এনসিপির আন্ডারে আরো অনেকগুলো দল আসছে। এটা আমরা বড় ধরনের একটা পার্টি করতে যাচ্ছি।”
সংস্কার যদি না হয় তাহলে ফেব্রুয়ারিতে এনসিপি নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে নাসীরুদ্দিন পাটওয়ারী বলেন, “আমি বলেছিলাম ফেব্রুয়ারিতে ইলেকশন হবে কি না, কনফিউশন আছে। সরকার অনেক ইনসিস্ট করছে ফেব্রুয়ারিতে ইলেকশন করার জন্য সবাইকে। কিন্তু আমাদের জুলাই সনদের লিগাল পার্সপেক্টিভের এখনো কোনো সলিউশন হয়নি।”
ঢাকা/রায়হান/সাইফ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ ত য় ন গর ক প র ট এনস প ন স র দ দ ন প টওয় র এনস প র র জন য আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
তিনি কৃষক, বই পড়েন, গানও লেখেন
সিলেবাসের বাইরের পড়ালেখার জগৎ বেশি বিস্তৃত, স্কুলজীবনে এমন অনুধাবন হয়েছিল সোহরাব আলীর। তাই প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বাইরের বই পড়া শুরু করেছিলেন। এখন তাঁর বয়স ৭২ বছর। তাঁর পড়াশোনার উপজীব্য হয়ে উঠেছে বিশ্বসাহিত্য, দর্শন ও ইতিহাস। কৃষক হয়েই সারা জীবন একটি শোষণহীন সমাজের চিন্তায় জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। আর কৃষক-শ্রমিকদের জন্য লিখে চলেছেন গণসংগীত।
কৃষক সোহরাব আলীর বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার মাদারীপুর (জমসেরপুর) গ্রামে। ইতিহাস-দর্শনের মোটা মোটা সব বই কিনে শুধু তিনি নিজেই পড়েন না, অন্য কৃষকদেরও পড়তে দেন। এমনকি যে কৃষক কোনো দিন স্কুলে যাননি, তাঁকেও তিনি পাঠক বানিয়েছেন। তাঁর লক্ষ্য কৃষকদের সত্যিকারের শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।
এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক গণসংগীত লিখেছেন কৃষক সোহরাব আলী। ‘কাস্তে হাতুড়ি আর গাঁইতি হাতে, দল বেঁধে ছুটি একই সাথে/ সিফটিং ভেঙে মোরা গড়ি ইমারত, আমাদের নালিশের নেই আদালত’—সোহরাব আলীর লেখা এমন অসংখ্য গণসংগীত নানা অনুষ্ঠানে পরিবেশন করেন স্থানীয় শিল্পীরা।
গানের কথা ও সুর সম্পূর্ণ নতুন। এর সূত্র খুঁজতে গিয়েই পাওয়া গেল সোহরাব আলীকে। অনুষ্ঠানে কণ্ঠশিল্পী ও স্কুলশিক্ষক আতাউর রহমানও সোহরাব আলীর গান গাইলেন, ‘বারবার আসে প্লাবন খেয়ে যায় সোনার ধান, পানির দামে বেচাকেনা হয়, নারীর সতীত্ব শ্রমিকের ঘাম...’ছেঁড়া কাগজে লিখেছেন গান
মাদারীপুর গ্রামে গত বছর নবান্ন উৎসবে সোহরাব আলীর সঙ্গে পরিচয় হয়। সেই অনুষ্ঠানে অতিথিদের বটপাতায় পায়েস পরিবেশন করা হয়। খাওয়ার জন্য দেওয়া হয় তালপাতার চামচ। অনুষ্ঠানে স্থানীয় শিল্পী রেজাউল ইসলাম (বাবু) গাইলেন গণসংগীত, ‘কাজ করে খেতে চাই, লাঞ্ছনা কেন পাই, জবাব দিবে কি গো বিশ্ববাসী॥ শ্রমজীবী মানুষের অন্ন কেড়ে, কলকারখানাগুলো উঠছে বেড়ে, শ্রমিকের আছে শুধু মাংসপেশি॥’
গানের কথা ও সুর সম্পূর্ণ নতুন। এর সূত্র খুঁজতে গিয়েই পাওয়া গেল সোহরাব আলীকে। অনুষ্ঠানে কণ্ঠশিল্পী ও স্কুলশিক্ষক আতাউর রহমানও সোহরাব আলীর গান গাইলেন, ‘বারবার আসে প্লাবন খেয়ে যায় সোনার ধান, পানির দামে বেচাকেনা হয়, নারীর সতীত্ব শ্রমিকের ঘাম...’
কবি ও ঔপন্যাসিক মঈন শেখের বাড়ি রাজশাহীর তানোরে। তিনি সোহরাব আলীকে খুব ভালো জানেন। তিনি তাঁর গান সম্পর্কে বলেন, তিনি তাঁর গানে শুধু জীবনের কথাই লিখেছেন। তাঁর গান অনেক সমৃদ্ধ, কিন্তু ছন্নছাড়া জীবনের মতোই গানগুলো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে লিখেছেন। কখনো সিগারেটের প্যাকেটে লিখেছেন, ছেঁড়া কাগজে লিখেছেন। তাঁর স্ত্রী ফেলে দিয়েছেন। স্থানীয় শিল্পীরা সুর করে যে কটি কণ্ঠে ধারণ করে রেখেছেন, সেই কটি গানই বেঁচে আছে।
সেই অনুষ্ঠানে অতিথিদের বটপাতায় পায়েস পরিবেশন করা হয়। খাওয়ার জন্য দেওয়া হয় তালপাতার চামচ।পাঠকের বাড়িতে সোহরাবের বই
সোহরাব আলী কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নের আন্দোলন হিসেবে যেমন গান লিখেছেন, তেমনি কৃষকদের হাতে তুলে দিয়েছেন বই। তাঁর কাছ থেকে বই নিয়ে পড়তে পড়তে পাঠক হয়ে উঠেছেন স্কুলে না যাওয়া সত্যেন্দ্রনাথ প্রামাণিক। সোহরাব আলীর ভাষায়, সত্যেন তাঁর সবচেয়ে বড় পাঠক। এখন দর্শনের বই পড়ে দর্শন ব্যাখ্যা করতে পারেন।
সম্প্রতি তানোরের মাদারীপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মাটির ঘরে খাটের ওপর বসে আল্লামা ইকবালের ‘শেকওয়াও জওয়াবে শেকওয়া’ বইটি পড়ছেন। তাঁকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে সাইয়েদ আবদুল হাইয়ের ‘ভারতীয় দর্শন’, আরজ আলী মাতুব্বরের ‘রচনাসমগ্র’, রুশোর ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’, ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জাপান যাত্রী’, রেবতী বর্মনের ‘দ্য ক্যাপিটাল’–এর মতো সব বই।
সারা জীবন বই পড়ে শুধু কৃষক হয়ে থাকলেন কেন জানতে চাইলে বেগম রোকেয়া থেকে উদ্ধৃত করে সোহরাব আলী বললেন, ‘এ কঠোর মহীতে চাষা এসেছে শুধু সহিতে, আর মরমের ব্যথা লুকায়ে মরমে জঠর অনলে দহিতে।’ এরপর বললেন, ‘আমি যেহেতু চাষার ছেলে চাষা তাই এসবের দ্বারাই বোধ হয় প্রভাবিত হয়েছি।’
সোহরাব আলীর সংগ্রহে রয়েছে ছয় শতাধিক বই। এর মধ্যে মাত্র ১০০টির মতো তাঁর বাড়িতে রয়েছে। বাকি পাঁচ শতাধিক বই বিভিন্ন এলাকার মানুষকে পড়তে দিয়েছেন।
সোহরাব আলী জানান, দুই বছর পর গত ৩০ আগস্ট আরজ আলী মাতুব্বরের ‘চিন্তারজগৎ’ বইটি ফেরত দিলেন রাজশাহীর এক পাঠক। একই দিনে ফেরত পেলেন জেলার বাগমারা উপজেলার মচমইল গ্রামের এক পাঠকের কাছ থেকে হায়দার আকবর খান রনোর ‘ফরাসি বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব’। শুধু এই বই দুটি আদায় করতে তিনি তানোর থেকে রাজশাহী শহরে এসেছিলেন। তাঁর সব বইপুস্তক এভাবেই পাঠকের বাড়িতে থাকে।
সম্প্রতি তানোরের মাদারীপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মাটির ঘরে খাটের ওপর বসে আল্লামা ইকবালের ‘শেকওয়াও জওয়াবে শেকওয়া’ বইটি পড়ছেন। তাঁকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে সাইয়েদ আবদুল হাইয়ের ‘ভারতীয় দর্শন’, আরজ আলী মাতুব্বরের ‘রচনাসমগ্র’, রুশোর ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’, ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জাপান যাত্রী’, রেবতী বর্মনের ‘দ্য ক্যাপিটাল’–এর মতো সব বই।ছোট্ট এক গল্পে বদলে যায় জীবন
স্কুলে পড়ার সময় হরলাল রায়ের বাংলা ব্যাকরণে ‘চোরের আত্মকাহিনী’ রচনাটি চোখ খুলে দেয় বলে জানালেন সোহরাব হোসেন। সেই গল্পটি ছিল—চোর বলছে, ‘চুরি করতে গিয়ে প্রথম যেদিন ধরা পড়ি, বেদম প্রহারে পড়েছিলাম।’ এ সময় একটি ছোট্ট শিশু তার বাবাকে বলছে, ‘বাবা, আমি চোর দেখব।’ দেখার পরে শিশুটি বলল, ‘বাবা, চোর কোথায়? ও তো মানুষ!’ চোর বলছে, ‘শিশুটির কাছ থেকে প্রথম জানতে পারলাম, আমি মানুষ ছিলাম।’
ছোটবেলা থেকেই তাঁর মনোজগৎ তাই মানবিকভাবে তৈরি হয়েছে। জানালেন, ছোটবেলায় তিনি বাড়ি থেকে চাল চুরি করে নিয়ে যেতেন পার্শ্ববর্তী হতদরিদ্র হাড়িপাড়ায়। তাদের তিনবেলায় খাবার জুটত না। এ প্রসঙ্গে ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগোর একটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘লা মিজারেবল’–এর মূল চরিত্র জাঁ ভ্যালজাঁর গল্প শোনালেন সোহরাব; বললেন, একটি রুটি চুরির অপরাধে তাঁকে ১৯ বছর কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছে। জাঁ ভ্যালজাঁর গল্প তাঁর চোখ ভিজিয়ে দেয়।
সোহরাব বই পড়া শুরু করেছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই। এসএসসির পর আনুষ্ঠানিক পড়া ছেড়ে দিয়ে সোহরাব আলী ‘সত্যিকারের পড়াশোনা’ শুরু করেন। তাঁর চিন্তার ক্ষেত্রে পরিবর্তনে প্রভাব ফেলেছে কার্ল মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, স্টালিন, মাও সে–তুং, হোচিমিন, চে গুয়েভারা, ফিদেল কাস্ত্রো, ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, মাস্টারদা সূর্য সেন, বীরকন্যা প্রীতিলতা, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো মনীষীরা। তিনি তাঁদের জীবনকে গভীরভাবে জেনেছেন। কথায় কথায় বললেন, ‘ছোটবেলায় উপন্যাস পড়েছি বেসুমার। এখন দর্শন ছেড়ে উঠতে ভালো লাগে না।’
সোহরাব আলীর দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। ছোট ছেলে ও ছোট মেয়ে স্নাতক। বড় ছেলে ও বড় মেয়ে এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তাঁরা সবাই সংসারী।
সারা জীবন কৃষক থাকার জন্য কোনো দুঃখ নেই সোহরাব আলীর। দেড় শ বছরের পৈতৃক মাটির বাড়িতেই তাঁর সংসার। এই বাড়ি থেকে বড় হয়ে মোট ১১ সদস্য অন্যত্র বড় বড় বাড়ি করেছেন। শুধু তিনিই এই মাটির বাড়িতে রয়ে গেছেন।